#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(8)
জীবনের প্রথম কোনো পুরুষের ছোঁয়া নিজের মাঝে পেয়ে চমকে ওঠে অরুনিকা। শরীরের সাথে মনেও খেলে যায় অদ্ভুত এক শিহরণ। হাতটা শুধুই কোমরে গাঢ় করে ছুঁয়েই খান্ত হয়নি, দুই হাতে আগলে ধরেছে কোমর। অরুনিকা পিছন ঘুড়ে শক্ত কন্ঠে কিছু বলার জন্য প্রস্তুতি নিতেই ঘাড়ে গরম নিঃশ্বাসের সাথে ঠোঁটের ছোঁয়া অনুভব করে থমকে যায়। নড়ার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলে সে। সারা শরীর হিমশীতল হয়ে বরফে পরিণত হয়েছে।
“দেখুন!”
“দেখার জন্য তো সারারাত পড়ে আছে প্রাণপাখি। আজ আমাদের বাসর, মনে আছে তো?”
আদাভানের ঠাট্টা করে বলা কথা শুনে গা জ্ব*লে ওঠে অরুনিকার। একটা মানুষ এতটা নিঃলজ্জ কিভাবে হতে পারে ভেবে পায়না সে। এত বড়ো অপরাধ করেও কিভাবে আদাভান এতটা স্বাভাবিক থাকতে পারে তার মাথাতেই আসছেনা। বেশ মোচড়ামুচড়ি করে নিজেকে আদাভানের থেকে ছাড়িয়ে নেয় অরুনিকা। এই মুহূর্তে কোনোভাবেই এই লোকটার সামনে থাকতে চাচ্ছেনা সে। রাগটা মাথায় চেপে বসে আছে তার, উল্টোপাল্টা কিছু করে না বসে বিধায় সেখান থেকে চলে আসে।
সবাইকে একসাথে ড্রয়িং রূমে বসে কিছু আলোচনা করতে দেখে বেশ ইতস্তত বোধ করে অরুনিকা। লজ্জা আর ইতস্তত বোধে ড্রয়িং রুম থেকে চলে আসতে নিলে আদাভানের মায়ের ডাকে ধীর পায়ে ওনার কাছে যান। উনিও অরুনিকাকে তার পাশে বসতে ইশারা করেন। এমন অচেনা জায়গায় অচেনা পরিস্থিতিতে নিজেকে জোকার ছাড়া আর কিছুই মনে হয়না অরুনিকার। আনিকা আহসানের পাশে বসে আলতো করে সামনের দিকে তাকাতেই চমকে ওঠে অরুনিকা। এটা তো সেই মেয়েটা, স্যারের গার্লফ্রেন্ড! উনি এখানেকি করছেন? আচ্ছা স্যার আমাকে বিয়ে করেছেন এটা শুনে এসেছেন কি উনি? কিন্তু ওনার তো এখন রেগে থাকার কথা, কই রেগে তো নেই! বরং বেশ হেঁসে হেঁসে কথা বলছে সবার সাথে। দেখে মনে হচ্ছে সবার মত উনিও ভীষণ খুশি এই বিয়েতে।
“অরুনিকা মা! আমার ছেলেটা ছোটো থেকেই ভীষণ চুপচাপ, গম্ভীর স্বভাবের। এজন্য খুব বেশি মানুষের সাথে তার মেলামেশাও নেই। নিজের জিনিস কিভাবে আগলে রাখতে হয়, ভালোবাসার মানুষকে কীভাবে ধরে রাখতে হয় নিজের জীবনে সে জানেনা। তবে আমি খুব খুশি হয়েছি এটা জেনে যে আদাভান এবারে অন্তত নিজের অনুভূতিটা হারাতে দেয়নি। হারিয়ে যাওয়ার আগেই শক্ত করে বেঁধে নিয়েছে তাকে নিজের মাঝে।”
“আণ্টি ওনার জন্য আমার আব্বু আমাকে ভুল বুঝেছেন। আমি আমার আব্বুকে কখনও কাঁদতে দেখিনি কখনও এর আগে। সেই শক্ত মানুষটা আজ হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছে আণ্টি। আমি কিভাবে সহ্য করবো এগুলো বলুন? আমি তো নিজের চোখে দেখেছি আমার আব্বুকে ভে*ঙ্গে পড়তে, ওনার উঁচু মাথা আজ নীচু হয়ে গেছে শুধুমাত্র স্যারের জন্য। উনি এমনটা কেনো করলেন আণ্টি? আমি যে সরাজীবনের জন্য আমার পরিবার হা*রালাম। আব্বু আমার মুখও আর কখনো দেখতে চান না যে।” কান্না করতে করতে হেঁচকি উঠে গেছে অরুনিকার। আনিকা আহসান শক্ত করে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরেন অরুনিকাকে। আলতো করে হাত বুলিয়ে দেন অরুনিকার মাথায়। এতক্ষনে কারোর মততময়ী স্পর্শে আরও বেপরোয়া ভাবে কেঁদে ওঠে অরুনিকা। বেশ কিছুটা সময় নিয়েই উনি অরুনিকাকে স্বাভাবিক করেন তারপর এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেন অরুনিকার দিকে। অরুনিকাও বিনা বাক্য ব্যয়ে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে।
বেশ কিছুক্ষন চুপ থেকে উনি বলেন,
তুমি হয়তো ভাবছো আদাভান অন্যায় করেছে তোমাকে এভাবে বিয়ে করে, তোমাকে তোমার পরিবার থেকে দূরে করে দিয়েছে ও। তুমি এটাও হয়তো ভাবছো যে আমরা কেনো ওকে এসবে প্রশ্রয় দিলাম। কিন্তু আমি তোমাকে বলছি একদিন তোমার নিজেরও মনে হবে যে আদাভান ভুল করেনি। অনেক সময় ক্ষণিকের কষ্ট সারাজীবনের সুখ এনে দেয়। যেদিন তুমি আদাভানকে বুঝতে পারবে সম্পূর্ণভাবে সেদিনই তুমি এই উপলব্ধিটা করবে এটা আমি নিশ্চিত। তবে মা আমার একটাই জিনিস চাওয়া তোমার কাছে, আমার আদাভানকে কখনও কষ্ট দিওনা। ওর ভালোবাসাটা একটু বোঝার চেষ্টা কোরো।
আমি আর ওর আব্বু পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম। আমরা অনেক চেষ্টা করি পরিবারকে মানানোর কিন্তু তারা মানেনি। কারণ উনি তখন বেকার না হলেও খুব অল্প বেতনের চাকরি করতেন। আমি নিজের সুখের জন্য ছেড়ে এসেছিলাম সবকিছু। একটা সময় পর পরিবারও মেনে নিয়েছে আমাদের, আমার সুখটা তাদের চোখে পড়েছে। কিন্তু আমি যদি সেদিন তাদের সুখের কথা ভেবে না চলে আসতাম তবে জীবনে থেকে যেতো অপ্রাপ্তি। টাকা থেকেও কোথাও একটা সুখের অভাব থেকেই যেত। সময়কে সময়ের স্রোতে চলতে দাও। একমাত্র সময়ই পারে সব ঘা ভরে দিতে, আবারো সব ঠিক করে দিতে। আমার বিশ্বাস তুমিও একদিন তোমার পরিবারকে ফিরে পাবে। তবে তার জন্য বর্তমানকে হারাতে দিওনা।
এতক্ষনে অরুনিকা ওনার কথার মাঝে এতটাই হারিয়ে গেছিলো যে তাদের আশেপাশের সবাই যে চলে গেছে সেটা খেয়ালই করেনি। হটাতই স্যারের গার্লফ্রেন্ড সেই মেয়েটা অরুনিকার হাত ধরে বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে আনিকা আহসানকে বলে,
“আম্মু আমি ভাবীকে ভাইয়ার রুমে রেখে আসছি। রুম সাজানো হয়ে গেছে, এখন ভাবীকে একটু সাজিয়ে দিয় বরং।”
