#আমার_পূর্ণতা
#রেদশী_ইসলাম
পর্বঃ ৯
” তোমাদের এখন মানে এই রাতের বেলা কেনো বসিয়ে রেখেছি ভাবছো নিশ্চয়ই?”
ইশতিয়াক চৌধুরীর কথায় সবাই একে অপরের দিকে তাকালো। শুধু নির্বাক রইলো মিসেস ফারাহ ও তাফসির। মিসেস ফারাহ ইশতিয়াকের পাশে বসে বসে মুচকি হাসছে সবার মুখভঙ্গি দেখে। আর তাফসির সোফায় হেলান দিয়ে তাকিয়ে আছে ইশতিয়াক চৌধুরীর দিকে। হয়তো মনে মনে বোঝার চেষ্টা করছে যে ইশতিয়াক চৌধুরী কি বলতে পারেন। কিন্তু মুখে কোনো চিহ্ন মাত্র নেই। একদম স্বাভাবিক ভঙ্গি তার।
সকলের মুখ একবার পর্যবেক্ষণ করে ইশতিয়াক চৌধুরী পুনরায় বলতে শুরু করলেন—
” সুফিয়াকে তো তোমরা চেনো সবাই। আমাদের ছোট চাচা কামরুলের মেয়ে। আর এটাও জানো যে সে আমেরিকায় থাকে। কিন্তু সে বাংলাদেশে ফিরে এসেছে মাস খানিক আগে। তোমাদের কারো সাথে যোগাযোগ না থাকলেও আমার সাথে যোগাযোগ ছিলো তার। তাকে তো কখনো চাচাতো বোনের মতো দেখি নি। আপন বোনের মতোই দেখেছি আর সেও আমাদের তিন ভাইকে নিজের আপন ভাইয়ের মতো ভালোবাসে যেহেতু তার আর কোনো ভাই নেই।”
ইশতিয়াক চৌধুরী কথা গুলো বলে একটু থামলেন। তার কথা শুনে ইকরাম বলে উঠলো—
” হ্যাঁ ভাইজান সবই জানি। কিন্তু তাতে কি হয়েছে?”
” আমরা কাল অর্থাৎ শুক্রবার তার বাড়িতে যাবো বেড়াতে”
” হঠাৎ সুফিয়া আপার বাসায় কেনো যাবো ভাইজান?”
” সে যেহেতু অনেক বছর সবাইকে দেখে না আর সামি-সাদনান আর প্রাচুর্যকেও কখনো দেখে নি তাই সবাইকে দেখতে চাইছে। আর রাদিয়া বিয়ে করেছে শুনেছে তাই আবিরকে ও দেখতে চাচ্ছে। ”
” তাহলে ওনাকেই আসতে বলুন। তাহলেই তো হয়ে যাচ্ছে”
ইকরামের কথায় খানিক বিরক্ত বোধ করলেন ইশতিয়াক। মনে মনে ভাবলেন ছেলেটা বড্ড কথা বলে। তাই বিরক্তি চোখে ইকরামের দিকে তাকিয়ে বললেন—
” আমার কথা শেষ করতে দাও ইকরাম। তারপর নাহয় প্রশ্ন করো?”
” দুঃখীত ভাইজান। বলুন আপনি।”
ইকরামের দিক থেকে চোখ সরিয়ে চশমাটা উপরে ঠেলে ভালো করে পরে নিলেন ইশতিয়াক। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন—
” সুফিয়াকে বলেছিলাম আসতে। কিন্তু দু বছর আগে একটা এক্সিডেন্টে তার দু’পা অকেজো হয়ে যায়। এখন হুইলচেয়ার ছাড়া চলতে পারে না সে। আবার তার কিছুদিন পরেই তার স্বামী হাসান জমাদ্দার মারা গেছেন ব্রেইন স্ট্রোকে। তাই শোক সামলাতে না পেরে সেই থেকে ভিষণ অসুস্থ সে।”
” তাহলে এখন কার কাছে থাকছে ভাইজান? দেখাশোনা করছে কে?”___কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন শাহানা।
” বাড়িতে দেখাশোনার জন্য মানুষ রাখা আছে। আর ছেলে বিয়ে করেছে তার বউ আছে। তারাই দেখাশোনা করছে। আচ্ছা সেসব বাদ। এবার আসল কথায় আসা যাক।
আমি চাইছি কাল সকলে সুফিয়ার বাড়িতে যাবো। তাই যা যা দরকার বিকালের মধ্যেই শেষ করে ফেলবে। রাতে রউনা হবো আমরা।”
” কিন্তু ভাইজান অফিসের এতো কাজ কে সামলাবে? ”
” ম্যানেজার কে বলে রাখো। সে সব দায়িত্ব সামলাবে। এখন ঘরে যাও সবাই।”
ইশতিয়াক চৌধুরীর কথায় সবাই ভিষণ খুশি হলো। রিয়া,প্রাচুর্য তো ভেবেছিলো যাওয়া হবে না। কারন খাবার টেবিলে ইশতিয়াক একবারো যাওয়ার কথা তোলে নি। কিন্তু সবাইকে ডেকি নিয়ে যে এভাবে বলবে তা বুঝতে পারে নি তারা। রিয়া তো পারছে না খুশিতে লুঙ্গি ড্যান্স দিতে। এতোদিন পরে যেহেতু কোথাও ঘুরতে যেতে পারবে ফাইনালি।
——————
প্রাচুর্য ঘরে এসে বিছানা ঝেরে লাইট অফ করে শুয়ে পরলো। ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনে অন্য সময় যে মেয়ে সব থেকে বেশি খুশি হয় অতি আশ্চর্যের বিষয় আজ তার মধ্যে কোনো ভাবাবেগ নেই। কিছুই ভালো লাগছে না তার। এইযে তখন বসে বসে রিয়া কতো প্লানিং করলো যে চট্টগ্রামের কোথায় কোথায় ঘুরবে বা কি কি খাবে কিন্তু এতে তার কোনো মনই ছিলো না। তাই শেষে বিরক্ত হয়ে রিয়া চুপ করেই ছিলো।
বেশ কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে উঠে বসলো প্রাচুর্য। একবার দেয়ালে টাঙানো ঘড়ির দিকে তাকালো। নাহ ড্রিম লাইটের আলোয় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না সময় টা। তাই প্রাচুর্য মোবাইল হাতে নিলো। পাশের পাওয়ার বাটন অন করে সময় দেখে নিলো। ঘড়িতে এখন ২ টা বেজে ১৫ মিনিট। এতোক্ষণ হয়ে যাওয়ার পর ও ঘুম আসলো না ভেবে বিরক্ত হলো সে। বিছানা থেকে নেমে দাড়ালো বেলকনিতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ড্রিম লাইটের আলোয় ধীর পায়ে গিয়ে দাড়ালো বেলকনিতে। বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার। রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্টে আলো জ্বলছে। দুর থেকে ভেষে আসছে কুকুরের সুর তোলা ডাক। নিস্তব্ধ পরিবেশে কুকুরের ডাক গুলো ভয়ঙ্কর লাগছে বটে। কোথায় জানি শুনেছিলো প্রাচুর্য যে রাত বেরাতে কুকুরেরা নাকি জ্বিন বা ভুত দেখলে চিল্লায়। তবে এখন কি তারা জ্বিন বা ভুত দেখেছে?
” এই এতো রাতে এখানে তুই কি করছিস?”
হঠাৎ পাশ থেকে কারো গলার আওয়াজে চমকে উঠলো প্রাচুর্য। বুকে থুথু ছিটিয়ে পাশে ফিরে তাকালে। তাফসির দাঁড়িয়ে আছে তার বেলকনিতে। যা দেখে মেজাজ খারাপ হলো প্রাচুর্যের। গলার স্বর খানিক উঁচু করে বললো—
” উফফ তাফসির ভাই। পাশ থেকে এভাবে আচমকা কেউ কথা বলে? ভয় পেয়েছি তো।
প্রাচুর্যের কথায় তাফসির ভ্রু কুঁচকে বললে—
” তুই ভয় পেয়েছিস? ভয় তো আমার পাওয়ার কথা তো সেখানে তুই ভয় পেলি কেনো?”
” আপনার ভয় পাওয়ার কথা মানে? আপনি কেনো ভয় পাবেন?”
” বাহ রে ভয় পাবো না?রাত বেরাতে এমন কালো টিশার্ট, কালো প্লাজু পরে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে তো যে কারোর ই ভয় পাওয়ার কথা। নির্ঘাত আমি সাহসী ছেলে নাহলে হার্ট অ্যাটাক ফ্যাটাক করে মরেই যেতাম।”
” একদম ফালতু কথা বলবেন না তাফসির ভাই। ”
” বিশ্বাস কর একটু ও ফালতু কথা বলছি না। আমি তো প্রথমে ভেবেছিলাম কোনো পেঁচি হয়তো দাঁড়িয়ে আছে। আচ্ছা সেসব কথা বাদ এখন বল এতো রাতে তোর বেলকনিতে কি কাজ?”
” ঘুম আসছিলো না তাই এসেছি।”
আমার কথা শুনে তাফসির ভাই মুখ গম্ভীর করে ফেললেন। তারপর আদেশের সুরে বললেন—
” ঘরে যা প্রাচুর্য। রাত বেরাতে তোকে যেনো আর কখনো বেলকনিতে আসতে না দেখি।”
” আর কিছুক্ষণ থাকি না তাফসির ভাই? একটুও ঘুম আসছে না।”
” মেজাজ খারাপ করিস না প্রাচুর্য। ৩ সেকেন্ডের মধ্যে যদি আমি এই জায়গা খালি না দেখি তবে তোর একদিন কি আর আমার একদিন।”
তাফসির ভাইয়ের কথায় আর সেখানে দাড়ালাম না এক মুহুর্ত ও। ঘরে এসে বিছানায় কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করতে করতে ঘুমিয়ে পরলাম এক সময়।
.
.
.
.
আজ শুক্রবার। জুম্মার দিন। সকাল হতে না হতেই ব্যাগপত্র গোছানো শুরু করলাম সবাই। বাইরে ঝলমলে রোদ উঠেছে। বাবারা সবাই লনে বসে চা খাচ্ছেন। মা, বড় মা ও মেজো মা ব্যাগপত্র গুছিয়ে চলে গেলো রান্নাঘরে। তাফসির ভাই বাড়িতে নেই। সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা করেই বেরিয়ে পরেছেন বন্ধুদের সাথে দেখা করতে।
আমি আর রিয়া আপু বসে আছি ড্রয়িংরুমে। আপাতত আর কোনো কাজ নেই। ব্যাগপত্র গোছানো কমপ্লিট। তাই দুজনে বসে গল্প করছি। আমাদের গল্প করতে করতে কখন ১২ টা বেজে গেলো খেয়াল নেই। এর মধ্যে আজান দিতেই বাবা রা ঘরে প্রবেশ করলেন। সাথে পেছনে ফোন টিপটে টিপটে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলেন তাফসির ভাই। সে কোনো দিকে না তাকিয়ে চলে গেলেন নিজের ঘরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই পান্জাবি পরে চলে গেলেন নামাজ পরতে। সাথে সামি-সাদনান আর আবির ভাইয়া ও গেছেন। রাদিয়া আপুদের সেদিন চলে যাওয়ার কথা থাকলো আমার অবস্থা শুনে গেলেন না আর। একবারে চট্টগ্রাম থেকে ফিরে তারপরেই চলে যাবেন। এর মধ্যেই রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন মেজো মা। আমাদের বসে থাকতে দেখে বললেন—
” তোরা এখনো বসে আসিস? তাড়াতাড়ি যা গোসল করে আয়। তোরা গোসল করতে ঢুকলে তো আবার তিন ঘন্টা লাগে।”
” মোটেও না মেজো মা। মাত্র ১ ঘন্টা ২০ মিনিট লাগে।”
” বাহ সেটা আবার বড় মুখ করে বলছিস? বলি ১ ঘন্টা ২০ মিনিটকে কি তোর মাত্র মনে হলো? গোসল করতে যেয়ে ঘুমিয়ে পরিস না কি?”
” আরে কিসব বলছো মা? গোসল করতে যেয়ে কেউ ঘুমিয়ে পরে নাকি?”
” তাহলে এতোক্ষণ লাগে কেনো তোদের তাই বল।”
” জানি না তো। কিভাবে কিভাবে যেনো সময় চলে যায়।”
” আচ্ছা এবার যা নাহলে দেরি হয়ে যাবে। তোর বাবা রা আসলেই খেতে দিবো। আবার সন্ধ্যার মধ্যেই উবার চলে আসবে তিনটা। ”
” উবার কেনো আসবে মা? বাড়ির গাড়িতে কি হলো?”
” তোর বড় বাবা উবার বুক করেছে। নাহলে অতো দুর ড্রাইভ করতে কষ্ট হবে। কম দুরের পথ তো আর না।”
—————
সন্ধ্যা হতে না হতেই পরপর তিনটা উবার এসে হাজির হলো বাড়ির সামনে। আমরা সকলে উঠে বসলাম তাতে। একটা তে আমি, রিয়া আপু, তাফসির ভাই, আবির ভাইয়া ও রাদিয়া আপু। বাকিরা অন্য গাড়িতে। সামি-সাদনানের বমি জনিত সমস্যা থাকার কারনে ওরা মেজো মায়ের কাছে বসেছে। সবাই উঠে পরতেই গাড়ি চলতে শুরু করলো চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। আমি চোখ ফিরিয়ে বাইরের দিকে তাকালাম। আশেপাশের কৃত্রিম আলো পেরিয়ে তাকালাম আকাশের দিকে। নিকষ কালো অন্ধকারে এক ফালি চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। চাঁদ দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়ে পরলাম খেয়াল নেই। আমি আবার গাড়িতে উঠলে জেগে থাকতে পারি না। যখন ঘুম ভাঙলো তখন তাফসির ভাইয়ের কাঁধে আমার মাথা।
চলবে?