#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(7)
অনুভূতিগুলো নিজের মাঝেই পি*ষে ফেলে একটা ফাঁকা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এগিয়ে যায় অরুনিকার পিছু। ড্রয়িং রুমের হাজারো প্রশ্ন খান্ত হয় অরুনিকার পাশে আরও এক যুবকের অস্তিস্ত দেখে। অরুণিকার বাবা, মা দুজনেই নির্বাক দৃষ্টিতে দৃষ্টিপাত করছে তাদের দিকে। চোখেমুখে ভীড় করে আছে তাদের হাজারো প্রশ্ন।
“আঙ্কেল আমি অরুনিকার কলেজের প্রফেসর আদাভান আহসান। আসলে আমি আর অরুনিকা একে অপরকে ভালোবাসি। আপনাদের ভয়ে ও কখনও বলে উঠতে পারেনি আমাদের ভালবাসার কথা। অনেক সাহস নিয়ে আজ আমরা আপনাদের কাছে এসেছি। প্লীজ ভুল বুঝবেন না আমাদের। অরুনিকাকে আমি অনেক ভালো রাখবো আপনাকে কথা দিচ্ছি।”
“তোমার সাহস কি করে হয় আমার সামনে দাঁড়ানোর? আর কি যেনো বললে! ভালোবাসা? হাসালে আমাকে! এই ভালোবাসা শব্দের মর্ম বোঝো তোমরা? বোঝো! ভালোবাসি শব্দটা শুধু একটা শব্দ নাহ, এটা একটা দায়িত্ব। বিশাল বড় দায়িত্ব, কর্তব্য। তোমাদের ভালোবাসা নিছক এক নোংরামি। বেরিয়ে যাও আমার বাড়ী থেকে। আমি আর কখনও তোমাকে এই বাড়ীর ত্রিসীমানায় যেনো না দেখি।” বেশ রেগে সোফা থেকে উঠে দাড়িয়ে বলেন তাহসান সাহেব।
“আপনি না চাইলেও আমি এখন থেকে আপনাদেরই অংশ আঙ্কেল। আপনার একমাত্র মেয়ের একমাত্র জামাই। এখন থেকে এক ঘন্টা আগে আপনার মেয়ের সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। প্লীজ আঙ্কেল আমাদেরকে মেনে নিন।”
” অরু তুই? তুমি কিভাবে জড়ালি এই রকম নোং*রা সম্পর্কে। আমাদের একবারও জানানোর প্রয়োজন মনে করিসনি? আজ তুইও বেরিয়ে যা আমার বাড়ী থেকে। তোর মুখও আমি কখনও দেখতে চাইনা। তোর লা*শ দেখার থেকে ভালো জী*বিত বিদায় করা। আজ থেকে তুই ম*রে গেছিস আমাদের জন্য।”
আব্বু! আব্বু প্লীজ বিশ্বাস করো আমি এমন করতে চাইনি। আব্বু! আব্বু! কি হয়েছে তোমার? তোমার বুকে ব্যা*থা করছে?
রাগের বশে বেশ জোরে কথাগুলো বলে তাহসান সাহেব জোরে জোরে হাঁপাতে থাকেন। হাঁপানোর এক পর্যায়ে বুকে হাত চেপে ধপ করে সোফায় বসে পড়েন তিনি। আব্বুর এমন অবস্থা দেখে নিজের কথাগুলো অসম্পূর্ণ রেখেই ছুটে এগিয়ে যেতে চায় তাহসান সাহেবের কাছে। বুকে এক হাত চেপে রেখে আর এক হাত উঁচু করে থামিয়ে দেন তাহসান সাহেব অরুনিকাকে। পাশ থেকে চিন্তিত মুখে তাকে পানি এগিয়ে দেন রুবিনা বেগম। স্ত্রীর হাত থেকে পানিটুকু পান করে পুনরায় অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে সোজা তাকান অরুনিকার দিকে। তার এখনও বিশ্বাস হচ্ছেনা তারই সন্তান তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। চোখ দুটো পানিতে ভরে ওঠে ওনার। এই তো সেদিন তোয়ালে পেঁচানো অরুনিকাকে দুইহাতে করে আগলে নিয়েছিলেন তিনি হসপিটালে। অরুনিকা তার দ্বিতীয় সন্তান হলেও কখনও তাকে সেইভাবে দেখেননি তিনি।
“এইটুকু ছিলে তুমি তখন, তোমাকে কোলে নিতে গিয়েও ভীষণ ভয় লাগতো আমার। ছোটো মতো একটা পুতুল যদি হাত ফসকে পরে যায়? এই ছোট ছোটো হাতদুটো ধরে হাঁটতে শিখিয়েছি। সারাদিনের অফিস শেষে ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দেওয়ার পর যখন তোমার ওই নরম দুটো হাত দিয়ে আমার গাল দুটো ছুঁয়ে দিতে! সব ক্লান্তি আমার নিমেষেই হারিয়ে যেতো। যেই হাত দিয়ে আমার গলা ধরে ঝুলেছো, যেই হাত দিয়ে আমাকে আদর দিয়েছো, যেই হাত দিয়ে আমার হাত ধরে হাঁটতে শিখেছো সেই হাতে তো আমাকে খু*নও করে দিতে পারতে তোমরা? কি দোষ করেছিলাম আমরা বলতে পারো? কিসের শাস্তি দিচ্ছেন আল্লাহপাক আমাদের? সামান্য বেতনের চাকরি করেও তোমাদের সবকিছু পূরণ করে গেছি। নিজের জামা সেলাই করে পড়েছি তবুও তোমাদের প্রতিটা আবদার আমি নির্দ্বিধায় পালন করে গেছি। কত রাত তোমার আম্মুকে আধ পেটা খেয়ে কাটাতে দেখেছি, নিজের জন্য সে কখনও আমার কাছে কিছুই আবদার করেনি কিন্তু প্রতিবার তোমাদের পছন্দের সবকিছু ঠিক চেয়ে নিয়েছে আমার থেকে। সে কি দোষ করেছিলো আমাকে বলো? কেনো আমরা তোমাদের কাছ থেকে এগুলো পেলাম বলো। কেনো পেলাম?”
ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই। কিন্তু তিনি তো কাঁদছেন। হাউমাউ করে কাদঁছেন। তার কান্নার আওয়াজে তো সবার চোখে পানি এসে গেছে। তিনি যে হারিয়েছেন, সবকিছু হারিয়েছেন। তাহসান সাহেবের মতো কঠোর মানুষকে এভাবে কান্না যে মানায় না, কোথায় আজ তার দাম্ভিকতা? কোথায় তার গর্ব? তার দুই মেয়েই যে তার গর্ব ছিলো।
নিজের আব্বুকে এতটা ভেঙে পড়তে দেখে অরুনিকা আরো শেষ হয়ে যায়। ভেতর থেকে দুমড়ে মুচড়ে শে*ষ হয়ে যায়। সে যে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছে তার আব্বুকে। কঠোর মানুষটাকে এইভাবে কাঁদতে বাধ্য করেছে সে। তার নিজেরও যে মোরে যেতে ইচ্ছে করছে। চোখের জল ফেলতে ফেলতে একবার শুধু ঘৃনার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকের দিকে। অরুনিকার সেই দৃষ্টিতে কি ছিলো কিজানি, কিন্তু টা আদাভানের ভেতর পর্যন্ত নাড়িয়ে দিতে সক্ষম ছিলো।
