আমার ভীনদেশী এক তারা পর্ব-১৭

0
714

#আমার_ভীনদেশী_এক_তারা
#পর্ব১৭
#Raiha_Zubair_Ripte

ফাইনালি দুই পরিবারের সম্মতিতে আগামী সপ্তাহে তাদের বিয়ের ডেট ফিক্সড হলো। উপর থেকে খবর টা পেয়ে আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া আদায় করলো এনা। ফরিদা আর রত্না বেগম ডিনারের ব্যাবস্থা করছে। দুই পরিবার এক সাথে ডিনার করবে,সেই অনুযায়ী তোড়জোড় শুরু করে দিছে রত্না আর ফরিদা। মারুয়া বিষয় টা খেয়াল করলো,তিনি বসা থেকে উঠে রান্না ঘরে চলে গেলো। ফরিদা আর রাত্না বেগম রান্না ঘরের সামনে মারুয়া কে দেখে জিজ্ঞেস করে,,

” আরে আপা আপনি এখানে। কোনো কিছুর দরকার?

মারুয়া রান্না ঘরের ভেতরে ঢুকে বলে,,

” হুমম আপা আসলে আমার কাজের দরকার।

” মানে?

” মানে হচ্ছে এই,আপনারা দুজন খেটে ম’রছেন আর আমি সোফায় আরাম আয়েশে বসে থাকবো এটা হয় নাকি? তাই আর না পেরে চলে আসলাম।

” আপা চিন্তা করবেন না আমরা দুই জা মিলে সব করে ফেলতে পারবো। আপনি গিয়ে বসুন।

” আমি ও তো আপনাদের বেয়াইন হই মানে বোন-ই আমি ও তাহলে পারি সাহায্য করতে। আর তাছাড়া তিনজনে মিলে করলে তাড়াতাড়ি হবে।

” তা হয় না আপা। আপনি আমার মেয়ে শাশুড়ি।

” শাশুড়ি মানে মা। আমি আপনার মেয়ের আরেক মা। আচ্ছা কোনো কাজ না করতে দিলেন খাবার গুলো তো টেবিল পর্যন্ত নিয়ে যেতে তো পারি? নাকি সেটাও করতে দিবেন না।

রত্না বেগম এবার হেসে ফেললেন।

” আচ্ছা তাহলে কষ্ট করে খাবার গুলো টেবিল পর্যন্ত নিয়ে যান।

মারুয়া খুশি হয় খুব। মারুয়া মিশুক প্রকৃতির এক মেয়ে। সবার মনে এক নিমিষেই জায়গা করে নিতে পারে। মারুয়া খাবার গুলো টেবিলে নিয়ে সাজায়।

আব্রাহাম, আরমান,এনামুল তিন বেয়াই গেছে বাহিরে একটু হাটাহাটি করতে। সোফায় বসে আছে আরহাম, মুনিয়া,হেনা,শান। ফারাহ্ এর শরীর টা আজ ভালো নেই তাই উপরে গিয়ে এনার রুমে শুয়ে আছে। এতোক্ষণ ধরে নিচেই ছিল। শরীর টা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছিল দেখে এনার রুমে যায়।

আরাভ কোনো একটা কারনে বাহিরে গিয়েছিল একটু আগে। এখন ফিরল। চোখ তার লল রক্তিম বর্ণ ধারন করেছে। সবাই আরাভের দিকে তাকালো। হেনা কিছু বলতে উদ্যত হবে আরাভ সবাই কে উপেক্ষা করে হনহনিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল। মুনিয়া এক ঝলক আরাভের দিকে তাকিয়েছিল লোকটাকে এই প্রথম সামনা-সামনি দেখলো। এর আগে শুধু শানের ফোনেই দেখেছে। সবাই বেশ অবাক হয় আরাভের ব্যাবহারে। হেনা ভ্রু কুঁচকে বলে,,

” আরে এই আরাভ ভাইয়ের কি হলো। চোখ মুখ লাল কেনো?রেগে আছে? কিন্তু কেনো?

আরহাম টেবিল থেকে জুশ টা মুখে নেয়।

” উনি কি ছ্যাকা ট্যাকা খাইছে নাকি। না মানে আমার বন্ধ ফ্লেক্স যখন ছ্যাকা খেতো তখন ওর চোখমুখ ও এমন হয়ে যেতো।

কথাটা কর্ণকুহর হতেই মুনিয়ে বিষম খায়। মুখ থেকে জুশ ছিটকে তার জামা তে পড়ে। সবাই মুনিয়ার দিকে তাকায়। হঠাৎ তার বিষম খাওয়ার ব্যাপার টা হজম হলো না কারোরই। মুনিয়া চশমা টা ঠেলে হেনার দিকে তাকিয়ে বলে,,

” আপু ওয়াশরুম টা কোন দিকে?

” চলো আমি নিয়ে যাচ্ছি।

” না থাক তুমি বলে দাও আমি যাচ্ছি।

” আচ্ছা সিঁড়ি বেয়ে ডান দিকে গিয়ে বামের তিন রুমের পড়ে ওয়াশরুম আছে।

মুনিয়া সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে ডানে গিয়ে বামে থাকা রুম গুলোর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তিন রুমের পরে থাকা রুমটার ওয়াশরুমে ঢুকে জামাটা পরিষ্কার করে আসে। জামা থেকে পানি ঝাড়তে ঝাড়তে দ্বিতীয় রুম ক্রস করতেই সজোরে কিছু ভাঙার শব্দ আসে মুনিয়ার কানে। মুনিয়া সরসা দাঁড়িয়ে যায়। দরজার কাছে যায়। দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে থাকে দরজায় টোকা দিবে কি দিবে না। কারন শব্দ টা আবার ও ভেসে আসতেছে। মুনিয়া ভয়ডর নিয়েই দরজাটা হালকা ফাঁক করে। সামনে তাকাতেই দেখে ফ্লোরে র”ক্ত ছুপছুপ করছে। আরাভের হাত দিয়ে টপটপ করে র”ক্ত পড়ছে। মুনিয়া ভয় পেয়ে যায়। র”ক্ততে তার ফোবিয়া আছে। সরসা মুনিয়া ঘুরে চলে আসতে নিলে দরজার সাথে বারি লাগে। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ কানে আসতেই দরজার পানে চেয়ে দেখে শানের বোন। মুনিয়াও ফিরে তাকায় আরাভের দিকে ভীতি চাহনি নিয়ে। আরাভ ভ্রু কুঁচকে ফেলে মুনিয়া কে দেখে। একপা একপা করে মুনিয়ার দিকে এগোতে নিলে মুনিয়া আরো ভয় পেয়ে যায়। আরাভের হাত বেয়ে এখনো র”ক্ত পড়ছে। মুনিয়া সেটা দেখে থরথর করে কাঁপতে থাকে। মুনিয়াকে এভাবে কাঁপতে দেখে আরাভের ভ্রুকুটি সটান হয়।

” কি হয়েছে তুমি আমার রুমের সামনে কেনো? আর এভাবে কাঁপছ কেনো?

মুনিয়া কথা বলতে পারছে না। ভয়ে যেনো তার গলার স্বর দিয়ে যেনো কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। মুনিয়াকে কিছু বলতে না দেখে আরাভ মুনিয়ার হাত ধরে।

” হেই তোমায় বলছি কথা কানে যাচ্ছে না? আমার রুমের সামনে কেনো তুমি।

মুনিয়া তার ধরে রাখা হাত টার দিকে তাকায়। শরীরের কাঁপুনি যেনো আরো বেড়ে গেছে মুনিয়ার।

” এই মেয়ে এতো কাঁপছো কেনো? ভয় পেয়েছো কিছু দেখে?

কাঁপা কাঁপা গলায় এবার মুনিয়া বলে,,

” আ আপনার হ হাতে র র”ক্ত। আ আমার ভয় করছে।

কথাটা কর্ণকুহর হতেই আরাভ মুনিয়ার হাত ছেড়ে দেয়।

” তুমি র”ক্ত দেখে ভয় পাচ্ছ?

মুনিয়া মাথা ঝাকায়। আরাভ নৈঃশব্দ্যে হাসে। মুনিয়া কে টেনে রুমে নিয়ে আসে। বিছানায় বসিয়ে নিজেও তার থেকে খানিকটা দূরত্ব নিয়ে বসে।

” ড্রয়ারে দেখো ফাস্টএইড বক্স আছে বের করো।

মুনিয়ার ভেতর কোনো ভাবান্তর না দেখে এবার কিছুটা জোরেই আরাভ বলল,,

” এই মেয়ে কথা কানে যায় না? বললাম না ড্রয়ার থেকে ফাস্টএইড বক্স বের করতে। শীগ্রই বের করো।

মুনিয়া কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,,

” আ আমাকে বলছেন?

” তুমি ছাড়া কি আর কেউ আছে এই রুমে। দেখো তো কেউ আছে কি না।

মুনিয়া পুরো রুমে চোখ বুলায়। ফ্লোরে ফুলদানি কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

” কুইকলি ফাস্টএইড বক্স আনো।

মুনিয়া ড্রয়ার থেকে ফাস্টএইড বক্স বের করে আরাভের দিকে বাড়িয়ে দেয়।

আরাভ সেটা দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে।

” আমাকে দিতে বলছি আমি?

মুনিয়া তাকায় আরাভের মুখের দিকে।

” আমার মুখের দিকে না তাকিয়ে হাত টা ব্যান্ডেজ করে দাও।

মুনিয়ার এবার রাগ হয়। লোকটা এখন তাকে দিয়ে হাত ব্যান্ডেজ করাবে। দেখতেই পাচ্ছে র”ক্ততে সে ভয় পাচ্ছে।

” কি হলে দিচ্ছো না কেনো? এক কথা একবার না বললে সেটা কানে ঢুকে না নাকি?

” আমার ভয় করছে ভাইয়া। আপনি করুন না ব্যান্ডেজ।

” তোমার চোখ নেই নাকি মাথায় বুদ্ধি নেই। আমি এক হাত দিয়ে অন্য হাতে ব্যান্ডেজ করবো কিভাবে?

” তাহলে হেনা আপু কে ডেকে দেই।

” এই মেয়ে তোমাকে বলেছি না করে দিতে। না করতে পারলে আমার রুম থেকে বের হতে পারবে না।

মুনিয়া কাঁপা কাঁপা হাতে তুলায় স্যাভলন ভরিয়ে আরাভের হাত নিজের কোলের উপর নেয়। সযত্নে তুলো দিয়ে কা”টা জায়গা টা স্যাভলন দিয়ে পরিষ্কার করে। আরাভের বেশ ভালে লাগছে মুনিয়ার ভয়ার্ত চেহারাটা দেখে। মুনিয়াকে আরো একটু ভয় দেখানোর জন্য এবার আরাভ ইচ্ছে করে একটু ব্যাথা পাওয়ার ভান করে আহ্ শব্দ করে উঠে।

শব্দ টা কর্ণকুহর হতে মুনিয়া ছিটকে উঠে। আরাভের হাতে ফু দিতে দিতে বলে,,

” সরি সরি আমি বুঝতে পারি নি আপনি ব্যাথা পাবেন।

” ইচ্ছে করেই তো ব্যাথা দিচ্ছ। কি মনে করেছো আমি বুঝি নি। ইচ্ছের বিরুদ্ধে একটু ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছ দেখে এভাবে ব্যাথা দিবে।

এবার মুনিয়া কেঁদেই দিবে এমন অবস্থা একে তো র”ক্ত গুলো তার পরিষ্কার করতে হচ্ছে তার উপর আরাভ বলছে সে ইচ্ছে করে ব্যাথা দিচ্ছে।

আরাভ মুনিয়ার মুখটা দেখে এবার শব্দ করে হেসে উঠে। হঠাৎ এমন হাসির শব্দ শুনে মুনিয়া মাথা তুলে তাকায়। লোকটার হাসির কারন কি?

” হয়েছে মেয়ে যাও আর কষ্ট করতে হবে না। সামান্য র”ক্ত দেখেই এতো কাঁপা-কাঁপি। তোমাকে দেখলে তো মনে হয় না এতো ভীতু তুমি।

কথাটা কর্ণকুহর হতেই বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায় কোনো দিকে না চেয়ে সোজা রুম থেকে বেরিয়ে আসে। সোফায় বসে থাকা আরহাম মুনিয়াকে আসতে দেখে বলে,,

” কিরে ওয়াশরুমে গিয়ে কি ঘুমিয়ে পড়ছিলি নাকি।

মুনিয়া কিছু না বলে চুপচাপ সোফায় বসে পড়ে।

” কিরে সত্যি সত্যি কি ওয়াশরুমে ঘুমায় পড়ছিলি।

কথাটা বলে আরহাম মুনিয়ার বাহুতে হাত দিয়ে দেখে তার বোন থেকে কাঁপতেছে।

” কিরে মুনিয়া তুই এভাবে কাঁপতেছিস কেনো।

মুনিয়া হাসার চেষ্টা করে বলে,,

” না ভাইয়া এমনি আসলে শীত শীত লাগছে তাই।

” ওহ্ এসির পাওয়ার টা কমিয়ে দেই তাহলে?

মুনিয়া মাথা ঝাকায়। আরহাম হেনার দিকে তাকিয়ে বলে,,

” বেয়াইন সাহেবা কষ্ট করে একটু এসির পাওয়ার টা কমিয়ে দিন। আসলে আমার বোনের শীত লাগছে।

হেনা এসির রিমোট নিয়ে এসির পাওয়ার কমিয়ে দেয়।

শান আর এনা দাঁড়িয়ে আছে ছাঁদে। শানের দৃষ্টি পূর্ণাঙ্গ এনার পানে। ফাইনালি তার ভীনদেশী তারা এবার নিজের একান্ত তারা।

” কি দেখছেন এভাবে?

” আমার ব্যাক্তিগত তারা টার ভিন্ন ভিন্ন রূপ দেখছি আর ভাবছি তাকে এতো স্নিগ্ধ কেনো লাগছে!

এনা লজ্জা পাওয়ার ভান করে এক হাত দিয়ে চুল গুলো কানের গুঁজে দিতে দিতে বলে,,

” ইশ ওভাবে বলবেন না আমি লজ্জায় ম”রে যাচ্ছি।

কথাটা শানের কর্ণকুহর হতেই শব্দ করে হেসে উঠে শান।

” আরেকটু করি প্রশংসা।

এনা হেসে জবাব দেয়,,

” করুন।

“তোমার ঐ ঠোঁটের হাসি যত বার দেখি ঠিক ততো বারই প্রেমে পড়ে যাই।
তুমি এতো সুন্দর যে তোমার রূপের প্রশংসা করে শেষ করে যাবে না, তাই তোমাকে যতই দেখি ততই মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকি। ভালোবাসি ভীনদেশী তারা তোমায়।

#চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে