#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(6)
“আমাকে স্পর্শ করার অধিকার আমি আপনাকে দিয়নি। ঘেন্না করে আমার আপনার স্পর্শে।”
সদ্য বিয়ে করা বউ এর মুখে এমন কথা শুনে আদাভানের চরম অবাক হাওয়ার কথা। কিন্তু তার ভাবমূর্তি এমনই যেনো এমন হবে সে আগে থেকেই জানতো। আদাভানের এমন ডোন্ট কে ভাব দেখে রাগে, দুঃখে ফুফিয়ে কেঁদে উঠলো অরুনিকা। কিছুক্ষণ আগে আদাভানের করা কাজের কথা মনে পড়তেই কান্নার বেগ বেড়ে গেলো তার।
আজ সকাল থেকেই বেশ ফুরফুরে মেজাজ নিয়েই কলেজে এসেছিলো অরুণিকা। ক্লাসে ঢোকার আগে হটাত করেই আদাভানের সাথে দেখা হয় তার। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে অরুনিকাকে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই তাকে সম্পূর্ণরূপে অভয়েড করে ক্লাসরুমে প্রবেশ করে আরুনিকা। রাগটা এবার লাগামহীন হয়ে পড়ে আদাভানের। আর কোনোকিছু না ভেবে সোজা ক্লাসে ঢুকে অরুনিকার হাত ধরে টানতে টানতে কলেজের বাইরে নিয়ে আসে। অনেক মোচড়ামুচড়ি করেও এই সুঠামদেহী পুরুষের থেকে নিজেকে ছাড়াতে ব্যার্থ হয়ে রাগে সাপের মতো ফুঁসতে থাকে অরুনিকা। একটা রিক্সা দাঁড় করিয়ে টেনে হিঁচড়ে সেটাতে তোলে অরুনিকাকে। তারপর নিজেও তার পাশে বসে বেশ শক্ত হাতে অরুনিকার দুই হাত নিজের হাতের মাঝে ধরে রাখে। রিক্সাওয়ালাকে একটা ঠিকানা বলে আপনমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে গান করতে থাকে। অরুনিকা হাজার চেষ্টার পর নিজেকে ছাড়াতে না পেরে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে কামড় বসায় আদাভানের ডান হাতের লোমশ অংশে।
এতক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথাটা সহ্য করলেও, আর সহ্য করতে না পেরে “আহ” করে শব্দ উচ্চারণ করে আদাভান। ফর্সা হাতে লালচে কামড়ের দাগ দেখে খারাপ লাগারা বাসা বাঁধে অরুনিকার মনে। দাগটাকে ঠিক লালচে না বলে কালচে বলা চলে। কয়েক জায়গা থেকে এখনো তাজা রক্ত বেরোচ্ছে। হটাত করেই অরুণিকা ছলছল চোখে তাকায় আদাভানের দিকে। দুজনের দৃষ্টি একসাথে হওয়ায় ভীষণ অসস্তিতে পড়ে যায় অরুণিকা। না চাইতেও আবারো সেই হাতের দিকে তাকিয়ে ক্ষত স্থানে আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয় অরুনিকা।
~বিয়ের আগেই লাভ বাইট দিয়ে দিলেন মিস পমপম?
আদাভানের কথা শুনে যেটুকু খারাপ লাগা সৃষ্টি হয়েছিলো সব হারিয়ে গেলো নদীর স্রোতের মতো। কিন্তু কি বললো এটা আদাভান বিয়ে! সেই বিয়ে! যে বিয়ে কেড়ে নিয়েছে আমার কাছ থেকে সবকিছু, কেড়ে নিয়েছে আমার আপনজন। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো কিছুতেই বিয়ে করবেনা এই মানুষটাকে। অরুণিকা নিজের ভাবনায় এতটাই বিভোর ছিলো যে বেশ কিছুক্ষন আগে রিক্সা থেমে গেছে তাতে তার খেয়াল নেই। হাতে টান পড়ায় সামনের দিকে তাকিয়ে আঁতকে ওঠে অরুনিকা। বিড়বিড় করে একবার শুধু বলে, কাজী অফিস!
“আমাকে এখানে নিয়ে আসার মানে কি মিঃ আদাভান আহসান। আপনার কি মনে হয় আপনার মতো একজন চরিত্রহীন মানুষকে আমি বিয়ে করবো? যদি সেটা ভেবে থাকেন তাহলে সম্পূর্ণ ভুল ভাবছেন। আপনি অরুণিকাকে
এখনো চিনে উঠতে পারেননি মিঃ। আপনার কলিজা টেনে বের করে নেওয়ার জন্যই জন্ম হয়েছে এই অরুণিকার।”
“আদাভানের কলিজাতে হাত দেওয়ার জন্য হলেও এই বুকে বাসা বাঁধতেই হবে তোমাকে প্রাণপাখি।”
কাজি অফিসে দুটো চেয়ারে পাশাপাশি বসে আছে অরুনিকা আর আদাভান। সামনে বসে থাকা কাজি মতোন লোকটা বিরক্তিতে এবার তাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। গত ত্রিশ মিনিট ধরে তিনি অরুনিকাকে কবুল বলার জন্য বলছেন, কিন্তু অরুণিকার মুখ থেকে “ক” উচ্চারণ টুকুও করাতে পারেননি এখনও।
আদাভানকে নড়েচড়ে বসতে দেখে বেশ আয়েশ করে নিজের চেয়ারে বসেন কাজি মতোন লোকটা।
“মিঃ তাহসান হোসেইন সল্টলেক সেক্টর ফাইভে “আর. কে ইন্ডাস্ট্রি” তে জব করেন তাইনা? ওখান থেকে বাসে চড়ে তরপর অটো ধরে বা রিক্সা করে বাড়িতে ফেরেন তাইনা? আজ বাড়িতে ফিরতে চারটার জায়গায় যদি আটটা হয় কেমন হবে বলোতো? আবার এটাও ভাবো যদি হটাত করেই ভরা বাস থেকে পড়ে যায়? কি হবে ভাবতে পারছো?”
আদাভানের কথা শুনে অসহায় চোখে তার দিকে তাকায় অরুণিকা। চোখ দুটো তার জলে টইটুম্বুর। আর একটু হলেই টা চোখের কোটর ছেড়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। নিজের কঠোরতা আর ধরে রাখতে পারলোনা অরুনিকা। হাউমাউ করে কেঁদে দিল সে।
“প্লীজ আমার আব্বুকে কিছু করবেন না। আমি আপনার সব কথা শুনবো। আমার আব্বুর যেনো কিছু না হয়। আমি মরে যাবো তাহলে। আর কোনো আপনজন হারাতে পারবোনা। পারবোনা আর কারোর দূরে যাওয়া সহ্য করতে।”
দুই হাতে নিজের চোখের পানি মুছে আবারো বলে,
“কোথায় সাইন করতে হবে বলুন, আমি সব করে দিচ্ছি।”
এরপর রেজিস্ট্রি সহ তিন কবুলে তাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়। আবদ্ধ হয় দুজনে এক পবিত্র বন্ধনে।
আলহামদুলিল্লাহ! আপনাদের বিয়ে সম্পন্ন হলো। আজ থেকে আপনারা স্বামী-স্ত্রী। কাজির কথা শুনে দুই চোখের পাতা বন্ধ করে নেয় অরুণিকা। আদাভান অপলক তাকিয়ে থাকে তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর দিকে। চোখ ভর্তি পানিগুলো পাঁপড়ি স্পর্শ করে আসতে আসতে গাল বেয়ে নেমে এসে জমা হয় থুতনির কাছে। বেশকিছুটা সময় নিয়ে সেখানে একত্রিত হাওয়ার পর বড়ো ফোঁটা আকারে টা গড়িয়ে পড়তে নিলে ফট করে নিজের হাত মেলে ধরে আদাভান।
প্রেয়সীর চোখের পানি হাতের মাঝে নিয়ে টা চেপে ধরে নিজের বুকের বাম পাশটায়। তরপর মনে মনে বিড়বিড় করে বলে, “তোমার চোখের পানিটুকুও অন্যত্র পড়া আমি সহ্য করবোনা আমি প্রাণপাখি। আমার বুকই হবে তোমার সুখ দুঃখের জায়গা।”
বেশ কিছু সময়ের মধ্যেই দুজনে উপস্থিত হয় অরুনিকার বাড়ীতে। নিজের বাড়ীর কাছে এসে আরও বেশী কষ্ট হয় অরুনিকার। আব্বুকে বাঁচানোর জন্যে যে সে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে এটা কি সবাই বিশ্বাস করবে? নাকি আজই হারিয়ে ফেলবে তাদের ভালোবাসা। তারা কি আদৌ বিশ্বাস করবে অরুনিকাকে? নাকি আদাভান যা বলবে সেটাই বিশ্বাস করে নেবে তারা? আব্বু আম্মু তাকে ভুল বুঝবেনা তো? সব চিন্তা ভাবনা মাথার মাঝে জট পাকিয়ে গেছে অরুনিকার। হাত পা অসম্ভব রকম কাঁপছে তার। কিভাবে মুখোমুখি হবে এই মানুষগুলোর সামনে? কি বলবে তাদের সামনে গিয়ে? সে যে অনেক বড়ো অন্যায় করে ফেলেছে। সকাল থেকে না খাওয়ায় আর এত চিন্তা আর কষ্টের মাঝে হটাত করে পড়ে যেতে নিলে তাকে দুই হাতে আগলে নেয় আদাভান। নিজের বুকের সাথে আগলে নিয়ে চিন্তিত হয়ে বলে, “ঠিক আছো তুমি?”
আদাভানের চিন্তিত স্বর অরুনিকার কান পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই মন থেকে ঘৃনার সাড়া আসে। বিশিয়ে ওঠে সারা শরীর আদাভানের ছোঁয়ায়। নিজের শরীরের চামড়া ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে অরুনিকার এই মুহূর্তে। চিল্লিয়ে বলে ওঠে,
“আমাকে স্পর্শ করার অধিকার আমি আপনাকে দিয়নি। ঘেন্না করে আমার আপনার স্পর্শে। মনে হয় কেউ আমার শরীরে বিষ ঢেলে দিয়েছে”
কথাগুলো বলে গটগট করে নিজের বাড়ির দিকে রওনা হয় অরুনিকা। ভীষণ শক্ত মণের অধিকারি আদাভানের চোখেও আজ পানির আনাগোনা। সদ্য স্ত্রী রুপে পাওয়া প্রিয়তমার মনে তার জন্য জমে থাকা ঘৃনার পাহাড় আজ সে বুঝতে পেরেছে। তবে এই পাহাড় সমান ঘৃনার কারনটা তার কাছে অজানা। সে তো শুধু ভালোবেসেছে অরুনিকাকে। এক ভুল সে দ্বিতীয়বার করতে চায়নি। আগের বার নাহয় নিজেকে সামলে নিয়েছিলো। ভেঙ্গে যাওয়া মণের প্রতিটা টুকরো খুব যত্ন সহকারে কুড়িয়ে নিয়ে এসেছিল। তারপর পাঁচটা বছর সময় নিয়ে একটু একটু করে সেগুলোকে একত্রিত করেছে। খুব কষ্ট করে জোড়া লাগিয়েছে নিজের মনকে। আচ্ছা! তার প্রিয়সী কি কখনো বুঝতে সক্ষম হবে তার ভালোবাসা? কখনও কি একবারের জন্যও ঝেঁকে দেখবে তার ভাঙ্গা মণের জোড়া লাগার নিশান গুলো? কখনও কী আলতো হাতে ছুঁয়ে দেবে সেই ব্যাথাগুলো? দেবে কি তার ভালোবাসা দিয়ে আগের নিশান মুছে?
চলবে?
#Fiza Siddique