আমার চুপকথা – লেখা সুমাইয়া আক্তার মনি

0
1022

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট_২০২০
আমার চুপকথা
লেখা সুমাইয়া আক্তার মনি

মা মারা যাওয়ার দেড় মাস যেতে না যেতেই বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। আমার বয়স ছিল তখন ছয় মাসের মতো। তখন না পেয়েছি মায়ের ভালবাসা, না পেয়েছি বাবার। দাদী, ফুফু, চাচাদের কাছেই বড় হওয়া আমার।

সেই ছয়মাস থেকেই বাবার অবহেলায় বড় হয়েছি। বাবা যখন বাড়িতে আসতেন সৎ মা সারাক্ষণ বিচার নিয়ে বসে থাকতেন। কিছুক্ষণ দাদীর বিচার, কিছুক্ষণ ফুফুর, বাকিসময় আমার বিচার। বাবা অন্যকাউকে কিছু না বললেও আমাকে ভয়ংকরভাবে মারা শুরু করেন। পিঠে বাঁশের কঞ্চির দাগগুলো স্পষ্ট দেখা যেত। শব্দ করে কাঁদলেও হাত-পা একসাথে করে উঠোনে ছুড়ে মারতো। ছয় বছরের একটা ছেলেকে এভাবে ছুড়ে মারলেন নিজের বাবা। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলেও ফিরে তাকাননি তিনি। সেদিন গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পরায় উঠোনের অবস্থাও নাজেহাল ছিল। উঠোনে রাখা ইটের কোণায় লেগে মাথা ফেটে যায়। সেদিন ফুফু ছুটে আসছিল আমার কাছে কিন্তু ফুফুকেও অনেক কথা শুনতে হয়। সে কেঁদে দিয়েছিলো সেদিন। মা না থাকলেও ফুফুর ভালোবাসায় কোনো কমতি ছিল না। প্রতিদিন গোসল করানো, স্কুলে যাওয়ার সময়ে সবকিছু গুছিয়ে দেওয়া ফুফুর নিত্যদিনের কাজ ছিল।
বয়স ধীরেধীরে বাড়ছে। সবকিছু বুঝতে শিখেছি সাথে ফুফুকে হারানোর ভয়ও শিখেছি। মেয়ে হলে যে স্বামীর বাড়িতে যেতে হবে এই কথাটিও মাথায় এসেছে। এমনকি কিছুদিন যাবৎ ফুফুর জন্য একেরপর এক সম্বন্ধ আসছে । প্রতিবার দরজার আড়াল থেকে কেঁদে দিতাম। ফুফু চলে যাবে খুব শীঘ্রই, এই ভেবে।

অবশেষে আসলো সেই দিন। আজ শুক্রবার ফুফুর বিয়ে। মোল্লা বাড়ির মসজিদে কাকার হাত ধরে যাচ্ছি। সেখানেই বিয়ে হবে। সবার মনে হাসি-আনন্দের ছড়াছড়ি বয়ে যাচ্ছে; আর আমার মনে ফুফুকে হারানোর ভয় ঘিরে রয়েছে। অবশেষে বিয়েটা হয়েই গেল।

এক মাস পরে ফুফুকে শ্বশুর বাড়ি নিয়ে গেল। সাথে সাথেই আমার কষ্টের দিন শুরু হল। এর আগে যে সুখ করেছি তেমন নয়; কিন্তু ফুফু ছায়ার মতো পাশে ছিল। বৃদ্ধ দাদী একা আর কতকিছু সামলাবে। আমার সৎ মা তো ঘরের কোনো কাজেই হাত লাগায়না। তাঁর এককথা ছিল স্বামীর টাকায় সংসার চলে; তাই ঘরের কাজকর্ম সে করবে কেন! বাবাও কিছু বলতেন না।

শ্বশুর বাড়ি থেকেও ফুফু প্রতি শুক্রবার আমাদের বাড়িতে আসতেন। শুধুমাত্র আমার জন্যই তাঁর এমন ছুটে আসা । এরজন্য শ্বশুর বাড়ি থেকেও তাঁর কথা শুনতে হয়; কিন্তু ফুফু সবকিছু শুনেও আমার কাছে ছুটে আসতেন। প্রতি শুক্রবার সে নিজ হাতে আমায় গোসল করিয়ে মসজিদে পাঠিয়েছেন। আমিও প্রতি শুক্রবার তাঁর অপেক্ষায় থাকতাম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতাম কখন ফুফু আসবে।
একসময়ে ফুফুর আসা-যাওয়া সীমিত হয়ে যায়। এভাবে হুটহাট করে আসতে দিতোনা তাহলে সংসারে অশান্তি লেগে যেত। তাই ফুফুও আসার মাত্রা কমিয়ে দেন।

যখন ক্লাস নাইনে পড়ি, তখন আমার সৎ মায়ের কথায় বাবা কাজে দিতে চাইছিলেন। সেদিন পায়ে ধরে বলেছিলাম, একটু পড়তে চাই। বড় চাকরি করতে চাই। কিন্তু আমার বাবা কোনো কথা শুনেননি। সেদিন কাকার জন্য বেঁচে গেলাম। সে বাবার থেকে ছোট হলেও সেদিন মুখের উপরে জবাব দিয়েছিলেন। দরকার হলে তাঁর রক্ত বেঁচে আমাকে পড়াবে। জবাবে কাকাকে কথা শুনালেও কাকা আমায় আগলে রাখেন। সেদিন মায়ের কবরের কাছে যেয়ে কান্না করি খুব। আমায় অসহায় করে সে শান্তিতে ঘুমোচ্ছে। যে শান্তির ঘুম থেকে কখনো উঠবেনা।

যখন নতুন কাকী আসেন আস্তে আস্তে আমার ভরণপোষণের দায়িত্ব থেকে কাকাও দূরে সরে যান। কাকী ঢাকাতে কাকার কাছে থাকেন, এখন টাকাপয়সার ঘাটতিও দেখা দিচ্ছে। এখন লেখাপড়া মাঝপথে বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণ স্পষ্ট । তবুও মাঝপথে হাল ছাড়িনি আমি। বাড়ির আশেপাশে কোনো টিউশনি না পেলেও স্কুলের পাশে ঠিকই পাই। স্কুলের সম্পূর্ণ ক্লাস করে দুপুরে না খেয়ে পড়াতে যাই। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতে হয়। শত কষ্টের মাঝেও একটাই লক্ষ্য। নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াতে হবে। মেয়ে হলে হয়তো এতদিনে বিয়ে দিয়ে দিতো। কিন্তু আমি একজন ছেলে; নিজের পরিচয় নিজেরই গড়তে হবে। এসব চিন্তাভাবনা করেই এত কষ্ট সহ্য করা আমার। মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে উচ্চমাধ্যমিকে পদার্পণ করি। কোনোরকম টিউশন ছাড়াই পড়াগুলোকে নিজের মতো করে গুছিয়ে নিতে হয়। বিকেল থেকে রাত আট’টা অবধি টিউশনি করাই। তারপরে রাত জেগে পড়তে হয়। এভাবেই দিনগুলো চলে যাচ্ছে আমার। নিজেকে সম্পূর্ণভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা এখন থেকেই শুরু করে দেই। মনে মনে একটা প্রার্থনা’ই করি আমার সন্তানদের একজন ভাল বাবা হয়ে থাকবো।

দেখতে দেখতে পরীক্ষা নিকটে চলে এসেছে। টেস্ট পরীক্ষায় ডিপার্টমেন্টের প্রথম হয়েছি। ফরম পূরণ এর জন্য কারো টাকার’ই প্রয়োজন হয়নি। ইন্টারের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত নিজের টাকাতেই নিজে চলতে পেরেছি। তাহলে এখন আর ক’টা টাকাই বা লাগবে। পরীক্ষার সাতদিন আগে সবার কাছে দোয়া চাইতে যাই। সেদিন দাদী, ফুফু, কাকা সবাই প্রাণভরে দোয়া করে আমায়। বাবা ঘরের এক কোণে বসে ছিল। আমি সামনে যাওয়া মাত্রই সে পকেট থেকে হাজার টাকার নোট বের করে ; এই প্রথম আমার হাতে ধরিয়ে দেন। এই প্রথম বারের মতো সে আমায় ভালোবেসে মন থেকে বলেন, ভালোভাবে পরীক্ষা দিয়ো আব্বু। আশেপাশেও নজর রেখো, কেউ যেন নকল দিয়ে তোমার দোষ না দেয়। দোয়া করি, আমার ছেলে যেন একজন সম্মানিত মানুষ হয়। তাঁর বাবার মতোন যেন পাপিষ্ঠ না হয়। সেদিন বাবার চোখের কোণে পানির বিন্দু বিন্দু জল স্পষ্ট দেখা যায়। এতদিনের অভিমান জমিয়ে রেখে আমি ভাল-মন্দ কিছু বলিনি। মনে মনে ঠিকই কান্না করেছি, যে কান্না কারো অনুভব করারও সাধ্যি নেই।
এমনিতেই ছেলেরা তো কান্না করেনা। তাহলে আমি কেন করবো! আমিও করিনি কান্না।

এইচএসসি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় প্রথম দিকে থাকি। রেজাল্টের পরে বাবা বাড়িতে মিষ্টির বন্যা বসিয়ে দেন। আর সবার কাছে বলেন, তাঁর ছেলে ডাক্তার হবে। সব অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে তুলবে।
আমিও বাবার কথা রাখি। সবাইকে সুস্থ করার দায়িত্ব ঠিকই নেই। তবে, নিজের বাবাকে সুস্থ করতে পারিনি। যখন মেডিকেলে প্রথম বর্ষে ছিলাম। তখন বাবা মারা যায়। তাঁর চিকিৎসা করতে পারিনি আমি। তবে এখন হাজার হাজার রোগীর ভিড়ে আমার বাবাকে খুঁজে বেড়াই।
আমার চুপকথা গুলোকে আমার মধ্যেই লুকিয়ে রেখে ছেলেমেয়েকে আষাঢ়ে গল্প শোনাই। যে গল্পে শুধুই বাবা-সন্তানের মধ্যে বন্ধুত্বের ছোঁয়া থাকে।

#সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে