আমার শহরে তোমার আমন্ত্রণ ২ পর্ব-৪০ এবং শেষ পর্ব

0
867

#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব৪০( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ)
#প্রথম_পরিচ্ছদ_অন্তিম_পর্ব
#Raiha_Zubair_Ripti

আচমকা আবহাওয়ার বদল। বাহিরে ঝুম বৃষ্টি। উতালপাতাল বাতাস, থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে। বাচ্চাকে বুকে নিয়ে শুয়ে আছে চিত্রা। তুষার বাসায় নেই। চিত্রার পাশে নিস্তেজ হয়ে বসে আছে রোমিলা বেগম। তুষার বলে দিয়েছে রোমিলা বেগম তাদের সাথেই থাকবে। রোমিলা বেগম কে এক ধ্যানে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে-
-“ আন্টি ওকে একটু কোলে নিবেন? আসলে আমার পিঠ লেগে আসছে।
রোমিলা বেগমের দৃষ্টি বিচ্যুত হলো। দু হাত দিয়ে বাচ্চা টাকে আলতো করে বুকে জড়িয়ে ধরলো। যেনো খুব অমূল্য কিছু পেয়ে গেলো সে। বাচ্চা টার মুখে চুমু খেয়ে বিরবির করে বলল- আমার রাতুল।
চিত্রার কান অব্দি গেলো না সে কথা। চিত্রার শীত লাগছে শোয়া থেকে আস্তেধীরে উঠে চাদর জড়িয়ে নিলো শরীরে।

তৃষ্ণা খাবার নিয়ে আসলো রুমে। খাবার টা চিত্রা কে খাইয়ে রোমিলা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ আন্টি খাবে চলো।
রোমিলা বেগম বাচ্চাটার দিকে তাকালো। চিত্রা কে দিতে ইচ্ছে করছে না। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে বাচ্চা টাকে চিত্রার কাছে দিয়ে তৃষ্ণার পিছু পিছু নিচে নামলো। রাফি, তামিম খাঁন, সামির খাঁন, তরিকুল খাঁন বসে আছে ডাইনিং টেবিলে। রোমিলা বেগম কে দেখে তামিম খাঁন মৃদু করে বলল-
-“ কেমন আছো এখন বোন?
রোমিলা বেগম কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে জবাব দিলো-
-“ ভালো ভাই।
-“ বসো খেয়ে নাও।
রোমিলা বেগম বসলেন না।
-“ আমি আপার সাথে খেয়ে নিবো ভাই।
তানিয়া বেগম যেতে ধরে বসালো রোমিলা বেগম কে। প্লেটে খাবার দিয়ে বলল-
-“ কখন থেকে না খেয়ে আছো খেয়াল আছে? এভাবে চলতে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে।
রোমিলা বেগম স্মিত হাসলো। প্লেটে খাবার নাড়াচাড়া করে বলল-
-“ তুষার ফিরলো না কেনো এখনও?
-“ বৃষ্টির জন্য আঁটকা পড়ে আছে। বৃষ্টি টা থামলেই চলে আসবে খালা।
রাফি খাবার মুখে দিতে দিতে কথাটা বলল। রোমিলা বেগম চুপচাপ খাবার খেলো। তামিম খাঁন সামির খাঁন তরিকুল খাঁন খেয়ে দেয়ে চলে যায়। রাফি এঁটো প্লেটে হাত ধুতে ধুতে বলে-
-“ খালা এভাবে ঘরকুনো হয়ে থাকবে না আর। জানি রাতুলের মৃত্যু টা মেনে নিতে পারছো না কিন্তু সত্যি টা তো মেনে নিতেই হবে। তোমার জন্য আমি আছি ব্রো আছে পুরো পরিবার আছে। আমাদের জন্য হলেও একটু মুভ অন করো খালা।

রোমিলা বেগম তাকালো রাফির দিকে। রাফির অনুনয় হয়ে বলা কথাটা খুব নাড়া দিলো মনে। মনের স্মৃতিপটে ভেসে আসলো চিত্রার বাচ্চাটার মুখশ্রী। বাচ্চাটার মাঝে নিজের রাতুল কে খুঁজে নিয়েছে সে।

পার্টি অফিসে বসে আছে তুষার। বৃষ্টি ছাড়ার নামগন্ধ নেই। আর এই তুমুল বৃষ্টির মধ্যে গাড়ি চালানো মোটেও ঠিক না। চেয়ারে বসে অঙ্ক কষছে তুষার। লিমনের পক্ষে কোনো ভাবেই সম্ভব নয় একা এতোকিছু করার। হালিম সরকারের বিরুদ্ধে ও কোনো ক্লু পায় নি পুলিশ যে সে এসবে কানেক্টেড ছিলো। আর আকবর কে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে বারবার ছেলের নাম ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে। এই কয়েকদিন হালিম সরকার ও আকবরের উপর ২৪ ঘন্টা নজর রেখেছিল তুষার। সন্দেহের মতো কিছু তারা করে নি। লিমন টা ম-রে গিয়েও রেখে গেলো এক রহস্যের মধ্যে।

কথাগুলো এক এক করে ভাবতেই হঠাৎ চোখ গেলো ফোনের দিকে। কিছু একটা মনে পড়তেই চট করে ফোন অন করে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে। মালদ্বীপ থেকে আসা সেই নম্বরের মেসেজ টা আবার পড়লো। এই মেসেজের কথা সে টোটালি ভুলে গিয়েছি। নম্বর টা একবার দেখে সেটা তার পরিচিত এক ফ্রেন্ড কে পাঠিয়ে বলে নম্বর টার এ টু জেট বের করতে।

এরমধ্যে বৃষ্টি কমে আসলে তুষার বাসার উদ্দেশ্যে চলে যায়। রোমিলা বেগম শুয়ে আছে নিজের রুমে। তৃষ্ণা রাফির রুমে। কথা ছিল রাফি দেশে ফিরলে ধুমধাম করে বিয়ে করবে। কিন্তু বাসার যা পরিস্থিতি তাতে ধুমধাম করে বিয়ের প্ল্যান বাদ। বিয়ে তো হয়েই গেছে তাই আর রাফি বাড়তি ঝামেলা চাচ্ছে না। রাফির বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে তৃষ্ণা। রাফির এক হাত তৃষ্ণার চুলের ভাজে।
-“ হঠাৎ করে সবটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো তাই না বলুন?
রাফি হুমম বলল।
-“ জানেন অধরা আপু এখনও মুভ অন করতে পারছে না।
-“ এটাই কি স্বাভাবিক নয়? ভালোবাসতো দু’জন দু’জন কে। ধরো আমার যদি কিছু হয়ে যায় তুমি পারবে মুভ অন করতে?
তৃষ্ণা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রাফি কে।
-“ ম-রেই যাবো।
-“ অধরা তবুও স্ট্রং আছে। আমি জানি আমার কিছু হয়ে গেলে তোমাকে খুঁজেই পাওয়া যাবে না।

তুষার বাসায় রোমিলা বেগমের সাথে দেখা করে সোজা নিজের রুমে ঢুকে। চিত্রা এক কাত হয়ে শুয়ে আছে বাচ্চা কে ধরে। আস্তেধীরে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বাচ্চার কপালে চুমু খেয়ে নিচে নামে ডিনার করার জন্য। তানিয়া বেগম খাবার বেড়ে দিলে তুষার তানিয়া বেগম কে বলে রুমে চলে যেতে। সে খেয়ে দেয়ে খাবার ফ্রিজে রেখে দিবে। তানিয়া বেগম চলে যায়। তুষার খাওয়া দাওয়া শেষ করে খাবার গুলো ফ্রিজে রাখতেই ফোন বেজে উঠে। তুষার ফোনের স্কিনে তাকিয়ে দেখে রকির নাম জ্বল জ্বল করছে। যাকে নম্বর দিয়েছিল। তুষার ফোন রিসিভ করে কানে নিতেই ওপাশ থেকে রাফি বলে উঠে –
-“ তুই যেই নম্বর টা দিয়েছিস সেই নম্বর টা মালদ্বীপে থাকা জনস নামের কোনো লোকের। যে এলএম ইন্ডাস্ট্রির মালিক।
-“ শিউর?
-“ হ্যাঁ। দেখ ডকুমেন্টস পাঠিয়েছি কিছু তোর ফোনে চেক কর।
তুষার ফোন টা কেটে চেক করে দেখে রকির বলা কথা গুলো সত্যি। তুষার হোয়াটসঅ্যাপে কল দেয় ঐ মালদ্বীপের নম্বরে। দু বার রিং বাজার পর ফোন রিসিভ হয়। ওপাশ থেকে ভেসে আসে কর্কশ গলায়-
-“ হু আ’র ইউ ম্যান? হোয়াই ডিস্টার্ব মি?
তুষার ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল-
-“ তুষার খাঁন ফ্রম বাংলাদেশ। আর ইউ জনস?
-“ ইয়েশ। ডু ইউ নোও মি?
-“ নো। বাট আই গট এ্যা ম্যাসেজ ফ্রম ইউর ফোন টু মাই ফোন। হোয়াট ইজ দ্যা মিনিং অফ সেন্ডিং সাচ এ্যা ম্যাসেজ?
-“ হোয়াট ম্যাসেজ আর ইউ টকিং এবাউট?
-“ আই এ্যাম সেন্ডিং ইউ দ্যা স্ক্রিনশট অফ দ্যা মেসেজ।
-“ ওকে।

