#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব২৯( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ)
#Raiha_Zubair_Ripti
ছেলেবেলায় শহরে যেমন বৃষ্টি দেখা যেত, তেমন ঘনিয়ে বৃষ্টি বোধহয় এখন হয় না। বৃষ্টির তেমন সমারোহ নেই যেন, বৃষ্টি এখন যেন ইকনমিতে মন দিয়েছে – কোনরকম করে জল ছিটিয়ে চলে যায়। আগেকার মতো সে বজ্র বিদ্যুৎ বৃষ্টি বাতাসের মাতামাতি দেখা যায় না। আগেকার বৃষ্টির মধ্যে একটা নৃত্য ও গান ছিল, একটা ছন্দ ও তাল ছিল – এখন যেন প্রকৃতির বৃষ্টির মধ্যেও বয়স প্রবেশ করেছে, হিসাব কিতাব ও ভাবনা ঢুকেছে, শ্লেষ্মা শঙ্কা ও সাবধানের প্রাদুর্ভাব হয়েছে।
তবুও পরিবেশ টার সাথে আজকের দিন টা খাপে খাপ মিলে গেছে। ১৪ ফেব্রুয়ারী, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। এই দিন কে কেন্দ্র করে সহস্র যুগলবন্দী প্রেমিক প্রেমিকার অনেক প্ল্যান থাকে।
ছাঁদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে সেসব হাজার কল্পনা জল্পনা করতে ব্যাস্ত তৃষ্ণা। না হোক তার আর রাফির প্রেম তাকে গোলাপ দিতে সমস্যা কোথায়? আজ না হয় একটু মিষ্টি মিষ্টি করে কথা বলবে। ভালোবাসার দিবসে ভালোবাসায় গা এলাবে।
কথাগুলো ভেবেই তৃষ্ণা রাফির নম্বরে একটা মেসেজ পাঠায়।
রাফি কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে ছিলো। মেসেজে টুং টাং শব্দ কানে ভেসে আসতেই বিছানার পাশ থেকে ফোন টা নিয়ে দেখে তৃষ্ণার আইডি থেকে মেসেজ এসেছে। রাফি মেসেজ নোটিফিকেশনে ক্লিক করতেই দেখে ভালোবাসা দিবস নিয়ে একটা রচনা। এই রচনা টা সচারাচর ফেসবুকের মেসেজ অপশনে সবাই একাধারে ফরওয়ার্ড করতে থাকে। রাফি টাইপ করলো-
-“ এমন গরুর রচনা পাঠানোর মানে কি?
তৃষ্ণা রাফির এমন মেসেজ টা দেখেই ভ্রু কুঁচকালো।
-“ হার্টলেস নাকি আপনি?
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওপাশ থেকে টাইপ হলো-
-“ হার্টলেস হলে এই মন এতো সহজে একটা পুচকি মেয়ে নিজের বশে নিয়ে যেতে পারতো না।
-“ আজ কি জানেন?
-“ রচনা দেখে বুঝলাম এখন আজ কি।
-“ তো আপনার কি উচিত না কিছু করার?
-“ হ্যাঁ বিয়ে টা করে ফেলা উচিত। ব্রো এর বিয়ে শেষ আমার ও তো বয়স হচ্ছে।
-“ পাত্রী দেখবো?
-“ সে তোমার ইচ্ছে। তুমি নিজেই পাত্রী হবে নাকি অন্য কাউকে তোমার পরিবর্তে দিবে।
-“ আচ্ছা শুনুন না।
-“ হুমম বলো।
-“ আজ ঘুরতে নিয়ে যান না।
-“ কোথায় যাবা?
-“ আগে বাসা থেকে বের হই। তারপর ভাবা যাবে কোথায় যাওয়া যায়।
-“ আকাশের অবস্থা তো ভালো না।
-“ তাতে কি।
-“ যদি বৃষ্টি হয় তখন?
-“ আরো ভালো হবে বৃষ্টি তে ভিজবো।
-“ আচ্ছা দুপুরে রেডি হয়ে থেকো।
-“ আচ্ছা। শুনুন ব্লাক স্যুট পড়বেন কেমন?
-“ আচ্ছা। এখন এক কাপ কফি দিয়ে যাও রুমে। মাথা ব্যাথা করছে।
তৃষ্ণা ছাঁদ থেকে নিচে নেমে গেলো।
চিত্রা আজ ডার্ক রেড কালারের শাড়ি পড়েছে। হাতে লাল রেশমি চুড়ি আখি জোড়া কালো কাজল দ্বারা রাঙায়িত চুলগুলো খোঁপায় বাধা। খোঁপায় আছে বেলি ফুলের গাজরা । তুষারের শরীরে ব্লাক শার্ট। কোলে ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছে। চিত্রা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একবার নিজেকে দেখে নিলো। তার পর গলায় একটা ছোট্ট গয়না পড়ে তুষার সামনে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ আমি রেডি।
তুষার একপলক তাকালো চিত্রার পানে। আজ সকালেই এসেছে চিত্রা দের বাসা থেকে। এখন বাজে দুপুর দু’টো। বায়না ধরেছে আসার পর থেকেই সে ঘুরতে বের হবে। তুষার ও আজ ফ্রী তাই নাকচ করে নি। কোল থেকে ল্যাপটপ টা নামিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে বা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে-
-“ চলো তাহলে।
চিত্রা মুচকি হাসে। তুষারের বা হাতে নিজের ডান হাত দিতেই তুষার শক্ত করে মুঠোবন্দি করে। তারপর বাসা থেকে বের হয়।
তুষার আজ নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশে চিত্রা কে নিয়ে কাটাবো। তাই তার সেই পছন্দের জায়গায় চলে যায়। যেখানে নেই কোনো মানুষের সমাগম আছে শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য আর ঘ্রাণ। তুষার গাড়িটা নিয়ে শহর থেকে একটু দূরে অবস্থিত সেই খোলা মাঠ টায় আসে। যার একপাশে একটা কুঁড়েঘর আর তার পাশে ছোট্ট একটা নদী। তুষার গাড়ি থেকে নামে। চিত্রার কাছে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে চিত্রা কে বের হতে সাহায্য করে। চিত্রা বের হয়। পরিচিত সেই জায়গা টা দেখে মুখের হাসি চওড়া হয়।
তুষারের হাতের মধ্যে তার হাত। পায়ের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটছে। চিত্রা লম্বা একটা শ্বাস নিলো। এক হাত দিয়ে তুষারের বাহু চেপে ধরে বলে-
-” আপনার আমার মিলে এখন জায়গা টা আমাদের তাই না?
তুষার স্মিত হাসলো। ইশারায় বলল হ্যাঁ। নদীর একপাশে একটা ঝুড়িতে রয়েছে ঝুড়ি ভর্তি লাল,হলুদ,সাদা গোলাপ ফুল। ঝুড়ি টা চিত্রার নজরে আসলো। ভ্রু কুঁচকে বলল-
-“ আপনি আনিয়েছেন তাই না?
তুষার কিছু বললো না। চিত্রা এগিয়ে গেলো ফুল গুলোর দিকে। একটু ঝুঁকে ফুল গুলোর কাছে মুখ নিয়ে সুবাস নিতে থাকে। গোলাপ ফুলের সুবাস আছে নাকি? এটা না ফুলের রাণী এর তো থাকা উচিত সুবাসিত ঘ্রাণ। যেনো ক্রোশ মাইল দূরে থেকেও ঘ্রাণ পাওয়া যায়।
কোনো ঘ্রাণ না পেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। একটা হলুদ কালার ফুল নিয়ে তুষারের দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ আপনার আনা ফুলে ঘ্রাণ নেই এমপি মশাই। এই ফুলটা বরং আমার খোঁপায় লাগিয়ে দিন তো।
তুষার এগিয়ে আসলো। ফুল টা নিয়ে যত্ন সহকারে খোঁপায় গেঁথে দিলো। চুলের ভাজে আলতো করে চুমু খেলো। নদীর পাশে থাকা বকুল ফুলের গাছের ছায়াতলের বেশ টাতে গিয়ে বসলো। নদীতে একটা পদ্মফুল আছে। রং টা বেশ গাঢ়। অকপটে আবদার করে তুষার কে বলে উঠলো-
-“ ফুল টা আমার চাই এমপি মশাই। এনে দিন না।
তুষার পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে আসতে বলল। মিনিট দশেক পর লিমন হাঁপাতে হাঁপাতে তুষারের সামনে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ জ্বি ভাই বলেন।
তুষার পদ্মফুলের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ ফুল টা এনে দাও তো লিমন।
লিমন পদ্মফুলের দিকে তাকালো। পাশেই তো পড়ে আছে এক গাদা হরেক রকমের গোলাপ ফুল। এখন আবার পানিতে থাকা পদ্মফুল ও লাগবে! ক্যাবলরামের মতো কিয়ৎ ক্ষন চুপ থেকে প্যান্ট গুটিয়ে পানিতে নেমে পদ্ম ফুল টা এনে দেয়। তুষার হাতে নেয়। ইশারায় চলে যেতে বলে। লিমন চলে যায়। তুষার লতি সহ পদ্মফুল টা চিত্রার দিকে বাড়িয়ে দেয়। চিত্রা পদ্মফুল টা হাতে নিয়ে তুষারের কাঁধে মাথা রাখে।
-“ আর কতক্ষণ লাগবে আপনার?
তৃষ্ণা অধৈর্য্য হয়ে উক্ত কথাটি রাফির মোবাইলে পাঠাশ। সেই কখন থেকে রেডি হয়ে বসে আছে কিন্তু রাফির আসার নাম গন্ধ নেই। মিনিট দশেক পরে হোয়াইট স্যুট পড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামে। তৃষ্ণা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তাকে না বলেছিল ব্লাক স্যুট পড়তে? রাফি কাছে আসতেই তৃষ্ণা ভ্রু কুঁচকে বলে-
-“ ব্লাক স্যুট না পড়তে বলেছিলাম?
রাফি টাই টা ঢিলে করতে করতে বলে-
-“ বোতাম একটা খুলে গেছে সেজন্য আর পড়ি নি। আর তাছাড়া আমরা ম্যাচিং ম্যাচিং তো। তুমিও হোয়াইট আমি ও হোয়াইট।
-“ এবার চলুন যাই।
রাফি আগে আগে হাঁটা শুরু করে। তৃষ্ণা পেছন পেছন। রাফির পাশে গাড়িতে গিয়ে উঠে বসে। রাফি গাড়িটা নিয়ে সোজা ধানমন্ডির লেকের পাড় চলে যায়।
ঢাকা শহরের সবচেয়ে সুন্দর লেকগুলোর একটি ধানমন্ডি লেক। মানুষ মর্নিংওয়াকের জন্য এর ওয়াকওয়ে ব্যবহার করেন এবং অনেকে পার্কিং স্পেসে করেন ব্যায়াম। সামাজিকীকরণের স্থান হিসেবে ধানমন্ডি লেক রাজধানীবাসীর জন্য একটি জনপ্রিয় জায়গা।
ঘড়িতে সন্ধ্যা ৬টা ১২। লেকের ভেতরে অফিস ফিরতি সারি সারি গাড়ি, রিকশার টুং টাং শব্দ, সিএনজির কালো ধোঁয়া,শীতের সন্ধ্যা। আরো ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল আলো-আধারিযুক্ত আবহ। রাস্তার এক পাশে লেকের টলটলে পানি। পানির ওপর গাছের ছায়া আর দূর থেকে ভেসে আসা টীমটীমে আলোর চাদরে লেকের ভেতর সে এক অন্যরকম দৃশ্য। অন্য দিকটায় কিছুটা দূরত্ব পর পর বসেছে যুগলবন্দী প্রেমিক প্রেমিকার সমাগম। এসব অবলোকন করতে করতে হঠাৎ সামনে মিলে গেল পরিচিত কিছু মুখ।
রিয়া আর রায়ান এগিয়ে আসছে রাফি তৃষ্ণার দিকে। তৃষ্ণা ঘাড় ঘুরিয়ে রাফির দিকে তাকালো। মুখে লেগে আছে মৃদু হাসি। রায়ান এগিয়ে এসে রাফি কে জড়িয়ে ধরে।
-“ কেমন আছিস?
রায়ান রাফি কে ছেড়ে বলে-
-“ আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তোরা?
রাফি তৃষ্ণার দিকে একপলক তাকিয়ে বলে-
-“ এই তো আছি ভালো। তোরা এখানে যে?
-“ আজ কি?
-“ ফাগুন,বসন্ত।
-“ আরেক টা কি?
-“ নিব্বা নিব্বির প্রেম বিনিময় দিবস।
রায়ান হোহো করে হেঁসে উঠে। রাফির বাহুতে কিল দিয়ে বলে-
-“ হ্যাঁ সেটাই তো এর জন্যই এই সাঝ সন্ধ্যায় বেলা এসেছিস প্রেম বিনিময় করতে।
রিয়া রাফি আর তৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ বাহ ম্যাচিং ম্যাচিং দু’জনে।
-“ হ্যাঁ।
তৃষ্ণা বোবার মতো চুপ রইলো। রাফি তৃষ্ণার হাত নিজের হাতের মুঠোয় বন্দী করে। রায়ান, রিয়া,তৃষ্ণা রাফি গিয়ে টঙের দোকানে যায়। চারজনে মিলে চা খায়।
এরমধ্যে ঝুম বৃষ্টি নামা শুরু করে। টঙের ছাওনিতে দাঁড়িয়ে ঝুম বৃষ্টি দেখে তারা।
কুঁড়েঘর কৃত্রিম আলোয় সজ্জিত। বিছানার উপর লাল টকটকে গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো। টেবিলের উপর কয়েকটা মোমবাতি জ্বালানো আর তার পাশে পাপড়ি দিয়ে লেখা- হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে মাই লাভলি ওয়াইফ।
বেডের পাশে ছোট্ট টেবিলটায় রাখা তাদের বিয়ের ফটো।
চিত্রা মুগ্ধ হয়ে দেখছে সব। একটু আগেই বাহিরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছিল দেখে তুষার চিত্রা কে নিয়ে কুঁড়েঘরে আসে। আজ রাতে বাড়ি ফিরবে না তারা। সময়টা নিজেদের মতো করে একান্তে কাটাবে। খুব বেশি আসবাবপত্র নেই ঘরে। একটা বেড,একটা ড্রেসিং টেবিল, একটা আলমারি, এক জোড়া সোফা,একটা বুক সেলফ আর ছোট ছোট কয়েকটা শর্ট টেবিল।
-” পছন্দ হয়েছে?
চিত্রা চারদিকে তাকাতে তাকাতে বলে-
-“ ভীষণ। কে সাজিয়েছে এভাবে রুম টা?
-“ লিমন ছেলে টা।
-“ যে ফুল তুলে দিলো?
-“ হ্যাঁ।
কথাটা বলতে বলতে তুষার চিত্রাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। চিত্রা ভ্রু কুঁচকে বলে-
-“ কি করছেন।
তুষার চিত্রার কানের ললিতে অধর ছুঁয়ে বলে-
-“ এখন ও তো কিছুই করলাম না সোনা।
চিত্রা তুষারের থেকে নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলে-
-“ আপনি বন্ধ দরজার ভেতরে এক রকম। আর বাহিরে আরেক রকম।
-“ যেমন?
-“ এই যে এখন আপনাকে অন্য কেউ দেখলে বিশ্বাস ই করবে না যে তুষার খাঁন বন্ধ দরজার ভেতরে এতোটা অসভ্য।
তুষার চিত্রা কে টেনে কাছে নিয়ে এসে বলে-
-“ তুষার খাঁন তার বউয়ের কাছে শুধু অসভ্য কেনো আরো কিছু হতে পারে। দেখতে চাও?
চিত্রা আমতা আমতা করে বলে-
-“ ম..মোটেও ন..না। ছাড়ুন আমায় বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে আমি বৃষ্টি দেখবো।
-“ বৃষ্টি দেখে কি হবে। বৃষ্টিময় প্রেমে পাড়ি জমাবো তোমাকে নিয়ে। আজকের পরিবেশ টা মারাত্মক রোমান্টিক। মিঙ্গেল দের জন্য পারফেক্ট।
কথাটা বলে তুষার চিত্রা কে পাঁজা কোলে তুলে নিলো। চিত্রা তুষারের গলা জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ লুকিয়ে আছে। চিত্রা কে আলতো করে বিছানায় শুইয়ে দেয়। কপালে অধর ছুঁয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে দেয়। ঘর জুড়ে একখণ্ড মোমবাতি জ্বলে রইলো। খোলা জানালার দমকা হাওয়া এসে সেই মোমবাতি টাকেও নিভিয়ে দিয়ে গেলো। রাত যত গভীর হলো কারো নিশ্বাস ফেলার শব্দ তত ভারী হলো।
#চলবে?
#আমার_শহরে_তোমার_আমন্ত্রণ_২
#পর্ব৩০( অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষিদ্ধ)
#Raiha_Zubair_Ripti
একের পর এক হাঁচি দিচ্ছে রাফি। তার পাশেই অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে বসে আছে তৃষ্ণা। শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। গায়ে জ্বর। তানিয়া বেগম মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। বিছানার পাশেই রাখা গরম স্যুপ। তৃষ্ণা বানিয়ে এনেছে। নিচ থেকে তামিম খাঁনের ডাক ভেসে আসে। তানিয়া বেগম তৃষ্ণা কে জলপট্টি দিতে বলে নিচে চলে যান। তৃষ্ণা রাফির পাশে বসে। জল থে পট্টি তুলে সেটা চেপে রাফির কপালে দিয়ে মিনমিন করে বলে-
-“ সরি আমি বুঝতে পারি নি আপনার সত্যি সত্যি জ্বর চলে আসবে সামান্য বৃষ্টিতে ভেজায়।
রাফি পাশ থেকে টিস্যু নিয়ে নাক মুছে।
-“ এখন সরি বলে কি হবে। যা হবার তা তো হয়েই গেছে।
তৃষ্ণার ভীষণ অনুশোচনা হচ্ছে। রাফি পই পই করে কাল বলেছিল সে বৃষ্টি তে ভিজবে না। শরীর অসুস্থ হবে। তৃষ্ণা এক প্রকার জোর করেই রাফিকে বৃষ্টিতে ভেজায়। যার দরুন ছেলেটা এখন বিছানায় শুয়ে জ্বরে কাতরাচ্ছে।
-“ স্যুপ টা খেয়ে নিন না আরাম লাগবে কিছু টা।
রাফি স্যুপের দিকে তাকিয়ে নাক মুখ কুঁচকে বলে-
-“ ঐ তরল জিনিস টা প্লিজ খেতে বলো না। সব কিছু তিতা তিতা লাগছে।
-“ বেলা বাজে দশটা। এখনও পেটে কিছু পড়ে নি আপনার। ঔষধ খেতে হবে তো। তা না হলে জ্বর কমবে কি করে? আপনি একটু উঠে বসুন আমি খাইয়ে দিচ্ছি। অল্প করে একটু খান।
তৃষ্ণা রাফি কে উঠে বসতে সাহায্য করে। পিঠের পেছনে বালিশ দেয়। রাফি বালিশে ভর দিয়ে আধশোয়া হয়। তৃষ্ণা স্যুপের বাটি টা তুলে ফু দিয়ে দিয়ে রাফি কে খাইয়ে দেয়। তিন চামচ খেতেই রাফি মুখ সরিয়ে নেয়। সে আর খাবে না। তৃষ্ণা ও আর জোর করলো না। টেবিল থেকে মেডিসিন নিয়ে খাইয়ে দেয়। রাফি মেডিসিন টা খেয়ে আবার কম্বলের তলে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়ে। তৃষ্ণা কে বলে দেয় যাওয়ার আগে রুমের লাইট গুলো অফ করে দিতে।
তৃষ্ণা স্যুপের বাটি টা নিয়ে রুমের লাইট অফ করে দরজা চাপিয়ে চলে যায়।
ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে তুষার,তামিম খাঁন,সামির খাঁন,তরিকুল খাঁন। তানিয়া বেগম আর চিত্রা রান্না ঘরে।
সামনে ভোট আজ থেকেই ভোট প্রচারণা চালানো শুরু করবে। জায়গায় জায়গায় ছোটাছুটি করতে হবে। চিত্রা রান্না ঘর থেকে খাবার গুলো এনে ডাইনিং টেবিলে রাখে। সোফার দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ বাবা আপনারা খেতে আসুন।
তুষার এক পলক তাকায়। তারপর সবাই সোফা থেকে উঠে টেবিলে বসে খাবার খেতে। খাওয়া দাওয়া শেষে তুষার আর তামিম খাঁন চলে যায় ভোট প্রচারের জন্য। যাওয়ার আগে চিত্রা কে বলে গেছে তুষার,সময়মত খাবার খেয়ে নিতে তার ফিরতে দেরি হতে পারে। সামির খাঁন তানিয়া বেগমের কাছে রাফির শরীরের অবস্থার খবর জেনে তিনিও অফিসের জন্য বেরিয়ে পড়ে। তরিকুল খাঁন চিত্রা কে ডেকে ফিসফিসিয়ে বলে- ফ্রিজ থেকে লুকিয়ে একটা মিষ্টি দিতে।
চিত্রা আশেপাশে তাকায়। কাউকে আশেপাশে না দেখে চুপিচুপি ফ্রিজ থেকে মিষ্টি নিয়ে টেবিলের সামনে আনতেই পেছন থেকে তাসলিমা খাঁন বলে উঠে –
-“ তোমার হাতে কি নাত বউ ওটা?
চিত্রা হকচকিয়ে যায়। মিষ্টির বক্স সমেত পেছন ঘুরে বলে-
-“ আ….আসলে দাদিজান আমার হাতে মিষ্টি।
তরিকুল খাঁনের মুখে আঁধার ঘনিয়ে আসে। কত আশা নিয়ে ছিল একটা মিষ্টি খাবে। সেই আশা তে বালতি ভরে জল ঢেলে দেওয়ার জন্য তার সহধর্মিণী হাজির। তাসলিমা খাঁন মিষ্টির বক্স থেকে একটা মিষ্টি মুখে নিয়ে বলে-
-“ তোমার দাদাজান কে মিষ্টি দিয়ো না নাত বউ। তার ডায়বেটিস মিষ্টি খাওয়া বারন।
চিত্রা তরিকুল খাঁনের দিকে তাকালো। চোখ মুখে অসহায়ত্ব। চিত্রা আশ্বাস দিলো পরে ডাবল মিষ্টি দিবে।
-“ জ্বি দাদি জান মনে থাকবে। আসলে মিষ্টি রাফি ভাইয়ার জন্য নিচ্ছিলাম। তার তো শরীর খারাপ। কিচ্ছু খেতে পারছে না। তাই ভাবলাম মিষ্টি নিয়ে যাই।
-“ আচ্ছা নিয়ে যাও।
চিত্রা প্লেটে তিন খানা মিষ্টি নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে চলে যায়। তাসলিমা খাঁন স্বামীর পানে তাকিয়ে বলে-
-“ খবরদার লুকিয়ে মিষ্টি খাবা না। এখন রুমে চলো খাওয়া শেষ তোমার।
তরিকুল খাঁন একবার ফ্রিজের দিকে তাকিয়ে স্ত্রীর সাথে চলে যায়।
চিত্রা উপরে উঠে সোজা তৃষ্ণার রুমে চলে যায়। রুম পুরো ফাকা। অধরা সকালেই ভার্সিটি চলে গেছ। পুরো রুম জুড়ে যখন তৃষ্ণার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পেলো না তখন বেলকনির দিকে তাকাতেই দেখে তৃষ্ণা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে।
চিত্রা মিষ্টির প্লেট টা সেন্টার টেবিলে রেখে তৃষ্ণার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে-
-“ মুড অফ?
তৃষ্ণা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো চিত্রার দিকে। তারপর দৃষ্টি সামনে রেখে বলল-
-“ নাহ মুড অফ না।
-“ তাহলে?
-“ অনুশোচনা হচ্ছে।
-“ কি নিয়ে?
-“ রাফি ভাইয়ার শরীর খারাপ টা আমার জন্যই হলো। কাল যদি তার কথা মেনে নিয়ে তাকে জোর না করতাম তাহলে অসুস্থ হতো না।
চিত্রা মৃদু হাসলো। তৃষ্ণা কে রুমে এনে বলল-
-“ এতে অনুশোচনা হবে কেনো। মাঝেমধ্যে শরীর অসুস্থ হবে এটাই স্বাভাবিক। আর তুই তো আছিস তার সেবা করার জন্য। দেখবি তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবে।
তৃষ্ণা আগের ন্যায়ই রইলো।
সন্ধ্যার দিকে,,
সন্ধ্যার নাস্তা বানাচ্ছে চিত্রা। অধরা ভার্সিটি থেকে ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। রুমে গিয়েছে ফ্রেশ হতে। বসার ঘরে তরিকুল খাঁন, তাসলিমা খাঁন, তানিয়া বেগম বসে টিভি দেখছেন। রাফির শরীর আগের তুলনায় একটু ভালো। তৃষ্ণা রাফি কে ধরে নিয়ে আসছে।
চিত্রা গরম-গরম পকোড়াগুলো এনে সেন্টার টেবিলে রাখে। তানিয়া বেগমের পাশে বসে বলে-
-“ আম্মা আপনার ছেলে কি ফোন দিয়েছিল?
তানিয়া বেগম না বলে। অধরা ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামে। তাসলিমা খাঁনের পাশে বসে। পকোড়ার প্লেট থেকে পকোড়া নিয়ে চিত্রার দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ তুমি বানালে?
চিত্রা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো। সদর দরজার দিকে তাকাতেই দেখে সামির খাঁন আর তামিম খাঁন ক্লান্ত শরীর নিয়ে ভেতরে ঢুকছেন। চিত্রা ঘাড় উঁচিয়ে দেখলো তুষার আছে কি না পেছনে। কিন্তু নাহ তুষার নেই। সামির খাঁন রাফির পাশে এসে বসে বলে-
-“ এখন শরীর কেমন আছে আব্বা?
রাফি স্মিত হাসে।
-“ এখন ভালো আছি। ফ্রেশ হয়ে আসো।
সামির খাঁন উপরে চলে যায় ফ্রেশ হতে সাথে তামিম খাঁন ও।
মিনিট বিশেক পর দু ভাই ফ্রেশ হয়ে নিচে নামে। তানিয়া বেগম তামিম খাঁনের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ তুষার কোথায়?
তামিম খান পকোড়া খেতে খেতে বলে-
-“ ভোট প্রচারের ওখানে। ফিরতে দেরি হবে।
চিত্রা অধৈর্য্য হয়ে বলল-
-“ কত দেরি বাবা?
তামিম খাঁন চিত্রার দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ দশ টা এগারো টা বাজতে পারে মা।
তানিয়া বেগম স্বামীর দিকে তাকালেন। বিরক্তি হয়ে বললেন –
-“ তুষার কে একা রেখে আসলে কেনো? জানো তো পরিবেশ এখন কত গরম। বিপরীত দলের লোকেরা কেমন জানা নেই তোমার?
-“ গার্ড আছে সাথে রাতুল লিমন ও আছে। মিছে মিছে চিন্তা করছো।
অধরা গলা ঝাড়লো। তামিম খাঁনের দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ মামু আমি একটা কথা বলতে চাই তোমাদের।
সবার দৃষ্টি গিয়ে পড়লো অধরার দিকে। অধরা হাত কচলে নিজেকে ধাতস্থ করে। তামিম খাঁন বলেন-
-“ কি কথা অধরা?
-“ মামু আসলে আমি নেক্সট উইক থেকে হলে থাকতে চাচ্ছি।
সবার কপালের মাঝে দু ভাজ পড়লো। এমপির ভাগ্নি কি না থাকবে হলে! তার চেয়ে বড় কথা এখন ভোটাভুটির তোড়জোড় চলছে। পরিবেশ গরম। এই সময়ে ঘরের মেয়ে বাহিরে থাকা মানে আলাদা এক্সট্রা করে চিন্তা মাথায় নেওয়া। তামিম খাঁন সহসা না করে দেন।
-“ হলে থাকার পারমিশন পাবা না অধরা। বুঝতেই পারছো পরিবেশ ভালো না। বাই এনি চান্স শত্রুরা তোমার উপর হামলা করলে তখন কে প্রটেক্ট করবে? তুমি দূরে থাকা মানে আলাদা করে এক্সট্রা চিন্তার মধ্যে থাকা আমাদের। আর আছোই তো কয়েক মাস ভার্সিটি তে শুধু শুধু এই কয়েকটা দিনের জন্য হলে উঠে কি করবা।
অধরা নুইয়ে যায়। হলে থাকা নিয়ে রাতুলের সাথেও তার কথা হয়েছে। রাতুল ও মানা করেছে। কিন্তু অধরা তো বাসায় থাকলে যখন তখন বের হতে পারবে না। এমনিতেই রাফি সন্দেহ করে। হলে থাকলে রাতুলের বাসা হল থেকে বেশি দূরে না। মুড সুয়িং হলে যখন তখন রাতুলের সান্নিধ্য পাওয়া যাবে। কিন্তু জোর দিয়েও বলতে পারছে না। তাদের কথাতেও লজিক আছে।
রাত বাজে পনে দশটা। ডিনার করে যে যার রুমে চলে গেছে। শুধু ড্রয়িং রুমে একাকী বসে আছে চিত্রা। তানিয়া বেগম বলেছিল তাদের সাথে খাবার খেয়ে রুমে গিয়ে শুতে। কিন্তু চিত্রা না করেছে। লোকটা কোনে কাণ্ডজ্ঞান নেই? সেই যে সকালে যাওয়ার আগে বলল ফিরতে দেরি হবে সময়মত খাবার খেয়ে নিতে। তার কি একটা বার ফোন দেওয়া উচিত ছিলো না? ফোন না দিলো রিসিভ তো করতে পারতো ফোন। কথাগুলো ভাবতেই চোখ মুখ কুঁচকে এলো। এগারো টার দিকে তুষারের আগমন ঘটে। এক্সট্রা চাবি দিয়ে ঢুকে বাসায়। ড্রয়িং রুমের লাইট নিভানো। সুইচ খুঁজে লাইট জ্বালাতেই দেখে ডাইনিং টেবিলে মাথা রেখে বসে আছে চিত্রা। অপেক্ষা করতে করতে তার অপেক্ষারাণীর চোখে তন্দ্রা ভর করেছে। স্মিত হাসলো তুষার।
আজ কাজের প্রেসারের জন্য ফোন করতে পারে নি বউ টাকে। আর ফোন টা ছিলো রাতুলের কাছে। সারাদিনের দৌড়াদৌড়ি জন্য শরীর একদম নেতিয়ে গেছে তুষারের। এমপি হওয়া কি এতোই সহজ? শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে ক্লান্ত শরীর নিয়ে চিত্রার কাছে আসে। মুখের উপর এসে জড়ো হয়েছে অবাধ্য চুল। আলতো হাতে চুল গুলো সরিয়ে দিলো। কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো চিত্রা। তুষার তার অধর চিত্রার কানের কাছে নিয়ে ফিসফিস করে বলে-
-“ জান উঠো ক্ষিধে পেয়েছে।
চিত্রা ঘুমঘুম চোখে পিটপিট করে তাকালো। অস্পষ্ট হলো সামনে থাকা মানুষটার অবয়ব। চোখ টা আবার বন্ধ করে হুট করে আবার চোখ মেলে তাকায়। টেবিলের উপর থেকে মাথা উঠায়। চোখ ঢ’লে বলে-
-“ কখন আসছেন আপনি? আমি বুঝতে পারি নি হুট করে চোখ টা লেগে আসছিলো। চেয়েও মেলে রাখতে পারি নি।
-“ চোখ মুখে পানি দিয়ে আসো। আর খাবার টা রুমে নিয়ে আসো। আমি ফ্রেশ হবো।
চিত্রা মাথা নাড়িয়ে আচ্ছা জানালো। তুষার উপরে উঠে চলে গেলো। চিত্রা খাবার বেড়ে প্লেটে করে নিয়ে উপরে রুমে চলে গেলো।
তুষার সেন্টু গেঞ্জি পড়ে টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বের হয়। ফর্সা নগ্ন পেশীবহুল বাহু বেশ আকর্ষণীয় লাগছে।
ভেজা টাওয়াল টা বেলকনিতে মেলে সোফায় বসে। ইশারায় পাশে বসতে বলে চিত্রা কে। চিত্রা খাবারের প্লেট টা নিয়ে তুষারের পাশে বসে। তুষার পাশ থেকে ল্যাপটপ টা কোলে তুলে নিয়ে বলে-
-“ একটু কষ্ট করে আমাকে খাইয়ে দাও আর নিজেও চটপট খেয়ে নাও।
চিত্রা তপ্ত শ্বাস ফেললো।
-“ আপনার কাজ এখনও শেষ হয় নি?
তুষার ল্যাপটপেই চোখ রেখে বলে-
-“ কেনো? স্বামী কে কাছে চাইছো?
-“ অসভ্য পুরুষ।
কথাটা বলে চিত্রা তুষার কে খাবার খাইয়ে দেয়। চিত্রা কে খেতে না দেখে বলে-
-“ সোনা আমি ভীষণ বিজি। একটু তুমিও খেয়ে নাও না।
চিত্রা তুষারের মুখের সামনে ভাতের লোকমা তুলে বলে-
-“ আমি খেয়েছি আপনি খান।
তুষার চিত্রার দিকে তাকালো।
-“ মিথ্যা বলা আমি মোটেও পছন্দ করি না চিত্রা। আমি জানি খাও নি তুমি।
চিত্রার এবার অভিমান হলো। কপাট রেগে বলল-
-“ আমার খাওয়ার চিন্তা আপনার করা লাগবে না। আপনি খান,খেয়েদেয়ে কাজ নিয়ে পড়ে থাকেন। আমাকে নিয়ে ভাবার প্রয়োজন নেই। কতগুলো ফোন দিছি আমি আপনাকে? একটা ফোন ও রিসিভ করেন নি।
তুষার দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। কোল থেকে ল্যাপটপ টা পাশে রেখে চিত্রা কে টেনে কোলে বসালো। কাঁধে থুঁতনি রেখে বলল-
-“ ফোন টা আমার কাছে ছিলো না। বুঝতেই তো পারছো ভোট প্রচারের জন্য গিয়েছিলাম। সারাটা দিন আমাকে এদিকে ওদিকে ছুটতে হয়েছে। সেখানে বাসায় এসে যদি তোমার এই অভিমানী মুখশ্রীর দেখা মিলে তাহলে আমি সারাদিনের ক্লান্তি কার কাছে গিয়ে সুখে পরিনত করবো?
-“ আর আমার আপনাকে নিয়ে যে চিন্তা হয় সেটা বুঝেন না? একটু তো ফোন দিয়ে আপনার কন্ঠ স্বর শুনতে ইচ্ছে করে। বুঝেন না আপনি?
-“ জ্বি আমারই ভুল হয়েছে ফোন টা রাতুলের কাছে রেখে। এবার থেকে ফোন করবো,তোমার তৃষ্ণা মেটাবো। খুশি?
চিত্রা তুষারের কোল থেকে উঠে পাশে বসলো। তুষার কে খাইয়ে নিজেও খেয়ে নিলো। এঁটো হাত পানি দিয়ে ধুয়ে সেন্টার টেবিলের পাশে প্লেট টা রেখে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে চিত্রা। তুষার রুমের লাইট অফ করে ল্যাপটপ টা আবার কোলে নেয়। চিত্রা চাদর দিয়ে শরীর ঢেকে মাথা উঁচু করে তুষারের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ বেশি রাত যেনো না হয় বিছানায় আসতে।
তুষার চোখ তুলে তাকায়। ল্যাপটপ টা বন্ধ করে সোজা বিছানায় গিয়ে চিত্রা কে কাছে টেনে নেয়। চিত্রা তুষারের বুকে মুখ গুঁজে এক হাত দিয়ে সেন্টু গেঞ্জি খামচে ধরে আছে। চিত্রার কপালে অধর ছুঁয়ে দিয়ে বলে-
-“ আজ ভীষণ ক্লান্ত আমি। ওসবের মুডে একদম নেই। তবে তুমি চাইলে…..
চিত্রা মাথা তুলে তাকায়। জ্যোৎস্নার আলোয় ঘর খানিক টা আলোকিত। ঝাপসা বোঝা যাচ্ছে তুষারের মুখের আদল। চোখ বন্ধ করে আছে। ক্লান্ত ভীষণ সে তার মুখই বলে দিচ্ছে।
-“ আমি মোটেও ওসব ইঙ্গিত করি নি। আপনাকে ছাড়া ঘুম ধরবে না তাই বলেছি বিছানায় আসতে যেনো বেশি রাত না হয়।
তুষার কিছু বললো না। চিত্রা কে জড়িয়ে ধরেই ঘুমের দেশে পাড়ি জমালো। চিত্রা তুষারের দিকে কিয়ৎ ক্ষন তাকিয়ে থেকে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ে।
———————————-
পুরো কয়েকদিন ব্যাপি ভোট প্রচারের কাজে পুরোদমে ব্যাস্ত ছিলো তুষার। জনগণ কে আস্বস্ত করেছে তার শহরে চাঁদা বাজির বিষয়ক কোনো ঘটনা ঘটবে না। রাস্তার ধারে দোকানপাট করার জন্য ব্যাবসায়িদের আলাদা চাঁদা দিতে হয় এলাকার কিছু নিম্ন মানের রাজনীতি করা লোকদের। সেটা সম্পূর্ণ ভাবে নিশ্চিহ্ন করবে। এলাকার রাস্তা ঘাট গুলো সম্পূর্ণ মেরামত করবে। যেই এলাকায় ঝুম বৃষ্টি হলেই পানিতে রাস্তা তলিয়ে যায় সেই এলাকা গুলো চিহ্নিত করে সেই এলাকার রাস্তাঘাটে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে যাওয়ার জন্য ড্রেন তৈরি করবে। রাস্তা ঘাটে ফুটপাতে থাকা দোকানদারদের দোকানের জন্য আলাদা জায়গা দিবে।
শহর জুড়ে রাস্তার আনাচে-কানাচেতে তুষারের ভোটের পোষ্টার। বিরোধী দলের লোক হালিম সরকার ও তার ছেলেকে এবার নামিয়েছে তুষারের বিপরীতে। ছেলেটা রাজনীতির র ও বুঝে না। তাই তুষার সেদিকে মাথা ঘামাতে মোটেই চাইছে না।
আজ চিত্রা দের বাসা থেকে চিত্রার মা বাব আর সিমি রিয়াদ এসেছে। চিত্রা আর তানিয়া বেগম তারজন্য সেই বেলা থেকেই রান্নার তোড়জোড় শুরু করেছে। বেশ অনেক আইটেমের ই খাবার রান্না করে বউ শ্বাশুড়ি মিলে।
রিয়াদ চুপচাপ বসে আছে। কত কিছু ভেবে এসেছিল এই শহরে। এখন তাকেই নিরব হয়ে সব দেখতে হচ্ছে। এমপির বাড়ির বউ মনে যা এঁটে এসেছিল তা বাস্তবায়ন করতে গেলে নির্ঘাত মা-ইর গুতা খেয়ে শহর ছেড়ে যেতে হবে। আপাতত চুপ চাপ থেকে দেখা ছাড়া উপায় নেই। সুযোগ বুঝে কোঁপ বসাবে।
তুষার ফিরেছে দুপুরের দিকে। আজ শুক্রবার,গোসল সেরে বাপ চাচা,শ্বশুরের সাথে জুম্মার নামাজ আদায় করে মসজিদে গিয়ে। মসজিদের ইমাম সাহেব তুষার কে ডেকে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে জানায় তার বেতন নিয়ে। মাস কয়েক হলো তার বেতন ঠিক মতো পাচ্ছেন না। তুষার তার বেতনের সুনিশ্চিয়তা দেয়। ইমাম সাহেব খুশি হন।
তুষার মাথার টুপি খুলতে খুলতে বাসার ভেতর ঢুকে। শরীর ঘেমে একাকার। চিত্রা তুষার কে দেখেই এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এগিয়ে দেয়। রিয়াদ যায় নি জুম্মার নামাজে। চিত্রার দিকে তাকিয়ে আছে। তুষার লক্ষ করলো। পানি টা নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে সেন্টার টেবিলে রাখলো। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাওয়ার সময় চিত্রা কে ডেকে রুমে আসতে বলল।
রাফি এখন পুরোপুরি সুস্থ। পুরো দমে বাবার ব্যাবসার হাল ধরেছে। এখনই সব বুঝে নেওয়ার সময়। বাবার বয়স হচ্ছে আর যোগ্য পাত্র হিসেবে নিজের ও আলাদা পরিচয় হচ্ছে। সব ঠিকঠাক করে নিয়েছে ভোটাভুটি শেষ হলে চাচার কাছে বিয়ের প্রস্তাব রাখবে। ওসব রিলেশনশিপ টিলেশনশীপ রাফির ধাঁচে নেই। একদম হালাল করে তারপর জমিয়ে প্রেম করবে। সেই ভেবে সব প্ল্যান করা শেষ। আর তো মাত্র কয়েক টা দিন। তারপরই তো ভোটাভুটি শেষ। কথাটা ভেবেই আনমনে হেঁসে উঠলো।
সামির খাঁন ছেলের রুমে এসেছেন। এখনও সব সব কিছু বুঝিয়ে দিতে পারেন নি তিনি ছেলেকে। ছেলেটা তার বড্ড আদরের। স্ত্রী মা-রা যাওয়ার পর আর দ্বিতীয় বিয়ে করেন নি। তার ধারণা সৎ মা কখনই মায়ের মতো হয়ে উঠতে পারে না। তার ছেলের অযত্ন হবে। আর ছেলেও বড় হয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিয়ে করে লজ্জার সম্মুখীন হতে চান নি।
রাফি সামির খাঁন কে দেখে স্মিত হেঁসে বলে-
-“ কিছু বলবে?
-“ হুম।
রাফির পাশে বসলো। মাথায় হাত রেখে আলতো হেঁসে বলে-
-“ কারওয়ান বাজারের একটা নতুন প্রজেক্টের কাজ চলছে। সময় সুযোগ বুঝে এই সপ্তাহের মধ্যে একবার দেখে এসো বরং।
রাফি আচ্ছা জানালো। তৃষ্ণা এসেছিল রাফি কে ডাকতে খাবার খেতে। রুমের মধ্যে চাচা কে দেখে হকচকিয়ে যায়। মৃদু হেসে বলে-
-“ চাচা খেতে আসো।
তৃষ্ণা চলে যায়। সামির খাঁন ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে নিচে নামে।
আজকাল নিত্যদিনের মতো অভ্যাসে পরিনত হচ্ছে রোজ তিনবেলা করে রাতুলের সাথে কথা বলা। রাতের প্রায় মধ্যে রাত অব্দি দু’জনের কথোপকথন চলে। কথা বলতে বলতে কখন ও অধরা বেলকনির চেয়ারেই ঘুমিয়ে পড়ে। আজ ও ব্যাতিক্রম নয়। রাতুলের ব্যাক্তিত্ব মারাত্মক ভাবে আকৃষ্ট করছে অধরা কে। তাদের প্রণয় হয় নি সেভাবে কিন্তু বন্ধুত্ব হয়েছে মজবুত। মাঝেমধ্যে ঘুরাঘুরি,খাওয়াদাওয়া, পায়ের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটা ভীষণ ভালো লাগছে অধরার। রাতুল কখনও হাঁটার মধ্যে অধররা হাত ভুলের নিজের হাতের মুঠোয় নেয় নি। বরংচ বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে তারা হাটতো। পাশাপাশি বসলেও তাদের মাঝখানে কিছুটা দূরত্ব থাকতো।
এই ছোট্ট ছোট্ট বিষয় গুলো খুব চোখে লাগে অধরার।
চিত্রা ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে রুমে প্রবেশ করে। তুষার চিত্রার উপস্থিতি টের পেয়ে কোল থেকে ল্যাপটপ টা পাশে রেখে বলে-
-“ এদিকে আসো।
চিত্রা বাধ্য মেয়ের মতো তুষারের কাছে যায়। তুষারের পাশে বসতে ইশারা করে। চিত্রা বসতেই তুষার গম্ভীর কন্ঠে বলে-
-“ তোমার কাজিন রিয়াদ ওভাবে তাকিয়ে থাকে কেনো তোমার দিকে?
চিত্রা আকস্মিক এমন কথায় মাথা তুলে তাকায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলে-
-“ কি বলছেন এসব,কিভাবে তাকাবে আমার দিকে।
-“ কেমন একটা নজরে তাকায়। ভালো লাগে না ঐ নজর। আমার বউয়ের দিকে ওভাবে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকবে কেনো?
-“ আর বইলেন না। এই ছেলের সাথে একটা সময় রিলেশন করছিলাম।
তুষার সরু চোখে তাকায়। কি নির্দ্বিধায় তাকে বলছে মেয়েটা। বিস্ময় হয়ে বলে-
-“ ঐ ছেলে তোমার এক্স?
-“ হ,বাদ দিন তো এখন ওর কথা।
-“ এটা মোটেও বাদ দেওয়ার কথা না। একটা মেয়ের পেছন কেনো এতো ছেলের নজর থাকবে হোয়াই? এক আরহাম এরপর তোমার এই কাজিন। মানে কি একটা ব্যাপার। আমার বউয়ের দিকেই এতো ছেলের নজর পড়তে হলো!
-“ আচ্ছা ভালো কথা মনে করিয়েছেন তো। আরহাম লোকটার কি খবর? কোনো খোঁজ খবর পাওয়া যায় না ইদানিং।
তুষার হাই তুলতে তুলতে বলে-
-“ আপাতত দেশে নাই। বাহিরের হাওয়া খাচ্ছে।
-“ মানে?
-“ মানে টা না হয় রহস্য থাক। তোমার কাজিন কে বলে দিয়ো আমি যদি আর একবার তোমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখছি তো..
-“ তো কি?
-“ কিছুনা জাস্ট মনের রাগ মেটাবো তার উপর ব্যাস।
#চলবে?