#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব৩৯( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ)
#Raiha_Zubair_Ripti
দীর্ঘ ছয় ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরে চিত্রার। হালকা চোখ মেলে তাকাতেই নজরে এলো তুষার তার মাথার কাছে বসে ঝিমাচ্ছে। পেট কা’টার জায়গা টার ব্যাথা ক্রমশ বাড়তে লাগলো। ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে পেটের উপর হালকা হাত রাখলো। হাত নাড়ানোর সময় তুষারের হাতে স্পর্শ হয় চিত্রার হাত। তুষার ফট করে চোখ মেলে তাকায়। একদিকে রাতুল কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে বাচ্চা কাঁদছে না। আবার চিত্রার ও জ্ঞান ফিরছে না। বিষয় গুলো নিয়ে ভাবতে ভাতে যে কখন চোখ লেগে এসেছিল বুঝতেই পারেনি তুষার। চিত্রা কে চোখ মুখ কুঁচকে থাকতে দেখে খুশিতে চোখ মুখে হাসির আভা আসে। হন্ত হয়ে বলে-
-“ পাখি ব্যাথা করছে খুব?
চিত্রা চোখের ইশারায় জানালো।
-“ ডক্টর ডাকবো?
চিত্রা না করলো। আশেপাশে তাকালো। বাচ্চার কোনো ছিটেফিটে নেই। ধড়াস করে বুকটা ধক করে উঠল। মৃদু শব্দ করে বলল-
-“ আ..আমাদের বাবু কই? ও ঠিক আছে তো?
তুষার চিত্রার মাথায় হাত রাখলো। শীতল কন্ঠে শুধালো-
-“ বাবু ঠিক আছে। তোমার মায়ের কাছে আছে। আসলে আমি ঠিক ভাবে ক্যারি করতে পারছিলাম না।
-“ আমি দেখবো ওকে, ছুবো।
-“ নিয়ে আসছি।
তুষার কেবিন থেকে বের হয়। চয়নিকা বেগম অন্য কেবিনে ছিলো নাতির সাথে। তুষার কেবিনে ঢুকে দেখে রোমিলা বেগম আর সাহেল আহমেদ সোফায় ঘুমিয়েছে। আর দোলনায় বাচ্চা টা ঘুমিয়ে আছে। তুষার চয়নিকা বেগমের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল-
-“ আম্মা।
চয়নিকা বেগম নড়েচড়ে তাকালো। তুষার কে দেখে ঠিক হয়ে বসে বলল-
-“ চিত্রার জ্ঞান ফিরছে বাবা?
তুষার মাথা ঝাকালো। চয়নিয়া বেগম শুকরিয়া আদায় করলেন। তারপর বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে বললেন-
-“ বাবু ঘুমিয়েছে কিছুক্ষণ আগেই তাই শুইয়ে দিয়েছি।
কথাটা বলে চয়নিকা বেগম কেবিন থেকে বের হয়ে মেয়ের কাছে ছুটলেন। তুষার বাচ্চাটার দিকে এগিয়ে গিয়ে কোলে তুলে নিলো। বাচ্চা টা নড়েচড়ে উঠলো কিন্তু চোখ মেলে তাকালো না। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বের হলো।
চয়নিকা বেগম চিত্রার মাথার কাছে বসে আছে। পরপর কয়েকটা চুমু খেয়েছে কপালে। চিত্রা বারবার দরজার পানে তাকাচ্ছে মানিক টাকে দেখবে। অধৈর্য্য হয়ে বলল-
-“ মা বাবু কই?
-“ তুষার আনতেছে।
তুষার কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। চিত্রা তাকালো। মুহূর্তে ফুটে উঠলো হাসি। তুষার এগিয়ে এসে চিত্রার পাশে এক হাতের উপর বাবু কে শুইয়ে দিলো। চিত্রা চেয়ে রইলো বাচ্চাটর দিকে। কপালে দু ভাজ পড়ে আছে। মনে হচ্ছে ভীষণ বিরক্ত সে। চিত্রা চুমু খেলো ছেলের মুখে। চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নিলো। বাচ্চা টা পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালো। চিত্রা বাচ্চাটার মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ মা বাবু তাকিয়েছে।
-“ একটু বুকের দুধ খাইয়ে দে। পাশের কেবিনে থাকা এক মহিলার বুকের দুধ নিয়ে খাইয়েছি বেশ অনেকক্ষণ আগে।
চিত্রা মায়ের কথা মতো তাই করলো। বাচ্চাটা চুপচাপ খেতে লাগলো। পাশের কেবিন থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসলো। চিত্রা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ ও কি খুব কেঁদেছে মা?
চয়নিকা মুখ খুললেন কিছু বলার জন্য তার আগেই তুষার বলল-
-“ না কাঁদে নি শান্ত ছেলে আমার।
চিত্রা স্মিত হাসলো। এরমধ্যে ডক্টর এসে দেখে গেলো চিত্রা কে। ডক্টর কেবিন থেকে বের হতে নিলে তুষার ও বের হয় ডক্টরের সাথে।
-“ ডক্টর চিত্রা ঠিক আছে তো?
-“ হ্যাঁ ঠিক আছে।
-“ বাবু তো এখনও কাঁদল না।
-“ অনেক সময় বেবিরা কাঁদে না। দুই তিনদিন দেখুন যদি না কাঁদে তাহলে মনে হয় ও বোবার বধি।
তুষার ভ্রু কুঁচকালো।
-“ বোবা!
-“ হতে পারে আবার নাও হতে পারে। আপনি এক কাজ করুন হালকা চিমটি কেটে দেখুন তো ব্যাথায় কাঁদে কি না। এটা ছাড়া তো উপায় দেখছি না এখন।
-“ ব্যাথা পাবে তো ও।
-“ ব্যাথা পাবে সেজন্যই তো বলেছি। ব্যাথা পেলেই তো কাঁদবে।
তুষার কেবিনে ঢুকলো। চয়নিকা বেগম কিছুক্ষণ থেকে চলে গেলেন। তুষার বসে রইলো চিত্রার পাশে। বাচ্চাটা খেয়ে আবার ঘুমিয়েছে।
-“ বাকিরা সবাই কোথায়?
-“ বাসায় চলে গেছে।
-“ বাবুর নাম কি রাখলেন?
-“ এখনও রাখি নি।
-“ আমি ভেবেছি।
-“ কি?
-“ তন্ময় শাহরিয়া খাঁন।
তুষার কিছু বলল না। চিত্রার অগোচরে বাচ্চাটার হাতে চিমটি কাটলো। খুব বেশি জোরে দেয় নি। তাতেই বাচ্চাটা চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। বাচ্চার আকস্মিক চিৎকারে চিত্রা ভয় পেয়ে যায়। আর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তুষার। চিত্রা ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে বলে-
-“ ও হঠাৎ করে কাঁদছে কেনো?
-“ বুকের দুধ দাও।
চিত্রা দিলো। বাচ্চাটা মুখ সরিয়ে নিচ্ছে। কান্না থামলো না। কান্নার আওয়াজ শুনে চয়নিকা বেগম চলে আসলো। কোলে নিয়ে ঘুরলো তবুও কান্না থামলো না। তবে কান্নার আওয়াজের জোর হাল্কা হয়েছে। তুষার কোলে নিলো চয়নিকা বেগমের থেকে। বাচ্চাটা চুপ হয়ে গেলো। চয়নিকা বেগম কে চিত্রার পাশে বসিয়ে বাচ্চাটা কে চিত্রার পাশে শুইয়ে রেখে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো।
পূর্ব আকাশে প্রতিদিনের মতো করে সূর্য উঠেছে। চারিপাশ ঝলমলে করে উঠেছে সূর্যের রশ্মি তে। অধরা জ্ঞান ফিরার পর সেই যে পাথরের মতো বসে আছে তো আছেই। রাফি আর তানিয়া বেগম চিত্রা কে গিয়ে দেখে এসেছে।
রাতুলের বডি খুঁজে পাওয়া যায় নি। তৃষ্ণা অধরাকে পাথরের মত বসে থাকতে দেখে আপু বলে ডেকে উঠে। অধরা সেদিকে তাকায়।
-“ আমাকে একবার নিয়ে যা না ওখানে।
তৃষ্ণা জড়িয়ে ধরলো অধরা কে।
-“ ভাইয়া নিয়ে যেতে মানা করছে।
অধরা অসহায় হয়ে বলে-
-“ প্লিজ একবার।
তৃষ্ণা রাজি হয়। অধরাকে নিয়ে চলে যায় সেই জায়গায়। তুষার পুলিশদের সাথে কথা বলছে। খবরের কাগজ ও টিভিতে একই নিউজ ঘুরপাক খাচ্ছে ঢাকা ১৯ এমপি তুষার খাঁনের সহযোগী রাতুল মর্মান্তিক এক এক্সিডেন্ট মা-রা গিয়েছে। যদিও তার লা-শ এখনও পাওয়া যায় নি তবে পুলিশদের ধারনা রাতুল বেঁচে নেই। লা-শটা হয়তো কোনো রাতে কোনো হিংস্র পশু ছিঁড়ে খে’য়েছে।