“এই মুহূর্তে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও তোমরা, নাহলে আমার ম*রা মুখ দেখবে।” তাহসান সাহেবের রাশভারী কন্ঠে এই কথাটা বলে নিজের রূমে গিয়ে দরজা আটকে দেন। সাথে সাথে রুবিনা বেগমও চলে যান সেখান থেকে। কথাটা যেনো কাঁ*টার মতো বিধ*লো অরুনিকার বুকে। ক্ষ*তবিক্ষ*ত নিজেকে কোনোরকম টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলো দরজার কাছে।
“আব্বু আমাকে এতটা পর করে দিওনা প্লীজ। আমাকে একটা বার কিছু বলার সুযোগ দাও প্লীজ। আমি তো তোমার সেই ছোট্ট অরু আম্মু। আমাকে মাফ করে দাওনা প্লীজ। আমাকে মাফ করো প্লিজ।” সন্তানের কান্নায় ভেঙ্গে পড়া কণ্ঠ, তার আর্তনাদও আজ কারোর মন গলাতে পারলোনা।
অতিরিক্ত টেনশন আর কান্নার ফলে সেখানেই সেন্সলেস হয়ে পড়েছিলো অরুণিকা। আদাভান খুব যত্নসহকারে নিজের বুকে আগলে নেয় তার প্রিয়তমাকে। তারপর কোলে তুলে নিয়ে আসে নিজের বাড়িতে।
বাড়ীতে ঢুকেই কাউকে কিছু না বলে অরুনিকাকে নিজের রূমে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেয় আদাভান। বেশ কিছু চোখ যে গোলগোল হয়ে তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো সেটা বুঝতে পেরে মৃদু হাসলো আদাভান। সবার চোখে মুখে হাজারো প্রশ্ন সাথে অবাক ভাব। বিগত চারটা বছর যে ছেলে মেয়েদের সাথে কথা বলাই পছন্দ করতোনা আজ সে নিজের কোলে করে একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছে, তাও তাকে নিজের রূমে রেখেছে। বিষয়টা আসলেই অবাক হওয়ার।
নিজের নিঃসঙ্গ জীবনের জন্য যে সে সঙ্গী খুঁজে এনেছে। কষ্ট মোচনের ওষুধ নিয়ে এসেছে, সে যে তার প্রাণপাখি নিয়ে এসেছে। এগুলো সবাইকে ঠিক কিভাবে এসব ভাবতে ভাবতে একহাতে নিজের চুলগুলোও পিছনে ঠেলে এগিয়ে আসে সবার মাঝে।
“আমি বিয়ে করেছি আম্মু। ওর নাম অরুণিকা, আমার স্টুডেন্ট। একটু আগে বাধ্য হয়ে রাগের বসে বিয়ে করে ফেলেছি আমি। আমাকে কি মাফ করা যায়না?”
অপরাধীর মত মাথা নীচু করে আদাভানকে কথা বলতে দেখে মৃদু হাসেন আনিকা আহসান। আদাভান যে শেষ পর্যন্ত নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিতে চেয়েছে এটাই তার কাছে অনেক। তিনি তো অনেক চেষ্টাই করেছিলেন আদাভানের বিয়ে নিয়ে, কিন্তু ছেলে যে বিয়ে করতে একদমই নারাজ। অবশেষে ওনার দুআ কবুল হয়েছে, ওনার ছেলের হৃদয়হরণী এসেছে। আদাভান এক এক করে সব ঘটনা খুলে বলে সবাইকে। শুধু এড়িয়ে যায় আরুনিকার ঘৃনার কথাগুলো। সে চায়না তার স্ত্রীকে কেউ একটুও খারাপ ভাবুন। থাকুক না কিছু কথা তাদের একান্তই গোপন।
এইবাড়ীতে সবাই খুব সহজেই মেনে নিয়েছে আরুনিকাকে। অরুনিকারও ভীষণ ভালো লেগেছে সবাইকে। ওদেরকে দেখে মনেই হচ্ছেনা যে অরুনিকা সব মাত্র কিছুক্ষন আগেই পরিচিত হয়েছে তাদের সাথে। সবকিছুর মাঝেও নিজের পরিবারের কথা ভেবে জানালার গ্রিল ধরে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকে অরুনিকা। তখনই নিজের কোমরে কারোর উষ্ণ হাতের ছোঁয়া অনুভব করে চমকে ওঠে সে। কিছু প্রতিক্রিয়া করবে তার আগেও নিজের কাঁধে তার উষ্ণ আলিঙ্গনের স্পর্শে পাথরে পরিনত হয় অরুনিকা।
চলবে?
#Fiza Siddique