#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(2)
আচমকা সামনে কিছু একটার সাথে ধাক্কা লাগায় হকচকিয়ে যায়। পড়ে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে সামনের মানুষটার দিকে তাকাতেই শুকনো ঢোক গেলে অরুনিকা। সব সাহস ফুস হয়ে যায়। ভয়ে ভয়ে পাশ কাটিয়ে চলে আসতে যাবে ঠিক এমন সময় শোনা যায় আদাভানের ভরাট কণ্ঠস্বর,
“পাঁচ মিনিটের মধ্যে তোমাকে যেনো আম আমার কেবিনে পাই” বলেই ভারি ভারি পা ফেলে চলে যায়। এদিকে চিন্তা আর ভয়ে একাকার অবস্থা অরুণিকার। মনের মধ্যে হাজারও দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে হাজির হয় আদাভানের কেবিনের সামনে। কেবিনে নক করার জন্য হাত বাড়াবে এমন সময় হটাত কেবিনের দরজা খুলে যায়। টাল সামলাতে না পেরে অরুনিকা সেই আগন্তুক সহ মেঝেতে পড়ে যায়। সবকিছু এত দ্রুত ঘটে গেলো যে অরুনিকা কিছুই বুঝতে পারলোনা। চোখ পিটপিট করে খুলে ইমাদ স্যারকে দেখে ভড়কে যায় অরুনিকা। লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করে তার। এদিকে একজোড়া চোখ যে ক্রমাগত তাকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে সেটা খেয়ালই নেই তার।
মানুষ হিসেবে ভীষণ অমায়িক ইমাদ আরিফ। একদিকে কলেজের সবচেয়ে রাগী স্যার আদাভান আহসান আর অপরদিকে সবচেয়ে শান্তশিষ্ট, সাদামাটা হলো ইমাদ আরিফ। তবে রাগী হলেও আদাভানের এই অ্যাটিটিউড এর উপর অর্ধেকের বেশি মেয়েরা ক্রাশ খায়।
“আপনি এখন আসতে পারেন মিস অরুনিকা।”
“কিন্তু আপনিই তো আমাকে আস্তে বললেন স্যার।” কথাটা শোনামাত্রই আদাভান শুধু একবার তাকায় অরুনিকার দিকে। ব্যাস আর পায় কে তাকে, এক দৌড়ে ক্লাসরুমে।
অরুনিকা চলে যাওয়ার পর নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায় আদাভান। কিছুতেই নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারছেনা। বারবার চোখের সামনে ইমাদের উপর অরুনিকার পড়ে থাকার দৃশ্যটা ভেসে উঠছে। নিজের কাজে নিজেই বিরক্ত হয়ে কাউকে কিছু না বলে কলেজ থেকে বেরিয়ে যায়।
অরুনিকা বেশ দৌড়ে ক্লাসে আসায় আলেয়া, আদিত্য, নূর অবাক হয়ে একবার একে অপরের মুখ দেখে তো একবার অরুনিকাকে দেখে। তারপর সবাই একসাথে হেসে দেয়।
“কিরে হনুমানের দল তোরা এমন ভাবে হাসছিস কেনো? আমার মাথায় কি শিং গজিয়েছে নাকি” নূরের পাশে বসতে বসতে বাকিদের উদ্দেশ্যে কথাটা বসে অরুনিকা।
“তুই আগে বল কোন বিশ্ব যুদ্ধ জয় করে আসছিস তুই? যেভাবে দৌড়ে এলি মনে হলো যুদ্ধ থেকে ভেগে এসেছিস। পিছনে কি বাঘ পড়েছিলো নাকি রে তোর?” আদিত্যর এমন কথায় একবার ভ্রু উচুঁ করে তাকায় তারপর গাল ফুলিয়ে বেঞ্চে মাথা দিয়ে বসে পড়ে।
“কিরে অরু কি হয়েছে তোর? শরীর খারাপ লাগছে নাকি? বাড়ি যাবি?”
“ভালো লাগছেনা কিছুই। আমি বরং বাড়ি যাই, তোরা ক্লাস কর। আর এই নূর আমাকে এই কয়দিনের নোটস গুলো দিস তো মনে করে।” বলেই আর কারোর কথার অপেক্ষা না করে বেরিয়ে যায় আরুনিকা। দুপুর হওয়ায় রাস্তায় একটাও রিক্সা না পেয়ে হাঁটতে শুর করে অরুনিকা। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর একটা আইসক্রীম দোকানের সামনে একটা ছেলেকে দেখে পিছন থেকে ভীষণ চেনা চেনা লাগে। ছেলেটা তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার সাথে ভীষণ হাসাহাসি করছে। অরুনিকা কিছুটা কাছে গিয়ে দেখে এটা আর কেউ নয় আদাভান। আর তার পাশের মেয়েটা আদাভানের প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। কেনো যেনো এই দৃশ্যটা সহ্য করতে পারলোনা অরুনিকা। চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আস্তে চাইছে, কিন্তু সে তো সহজে কাঁদতে পারেনা। এটা তার গুন নাকি দোষ সেটা জানা নেই, তবে খুব সহজে তার কান্না আসেনা। তবে ভেতরে কোথাও একটা ভীষণ কষ্ট অনুভূত হয়। সেই সাথে এক চাপা অভিমানও হয় আদাভানের উপর। সেই অভিমান ঠেকে কিনা জানা নেই, তবে আর এক মুহুর্তও সেখানে দারালোনা অরুনিকা।
বাড়ীতে এসে রুমে ঢুকে বেডের উপর শুয়ে পড়ে অরুনিকা। আবারো তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই দৃশ্য। আচ্ছা! স্যারকে তো কখনো মেয়েদের সাথে কথা বলতে দেখিনা তেমন। অনেকেই স্যারকে পছন্দ করে জোর করে কথা বলার চেষ্টা করে কিন্তু সবসময় দেখি ওনাকে মেয়েদেরকে এড়িয়ে যেতে। জানিনা ওনার মেয়েদের নিয়ে কি সমস্যা তবে যদি সত্যি উনি মেয়েদের থেকে এড়িয়ে চলা পছন্দ করেন তবে আজ যেটা দেখ সেটা কি? তবে কি মেয়েটা স্যার এর গার্লফ্রেন্ড? হয়তো সেটাই। কিন্তু একটা জিনিস কিছুতেই বুঝতে পারছেনা যে এসবে তার কি? ওর নিজের কেনো কষ্ট হচ্ছে এসব ভাবতে? কেনো স্যারের সাথে কোনো মেয়েকে মেনে নিতে পারছেনা।
আমি কি স্যারকে ভালোবেসে ফেললাম? উহু এটা কিছুতেই হতে পারেনা। স্যারের মনে এমন কিছুই নেই, থাকলে কখনও আমাকে শাস্তি দিতে পারতেন না। উনি আমাকে শাস্তি দিয়েই পৈশাচিক আনন্দ পান। আর স্যারের গার্লফ্রেন্ড আছে। আমাকে ওনার থেকে দূরে দূরে থাকতে হবে। আমার অনুভূতিকে আমি কিছুতেই প্রশ্রয় দেবোনা। যেটা ঘটে গেছে তার পর এটা কখনো সম্ভব নয়। অতীতের পাতা অনেক সময় ভবিষ্যতকে শেষ করে দেওয়ার মতো ক্ষমতা রাখে।
_______________
বেশ কিছুদিন ধরে আদাভান লক্ষ্য করে অরুণিকা তার সামনেই আসেনা। তাকে দুর থেকে আস্তে দেখলেই অন্য দিকে পালিয়ে যায়। কেমন যেনো পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায় মেয়েটা। ক্লাসেও একবারও তার দিকে তাকায়না, মাথা নীচু করে থাকে। দুষ্টুমি, বাচ্চামীটা আর নেই ওর মধ্যে। রোজ পড়াও করে আসে, পড়া না পারার বাহানায় যে শাস্তি দেবে সেটাও করতে পারেনা।