কথাটা শুনে মাথা ঘুরতে থাকে অরুনিকার। আসলে যে মেয়েটার জন্য এত কান্নাকাটি করলো, ভাবলো স্যারের গার্লফ্রেন্ড আসলে সে স্যারের বোন! নিজের ভাবনার মাঝেই হাতে টান পড়ায় সামনে তাকিয়ে মেয়েটার হাস্যোজ্জ্বল মুখটা দেখে অরুনিকাও একটু হাসি দেয়। পথিমধ্যেই জেনে নেয় মেয়েটার নাম প্রাপ্তি। ভীষণ চঞ্চল স্বভাবের, একদমই আদাভানের বিপরীত।
“জানো ভাবি, আমার না তোমাকে অনেক ভালো লেগেছে। আম্মু তো ভাইয়াকে বিয়ের কথা বলে বলে কান ঝালাপালা করে দিয়েছে। অথচ তার বিয়ে নিয়ে কোনো মাথাব্যথাই ছিলোনা। আমরা তো ভেবেই নিয়েছিলাম এই জনমে আর এই নিরামিষকে দিয়ে আর বিয়েই হবেনা। আমি তো চুপি চুপি আম্মুকে বলেছিলাম যে ভাইয়ার মত বেরসিক ছেলেকে যে বিয়ে করবে তার কপালটাই পুড়*বে। তার চেয়ে ভালো মেয়েটাকে বাঁচিয়ে সমাজসেবা করতে একটু।”
প্রাপ্তির কথায় অরুনিকার পেট ফেটে হাঁসি পেলেও নিজের হাঁসিটা দমিয়ে রখলো সে।
রূমে ঢুকে একটা ফাঁকা ঢোক গিললো অরুনিকা। পুরো রুমটা ফুলের গন্ধে মো মো করছে। বেডের উপর সুন্দর করে লাভ সেপ করা গোলাপের পাপড়ি দিয়ে। প্রাপ্তি অরুনিকাকে একটা কালো পাড়ের লাল শাড়ী পরিয়ে দেয় সাথে চুলগুলো খোঁপা করে অল্প সাজিয়ে দেয়।
রাত প্রায় বারোটা। দেড় ঘণ্টা যাবদ বসে আছে অরুনিকা এই রুমে। বিরক্তিতে উঠে আয়নার সামনে যেতেই হুড়মুড় করে রূমে প্রবেশ করে আদাভান। রুমের দরজা লক করে পিছনে ঘুরতেই গলা শুকিয়ে যায় তার। কালো পাড়ের লাল শাড়ী পরিহিতা এই রমণী তার স্ত্রী ভাবলেই এক প্রশান্তি চেয়ে যাচ্ছে আদাভানের সর্বাঙ্গে। স্ত্রী যে আজ বি*ধ্বংসী রূপ নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ধবধবে ফর্সা কোনোকালেই পছন্দ ছিলোনা আদাভানের। কেমন যেনো বিদেশি বিদেশী লাগে এই রংটাকে তার। অরুনিকার গায়ের রং বিদেশী ফর্সা না হলেও এটাকে ফর্সা বলাই যায়।
ফর্সা শরীরে লাল রংটা দারুন মানিয়েছে। চুলগুলো মাঝখান থেকে সিথী করে খোঁপা করা, খোঁপায় গাঁথা বেলি ফুলের গন্ধ বেশ দূর থেকেই অনুভব করতে পারছে আদাভান। কানে রয়েছে বেশ বড় বড় দুটো ঝুমকো, হাতে লাল চুড়ি। সব মিলিয়ে ভীষণ মায়াবী লাগছে অরুনিকাকে। আদাভান ধীর পায়ে আয়নার সামনে এগিয়ে গিয়ে পিছন থেকে কোমড় জড়িয়ে ধরে অরুনিকার কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে রেখে আয়নায় পর্যবেক্ষণ করতে থাকে তার প্রাণপাখির সৌন্দর্য্য। তারপর হটাত করেই অরুনিকাকে কোলে তুলে নিয়ে বেডের কাছে নিয়ে যায়।
হটাত এমন আক্রমনে ভেবাচেকা খেয়ে যায় অরুনিকা। ভয় পেয়ে খামচে ধরে আদাভানের বুকের দিকের শার্টের অংশ। আদাভান বেডের কাছে গিয়ে অরুনিকাকে নামিয়ে হটাত করেই একদম কাছে টেনে নেয়।
চলবে?
#Fiza Siddique