রোমিলা বেগম নিউজ টা পেয়েছে গতকাল রাতেই। তুষার সামলে নিয়েছে রাত টা। কিন্তু এখন তাকে সামলানো যাচ্ছে না। কোনো মা বাবাই পারে না নিজের মৃ’ত্যুর আগে ছেলে মেয়ের মৃ’ত্যুর খবর শুনতে। থেকে থেকে জ্ঞান হারিয়ে ফেরছেন। আবার জ্ঞান ফিরলেই রাতুল বলে পাগলের মতো চিৎকার করেন। এই পৃথিবীতে তো একমাত্র ছেলেটাই ছিলো তার। তবুও সেই ছেলেকেই কেঁড়ে নিলো তার বুক থেকে। তুষার ভেঙে পড়েছে।
অধরা পাথর হয়ে তাকিয়ে আছে ভেঙে চূর্ণ হয়ে যাওয়া গাড়িটার দিকে। এমন টা তো হওয়ার কথা ছিলো না। সামনেই তো তাদের বিয়ে ছিলো। অধরা সেই দিনটার অপেক্ষায় ছিলো। লোকটাকে ভালোবাসি যে এখনও বলা বাকি আছে। লোকটা ভালোবাসি না শুনেই এভাবে চলে গেলো কেনো? লোকটা নিজে থেকে স্বপ্ন দেখিয়ে স্বপ্ন পূরণ না করেই ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো। রোজ নিয়ম করে লোকটাকে ভালোবাসতে বলেছিল। এখন কাকে ভালোবাসবে রোজ নিয়ম করে? কার সাথে সেই সন্ধ্যার রাতে টঙের দোকানে চা খাবে? কার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটবে? কার কাছে পদ্ম ফুল চাওয়ার বায়না ধরবে? কার কাছে গিয়ে নিজের অনুভূতি মেলে ধরবে? কে বলবে আমি আছি আপনার পাশে সবসময়? কে বলবে কে?
অধরা ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো। ঘন জঙ্গলটার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল-
-“ কেনো ছেড়ে গেলেন আমায় রাতুল আপনি কেনো ছেড়ে গেলেন? একটা বার ভাবলেন না আপনাকে ছাড়া অধরা কি করে বাঁচবে? স্বপ্ন দেখিয়ে মাঝ পথে কেনো আমায় একলা করে চলে গেলেন। আপনি কথা দিয়েছিলেন আমার চলার পথের সঙ্গী হবে তাহলে কেনো এমন হলো। বিধাতা আমার সুখ কেনো দেখতে চায় না? আপনি না শুনেই চলে গেলেন। আমি যে ভালোবাসি আপনাকে। ফিরে আসুন না আমার কাছে। আমাদ দম বন্ধ লাগছে রাতুল। একবারে জন্য আসুন না আমার সামনে আর বলুন না আমি আছি তো আপনার পাশে।
তৃষ্ণা অধরার মাথা জড়িয়ে ধরলো।
-“ অধরা স্বান্তনার দেওয়ার ভাষা জানা নেই তার। অধরা জড়িয়ে ধরলো তৃষ্ণা কে। আর বলতে লাগল-
-“ তৃষ্ণা রাতুল কে বল না আমার সামনে আসতে। আমি ভীষণ ভালোবাসি তাকে। তাকে বলা হয় নি আমি ভালোবাসি তাকে। একটু এনে দে না। আমি লোকটাকে ছুঁতে চাই। জড়িয়ে ধরে বলতে চাই ভালোবাসি তাকে। তাকে ছাড়া নিজেকে কল্পনা করতে পারি না। বোন এনে দে না রাতুল কে।
তুষার দূর থেকে অধরার কান্না দেখলো। সে ছেলে মানুষ সে পারছে না অধরা বা রোমিলা বেগমের মতো কান্না করতে। তার মন মানতে চাইছে না রাতুল আর নেই। কাল দুপুরেও রাতুলের সাথে কাটালো। আর আজ নেই। তুষার তৃষ্ণা কে বলল অধরাকে নিয়ে চলে যেতে। রোমিলা বেগমের কাছে যেতেই রোমিলা বেগম তুষার কে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগল-
-“ আমার ছেলেটাকে এনে দে না বাপ। আমার তো ও ছাড়া কেউ নাই। ও কি একটা বার ভাবলো না ওর মায়ের কি হবে? একটু এনে দে না খুঁজে ওরে।
তুষার রোমিলা বেগমের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল-
-“ তোমার কেউ নেই কে বলেছে? আমি আছি তো খালা। কেঁদো না। শরীর অসুস্থ তোমার।
রোমিলা বেগম শুনলো না পাগলের মতো বিলাপ করলো।
————————-
রাতুলের এক্সিডেন্ট করা গাড়িটা পরীক্ষা নিরিক্ষা করে জানা গেছে এটা কোনো দূর্ঘটনা নয়। বরং জেনেশুনেই গাড়ির ব্রেকফেইল করানো হয়েছে। পুলিশ ইনভেস্টিগেশনের কাজ শুরু করে দিয়েছে। তুষারের সন্দেহের তালিকায় আছে হালিম সরকার আর আকবর। তবে আকবর কে সন্দেহের তালিকায় রাখতে ইচ্ছে করছে না তুষারের। বাপ হয়ে ছেলেকে মে’রে ফেলবে বিষয় টা কেমন লাগলো। আকবর এতোটা নিচে নামতে পারে না। তবুও বাদ ও দিতে পারলো না। পুলিশ প্রায় সবার থেকে রাতুলের বিষয়ে খোঁজ খবর নিলো। শুধু বাকি রইলো লিমন। কিন্তু লিমন ছেলেটাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। ফোন সুইচ অফ বলছে। হঠাৎ ফোন সুইচ অফ তার উপর এমন নিখোঁজ সন্দের তীর টা ক্রমশ লিমনের দিকে যাচ্ছে।
লিমনের লাস্ট লোকেশন ছিলো রেডিও কলোনি। তারপর থেকেই ফোন সুইচ অফ। তুষারের কপালে দু ভাজ পড়লো। লিমন কাজটা করেছে কি না? আর লিমনই বা কেনো রাতুলের এক্সসিডেন্ট করাবে? ওর কি স্বার্থ এতে?
প্রায় তিনদিন পর চিত্রা কে বাসায় আনা হয়। তিনটে দিন ঘরকুনো হয়ে ছিল অধরা। খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করে না। এই তিনটে দিন লিমন কে হন্যে হয়ে খুঁজে গেছে পুলিশ কিন্তু দুপুরের পর লিমনের লা’শ মিলেছে এক নদীর ঘাটে। সাথে একটা ভিডিও এসেছে তুষারের ফোনে। যেখানে রাতুল কে খু’ন করার কথা স্বীকার করেছে সে। আর একটা টেক্সট পাঠিয়েছে,, সে বুঝে গিয়েছিল পুলিশের থেকে বাঁচার আর কোনো উপায় নাই সেই জন্য সে নিজেই আত্মহ’ত্যা করেছে।
তুষার মেসেজ আর ভিডিও টা পড়ে থম মেরে বসেছিল। বিষয় টা কেমন অদ্ভুত লাগছে। লিমন কেনো মা’রলো রাতুল কে। আর মা’রলোই যখন তাহলে সে কেনো আত্মহ’ত্যা করলো?
চিত্রা বাড়ির থমথমে পরিবেশ দেখে তুষারকে জিজ্ঞেস করছিল বাড়ির সবার চোখমুখের এমন অবস্থা কেনো? আর অধরারই বা এমন অবস্থা কেনো? তুষার রাতুলের ব্যাপারে সব জানায়। চিত্রা কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সে মোটেও এটা আশা করে নি। সে আন্দাজ করেছিল তার এমন অবস্থার জন্য হয়তো এমন থমথমে পরিবেশ। কিন্তু এমন কথা সে শুনবে কস্মিনকালেও ভাবতে পারে নি। অধরার জন্য ভীষণ খারাপ লাগছে৷ সামনেই দুজনের বিয়ে ছিল। আর এখন এমন এক ঘটনা। মেয়েটা নিজেকে সামলাচ্ছে কি করে?
#চলবে?