তুষার ফোনটা না কেটেই মেসেজের স্ক্রিনশট টা পাঠিয়ে দেয় জনসের ফোনে।
-“ মিস্টার জনস ডু ইউ সাও দ্যিস স্ক্রিনশট?
-“ ইয়াহ আই সাও ইট।
-“ হোয়াই ইউ সেন্ট মি দ্যিস মেসেজ?
-“ মিস্টার তুষার খাঁন রাইট?
-“ ইয়াহ।
-“ আই ডিড নট সেন্ট ইউ দ্যিস মেসেজ।
তুষার ভ্রু কুঁচকালো।
-“ সো হু সেন্ট দ্যা মেসেজ? দ্যা নাম্বার ইজ ইউরস।
-“ ইয়েশ দ্যা নাম্বার ইজ মাইন। বাট আই ডিড নট সেন্ড ইউ এ্যানি সাচ মেসেজ। ইভেন আই ডোন্ট নও ইউ। সো হোয়াই উড আই সেন্ড ইউ সাচ অ্যা মেসেজ?
-“ আর ইউ শিউর ইউ ডিড নট সেন্ড দ্যা মেসেজ?
-“ ইয়া আই এ্যাম শিউর। আই থিংক মাই সন প্রেস্ড দ্যা ফোন এন্ড ফরওয়ার্ড দ্যা মেসেজ টু ইউ বাই মিসটেক।
-“ ফরওয়াড!
আশ্চর্য হয়ে বলল তুষার।
-“ ইয়েশ ফরওয়ার্ডেড। প্লিজ চেক দ্যা মেসেজ। দ্যা মেসেজ হ্যাজ বিন ফরওয়ার্ডেড টু ইউ,নট টাইপ্ড।

তুষার মেসেজ টা চেক করে দেখলো সত্যি মেসেজ টা ফরওয়ার্ড করে পাঠানো হয়েছে।
-“ ওহ্ ইয়েশ আই সও। আই ডিড নট নোটিশ এ্যাট অল। থ্যাংক ইউ,স্টে ওয়েল।

তুষার ফোন কেটে দিলো। একটু দুশ্চিন্তা মুক্ত হলো। লোকটার কথা শুনে মনে হয় নি মিথ্যা বলেছে। আলতো পায়ে হেঁটে রুমে এসে তন্ময়ের পাশে এসে শুয়ে পড়লো।

অন্ধকার রুম জুড়ে পারফিউমের কড়া সুভাস। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাদা শাড়িতে অপ্সরার মতো লাগছে অধরা কে। পড়নের শাড়িটা রাতুলের কিনে দেওয়া তুষারের বিয়ের সময়। শাড়িটা হাতে দেওয়ার পর একটা কথা বলেছিল রাতুল। কথাটা মনে পড়ছে ভীষণ তার। আলতো পায়ে হেঁটে গেলো বেলকনিতে। শেষ রাতে আকস্মিক আকাশে চাঁদ উঠেছে। অধরা তাকালো চাঁদের দিকে। পুরো বাড়ি এখন এক ঘুমন্তপুরি। অধরা ইজি চেয়ার টায় বসলো। ফোনে রাতুল আর অধরার একটা ছবি বের করে বলল-

-“ আপনার-আমার আবার দেখা হোক,
আপনার-আমার আবার কথা হোক,
আমাদের আবার সব হোক ঐ ইচ্ছেনদীর তীরে,
আমি আবার ও আপনার পড়বো প্রেমে।
জল থৈ থৈ ভালোবাসায় ভাসবো
নদীর জলে, অতি সঙ্গোপিত ভাবে।
ভাবতে পারছেন?
‘আমি’ নামক রমণী সেদিন আবারো আপনার প্রেমে পড়বে।
আবারো আপনার যন্ত্রণাদায় ভালোবাসায় গা এলাবে।
আচ্ছা! তখন কি আমরা দুঃখবিলাস করবো,এ জনমের আমার না হওয়ার জন্য?
নাকি বরাবরের ন্যায় ইচ্ছে বিসর্জন দিবো?
এ জনমে তো আপনি আমার হলেন না,
ইচ্ছে নদীর ঘাটে আপনি বরং আমার হইয়েন।
তখন তো কোন বাস্তবতা ছুঁবে না আপনায়,
আমাকেও ছাড়ার অজুহাত দেখাবেন না অন্য কোনো অজুহাতে।
জানেন? আপনার ভালোবাসা বড্ড পোড়ায়,
আপনার ভালোবাসা বড্ড পীড়া দেয়!
এতো পীড়ার মাঝেও আমি বারবার বলি, “ভালোবাসি! ভালোবাসি আমি আপনাকে। শুনতে পারছেন ভালোবাসি আমি আপনাকে।©Trisha Roy

কথাটা বলে ডুকরে কেঁদে উঠে অধরা।

অন্ধকার কক্ষে চেয়ারে বসে আছে কেউ। পুরো রুম জুড়ে ধোঁয়ার মেলা। থেকে থেকে একজন কেশে চলছে। গড়িতে টুংটাং শব্দ হতেই জানাল দিল রাত ১২ টা বেজে গেছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো আগন্তুক। ঐ বিশাল আকাশে থাকা চাঁদ টার দিকে তাকিয়ে চোখ মুখে হিংস্রতা এনে বলল-
-“ সুখে শান্তিতে সংসার করুক কয়েক বছর। ভুলে যাক এদিনের এই অতীত। হঠাৎ একদিন এসে চমকে দিবো ভীষণ। প্রতিশোধের আগুন দাউদাউ করে জ্বালাতে। আমাকে খুঁজে পাওয়া মোটেও সহজ কাজ নয়। নিজের জীবন বাঁচিয়েছি এতো সহজে ধরা পড়ার জন্য নয়। খুব গোপনে লুকিয়ে রেখেছি এই আমি কে। দূর থেকে দাবার গুটি চালবো এক এক করে। ধ্বংস করে দিব খাঁন পরিবার কে। এক এক করে সবাই ম-রবে।

কথাগুলো বলতেই আগন্তুকের ফোনে মেজের টুং বেজে উঠলো। আগন্তুক মেসেজ ওপেন করলো। গোটা অক্ষরে লেখা-
-“ দাবার চাল পালটে গেছে। সিংহ কে মা-রতে চেয়েছিলেন আমি বাঘ কে কৌশলে মে-রে দিলাম সিংহ কে বাঁচিয়ে। সিংহের প্রাণভোমরা এখন আমার হাতে তাকে তৈরি করবো তার বিরুদ্ধে।

আগন্তুক হেসে উঠলো ভয়েস দিয়ে পাঠালো –
-“ আপনার শহরে আমন্ত্রণের সুযোগ দিয়ে সেই আপনিই শহরে ঢোকা নিষিদ্ধ করে দিলেন! নট ব্যাড। আই লাইক ইট।

ফোনের ওপাশে থাকা আগন্তুক যেনো এমনই এক বার্তার অপেক্ষায় ছিল। বার্তা টা পেয়ে হেঁসে উঠলো।

সমাপ্ত

( দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ টায় রহস্য উন্মোচন করা হবে। আগন্তুক এখানে কয়জন হয়তো ধারনা পেয়েছেন। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ টা মূলত তুষারের ছেলে তন্ময় কে নিয়ে শুরু হবে। চরিত্র গুলো একই থাকবে আর ধন্যবাদ আমার পাঠকগণ সব্বাইকে। ভালোবাসা অবিরাম,এতোটা সাপোর্ট করার জন্য। সামনেও সাপোর্ট করবেন আশা করি। ভালো থাকবেন৷ আল্লাহ হাফেজ।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে