#আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে(10)
নূর আদিত্যের কাঁধে মাথা রেখে কলেজের দক্ষিণ দিকের পুকুর পাড়ে বসে আছে। দুজনের মাঝে ভীড় করে আছে হাজারও চিন্তার স্তূপ। সম্পর্ক শুরুর আগেই বিচ্ছেদটা কেউই চায়না। করে চায়না প্রিয়মানুষকে হারাতে। নিজে হেরে গিয়েও প্রিয় মানুষের সুখের জন্য হাজারও প্রেমিক প্রেমিকা বলি হয়ে যায়। আপশ করে বশে নিজের সুখের সাথে। ভালোবাসা মানে যে নিজে ভালো থাকা না, ভালোবাসা মানে একটা দায়িত্ব। প্রিয় মানুষকে ভালো রাখার দায়িত্ব। ভালোবাসার মানুষকে সুখে রাখার দায়িত্ব। সেটা যদি হয় নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে, তবে হোক না। প্রিয় মানুষের সুখের জন্য তো অনেকেই বিচ্ছেদের মতো বি*ষ পান করে ফেলে। এই বি*ষে দ*গ্ধ হয়ে সারাজীবন ম*রণ য*ন্ত্রণাতে ভুগেও দুর থেকেই প্রিয় মানুষের সুখ চায়। ক্ষতি কি যদি নূরও সেই ম*রণ বি*ষ পান করে! আদিত্যতো সুখে থাকবে, ভালো থাকবে, সুস্থ থাকবে। আদিত্যর গায়ে একটা আঁচ*ড়ও যে নূর সহ্য করতে পারবেনা।
“এই নুরপাখিটা! কি হয়েছে তোমার? এভাবে মনমরা হয়ে বসে আছো কেনো? আরে সমস্যা তো আসবেই জীবনে সাথে সমাধানও আসবে। দেখবে আল্লাহ ঠিক কোনো না কোনো সমাধান ঠিক খুঁজে দেবেন। এভাবে চুপচাপ থাকেনা পাগলিটা। এই! আমার দিকে দেখো। তাকাও বলছি আমার দিকে।”
নূর যে ইচ্ছে করেই তাকাচ্ছেনা আদিত্যর দিকে। নিজের অসহায়ত্ব কিছুতেই বুঝতে দিতে চায়না সে আদিত্যকে। দেখতে চায়না নিজের চোখের জল আদিত্যকে। তাহলে ছেলেটা যে আরও উতলা হয়ে পড়বে। তখন কিভাবে সামলাবে তাকে! এর চেয়ে ভালো আদিত্যর ডাইরীর পাতায় নূর নামক অধ্যায়টা ছলনাময়ী নামেই পরিচিত থাক। এই ম*রণ য*ন্ত্রণা শুধু তারই হোক। আদিত্য এক ছলনাময়ীকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টায় নাহয় মেতে উঠুক। সময়ের সাথে সাথে মণের কোনো এক কোণে অবহেলিত হয়েই নাহয় পড়ে থাকুক নূর। এগিয়ে যাক আদিত্য। ভালো থাকুক তার প্রিয়তম।
আদিত্য জোর করে দুই হাতে নূরকে নিজের দিকে ফেরায়। থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করে নিজের মুখের সামনে আনে। নূরও ছলছল চোখে মণ ভরে দেখে নেয় আদিত্যকে। আবারো নিজের মুখটা নীচু করে পিছন ঘুরে দাঁড়ায় নূর। দুই চোখের পাতা এক করতেই গড়িয়ে পড়ে জলধারা। পরক্ষণেই দুই হাতে খুব সন্তর্পনে মুছে ফেলে জলধারা। লুকিয়ে ফেলে দুর্বলতা। চোখ মুখ কঠিন করে নিজেকে উপস্থাপনের চেষ্টায় বেশ কিছুটা সময় ব্যয় করে সামনে ঘোরে।
“তুই জিজ্ঞাসা করছিলি না আমার কি হয়েছে? কেনো আমার মণ খারাপ? তবে শোন! আমার মন খারাপের কারন তুই। তুই আমার আশেপাশে থাকলে আমার একটুও ভালোলাগেনা। আমি উড়তে পছন্দ করি, আর তোর কাছে থাকলেই কেমন বন্দী বন্দী লাগে নিজেকে। তোর ছোঁয়া আমার সহ্য হয়না।”
“কেনো এমন অভিনয় করছো নুরপাখি? তুমি কি লক্ষ করেছো আমি আজ তোমাকে তুমি করে বলছি। তুমি সবসময় চাইতে না আমি তোমাকে তুই করে না বলে তুমি বলি! এই দেখো আমি তুমি করে বলছি। এমন কোরোনা প্লীজ। ভীষন ভালোবাসি তোমাকে। আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে খুব তাড়াতাড়ি আমি কিছু একটা করবো, আর তোমার বাড়িতে আমার আব্বু আম্মুকে পাঠাবো। প্লীজ সোনাটা এমন করেনা। একটু শান্ত হও।”
“তুই রাখ তোর ভালোবাসা। কি পেয়েছি আমি তোর ভালবাসায়? আমাকে ওই আইসক্রিম, ফুচকা আর ওই কয়েকটা ছোটো ছোটো কানের দুল, পায়েল ছাড়া তো কিছু দিতে পারিসনি আমাকে। জানিস আমার যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে তার নিজস্ব গাড়ি আছে। আমার সাথে প্রথম দেখা করার দিনই আমাকে একটা সুন্দর শাড়ী সাথে জুয়েলারি গিফট করেছে। আমার সাথে দেখা করার জন্য ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্ট বুক করেছিলো। এসব তোর কাছ থেকে আশা করা যায় নাকি? সো আমি ভেবে নিয়েছি। আমি এই বিয়েটা করে নেবো। রাজরানী হয়ে থাকবো ওই বাড়ীতে। আর তুই তোর মতোই লো স্ট্যান্ডার্ড এর কাউকে খুজে নিস। বিয়ের কার্ড পেয়ে যাবি। আসিস কিন্তু।”
কথাগুলো বলে আর এক মুহূর্তও দাড়ালোনা নূর। সেখানে দাড়ালে জে ধরা পড়ে যেতো। নিজের চোখের পানি গুলোকে যে কিভাবে এতক্ষন আটকে রেখেছিলো সেটা নিজেই জানে। কিছুতেই সেগুলোকে আদিত্যকে দেখানো যাবেনা তাইতো তারাহুরো করে চলে এলো সেখান থেকে।
আদিত্য এক দৃষ্টিতে নূরের চলে যাওয়া দেখছে। দেখছে তার আপন মানুষকে পর হতে, তার ভালোবাসাকে হারিয়ে যেতে। কোনো এক বড়োলোকের টাকা এসে ছিনিয়ে নিয়েছে তার ভালোবাসাকে। ছিনিয়ে নিয়েছে তার সুখ, তার খুশি, তার আনন্দ। তার মুখের হাসিটুকুও কেড়ে নিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে তার নূরপাখিকে। আজ নিজের অজান্তেই অশ্রুধারা গাল পেরিয়ে চিবুক ছুঁয়েছে। শুষ্ক বুকটা একটু ভিজিয়ে দেওয়ার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে তারা। যে শূন্যতা বুকের ভেতরের তা কি আদৌ উপরের আদ্রতায় কাজ হবে?
কলেজে গিয়ে অনেক খোঁজাখুঁজির পরও দেখা মিললোনা নূর বা আদিত্যর। খোঁজাখুঁজির শেষ পর্বে অরুনিকা আলেয়ার হাত ধরে চলে গেলো ক্লাসরুমে। এদের খুঁজতে গিয়ে আজ না ক্লাস মিস হয়ে যায় সেই ভয়ে। আজকে প্রথম ক্লাসটা আদাভানের তাই একদম শেষ সারির কোনার দিকে চুপচাপ বসে আছে অরুনিকা। আজকে এই ক্ষে*পা বাঘের সামনে কোনোমতেই পড়তে চায়না সে। নাজানি কিসের রাগ কিসের উপর দিয়ে তোলে। আলেয়াকেও নিজের পাশে বসতে দেয়নি অরুনিকা। যদি আলেয়াকে দেখে তার খোঁজ পেয়ে যায় সেই ভয়ে। আলেয়া বসেছে মাঝামাঝির দিকের একটা বেঞ্চে। স্যার আসবে তার ঠিক কিছুক্ষন আগে পাশে কারোর অস্তিত্ব অনুভব করে ঘাড় ঘুরিয়ে পূরবকে দেখে বেশ খুশি হয়ে যায় অরুনিকা। কলেজে আসার প্রথম দিনই পরিচিত হয়েছিলো পূরবের সাথে। মূলত পাশাপাশি বসেছিলো সেই সূত্রেই দুজনের মাঝে বেশ ভাববিনিময় ঘটেছিলো। তারপর মাঝে মাঝেই কথা হতো দেখা হলে দুজনের। কিন্তু হটাত করেই বেশ এক মাস যাবত আর দেখা হয়নি তাদের। খুব কাছের ফ্রেন্ড না হওয়ায় অরুনিকাও ততোটা গুরুত্ব দেয়নি ব্যাপারটাতে। তবে আবারো অনেকদিন পর পূরবকে দেখে বেশ খুশি হয়ে যায়। কথায় কথায় জানতে পারে এতদিন পুরবের মা অসুস্থ থাকায় সে আস্তে পারেনি কলেজ। সাথে এতদিনের নোটসও কালেক্ট করা নিয়ে বেশ চিন্তিত।
“আরে পূরব শোন, এত টেনশন নেওয়ার কি আছে? আমার কাছ থেকে সব নোটস পেয়ে যাবি। এক কাজ করিস ক্লাস শেষে লাইব্রেরীতে চলে আসিস। ওখানেই কথা বলবো এই নিয়ে।”
দুজনের কথা বলার মাঝে ক্লাসে এসে উপস্থিত হয় আদাভান। সবাই উঠে দাঁড়িয়ে তাকে অভর্থনা জানলেও অরুনিকা চুপ করে ঘাপটি মেরে বসে আছে। আদাভান ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেও কিছুই বললোনা। শুধু একটু মুচকি হেঁসে নিজের মতোই ক্লাস শুরু করলো।
অরুনিকা আর পূরব লাইব্রেরিতে বসে কিছু একটা ডিসকাস করছিলো। দুজনে এমন ভাবে বসেছে যে লাইব্রেরির গেট থেকে কেউ ঢুকলে শুধুই পূরবকেই পিছন থেকে দেখতে পাবে আর অরুনিকার জামার কিছুটা অংশ। দেখে মনে হবে দুজন দুজনের ভীষণ কাছে বসে আছে। একটা বই নেওয়ার জন্য লাইব্রেরীতে এসে এই দৃশ্য দেখে আদাভানের মেজাজ গরম হয়ে যায়। অরুনিকাকে কারোর সাথে এতটা কাছে দেখতে হবে সেটা কখনও কল্পনাও করেনি সে। চোখ দুটো ভীষণ জ্বলছে তার। একবার ভাবলো দুজনের সামনে গিয়ে চমকে দেবে। কিন্তু পরক্ষনেই অভিমানে বুকটা ভারী হয়ে গেলো। মনে পড়ে গেলো বিয়ের প্রথম দিনে অরুনিকার কথাগুলো।
আদাভানের স্পর্শে যে অরুনিকার ঘৃণা হয় সেদিন নিজের মুখেই স্বীকার করেছিলো অরুনিকা। অরুনিকার মনে পাহাড় সমান ঘৃণা তার জন্য। অথচ বাকি সবাই তার মণের অনেক কাছের। কীভাবে পারলো বিবাহিতা হয়েও অন্য পুরুষের এতটা কাছে যেতে অরুনিকা? অবশ্য অরুনিকা তো এই বিয়েটাই মানেনা। আমার জন্যই তো ও ওর পরিবার হারিয়েছে। আমি কথা দিচ্ছি অরুনিকা একদিন তোমার পরিবার তোমাকে ফিরিয়ে দেবো। তোমার মন থেকে আমার জন্য ঘৃণা সরিয়ে ভালোবাসার বীজ বপন করে দেবো। সব কিছু দেবো তোমাকে। শুধু এই আমি টা ছাড়া। পুরো দুনিয়া থাকবে তোমার কাছে কিন্তু আমি থাকবোনা। কারণ #আমার_অভিমান_তোমাকে_নিয়ে। এভাবেই মনে একরাশ অভিমান আর মুখে তাচ্ছিল্য ভরা হাসি নিয়েই বেরিয়ে গেলো আদাভান লাইব্রেরি থেকে।
চলবে?
#Fiza Siddique