আমায় ডেকো অপরাহ্নে পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0
1071

#আমায়_ডেকো_অপরাহ্নে
#আকাঙ্ক্ষা_আহনাফ_স্নেহা
#অন্তিম_পর্ব

কাকভেজা অপরাহ্নে ভিজে একাকার আমি,অনুভ্রর থেকে লিচুর ঝুড়িটা হাতে নিলাম। সে আমার বেগুনি রঙের ছাতা মেলে দিতে গিয়ে বললো, ‘ দাদাজান ফলগুলো দিয়ে পাঠিয়েছেন। আর কেউ না গেলে আপনার যদি ইচ্ছে হয় আমার সাথে যেতে বলেছেন ময়মনসিংহ।’ শাড়ির কুচি মুঠোয় নিয়ে এক আঙ্গুলে পাঞ্জাবির ব্যাগটা ধরে রাখলাম। তার দিকে হেসে বললাম ‘ দাদাজান ভালো আছেন?’

‘ আপনার কথা সবসময় বলে আপনার চিঠি আজকাল আমাকে দিয়ে পড়ায়। উনি চোখে ইদানিং কম দেখতে পান, মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে ডাক দিয়ে বলেন,অনু এদিকে আয় তো। চিঠিটা একটু পড়তো দাদুভাই।’

অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম ‘ আপনি বুঝি অসুন্দর হাতের লিখা গুলো পড়েন?’

অনুভ্র ছাতা নিয়ে আমার কাছে আসলো,আমরা একই ছাতার নিচে। সে ইট পাথরের শহরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। আমি মনে মনে তাকে একই প্রশ্ন বারংবার করছিলাম ‘আমাকে মনে পড়ে?’ ভাবনার ভিতরেই আমি পড়ে যাচ্ছিলাম পা পিছলে সে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখলো কিয়ৎক্ষণ। পাঞ্জাবিটা পড়ে গেলো নিচে, আমি তার হাত ছেড়ে পাঞ্জাবিটা তুললাম। বুকের মাঝে ব্যাগটা নিয়ে কাদা মুছার চেষ্টা করতেই, উনি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন
‘ খুউউব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন এই ব্যাগে তখন থেকেই লক্ষ্য করছি।’

‘ হু!’
______________________________

বাড়ির কাছে আসতেই গেইট খুলতে যাব এমন সময় লক্ষ্য করলাম উনি নেম প্লেটটা যত্ন করে ছুঁয়ে দেখছেন। আমাকে দেখে হাতটা সরিয়ে ফেললেন। বাড়ির ভেতরে পা রাখতেই মার সাথে অনুভ্রর পরিচয় করিয়ে দিলাম। উনার কণ্ঠ শুনে মা বিষ্ময় লুকিয়ে রাখা কিশোরীর মতো জিজ্ঞেস করলো ‘ বাবা, তুমি কী গান গাও?’ উনি হয়ত মায়ের সন্তুষ্টি ধরে রাখতেই মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বললেন ‘ মাঝে মাঝে গাওয়া হয়।’

মা ফ্ল্যাক্স থেকে চা দিতে দিতে হেসে বললেন ‘ আমাদের চিত্রাও গাইতে পারে। গতবছর স্কুলে রবীন্দ্র সংগীতশিল্পীরা একটা আয়োজন করেছিলে। আমার মেয়ে ফাইনাল রাউন্ডে মনোনীত হয়েছিল। তারপর কী হলো জানো? আগের দিন রাতে বৃষ্টিতে ভিজে ওর গলা বসে গেলো। এতো বড় আয়োজনে ওর আর যাওয়া হলো না। আচ্ছা বাবা, তোমার পরিবারে কে কে আছেন?

‘ আম্মা দুই বছর আগে মারা গিয়েছে, এখন আব্বা আছেন,ফুফু, আর ক্লাস এইটে পড়ুয়া একটা বোন আছে।’

মা আগ্রহ নিয়ে অনুভ্রর সাথে কথা বলছে। আমি এখান থেকে চলেই যাচ্ছিলাম, ভেজা কাপড় পাল্টাতে হবে।চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে ফ্লোরে। আবার জ্বর বাঁধবে শরীরে, চায়ের কাপ হাতে নিয়ে পা বাড়ালাম। এমন সময় মা জিজ্ঞেস করলো ‘ তুই জানতি ও যে আজকে আসবে?’

আশ্চর্য আমি কীভাবে জানবো,মার কী ধারণা এইজন্য সেজেগুজে বেড়িয়েছি বৃষ্টির মধ্যে। তারপর প্রেমিকের জন্য অপেক্ষা করেছি। আমি প্রেমে ডুবুডুবু অবস্থায় আছি। মনে মনে বলতে বলতেই আবার লজ্জা লাগছিল সত্যিই তো প্রেমে তো পড়েছি। কিন্তু আমি জানতাম না আজ মানুষটা দেখা দিবে। আমি মাথা নাড়িয়ে না বললাম মাকে, আমার ঘরে সিঁড়ি বেয়ে চলে এলাম। ঘরে এসে গোসল করে আয়নার সামনে বসে রইলাম। সারা বাড়িতে মায়ের হাতে রান্নার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। মা অবিকল নানির হাতের রান্নার মত, আগে গ্রামে বিয়ে শাদী হলে আগে নানিকে নিয়ে যেতো। মা তখন নানির থেকেই রান্নাটা শিখে নিয়েছে,বাবার কাছে আগে অনেকেই বাড়িতে প্রাইভেট পড়তে আসলে। মা তাদের বিভিন্ন পদের রান্না করে খাওয়াতো। একসময় বাবার এক ছাত্রী নাম মরিয়ম, উনি মায়ের কাছে কোর্স করে রান্নার। মরিয়মের বিয়ের সময় মা বাবুর্চিকে বলে কয়ে রান্না করিয়েছেন। সবাই হাতের আঙ্গুল চেটে খেয়েছে। আমার ধারণা অনুভ্র সাহেব সিগারেট খাওয়ার জন্য হাঁসফাঁস করছেন। আমি ড্রয়ারে এক প্যাকেট সিগারেট, ছোট মামা তার সুইজারল্যান্ড ফেরত বন্ধুর থেকে চমৎকার একটি দেশলাই উপহার পেয়েছেন। সেটা আমি রেখে দিয়েছি আমার কাছে।
.

.

.

খাওয়ার টেবিলে বাবা অনুভ্রকে দেখে খুশি হয়েছেন। খাওয়ার টেবিলে গরু গোশত খেতে গিয়ে ঝালে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছে। পানি ঢালতে গিয়ে অনুভ্র সাহেবের বুকের বা’পাশ ভিজিয়ে ফেলেছি। রাতে সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর বাগানে হাঁটতে এলাম, রাস্তার ঐ পাশে একসাথে অনেক গুলো কদমফুল গাছ সেখানে গুচ্ছ গুচ্ছ কদম ফুটে আছে। গন্ধ মৌ মৌ করছে। আমি ভেজা ঘাসে বসে তিথির কথা ভাবছিলাম। ওরা কদিন পরেই চলে যাবে। বাবা তিথির বাবাকে নিজে গিয়ে বলেছিলেন আমাদের বাড়ির রুম ফাঁকা আছে বড় ভাই হিসেবে ছোট ভাই ভাইয়ের বাড়িতে থাকতেই পারে। তিথির বাবা শুধু হেসে বলেছিলেন ‘ যা বলেছেন ভাই,তাতেই আলহামদুলিল্লাহ। নিজের আপন ভাইও এমন করে বলে না। আমার তিথি পড়াশোনা করলে তাহলে হয়তো আপনার বাড়িতে রেখে যেতাম। কিন্তু মেয়েটার এই অবস্থায়।‌ সমাজের মানুষের কথা প্রতিনিয়ত শুনতে হচ্ছে।’

‘ এতো রাতে রূপবতী মেয়েরা চুল ছেড়ে হাঁটাহাঁটি করা ভালো না কিন্তু। মন খারাপ?’

অনুভ্র আমার পিছনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন। আমি তার দিকে তাকিয়ে রইলাম,টলমলে চোখ লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করলাম।
সে আমার পাশে বসতে বসতে বললো ‘ আমারো মন খারাপ,হাসফাস লাগছে।’

আমি মুচকি হেসে বললাম একটু দাঁড়ান আমি আসছি। ঘরে ফিরে পাঞ্জাবিটা আর সিগারেটের প্যাকেট, লাইটারটা নিলাম। বুকের হৃদস্পন্দন ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। পা টিপে টিপে বাহিরে এসে দেখলাম অনুভ্র বাগান বিলাস গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি বাম হাতে পাঞ্জাবিটা পিছনে লুকিয়ে রাখলাম। ডান হাত দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিলাম।
‘ নিন এটা আপনার জন্য!’

উনি হাত বাড়িয়ে নিলেন ল্যাম্পপোস্টের আলোয় দেখলাম সে বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে,তাকে আমি পুরোপুরি চিনেছি এই বলে? সে হয়তো জানে না ভালোবাসা বাসির জন্য অনন্তকালের দরকার নেই। একদিনই যথেষ্ট। এটা অনেক গুনীজনও বলে গিয়েছেন। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ‘ ধন্যবাদ চিত্রলেখা! এখন ধরাই এটা?’

অনুভ্র সিগারেট বের করে ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরেছে। আমি তাকে আরেকটু চমকে দিতে লাইটারটা জ্বালিয়ে ধরলাম তার সামনে। সে সিগারেট ঠোঁট থেকে দুই আঙুলের মাঝে চেপে ধরলো। সে সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছে মাথা উপরের দিকে তুলে। আমি বাগান বিলাস গাছটা ধরে নাড়া দিতেই ঝড়ে যাওয়া ফুলের পাপড়ি গুলো উনার গায়ে পড়তে শুরু করলো। কয়েকটা পাপড়ি কপালে লেগে রইলো। উনি আমার দিকে তাকিয়ে থাকতেই মাথা নুইয়ে ফেললাম। ‘ আপনার হাতে ওটা কী?’

আমি কাঁপা কাঁপা হাতে উনার দিকে পাঞ্জাবি এগিয়ে দিয়ে বললাম ‘ একটা পাঞ্জাবি আজ এইজন্যই নিউমার্কেট গেলাম। এটা আপনার জন্য, এমনিতেই কিনেছি। কোনো কারণ নেই।’

আমার বাড়িয়ে দেওয়া বা’হাতে ছুঁয়ে পাঞ্জাবিটা নিতে নিতে বললেন ‘ আমার জন্য?’

‘ হু,সাদা পাঞ্জাবি। এটা আমার প্রিয় রং’

‘ কোনো কারণ না থাকাই ভালো, এমনিতেই এতকিছু আমার জন্য? দাদাজানের চিঠিতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমার কথা জানতে চাওয়া। সবকিছু এমনিতেই?’

‘হু।’

‘ প্রেমে পড়া ভালো, কিন্তু আরেক নারীর শখের পুরুষের প্রেমে পড়া ভালো না।

‘ আ..আরেক নারীর পুরুষ?’

উনি মাথা নেড়ে হেসে সম্মতি দিলেন।

ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বললাম ‘ আপনি কী বলছেন এসব?’
____________________________

সে আমায় ছেড়ে ঐদিন রাতেই চলে গিয়েছে ঠিক প্রথম দিনের মতোই। আমি মুখ ফুটে কিছু বলে উঠতে পারিনি শুধু মনে হয়েছিল ভিতর থেকে দম আটকে আছে।তার প্রস্থানে বুকের বা পাশে হৃদয়ের রুমালে বাসী বকুলের গন্ধ পুড়ে পুড়ে বিচ্ছিরি এক গন্ধ বের হচ্ছে। তার ছুঁয়ে দেওয়া বা হাত দিয়ে ঠোঁট চেপে ফুঁপিয়ে কেঁদে অস্থির হয়েছি। কেনো সে আমার চোখে দেখলো না? প্রবল জ্বর নিয়ে ঘরে এসে শুয়ে ‌নির্ঘুম রাত বিষাদ দিয়ে কাটিয়ে ফেললাম। নতুন সকাল হলো,ডায়েরী হাত দিতে গিয়ে অপরিচিত এক হাতের লিখা দেখলাম সাথে শুকনো বকুলের মালা।

আমার বকুলের সুরভী,
তোমার নামের মাঝেই আমার রোজ দেখা নক্ষত্রের উজ্জ্বল আলো দেখলাম। মানুষ শুকতারা দেখে আর আমি দেখি আমার জানালা দিয়ে একা একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রকে। তোমার দাদাজানের মুখে অনেক কথা শুনেছি তোমার। তোমার নামটা শুনলেই ভালো লাগতো। গত মাসে আমি গোপনে দুইবার এই বাড়ির প্রাঙ্গণে এসেছিলাম এসে দেখলাম রাত জেগে একটি মেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। তখন জানতে পারলাম আমি তার বুকে পুষে রাখা একান্ত অস্থির ব্যাকুলতা। একটি অসম্ভব সৌন্দর্য দিয়ে ঘেরা মুখশ্রী, হরণী চোখ, অসম্ভব সুন্দর হাসি। ঠোঁটের নিচে তিল যেখানে হাসলেই ছোট্ট একটি গর্ত হয়। যে মেয়েটা এক মাসেই তিনশো পৃষ্ঠা আমায় নিয়ে লিখেছে। আমি তাকে মনে রেখেছি। আজ নিউমার্কেটে তার সাথে দেখা হলো সে নীল অপরাজিতা ফুলের মতো উদয় হলো আমার চোখে। চিঠি লিখছি অনেক ঝুঁকি নিয়ে তার মা পাশের রুমেই কাঁথা সেলাই করছে। আমার হাতে সোহাগী ট্রেনের টিকিট। আমি আজ ছুতো নিয়ে এসেছিলাম তাকে একবার দেখার জন্য। মন খারাপ হলে আমায় ডেকো একা অপরাহ্নে। আমি আসব…’
.

.

তার সাথে আমি কথা বাড়িয়ে এগিয়ে যাইনি ভুলেও যাইনি। আমি অস্থিরতা বুকে চেপে রেখে দিন কাটিয়ে দিচ্ছি। হেসে সবার কথায় মনোনিবেশ করছি। নিয়ম করে খাচ্ছি ঘুমোচ্ছি। তিথিকে হুটহাট টেলিফোন দিয়ে কথা বলছি। বৃষ্টি আসলে কানে বালিশ গুজে ক্ষোভ প্রকাশ করি আকাশের সাথে। এই বৃষ্টিতে তাহারে বেশি মনে পড়ে এই যা আরকি। দাদাজানের কাছে জেনেশুনেই একটা চিঠি পাঠালাম ‘ আমার বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে, আপনি আসা অত্যাবশক।’
_____________________________

তিথিকে টেলিফোন করেই বাড়ি বাড়ি ফেরার পথে দেখলাম,গায়ে শুভ্র পাঞ্জাবি সেই চেনা অবয়ব অস্থির হয়ে হাঁটাহাঁটি করছে রাস্তায়। দেয়ালে চায়ের কাপ রাখা, পায়ের নিচে পিষে ফেলা অনেক গুলো সিগারেটের ফিল্টার। আমি যথেষ্ট স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বললাম ‘ বাহিরে দাঁড়িয়ে কেনো, আসুন বাড়ির ভিতরে আসুন।’ সে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো অবস্থা। তার শক্তপোক্ত হাত দিয়ে এমন ভাবে জড়িয়ে ধরলো যে, বুকের ভিতর অভিমানের পাহাড় খসে পড়তে শুরু করলাম। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম, তার মোহিত কণ্ঠস্বর ‘ আমায় মেরে ফেলতে চাও? ধূমপান মৃত্যুর কারণ এটা আগে জানতাম। আজ অবগত হলাম চিত্রলেখা ছাড়া আমার জীবন মৃত্যুর কারণ। আমি গুছিয়ে কথা বলতে পারছি না। তুমি বুঝতে পারছো তো?’

‘ অনুভ্র, আমাকে ভালোবাসেন?’

~ সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে