আফিম বড্ড নেশালো পর্ব-০৩

0
4199

#আফিম_বড্ড_নেশালো
পর্বঃ০৩
লেখিকাঃমাহযাবীন

-মা আমার এই চাকরি টা প্রয়োজন।বোঝার চেষ্টা কেনো করছো না?(নাফিয়া)
-কিছু বুঝতে চাইছি না আমি।এ চাকরি টি তুমি করছো না এটিই আমার শেষ সিদ্ধান্ত।
-তোমার সিদ্ধান্তকে আমি সম্মান করি কিন্তু তুমি শুধুই এক তরফা ভাবছো মা!তুমি শুধুই আমার সেফটির কথা ভাবছো কিন্তু এটি একবারও ভাবছো না যে এ চাকরিটি করলে আমাদের বিপদ কতোটা কেটে যাবে।থাকা,খাওয়া ফ্রীতে সেই সাথে মাস গেলে ২৫ হাজার টাকা!আর আমার কাজ টা কি?শুধু একজন বৃদ্ধার সাথে সারাদিন থাকা এবং তার ঔষধ থেকে শুরু করে তার যাবতীয় সব দিকে খেয়াল করা।ভাবতে পারছো এই প্রস্তাবটি আমাদের জন্য কতোটা লাভজনক?
-বোকার মতো কথা বলছো নাফিয়া।শুধু মাত্র একজন বৃদ্ধার দেখাশোনা করবা সেজন্যে মাস গেলে ২৫ হাজার টাকা?আবার শর্ত রাতেও থাকতে হবে!এটা কোনো ফন্দিও তো হতে পারে।
-বৃদ্ধ মানুষ!হুটহাট রাতেও অসুস্থ হয়ে পরতে পারে সেজন্যই হয়তো ঔ শর্তটি।আর ওরা অনেক বড়লোক মা!যে লোকটি কথা বলতে এসেছিলেন সে তাদের কর্মচারী কিন্তু সেই কর্মচারীকে দেখতেই লাখো পতি মনে হচ্ছিল।এখন তুমিই ভাবো,ওদের কাছে মাসে ২৫ হাজার কোনো ব্যাপার?
-ওরা তোমায় কোথায় পেলো?আর এই প্রস্তাব তোমাকেই কেনো দিলো?
-লোকটা বলেছিলো আমার কোনো এক স্টুডেন্টের প্যারেন্টস তাদের আমাকে এ কাজটি দেওয়ার জন্যে পরামর্শ দিয়েছে।
-তোমার স্কুলের চাকরিটার কি হবে?
-তা অব্যাহত থাকবে।আমি কথা বলে নিয়েছি লোকটির সাথে।স্কুলে আমার ৩ টি ক্লাস পরাপর আছে যা দের ঘন্টার ব্যাপার এতোটুকু ছাড় দিবেন তারা।
-তাও আমার মন সায় দিচ্ছে না।
-উফ মা!!
বলেই নাফিয়া তার মাকে জড়িয়ে ধরে।কন্ঠে একটু আহ্লাদীভাব এনে বলে ওঠে,
-মা প্লিজ না করো না।আমি সেফ থাকবো ইন শাহ আল্লাহ।আর তুমি নাহয় ৩ বেলা নিয়ম করে কল দিও।আর আল্লাহ না করুক কোনো সমস্যা হলে ব্যাস ৩৫/৪০ মিনিটের পথ।রাজি হয়ে যাও না?
-আচ্ছা করো যা ইচ্ছা।আমার কথা কি আর কেউ দাম দেয়!বাবাসহ মেয়ে দুটো ও তাই ই করবে যা তাদের মন চাবে।(বলতে বলতেই নাফিয়ার বাহুবন্ধনী হতে নিজেকে ছাড়িয়ে নাফিয়ার কক্ষ ত্যাগ করেন নয়না বেগম)

!!
সকাল সকাল নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস ব্যাগ ভর্তি করে নিজে প্রস্তুত হয়ে নেয় নাফিয়া।অতঃপর পরিবারের সকলের থেকে বিদায় নিয়ে রওয়ানা হয় নিজের নতুন কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে।
বিশাল জায়গা নিয়ে ঘেরাও করা একটি তিন তলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে নাফিয়া।মুগ্ধ হয়ে বাড়িটি দেখছে সে।সাদা এবং কমলা রং এর বাড়ি টির চারপাশ উঁচু দেওয়ালে ঘেরা।দেওয়ালের ভেতরের দিকটা বিভিন্ন ফুল গাছ দ্বারা সজ্জিত।মেইন গেইটি যেমন বড় তেমন এর উপর করা কারুকাজগুলোও আকর্ষণীয়।মুগ্ধতা নিয়ে নাফিয়া বাড়ির সদর দরজার বেল বাজাতেই একটি ২১/২২ বছরের মেয়ে দরজা খুলে বলে ওঠে,
-আসসালামু আলাইকুম ম্যাম।কাকে চাই?
-জ্বি আমাকে এ বাড়ির একজন বুজুর্গ ব্যক্তির পরিচর্যার দ্বায়িত্বে নিয়োগ করা হয়েছে।
-ওহ ভেতরে আসুন।
মেয়েটি নাফিয়াকে সোফার দিকে ইঙ্গিত করে বলে ওঠে,
-এখানে বসুন।আমি ম্যামকে দেকে দিচ্ছি।
-জ্বি।
মেয়েটি যেতেই নাফিয়া পুরো হল রুমটিতে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়।একটি বেশ বড় সাইজের টিভি দেওয়ালে লাগানো।সেই সাথে আরো অনেক আকর্ষনীয় আসবাবপত্র দিয়ে পুরো হল রুমটি সাজানো।এসব দেখার মাঝেই আফিমের মা সানিয়া বেগম এসে হাজির হন।তিনি নাফির সামনের সোফায় বসে যেই কিছু বলতে যাবে ওমনি কারো কন্ঠস্বর ভেসে আসে,
-হোয়াট’স ইউর নেম?
কন্ঠস্বরটি কানে আসতেই চোখজোড়া রসগোল্লার ন্যায় বড় বড় হয়ে যায় নাফিয়ার।সে নিজের জায়গায় একদম স্থির হয়ে থাকে।আফিম সিড়ি দিয়ে নামতে নামতেই প্রশ্নটি করেছিলো।এখন তার মায়ের পাশে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আফিম বলে ওঠে,
-কি হয়েছে? শুনতে পাওনি আমার প্রশ্ন?
আফিমকে নিজের সামনে দেখে একই ভাবে রসগোল্লার ন্যায় চোখ করে তাকিয়ে আছে নাফিয়া।সে এতোটাই অবাক হয়েছে যে বুঝে উঠতে পারছে না তার আসলে কি প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিৎ।নাফিয়ার এমন অস্বাভাবিক আচরণটা সানিয়া বেগমের বোধগম্য হয় না।তিনি কিছু বলতেই যাবে ওমনি আফিম বলে ওঠে,
-মম,তুমি একটু দাদীকে নিয়ে এসো আমি ততক্ষণে ওর সাথে কথা বলছি।
সানিয়া বেগমও আর কথা বাড়ান না।চলে গেলেন তার শাশুড়ি মাকে নিয়ে আসতে।সানিয়া বেগম যেতেই আফিম নাফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-হোয়াই আর ইউ স্টেয়ারিং (staring) লাইক দিস?(রাগান্বিত ও শান্ত কন্ঠে)
-আআআপনি এএএখাননে?
-আমারই বাসা।আর হ্যা খবরদার!যদি ভুলেও এই চাকরিটি না করার কথা চিন্তা করো তবে বেশ বড় ভুল করে বসবে।কারণ তোমার ঔ স্কুলের চাকরি যার টাকা দিয়ে তুমি চলো সেই চাকরিটি তোমার হাত ছাড়া করতে আমার জাস্ট একটা আদেশই যথেষ্ট।এছাড়াও তোমার এবং তোমার পরিবারের সদস্যদের জীবন নরক বানিয়ে দেওয়াও তেমন কোনো কঠিন কাজ নয় আমার জন্যে।
নাফিয়া বেশ ভালোই বুঝতে পারছে যে সে খুব বাজেভাবে ফেঁসে গিয়েছে।সে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে আফিমকে বলে ওঠে,
-প্লিজ আমায় ক্ষমা করে দিন সেই অপরাধ টার জন্যে! আমি সত্যিই ইচ্ছে করে করি..
নাফিয়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই আফিম বলে ওঠে,
-শাট আপ মরন।মাই মম এন্ড গ্রানী মাস্ট বি কামিং সুন।বিহেভ নরমাল!
সাথে সাথেই নাফিয়া নিজেকে ঠিকঠাক করে নেয় স্বাভাবিক না হয়ে ও স্বাভাবিক আচরণ করার জন্যে।
তার একটু পরেই আফিমের মা ও দাদী এসে পরেন।দু’জনে বসে প্রথমে নাফিয়ার সম্পর্কে জানতে চায় এবং পরে সারাদিনে দাদীর কি কি ঔষধ আছে সেগুলো এবং নাফিয়ার কাজ বুঝিয়ে দেন।কথার পর্ব চলাকালীনই চা-নাস্তাও সেরে নেওয়া হয়।সব শেষে,সেই মেয়েটিকে ডেকে বলা হয় নাফিয়াকে গেস্ট রুম কোথায় তা দেখিয়ে দিতে।
নাফিয়া গেস্ট রুমটায় প্রবেশ করে দেখে এ রুমটিও সুন্দর,বেশ পরিপাটি।কিন্তু এখন চেয়েও মুগ্ধ হতে পারছে না সে।কারণ তার মধ্যে মুগ্ধতার ‘ম’ ও কাজ করছে না,মন-মস্তিষ্ক সব জায়গায় আফিম নামক বড্ড ভয়ংকর প্রাণীটি ঘুরছে।যা হচ্ছে তা হতে দেওয়া ছাড়া যেহেতু আর কোনো উপায় নেই তাই নাফিয়া বেশি না ভেবে নিজের পরিহিত বোরকা খুলে ফ্রেশ হয়ে নেয়।অতঃপর তৈরি হয়ে সে অগ্রসর হয় দাদীর রুমের দিকে।পথে আফিমের চোখে পরে যায় নাফিয়া।নাফিয়া একটি হাতা লম্বা লং ড্রেস পরেছে সেই সাথে এমনভাবে ওড়না পরেছে যে মাথার চুল থেকে কোমড় অব্দি পুরোটাই ঢেকে আছে।না চাইতেও নাফিয়ার এই শালীনতাটি ভালো লাগে আফিমের।এক পলক দেখেই চোখ সরিয়ে নেয় আফিম এবং অগ্রসর হয় সদর দরজার দিকে অফিসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।আফিন দরজার কাছাকাছি যেতেই তার দিকে চোখ পরে নাফিয়ার। আফিমকে দেখেই নাফিয়া মনে মনে বলে ওঠে,
“যতই ভয়ংকর প্রাণী হও না কেন মিঃআফিম ইবনান আমিও এবার তোমায় দেখাবো আমি কি জিনিস।”

!!
আফিমের অফিসে যাওয়ার পর দিয়ে নিশ্চিতে দাদীর সাথে সময় পার করেছে নাফিয়া।প্রথম দিনেই দাদীর সাথে বেশ গল্প জমে তার।তারপর দুপুরে দাদীকে সময় মতো ঔষুধ খাওয়ানো,খাবার খাওয়ানো,বিকেলে দাদীর সাথে বাড়ির সামনের বিশাল বড় বাগান টায় হাঁটা সব কিছুই খুব উপভোগ করেছে নাফিয়া।তার এখানে এসে ভালোই লাগছে শুধু আফসোস সেই ভয়ংকর প্রাণীটিকে নিয়ে!
সন্ধ্যায় দাদীকে সোফায় বসিয়ে দাদীর ঘাড় ম্যাসাজ করে দিচ্ছিলো নাফিয়া ঠিক এমন সময় আফিম এসে হাজির হয়।এক নজর নাফিয়ার দিকে তাকিয়ে আফিম সোজা নিজের কক্ষে চলে যায়।আফিমকে দেখার পর থেকেই ভয়ে নাফিয়ার হৃৎস্পন্দনের গতি বেড়ে চলছে।না জানি কি করে!
কিছুটা সময় অতিক্রম হতেই নিচে নেমে আসে আফিম।সোফায় আয়েশ করে বসে নাফিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-ইউর নেম?শেখ নাফিয়া রাইট?
-জ্বি।
-ব্রিং আ কাপ অফ কফি ফর মি।
-আমি?
-তো?
-আচ্ছা আনছি।
বলে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে নাফিয়া মনে মনে বলে ভাবে,
“এই কাজ তো আমার না তাহলে আমি কেনো করছি! করবো নাকি করবো না?ধুর না করলে আবার না জানি কি শাস্তি দেয় তার চেয়ে এক কাপ কফি বানালে ক্ষতি নেই।”
কফি বানিয়ে আফিমের কাছে এসে কফির মগটি তার দিকে এগিয়ে দেয় নাফিয়া।আফিম কফির মগটি নেওয়ার সময় হুট করে মগটি তার হাত থেকে পিছলে পড়ে যায় ফলে গরম কফি ছিটকে গিয়ে পড়ে নাফিয়ার পায়ের উপর।সোফাতেই বসে ছিলেন দাদী।নাফিয়ার পায়ে গরম কফি পরতে দেখে তিনি দ্রুত উঠে টি-টেবিলে রাখা পানির জগ হতে কিছু পানি নাফিয়ার পায়ে ঢেলে দিলেন।নাফিয়ার পা টা জ্বলছে,সে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে সহ্য করছে।দাদী নাফিয়াকে আফিমের পাশে বসিয়ে একজন গৃহ পরিচারিকাকে ডেকে মলম আনতে বললেন।মলম আনা হলে তা নাফিয়ার পায়ে লাগাবার কিছু টা সময় পরই জ্বলা টা কমে যায়।পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতেই দাদী আফিমকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে,
-তোমার ভুলে মেয়েটা ব্যথা পেলো তাকে একটি স্যরি পর্যন্ত না বলে তুমি পত্রিকায় মুখ গুঁজে আছো?এ কেমন ভদ্রতা?
-আই এম স্যরি মিস.শেখ।(আফিম)
আফিমের দিকে তাকাতেই নাফিয়া দেখে আফিমের ঠোঁটে বাঁকা হাসি যা দাদীর নজরে পরেনি।আফিমের এ হাসিটির অর্থই হচ্ছে কাজটি আফিম ইচ্ছাকৃতভাবে করেছে।দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগটি নিয়ন্ত্রণ করে নাফিয়া বলে ওঠে,
-দাদী আমি নিজের রুমে যেতে চাচ্ছি।যাবো?
-হ্যা হ্যা যাও।
নাফিয়া সোফা থেকে উঠে আফিমের সামনে থেকে যাওয়ার সময় ইচ্ছে করে এমন ভাবে আফিমের পায়ের উপর পারা দিলো যেনো এটি অনিচ্ছাকৃত হয়েছে।পায়ে উঁচু জুতো থাকায় আফিমের পা খানিকটা কেটে যায়।পত্রিকা পড়ার মাঝেই ব্যথা অনুভব হওয়ায় “আহহ” শব্দ করে ওঠে আফিম।নাফিয়া চমকে যাওয়ার নাটক করে বলে ওঠে,
-স্যরি স্যরি স্যরি,আমি খেয়াল করিনি।
এদিকে আফিমের দাদী তার আদুরে পোতার পায়ে সামান্য রক্ত দেখে অস্থির হয়ে ওঠেন।এ সবের মাঝে আফিম চোয়াল শক্ত তাকিয়ে থাকে নাফিয়ার দিকে।সে বেশ বুঝতে পারছে নাফিয়া এটি ইচ্ছে করেই করেছে।আফিমের এমন রাগান্বিত চাহনিতে নাফিয়ার হৃৎস্পন্দন থেমে থেমে যাচ্ছে।সে মনে মনে ভাবে,
“আমার হয়তো এই কুমারী অবস্থায়ই মরতে হবে।”

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে