আমার অভিমান তোমাকে নিয়ে পর্ব-১১+১২

0
799

#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(11)

এতো এতো চিন্তায় মাঝে নিজের চুল নিজেরই ছিঁ*ড়তে ইচ্ছে করছে অরুনিকার। এই ছেলেটা কি একটুও শান্তি দেবেনা তাকে? আর কীভাবে অস্বাভাবিক করতে চায় সে?

বিকালে কলেজ থেকে বেরিয়ে সামনেই আদাভানকে বাইকে দেখতে পায়। তবে সে যে কারোর জন্য অপেক্ষায় ছিলোনা এটা স্পষ্ট করার জন্য দূর থেকে অরুনিকাকে আসতে দেখেই বাইক স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। আদাভানের কর্মকাণ্ডে আপনাআপনি মুখটা হা হয়ে যায় অরুনিকার। তাও ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে একটা রিক্সা করে বাড়ী ফিরে আসে।

“কিরে অরু মা তুই একা একা এলি যে আদাভান কোথায়? কোনো কাজে আটকে গেছে নাকি?”

আদাভানের আম্মুর কথা শুনে শূন্য চোখে তাকালো তার দিকে অরুনিকা। কি বলবে তাকে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেনা সে। সে যে যাওয়ার সময় আদাভানের সাথে যায়নি আর আসার সময় তাকে নেওয়া হয়নি, এসব তো তাদের ব্যাক্তিগত কথা। এগুলো কি ওনাকে বলা ঠিক হবে? উনি যদি কিছু মনে করেন এসবে তখন! এমনিতেই বাবা মার কথা প্রতি মুহুর্তেই মনে পড়ে তার। কিন্তু যেভাবে হোক আগে তাদেরকে সবটা বোঝাতে হবে। তার আগে এই বাড়ির কারোর মনে কোনোরকম কষ্ট দিতে চায়না সে। এই বাড়ী ছাড়া আর তো কোথাও যাওয়ার নেই এখন তার। এসব ভাবতে ভাবতেই হাতে টান অনুভব করে অরুনিকা। চোখটাও ভীষণ জ্ব*লছে তার।

“অ্যান্টি আসলে ওনার কোনো দরকারি কাজ পড়ে গেছে তাই আমাকে চলে আসতে বললো।”

“ছেলেটাও যে কি করে বুঝিনা আমি বাবা। কালকে বিয়ে করে নতুন বউ ঘরে আনলো আর আজকেই বেরিয়ে যেতে হলো ওকে কেলেজে! কয়েকদিন ছুটি করলে কি এমন হতো শুনি? আর সাথে করে মেয়েটাকেও নিয়ে গেলো। সবার সাথে যে একটু পরিচিত হবে ঠিকঠাক ভাবে সেই সময়টাই দিলোনা। সাথে করে হুকুম দিয়ে গেলো বিয়ে নিয়ে কোনোরকম বাড়াবাড়ি বা অনুষ্ঠান যেনো না করে। এই বয়সে আমার আর এসব ভালো লাগেনা। যা ইচ্ছে করুক সে।”

আনিকা আহসান নিজের কথা শেষ করে চলে গেলেন কিচেনের দিকে। অরুনিকাও এগিয়ে চললো তার জ্বা*লাপো*ড়া নিয়েই। এই মুহূর্তে মাথা থেকে সবকিছু ঝেড়ে ফেলে শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হওয়াটা অনেক জরুরি।

হুমায়ূন আহমেদের “নবনী” উপন্যাস হাতে ব্যালকনির ডিভানের উপর গা এলিয়ে বসে আছে অরুনিকা। বিকেল গড়িয়ে সময় সন্ধার শেষপ্রান্তে পৌঁছে গেছে অথচ আদাভান এখনও ফেরেনি। মাথায় হাজারো চিন্তার সাথে যোগ হয়েছে উপন্যাসে নবনীর জীবন নিয়ে আশ*ঙ্কা। রহস্য জিনিসটা বরাবরই অপছন্দ করা অরুনিকা কেমন যেনো রহস্যের মায়াজালে জড়িয়ে পড়ছে।