আজকে বারোটা থেকে আদাভানের ক্লাস আর তার আগের ক্লাসের স্যার না আসায় সব স্টুডেন্টরা আড্ডা দিচ্ছে। হটাত করে আদাভানকে ক্লাসে ঢুকতে দেখে সবাই অবাক হয় যায়। দরজার দিকে পিছন করে বসে থাকে আদাভান যে তার পিছনেই দাড়িয়ে আছে সেটা অরুনিকার খেয়াল নেই। সে তো গুনগুন করে গান করতে করতে আদাভানের একটা ছবি আঁকতে ব্যাস্ত। যেটাতে আদাভানের নাকের উপরে লাল রঙ দেওয়া, চোখ দুটো লাল লাল, বডিটাও বিকৃত ভাবে আঁকা। আর পাশে বড়ো বড়ো করে লেখা আদা স্যার। আঁকাটা শেষ করে বেশ খুশি খুশি মনে পিছনে ঘুরতেই একেবারে আদাভানের বুকের সাথে ধাক্কা খায়। অরুণিকা বেশ বুঝতে পারছে এরপর কি হবে, তাই ভয়ে ভয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আদাভান বলে, আমার কেবিনে আসবে এক্ষনি।
কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে যতরকম দোয়া দরুদ মনে পড়ে সবকটা পড়ে ফেলে অরুনিকা। হে আল্লাহ আমাকে আজকে এই নিমতিতার হাত থেকে বাঁচাও। আমার মতো শান্তশিষ্ট মেয়েকে শাস্তি দিয়ে যে কি মজা পায় এই জিরাফটা আল্লাহই জানে।
“আমাকে বকা শেষ হলে ভেতরে এসো।” এতক্ষনে যতটুকু সাহস জোগাড় করেছিলো আদাভানের এই কথা শুনে সেটুকুও কর্পূরের মতো উবে যায়। ধীর পায়ে ভেতরে যায় আর মনে মনে দোয়া পড়তে থাকে। না জানি আজ তাকে আবার কি শাস্তি দেয়।
অরুনিকাকে ভেতরে আসতে দেখে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায় আদাভান। অরুনিকার একদম সামনে গিয়ে বলে, তো আমাকে কি যেনো বলছিলে?
“স্যার বিশ্বাস করুন আমি আপনাকে নিমতিতা বলিনি। আপনি তো অনেক সুইট একেবারে চকোলেটের মতো। আপনাকে লম্বু, জিরাফও আমি বলিনি। আপনি তো কলেজের সবার ক্রাশ, পুরো টমেটোর মতো…….” এতক্ষনে অরুনিকার খেয়াল হলো সে কি বলে ফেলেছে। ফট করে দুই হাত দিয়ে মুখ চাপা দিয়ে ভয় ভয় চোখে তাকায় আদাভানের দিকে। আজ নিশ্চই তাকে গিলেই খেয়ে ফেলবে এই রাক্ষসটা।
অরুনিকার ভয় পাওয়া মুখ দেখে মুখে বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে আদাভানের। এক পা এক পা করে এগিয়ে যায় অরুনিকার দিকে। অরুনিকাও আর কোনো উপায় না পেয়ে পিছিয়ে যেতে থাকে। এক সময় দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায় অরুনিকার। আদাভানও অরুনিকার একদম সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটে বিদ্যমান তার বাঁকা হাসি। আদাভানের এত কাছাকাছি এসে ভয়ের থেকে লজ্জা বেশি কাজ করছে অরুনিকার মাঝে। জোরে জোরে নিশ্বাস টেনে নিচ্ছে অরুনিকা, যা সরাসরি আছড়ে পড়ছে আদাভানের বুকে। অরুনিকার দিকে আরও একটি ঝুঁকে মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো ফু দিয়ে সরিয়ে দেয় আদাভান। আদাভানের এমন কাজে চোখ দুটো বন্ধ করে দুইহাতে নিজের জামার খামচে ধরে আরুনিকা।
বেশ কিছুক্ষন ধরে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে আসতে করে চোখ খুলে দেখে আদাভান সামনে চেয়ারে বসে মিটমিট করে হাসছে আর তার হাতে থাকা পমপমটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।
স্যার আপনি আমার পমপম কেনো নিয়েছেন? আপনি জানেন এই পমপম আমার কতো পছন্দের?
হু জানি তো, পছন্দ বলেই তো সবগুলো ওড়নাতেই তোমার পমপম দেওয়া। এই একটা আমি নিলে কিছু হবেনা, তোমার কাছে অনেক আছে।
“আপনার লজ্জা করছেনা স্টুডেন্টের জিনিস চুরি করছেন আপনি? আমার জিনিস আমাকে ফেরত দিন জলদি।” অরুনিকার কথা শুনে বেশ জোরেই হেসে ওঠে বলে,
“তোমার সামনে একটু নিলজ্জ হতেই চাই মিস. পমপম।”
চলবে?