#আমার_পূর্ণতা
#রেদশী_ইসলাম
পর্বঃ ৮
ভাদ্রের বিকেল। আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ না ভাসলেও একখণ্ড কালো মেঘ ঠিকই ভাসে। আর সেই মেঘের দরুন শুরু হয় যখন তখন বর্ষা। আবার কখনো বা বয়ে যায় মিষ্টি বাতাস। কিন্তু এখন মিষ্টি বাতাস নয়। হচ্ছে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি।
তিশা,সাইমা,আদিতরা চলে গেছে সকাল দশ বা এগারোটার দিকে। যাওয়ার আগে অবশ্য প্রাচুর্যের সাথে দেখা করে গেছে। কিন্তু ভেতরের এতো খবর তারা কিছুই জানে না। জানতে দেই নি তাফসির। সেদিন চৌধুরী বাড়ির সবাই উপস্থিত থাকলেও ছোটরা ছিলো না সেখানে। তাফসির বুদ্ধি করে শুধু বড়দের ই ডেকেছিলো। আর এ বাড়ির সদস্যদের তেমন স্বভাব নেই যে চিল্লাপাল্লা করে বাড়ি মাথায় করবে বা আশেপাশের বাড়ির লোক জড়ো করবে। সেদিন যা হয়েছিলো তা প্রাচুর্যের রুমের ভেতরই সীমাবদ্ধ ছিলো। বাড়ির দুই মেয়ে অর্থাৎ রাদিয়া, রিয়া জানলেও জানে না সামি – সাদনান। কারন তাদের রুম নিচের তলায় অবস্থিত। আর সেই সাথে সাইমা, তিশা এবং আদিত কে নিচের দু’টি রুম দেওয়া হয়েছিলো তাই উপরের খবর তারা টের পাই নি। বাড়ির খবর বাইরে যাওয়া পছন্দ করেন না কেউই। তাই তারা জানে প্রাচুর্যের সাধারণ জ্বর এসেছে মাত্র।
ইশতিয়াক, ইকরাম এবং ইনসাফ ড্রয়িংরুমে বসে চা পান করছেন। এবং বিভিন্ন বিষয়ে গল্প করছেন। ইশতিয়াক চায়ের কাপে শেষ চুমুক টুকু দিয়ে কাপটা টি-টেবিলের উপর রেখে সরাসরি ইনসাফের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন—
” তা শুনলাম তোমাদের ছেলে নাকি মারপিট করেছে সেই ছেলের সাথে।”
” হ্যাঁ ভাইজান। ও যা করেছে আমার মেয়ের সাথে।”
” তা মারপিট করার কি দরকার ছিলো? সোজা জেলে ঢুকিয়ে দিলেই তো হতো।”
” জেলে ঢুকালে দু’দিন পর এমনিতেই ছাড়া পেয়ে যেতো। কিন্তু তাফসির যা মেরেছে আজীবন মনে রাখবে তা। আর কখনো কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারবে না। ”
” বাহ ছেলের উপর অনেক ভরসা দেখছি।”
” তাতো একটু থাকবেই ভাইজান। সবার আদরের বলে কথা। আর ভরসা করার মতোই ছেলে ও। তাছাড়াও এতোদিন যাবত কাছেও তো ছিলো না। ”
” বেশি লাই দিয়ো আবার। মাথায় উঠে বসবে। ”
” আমাদের তাফসির ওমন ছেলেই না ”
” প্রাচুর্যের কি খবর? কেমন আছে এখন? ”
” এখন তো জ্বর নেই আর তবে শুয়ে আছে ঘরে। ঘুমাচ্ছে হয়তো। ”
” আচ্ছা তা ভালো। ঘুমাক। ”
———————
রাত তখন ১০ টা। শুয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে উঠে বসলো প্রাচুর্য। মন খারাপ পিছু ছাড়ছেই না। একদম যেনো আঠার মতো চিপকে আছে। তবে কালকে থেকে আজকে যেহেতু শরীর টা সুস্থ আছে তাই ফোন টা হাতে নিলো সে। দেখি যদি অনলাইনে ঢু মেরে মনটা ভালো করা যায় তাই আর কি। এখন নিজের কাছেই নিজের কেমন লজ্জা আর আফসোস লাগছে তার। ইশশ আগে যদি সব বলে দিতো তাহলে আজ এমন লজ্জাজনক পরিস্থিতি ঘটতো না।
না জানি বাড়িতে সবাই তাকে নিয়ে কি ভাবছে এটা ভেবে ভেবে অস্থির সে। কিন্তু তার ও বা কি করার। সে তো বুঝতে পারে নি পরিস্থিতি এমন হবে। যদি বুঝতো তাহলে তো সেই কবেই বলে দিতো। কিন্তু এখন তো আর কিছু করার ও নেই।
এমন সময় ঘরে উঁকি মারলো রিয়া। প্রাচুর্যকে বসে থাকতে দেখে ভেতরে আসলো। প্রাচুর্যের পাশে বসে বললো—
” প্রাচুর্য? এই প্রাচুর্য শোন না। ইম্পরট্যান্ট নিউজ আছে। ”
রিয়া আপুর কথায় ভ্রু কুঁচকে উঠলো আমার। নিস্পৃহ কন্ঠে বললাম—
” কি নিউজ আপু?”
আমার কথায় আপু উৎফুল্ল হয়ে বললেন—
” এখনি ব্যাগ গুছিয়ে ফেল বুঝলি।”
” ব্যাগ গুছাবো মানে? কি হয়েছে?”
” মানে আমরা ঘুরতে যাচ্ছি। ”
” ঘুরতে যাচ্ছি? কিন্তু কোথায়?”
” চট্টগ্রাম যাচ্ছি রে চট্টগ্রাম। ”
” হঠাৎ চট্টগ্রাম? আর চট্টগ্রাম কার বাসা আপু? ”
” সুফিয়া ফুপ্পি কে চিনিস? ”
” না চিনি না। সুফিয়া ফুপ্পি আবার কে?”
” সুফিয়া ফুপ্পি বাবার আপন চাচাতো বোন। অনেক বছর আগে আমেরিকায় চলে গেছিলো। এখন আবার বাংলাদেশে শিফট হয়েছে। চট্টগ্রাম ওনার শশুর বাড়ি। বিশাল বড় ফ্ল্যাট কিনেছে নাকি। বিদেশ থাকে বলে চিনিস না। আমি মায়ের কাছে শুনেছি ওনাদের কথা তাই চিনি। এখন সবাইকে দাওয়াত দিয়েছে। ”
” তুমি এতো নিউজ কোথা থেকে জানলে?”
” আমি বড়মার কাছে যাচ্ছিলাম। তখন শুনি বড় বাবা কথা বলছে ফুপ্পির সাথে। সব শুনে আর এক মিনিট ও দাঁড়াই নি। ছুটে চলে আসলাম তোর ঘরে। এখন তো আর আপু নেই তাই তুই আমার সব।”
” তুমি শিওর তো আপু যে আমরা সবাই যাচ্ছি? চট্টগ্রাম তো অনেক দুর।”
” একদম শিওর। বড় বাবা একটু পর খাবার টেবিলে বলবে দেখিস। আর যদি না বলে তাহলে আর কি? যাওয়া হবে না।”
” আমার মনে হয় যাওয়া হবে না আপু। কারন বড় বাবা এতো সহজে রাজি হবে না। উনি তো ঘোরাঘুরি পছন্দ করেন না।”
” আরে আগে তো দেখি কি হয়। ”
——————
বুড়িগঙ্গার পাশে অবস্থিত একটি রেস্টুরেন্টের রুফটপে দাড়িয়ে আছে তাফসির। দৃষ্টি তার নদীতে চলাচল করা লঞ্চ গুলোর দিকে। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। যা এমুহূর্তে শেষ প্রায়। হঠাৎ কাঁধে কারোর স্পর্শে পাশ ফিরে তাকালো তাফসির। পাশে দাঁড়িয়ে আছে শাহিন। তাফসিরের প্রান প্রিয় বন্ধু। সুখে দুঃখে কখনোই তারা একে অপরের থেকে আলাদা হয় নি কখনো। শাহিনের সাথে তার পরিচয় কানাডা থাকা কালিন। একই ভার্সিটিতে পড়ালেখা করতো তারা। পরে জানতে পারলো দুজনের বাড়িই ঢাকা তে অবস্থিত। তবে শাহিনের বাড়ি সায়দাবাদ আর তাফসির উত্তরা। সেই থেকেই বেস্ট ফ্রেন্ড দু’জনে। এখন দু-জনে একই অফিসে চাকরি করে। শাহীন বাংলাদেশে এসেছে কাল সকালে। আর তাফসিরের সাথে দেখা করলো আজ। যদিও শুধু তারা দু’জন নয় এখানে। আরও চেনা পরিচিত অনেক বন্ধু-বান্ধব ই উপস্থিত আছে। প্রত্যেকের হাতেই জ্বলন্ত সিগারেট। আড্ডায় মশগুল তারা। সেদিকে একপলক তাকিয়ে তাফসিরের দিকে তাকালো শাহিন। মুখে হাসি টেনে বললো—
” কি ভাবছিস ভাই? ”
” ভাবছি তো অনেক কিছু।”
” এতো ভেবে কি লাভ বল? যা হবে দেখা যাবে। এতো চিন্তা করিস না। ”
” চিন্তা করছি না। শুধু ভাবছি কানাডা থেকে চলে আসবো কি না। এতোদিন থাকতে পারলেও এখন তো একমুহূর্ত ও থাকা সম্ভব না। ছুটি ও শেষ হতে চললো প্রায় ”
” আমার কথা শোন। আমার ও মনে হয় তোর ফিরে আসা উচিৎ। আমিও তো আর বেশিদিন থাকবো না ওখানে। চলে আসবো দেশে। তুই একা একা থেকে কি করবি? আর সব থেকে বড় কথা ওখানে তোর মন টিকবে তো? ”
শাহিনের কথায় উত্তর দিলো না তাফসির। আসলেই তো। তার মন টিকবে তো সেখানে? প্রান ভোমরা টা যে এদেশে।
——————
ইশতিয়াক চৌধুরীর জরুরি তলবে ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হলেন সবাই। খাবারের পাট চুকে গেছে অনেকক্ষণ আগেই। এখন ঘড়িতে রাত ১১ টা বেজে ৫৫ মিনিট। তাফসির ও উপস্থিত আছে সেখানে। বাড়িতে ঢুকেই এখনো পর্যন্ত ঘরে যেতে পারলো না। ঘরে ঢুকার আগ মুহুর্তেই ইশতিয়াক থমথমে গলায় ডাক দিয়েছিলেন তাকে। যদিও তাকে ডাক দেওয়ার কারন খুঁজে পাচ্ছিলো না তাফসির। কারন এতো বছর দুজনে একটা কথা ও বলে নি তাহলে আজ হঠাৎ কি হলো? তবুও কিছু না বলে ডাক শুনলো সে। হাজার হলেও বাবা তো। ডাক অগ্রাহ্য করতে পারে নি। তাই শান্ত কিন্তু শক্ত কন্ঠে বলেছিলো—
” জ্বি বলুন। কি বলবেন?”
” ড্রয়িং রুমে এসো কথা আছে সবার সাথে।”___বলে সেখান থেকে চলে গেলেন ইশতিয়াক চৌধুরী।
ইশতিয়াক চৌধুরীর কথায় কপাল কুচকে উঠলো তাফসিরের। একবার হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। এতো রাতে আবার কি কথা থাকতে পারে তাই ভাবছিলো সে। কিন্তু বাবা যখন ডেকেছে তখন যেতে তো হবেই তাই নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো সে।
চলবে