সন্ধ্যার ঝ*ঞ্ঝাট পেরিয়ে নেমেছে নিস্তব্ধ রাত্রি। আশেপাশের যানবাহনের আওয়াজও অনেকটা কমে এসেছে। সবাই ফিরে চলেছে আপন নীড়ে। কেউ বা পরিশ্রান্ত দেহখানি হেলিয়ে দুলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তো কেউ বড়ো বড়ো এসি গাড়ির মাঝে বসে সো সো করে বেরিয়ে যাচ্ছে। আশেপাশের কয়েকটা কুকুরের বিচরণের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে অরুনিকা বিভোর হয়ে আছে আদাভানের চিন্তায়। সেই যে সকালে বেরিয়েছিলো এখনও ফেরার নাম নেই তার। কোথায় আছে কেউ জানেনা।

“ইস্ কেনো যে ওনার নাম্বারটা নিয়ে রাখিনি! আন্টি কতোবার কল করলো একবারও ধরলোনা। রাগে নিজের মাথা নিজের ফাটাতে ইচ্ছে করছে।”

নিজের উপর বিরক্তবোধটা ক্রমে বেড়েই যাচ্ছে অরুনিকার। জীবনের কোনো সুতো খুঁজে পাচ্ছেনা। কোথায় যেনো তালগোল পাকিয়ে গেছে সব। এসব ভাবতে ভাবতেই আনমনে আলমারির কাপড় নাড়াচাড়া করতে থাকে অরুনিকা। আদাভানের শার্টগুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে সে। ছেলেদের শার্ট তার খুবই পছন্দের জিনিসের মধ্যে একটা। আলমারীর একদম মাঝের দিক থেকে আদাভানের সাদা রঙের একটা শার্ট টেনে বের করে নাকের কাছে ধরে। আয়রন করা সাদা শার্টের থেকে ভেসে আসছে একটা মনমাতানো স্মেল। এই স্মেলটা কয়েকবার পেয়েছে অরুনিকা। যখনি দুজনে খুব কাছাকাছি এসেছে এই মনমাতানো স্মেলটা বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে তাদের মাঝের দূরত্বের সংকীর্ণতা। নাক ডুবিয়ে নিজের মাঝে টেনে নেয় সেই স্মেলটা। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে তুলে বেশ কিছুক্ষন নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে রাখে আদাভানের শার্টটা। যেনো এটা আদাভানের শার্ট না বরং সে নিজেই। আনমনেই চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে কয়েকফোটা অশ্রুকণা। মনের মাঝে একটাই প্রশ্ন উঁকি দিয়ে ওঠে,

“কি এমন হতো যদি তুমি আমার হতে? কেনো আমার হয়েও তুমি আমারই হলেনা? তোমার প্রতি রাগের থেকে বেশী অভিমান জমা হয়েছে যে প্রিয়।”

“তোমার ভালোবাসার সংজ্ঞা আমি কিভাবে দেবো!
বেইমানীর গল্প লিখে, নাকি নিজেকে বুঝিয়ে নেবো?

বুঝিনা আমি আজ তোমাকে কোন জায়গায় বসাবো!
হজম করবো সব ব্যা*থা, নাকি অনুভূতি কে খসাবো?

মাঝে মাঝেই নিজের মনে আয়নাটাকে বলি,
হাটের মাঝে মুখোশটা তোমার ছিঁ*ড়ে যদি ফেলি!

পারবে নাকি সেই অপমান সইতে নিজে একা,
এই সাজটাই ধার্য্য করুক প্রেমিকা সম বোকা।

যদি নির্ল*জ্জ বলি তোমাকে সেটা নিজের অপমান।
আমিতো ভালো বেসেছিলাম দিয়েছিলাম সম্মান।”

অভিমানে সাজানো একগুচ্ছ কথাকে মনে মনেই আওরালো কবিতা আকারে। এই কি মায়াজালে তুমি জড়ালে আমাকে!

চোখ ভর্তি জল অথচ মুখে হাসি অরুনিকার, এ যেনো কোনো হেরে যাওয়া এক গল্পের সমাপ্তি। আসলেই কি গল্পের সমাপ্তি? উহু সবে তো গল্পের শুরু মাত্র। শুরুই যদি হয় বিষাদে ভরা, ছি*ন্নভিন্ন অনুভূতি তবে শেষটা কি বেদনার হা*হাকার?

রুমের দরজা খোলার আওয়াজে তারাহুরো করে অরুণিকা লুকিয়ে ফেলে শার্টটা। কোনোভাবে নিজের দুর্বলতা সে বাইরের কারোর সামনে প্রকাশ করতে চায়না। সেই মানুষটা যদি আদাভান হয় তাহলে তো আরো নয়। আদাভান জানে দূর্বলের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ছি*নিমি*নি খেলতে শুধু। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই রূমে এসে সবসময়ের গুছালো মানুষটাকে এভাবে অগোছালো ছ*ন্নছাড়া দেখে ভীষণ অবাক হলো। চুলগুলো এলোমেলো, পরনের ধূসর রঙের শার্টটার অর্ধেক অংশ বেরিয়ে আছে ইন থেকে, চোখে মুখে কেমন যেনো এক বেদনা সাথে ক্লান্তির ছাপ। অরুনিকা একভাবেই তাকিয়ে আছে আদাভানের দিকে অথচ সেই ব্যাক্তির কোনো হেলদোল নেই। দেখে মনে হচ্ছে সে বুঝেও না বোঝার ভান করছে। অরুনিকার চোখ দুটোও যেনো একইসাথে পন ধরে বসে যে যতক্ষণ না এই চার চোঁখের মেলবন্ধন ঘটবে ঠিক ততক্ষনই এভাবেই তাকিয়ে থাকবে তারা একদৃষ্টিতে। তাতে যদি ব্যা*থা হয় তবে হোক।

অবশেষে পরা*স্ত স্বীকার করেই ফেললো আদাভান এই গভীর দৃষ্টির নারীর কাছে। ঘটে গেলো দুইজোড়া চোঁখের মেলবন্ধন। বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করলো দুজনের না বলা কথাগুলো। কিন্তু হায়! সবই ব্যার্থ। দুজনই প্রেমে সিক্ত তবুও কোনো এক অদৃশ্য দেওয়াল দুজনের মাঝে কয়েক গজ পরিমাণ দূরত্ব সৃষ্টি করে ফেলেছে।

“প্রেম যার মনে গভীর, অভিমান তার মনেই বেশি বাঁধা মানে।”

এই উক্তিটি হয়তো সঠিক। তাইতো এক প্রেমিক পুরুষের গোছালো জীবনটা কেমন অগোছালো করে চলে গেলো এই অভিমান।

আদাভানের হটাত করা কাজে একেবারে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে অরুনিকা। কিছুক্ষনের মধ্যেই লোকটা কেমণ পাগলের মতো দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। শুধু জড়িয়ে ধরেছে বললে ভুল হবে জাপটে ধরেছে। জেনো ছেড়ে দিলেই চলে যাবে সহস্র দূর। অরুনিকাও পরম শান্তিতে বুকে মাথা রেখে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে তার প্রেমিক পুরুষকে। শান্তি! হুঁ শান্তিই তো পাচ্ছে অরুনিকা। সারাদিনের মন কেমনের অবসান হয়েছে তার। জ্ব*লতে থাকা বুকটা জেনো শীতলতার ছোঁয়া পেয়েছে। আদাভানও বেশ কিছুটা সময় ধরে জড়িয়ে ধরে নিজের ক্লান্তি, অভিমান, রাগ, অভিযোগ সবটা মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। ক্লান্তি আর রাগটা কমলেও বাকিদের কোনো পরিবর্তন দেখা গেলনা। তাইতো দুইহাতের মাঝে অরুনিকার কোমল মুখখানি ধরে কপালে আলতো এক পরশ এঁকে দেয়। সাথে এতক্ষনের জমিয়ে রাখা দীর্ঘশ্বাসটাকে মু*ক্তি দেয়। তারপর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে ওঠে,

“কাঁ*চ কতটা অভিমানী আয়না না ভা*ঙলে বোঝা যায়না।”

কথাটা বলে আর এক মুহূর্তও সেখানে দাড়ায়না আদভান। কিছু একটা লুকানোর তাগিদে খুব দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। এতটাই দ্রুত যে অরুনিকার বন্ধ চোখ এখনও ঝা*পটে ওঠেনি নিজের ডানা।

বেশকিছুক্ষণ হয়ে গেলেও কিছু একটা অনুভব করে চোখ মেলে তাকায় অরুনিকা। মাথার প্রতিটা নিউ*রোনে নিউ*রোনে একই কথা খেলছে “কাঁ*চ”, “আয়না”, “ভা*ঙ্গা”, “অভিমান”।

“এসব কী বলে গেলেন উনি? উনি কি কোনোভাবে আমার কারণে রেগে আছেন? নাহ নাহ রাগ নাহ এটা অভিমান। কিন্তু কেনো? আমি ঠিক কী করলাম? এই বিয়েটা না মেনে নেওয়ার জন্যই কি ওনার মনে এত কষ্ট! তাহলে উনি আমাকে সত্যি ভালোবাসেন? কিন্তু আমি তো কিছুই মেলাতে পারছিনা। একই নাম একই মানুষ অথচ চরিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। আচ্ছা, আমার কোথাও ভুল হচ্ছেনা তো? আমি অযথাই অনেক ভুল বুঝছিনা তো! ওনার চোখে সেই প্রথম থেকেই আমার জন্য মুগ্ধতা দেখেছি। আর আজ যেটা দেখলাম সেখানে ছিলো এক আকাশ সমান ভালোবাসা।”

রাত বেশ গভীর। ঘড়ির কাঁ*টাটা ঠিক এগারোটা বেজে ত্রিশ মিনিটের ঘর ছেড়েছে। আদাভান ব্যাস্ত নিজের মতোই ল্যাপটপ নিয়ে। আর অরুনিকা এপাশ ওপাশ করেও কিছুতেই ঘুমকে নিজের আয়ত্বে আনতে না পেরে আধসোয়া হয়ে ফোন চালাচ্ছে। ফেসবুক স্ক্রলিং করতে করতে অরুনিকার চোঁখ আঁটকে যায় একটা লেখার উপর। লেখাটা সেই লেখকের “নীল চিরকুট” আইডিটা থেকে।

” যতবার ভেবেছি আরও একবার ফিরে দেখি তোমাকে
ততবারই তোমার দেওয়া অবহেলা ঘিরে ফেলেছে আমাকে।”

চার ঘণ্টা আগে করা এই পোষ্টে রিয়েক্ট পড়েছে প্রায় পাঁচ হাজার আর কমেন্টও চার হাজার মতো। অরুনিকারও খুব ইচ্ছে করলো একটা সুন্দর কমেন্ট করতে তার প্রিয় লেখককে। তাই ঝটপট টাইপ করেই ফেললো,

তুমি ব্যাস্ত উপেক্ষাতে
আমি মাখছি অবহেলা।
অভিমানে ডু*বি মধ্যরাতে
সবকিছুই কি ছেলেখেলা?

ইচ্ছের বশেই কমেন্টটা করে বসে অরুনিকা। যদিও এভাবে ছন্দ সে কখনই লেখেনি তাই তেমন আহামরি কিছু লিখতে পারবেনা এটাই স্বাভাবিক। আর এতো এতো কমেন্টের ভিড়ে উনি কেনোই বা এই কমেন্টটা পড়তে যাবেন। আনমনে এসব ভাবতে ভাবতেই একবার আড়চোখে তাকালো আদাভানের দিকে। অন্ধকার রুমে ল্যাপটপের আলোতে একমনে কাজ করে যাচ্ছে আদাভান। এই আলোটুকুই আদাভানের সৌন্দর্য যেনো আরোও কয়েক গুন বাড়িয়ে দিয়েছে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে এই মানুষটার স্ত্রী সে, ভ লেই কেমন যেনো সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে। মনে মনে ঠিক করলো বিয়েটা যেভাবে হোক যখন হয়েই গেছে তাহলে মেনে নিলে ক্ষ*তি কি! এরকম সুন্দর একটা পরিবার তাকে উপহার দেওয়ার জন্য হলেও আদাভানকে মেনে নেবে সে। তবে সত্যের শেষ পর্যন্তও পৌঁছাবে, আপুর সাথে হওয়া সবকিছুতে যদি সত্যি আদাভান দায়ী হয় তবে তার শেষও শেষ দেখে ছাড়বো। সেদিন কোনোভাবেই ছাড় পাবেন না আমার কাছ থেকে। আই প্রমিস ইউ।

একধ্যানে আদাভানকে দেখে চলেছে অরুনিকা। দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা টাইপ করছে। নাকি কারোর সাথে চ্যাটিং করছে? ওনার মতো বেরসিক মা মানুষের আবার ফেসবুক থাকবে নাকি? আর থাকলেও হয়তো কেউ মেসেজ করলে বলবে, “হাউ ডেয়ার ইউ? এর জন্য তোমাকে শাস্তি পেতে হবে। যাও কান ধরে একশ বার উঠবোস করে আসো।”
আর কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে যে আপনি কি সিঙ্গেল? তখন উনি কি বলবেন? বেশ কিছুক্ষন চিন্তা করে, হ্যাঁ পেয়েছি।
“এই মেয়ে তোমার সাহস কি করে হয় বড়োদের সাথে এভাবে কথা বলার? তুমি জানো এর জন্য আমি তোমাকে কি শাস্তি দিতে পারি? তোমার গার্ডিয়ানের নাম্বার দাও আমাকে ওনাদেরকে জানাই আমি তোমার কান্ড” আর তারপর হয়তো মেয়েটা ভয়েই ব্ল*ক করে দেবে ওনাকে।

এসব ভাবতে ভাবতেই পেট ফে*টে হাঁসি আসে অরুনিকার। অনেক চেষ্টা করেও চেপে রাখতে না পেরে বেশ জোরেই হেসে দেয় সে। কাজ করার মাঝে হটাত করে এত রাতে হাঁসির আওয়াজ পেয়ে কিছুটা ভড়কে যায় আদাভান। লাইটটা অন করে দেখে অরুনিকা সারা বিছানায় গড়াগড়ি খেয়ে হাসছে আর কিছু একটা বিড়বিড় করছে। অনেকদিন পর অরুনিকাকে এভাবে মন খুলে হাসতে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে আদাভান। এতক্ষনে পেটে হাত চেপে ধরে হাসছে অরুনিকা, চোঁখের কোণে পানিও চিকচিক করছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে হাসতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তাও নিজের হাসিটা কিছুতেই কন্ট্রোলে আনতে না পারায় এভাবে হেসেই যাচ্ছে এখনও।

দুই পা এগিয়ে গিয়ে বেডে বসে আদাভান। আসতে আসতে এগিয়ে যায় অরুনিকার দিকে। এক হাতে বেডে ভর দিয়ে একদম কাছাকছি চলে যায় অরুনিকার। তারপর ডানহাত এগিয়ে দিয়ে ছুঁয়ে দেয় কামিজের ভেতরের উ*ন্মুক্ত পেট। শুধু যে ছুঁয়েই থেমে গেছে তা নয়, হাতটা কামিজের ভেতরেই আরও প্রসারিত করে একহাতে আ*কড়ে ধরে কোমর। আকড়েও যে খান্ত হয়নি প্রেমীক পুরুষ, সাথে বেশ খা*মচেই ধরেছে।

শিহরণে হাঁসি থামিয়ে দুই চোখ মুহুর্তেই বন্ধ করে ফেলে অরুনিকা। শিরদাঁড়া বেয়ে বয়ে যায় এক হিমশীতল স্রোত। ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে সর্বাঙ্গ। চোখের কোণে এখনো বেশ কিছুটা পানি দৃশ্যমান। আদাভান বাম হাতটা এগিয়ে দেয় সেদিকে।

চলবে?
#Fiza Siddique

#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(12)

উন্মু*ক্ত পেটে ডান হাত দিয়ে খাম*চে ধরে বাম হাত এগিয়ে দেয় অরুনিকার দিকে। আদাভানের খা*মচিতে ব্যাথা নয় বরং একরাশ লজ্জা ভর করলো অরুনিকার চেহারা জুড়ে। শিহর*ণে শিরদাঁড়া বেয়ে বয়ে চলছে এক শীতল স্রোত। ভালোলাগার অতলে তলিয়ে যাচ্ছে দুই মন। বাম হাতের আঙ্গুলের ডগা দিয়ে মুছে ফেলে আদাভান প্রেয়সীর চোখের জল।

হুট করেই অরুনিকাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় আদাভান। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টায় মত্ত হয়ে ওঠে সে। মনে পড়ে যায় তাদের সম্পর্কের কথা, মনে পড়ে অরুনিকা আর পূরবের মাঝের সেই ঘনি*ষ্ট দৃশ্যের কথা। কমে যাওয়া রাগ আর কষ্ট সেই সাথে মাথা চারা দিয়ে ওঠে তার। কিন্তু এই মুহূর্তে সে কোনোরকম ঝামেলা চাচ্ছেনা। পিছন ঘুরে একবার তাকায় সেই চোখের দিকে যে চোখে বারবার ডুবে যায় আদাভান। নাহ আর তাকাতে পারলোনা। অদ্ভুত সেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে তাকে বারবার, বোঝাতে চায় অন্য এক ভাষা যা সম্পূর্ণ ভুল। এই ভুল থেকে পালিয়ে বেড়াতে চায় সে। কোনোভাবেই এই ভুলে জড়াতে চায়না, কোনোভাবেই নাহ।

আদাভানের যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরুনিকা। মলিন মূখে একবার তাকায় ব্যালকনির দিকে, দেখতে পায় এক আলো ছায়ার মাঝে বিরাজমান প্রতিবিম্ব। এক যুবকের প্রতিবিম্ব, তার স্বামীর প্রতিবিম্ব। আজ অরুনিকার মনও কেনো জানি নিজে থেকেই চাচ্ছে তার স্বামীর স্পর্শ। আদাভান যে তাকে অবহেলা করতে চাইছে সেটা বুঝতে পেরে করুন হাসলো অরুনিকা। সবার অবহেলা পেতে পেতে আজ ক্লান্ত সে।

“আপা! তোমার মতো আমাকে আর কেউ বোঝেনা গো। আম্মু, আব্বুও আমাকে অবিশ্বাস করলো। আমি কী করবো এখন বলে দাও না। আমি আর পারছিনা এসব সহ্য করতে। তুমি চলে যাওয়ার পর পাল্টে গেছে আমার জীবন আপা। তোমার সেই ছোট্ট অরু বড়ো হয়ে গেছে।”

ভীষন কান্না পাওয়া সত্ত্বেও চোখ থেকে একফোঁটা পানি বেরোলোনা অরুনিকার। কষ্টেও বুঝি কেউ হাঁসে? হয়তো হাঁসে। অরুনিকাতো হাসছে, এক তাচ্ছিল্য ভরা হাঁসি। এই হাসিটা কাকে উপহার দিলো নিজের ভাগ্যকে নাকি ঘটতে থাকা সময়কে জানা নেই। তবে সেই হাসির মাঝে লুকানো ছিলো ব্যাথা, তীব্র এক য*ন্ত্রণাময় হাহাকার।
_____________

ফোন হাতে নিয়ে বেশ ব্যাস্ত ভঙ্গিতে বসে আছে অরুনিকা। স্বপ্নেও না ভাবা জিনিসটা সত্যি হয়েছে আজ। তার প্রিয় লেখক তার কমেন্টের রিপ্লাই করেছে। প্রতিউত্তরে সে লিখেছে,

“চোখের তলায় জমছে দেখো,
এক জীবনের গল্পখানা
সন্ধ্যা হলেই ভীর করে সব
অনুভূতিদের মিছে বায়না।”

আবেগে আপ্লুত হয়ে হুট করেই ঢুকে পড়লো “নীল চিরকুট” আইডিতে। মেসেজ দেবে কিনা দেবেনা ভাবতে ভাবতেই হয়ে গেলো এক ভুল। হাতের টাচ লেগে কল চলে গেলো তার কাছে। তারাহুরো করে কাটতেও ভুলে গেছে অরুনিকা। উফফ কি এক বিরক্তিকর অবস্থা! ঠিক চেনা নেই জানা নেই এমন একজনের কাছ থেকে কল পেয়ে নিশ্চই বিরক্ত হওয়ারই কথা কারোর। তাই অনেক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো একটা মেসেজে নিজের ভুলটা স্বীকার করার কথা।

“এইযে লেখক সাহেব,

আপনি আমার প্রিয় লেখকের মধ্যে অন্যতম। আপনার সব গল্পই মোটামুটি বারবারই পড়ি আমি। তবে আজ ভুল করেই আপনার আঙিনায় পদার্পণ করে ফেলেছিলাম। ঘটনাটা একদমই ভুলবশত ছিলো। কখন যে পা পিছলে পড়ে যাই সেখানে বুঝতেই পারলাম নাহ। আমার ভুলকে ফুল মনে করে ক্ষমা করবেন প্লীজ।”

মেসেজটা লিখে সেন্ড করার পর আবারো ডিলিট করে দিলো। এমন ঘোরানো পেঁচানো কথা সে কবে থেকে আয়ত্ব করতে শিখলো আবার? এসব তার জন্য মোটেও নয়। এসব সাহিত্যিকদের জন্য, কোনো সাহিত্য বা কাব্যে মানায়। সে তো সোজাসাপ্টা একটা সরি চেয়েই খান্ত হাওয়ার মেয়ে। তাই সরি লিখেই সেন্ড করে দিলো।
______________

কলেজে তাদের আড্ডার জায়গাটা এখন খালিই পড়ে থাকে। সেদিনের পর আদিত্য আর নূরের কোনো খোঁজ পায়নি কেউ। আদিত্যর ফোন বন্ধ পেয়েছে বারবার তারা, আর নূর কারোর কল ধরছেনা। আলেয়া আর অরুনিকা বিরক্তিতে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে ঠিক সেই সময় সামনে করোর পা লক্ষ করে সেদিকে তাকিয়ে সক হয়ে যায় দুজনে। এক মুহূর্তের জন্য যেনো ভয় পেয়ে গেছিলো তারা। এ তো তাদের নূর না, অন্য কেউ যেনো। তাদের নূর ছিলো ঠিক নূরের মতোই নূরানিময়। চেহারার সেই ঔজোল্য কোথায় হারালো তবে? মাত্র দুই সপ্তাহের মাঝেই দেহ হয়ে উঠেছে কঙ্কালসার। চোখের নীচে কালো স্তর, দেখলে যে কেউ বলবে ঘন কালো কাজল যেনো খুব যত্নে লেপ্টে দেওয়া হয়েছে সেখানে। সারা মুখে কেমন কলো কালো দাগ, যেনো কতো কাল মুখে পানি পড়েনা। ধবধবে ফর্সা শরীরটা কেমন শ্যামবর্ণ ধারণ করেছে। যেনো কতো কাল তাদের যত্ন নেওয়া হয়না।

এই কঙ্কালসার নূরকে দেখেই জাপটে জড়িয়ে ধরলো অরুনিকা। নিজের মাঝের অবাক ভাবটা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি সে। এগুলো কিভাবে সম্ভব? আগের নুরের সাথে যে আকাশ পাতাল ফারাক তার। তবে তাদেরকে কিছু বলার সুযোগ না দেওয়ার পরিকল্পনা যেনো নূর আগে থেকেই করে এসেছিলো। ব্যাগ থেকে তিনটে কার্ড বের করে এগিয়ে দিলো তাদের দিকে।

“সামনের মাসে আমার বিয়ে, তোদের ছাড়া আমার তো কোনো ফ্রেন্ড আর নেই। সবাই আসবি কিন্তু। আর আ…আদিত্য কোথায়? ওকে দেখছিনা যে?”

আদিত্য নামটা নিতেও আজ ভীষণ কষ্ট হচ্ছে নূরের। তাকে এক পলক দেখার জন্যই তো ছুটে এসেছে সে সব বাধা পেরিয়ে শেষ বারের মতো একবার দেখবে তার আদিত্যকে।

“তুই যেদিন থেকে কলেজে আসা বন্ধ করেছিস সেদিন থেকে আদিত্যরও কোনো খোঁজ পাইনি আমরা। ফোনটাও বন্ধ জানিনা আমরা কেউ ওর ব্যাপারে।”

আলেয়ার কথা শুনে বুকের ভেতরটা মো*চড় দিয়ে উঠলো নূরের। শুষ্ক উত্তপ্ত মরুর ন্যায় খাঁ খাঁ করছে তার বুক। দু*মড়ে মু*চড়ে শেষ করে দিচ্ছে সব। তবে কি শেষ বারের মতো ভালোবাসার মানুষটাকে দেখার সৌভাগ্যও তার নেই? এতো অভাগা হয়ে কেনো জন্ম নিলো সে? এতো অপ্রাপ্তি নিয়ে কীভাবে বেঁচে থাকবে সে?

এতোক্ষণে নিজের অবাকের সীমা থেকে বেরিয়ে এসে দুই হাতে ঝাঁকিয়ে ধরলো নূরকে অরুনিকা। কড়া দৃষ্টিতে চোখ রাখলো প্রানপ্রিয় বান্ধবীর চোখে।

“সত্যি করে বল নূর কি হয়েছে তোদের মাঝে। তোরা একে অপরকে ভীষণ ভালোবাসিস আমরা সবাই সেটা জানি। তবে এসব কি? হটাৎ করেই তুই বিয়ে করছিস, হটাত করেই আদিত্যর কোনো খোঁজ নেই। তোর কি আমাদের বাচ্চা মনে হয়? কিছু বুঝিনা আমরা?”

অরুনিকার কন্ঠে রাগের সাথে মিশে আছে বন্ধুদের প্রতি তীব্র ভালোবাসা। ওরা চারজনই একেঅপরের প্রাণের থেকেও প্রিয়। তবে ভাগ্য যে তাদের বিচ্ছেদ টেনে এনেছে। ঘনিয়ে এসেছে তাদের চারজনের শক্ত বাঁধন আলগা হওয়ার সময়। নূরের করুন দৃষ্টি অরুনিকার চোখের আড়াল হলোনা।

“দেখ অরু তুই যেটা ভাবছিস এমন কিছুই নাহ। আমাদের মাঝে যেটা ছিলো সেটা আবেগ। আর আবেগ দিয়ে তো জীবন চলেনা তাইনা? জীবনে ভালো থাকার জন্য টাকার দরকার হয়। তাই বাড়ী থেকে যার সাথে বিয়ে ঠিক করেছে আমার, আমি রাজি হয়ে গেছি। ব্যাস আর কিছুই না।”

“আমার ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে নূর তুই টাকার জন্য আদিত্যর সাথে সম্পর্ক শেষ করেছিস। কেনো নূর? কিভাবে পারলি এমনটা করতে? ভালোবাসার চেয়ে টাকা তোর কাছে বড়ো কবে হয়ে গেলো? তুই তো এমন ছিলিনা? আদিত্য তোকে পাগলের মতো ভালোবাসে। তোকে চিনতেও আজ আমাদের কষ্ট হচ্ছে।”

“তুই তো বড়ো ঘরেই জন্মেছিস। ছোটো থেকে যা চেয়েছিস তাই পেয়েছিস, টাকার জন্য জীবন কোথায় দাড়ায় তুই কিভাবে বুঝবি? আর তুই বলছিস ভালোবাসার কথা? নিজে তো বিয়ে করেছিস আদাভান স্যারকে। কলেজের প্রফেসর না হলে করতিস নাকি? আরে এগুলো কাউকে জ্ঞ্যান দেওয়ার সময় ভালো লাগে বাস্তবটা বড্ড কঠিন।”

এটুকু বলে আর এক মুহূর্তও দাড়ায়নি নূর। একবার পিছনে ফিরলে দেখতে পেতো কারোর করুন চাহনি। সে চাহনিতে রয়েছে অবিশ্বাস। যেনো ভুল কিছু শুনে ফেলেছে সে। ধপ করে মাটিতে হাটু গেড়ে বসে পড়ে অরুনিকা। জীবনটা কোথা থেকে কি হয়ে গেলো তার? এক এক করে সবাইকে হারিয়ে ফেললো। তার আপন বলতে আর কেউ নেই। কেউ নেই তার সুখ দুঃখের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনার। কেউ নেই হাসি ঠাট্টায় মাতিয়ে রাখার। কেউ নেই যত্ন করে আদুরে হাত মাথায় বুলিয়ে দেওয়ার। কোন ধ্বং*সখেলা খেলতে নেমেছে জীবন তার সাথে? এর শেষই বা ঠিক কোথায়?
___________

বিধ্ব*স্ত অরুনিকাকে নিজের বুকের মাঝে ধরে রেখেছে আদাভান। অরুনিকাও লেপ্টে আছে তার বুকে নির্দ্বিধায়। সর্বস্ব হারানো বুকটা এখানে একটু হলেও শান্তি খুঁজে পেয়েছে। ভাবনার গভীরে গিয়ে এক সময় তার মনে হলো অতীতকে আঁকড়ে তো কখনো ভালো থাকা যায়না। অতীত ঠিক উইপোকার মতো কুরে কুরে শেষ করে দেয় জীবনটা। যে চলে যায় সে কেনো তার সাথে করে যন্ত্র*নাগুলোও নিয়ে যায়না? এক বুক হাহাকার কি তবে উপহার স্বরূপ দিয়ে যায়? মানুষ কেনো এতো রঙ বদলায়! মানুষ চেনা তবে কি পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ?

জীবন হলো অলিখিত বোঝাপড়া!
মেনে নিলে ভালো, নয়তো সবই ছন্নছাড়া।

চলবে?
#Fiza_Siddique

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে