আপন মানুষ পর্ব-০১

0
4289

#আপন_মানুষ
#১ম_পর্ব
#অনন্য_শফিক

ডাক্তারের চেম্বার থেকে একটা সুসংবাদ নিয়ে বাসায় ফিরেছি। আমার শ্বাশুড়ি মাকে গিয়ে বলবো,মা আপনি দাদি হতে চলছেন!
কিন্তু বাসায় গিয়ে এই খবর দেয়ার আগেই শাশুড়ির মুখ থেকে আরেকটি দুঃসংবাদ শুনে আমার পৃথিবী থরথর করে কেঁপে উঠলো। শাশুড়ি মা মুখ শুকনো করে বললেন,’মাগো, তোমার কপাল পোড়ছে!’
আমি অবাক হয়ে বললাম,’কী হয়েছে মা?’
মা কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,’রবিন চলে গেছে!’
‘কোথায় গেছে?’
মা বললেন,’তোমার বান্ধবী অবনীরে নিয়া পালাইছে‌। এতোক্ষণে বোধহয় বিয়ে টিয়েও করে ফেলছে!’
মার মুখ থেকে কথাটা শুনে আমার রাগ পেলো।কারণ তিনি অবনীকে একটুও পছন্দ করেন না। পছন্দ না করার কারণ হলো অবনী আমার এখানে থাকে।ওর মা মারা গিয়েছিলেন তাকে ছোট রেখেই। তারপর ওর বাবাই লালন পালন করে ওকে বড় করেছেন। বছর খানেক হলো ওর বাবাও মারা গিয়েছেন। মেয়ে বড় হলেও বিয়ে দিয়ে যেতে পারেননি। অবনী বিয়ে করেনি।অবনীর ইচ্ছে ছিল সে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হবে। বাবার দুঃখ গুছাবে। তারপর বিয়ে!
কিন্তু ওর বাবা যখন ধুপ করে মারা গেলেন তখন ও অসহায় হয়ে পড়লো।কেউ নাই ওর যে ওকে দেখবে। ওকে একটুখানি আশ্রয় দিবে!ওর বাবার মৃত্যুর দিন ও আমায় জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বলতে লাগলো,’তিশা, আমিও মরে যাবো রে!বিষ খেয়ে মরে যাবো!’
আমি ওর হাতটা উপরে তুলে শক্ত করে নাড়া দিয়ে বললাম,’এসব কী বলছিস অবনী?তুই মরে যাবে কেন? পৃথিবীতে কেউ তো আর চিরদিনের জন্য আসে না। মানুষ মরণশীল। আঙ্কেলের হায়াত শেষ।তাই তিনি মারা গিয়েছেন।তাই বলে তুই মারা যাবি ‌বিষ খাবি এটা কেমন কথা!’

অবনী তখন কেঁদে কেঁদে বললো,’না মরে কী উপায় বল?কার কাছে থাকবো রে আমি?কে আশ্রয় দেবে আমায়?’
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম,’আমি না তোর বন্ধু অবনী?আমায় কী তোর আপন মানুষ মনে হয় না?আমি তোকে আশ্রয় দিবো। আমার কাছে থাকবি তুই!’
অবনী সেদিন কষ্টের ভেতরেই সামান্য হাসতে পেরেছিলো।তার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বুঝতে পেরেছিলাম ও যেন নদীতে তলিয়ে যেতে গিয়ে বাঁচার মতো একটা খড়কুঠো খুঁজে পেলো!

অবনীকে যখন বাসায় নিয়ে এলাম তখন রবিন সবকিছু শুনে বললো,’খুব ভালো করেছো ওকে এনে। আমার তো কোন বোন নাই।আমি একটা বোন পেয়েছি। ‌’
কিন্তু মা বিষয়টা পছন্দ করলেন না। তিনি আমায় আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন,’বউমা, কাজটা তুমি ঠিক করো নাই কিন্তু! নিজের কপালে নিজে কুড়াল মারলা!’
আমি অবাক হয়ে বললাম,’এ কী বলছেন মা?’
মা বললেন,’এটাই সত্যি। স্বামীর বাড়িতে ছোট বোন-বান্ধবীরে পাড় করা আর সতিন ডেকে আনা এক কথা।’
আমি মার কথায় খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।আর এই কথাটাই কেঁদে কেঁদে বলেছিলাম রবিনের কাছে। রবিন শুনে বললো,’মন খারাপ করো না।মার মাথায় একটু ছিট আছে।মা বাবাকেও খারাপ কথা বলতেন। আমার খালারা মার জন্য বাসায় আসতে পারতেন না ‌।মার আশঙ্কা ছিল,খালারা এখানে এলে বাবা তাদের সাথে —‘
আমি রবিনের মুখ চেপে ধরে ফেলেছিলাম।আর বলেছিলাম,’আর বলো না।শুনতে খুব বাজে লাগে এসব। ভাবতেই তো গা গুলিয়ে আসে! মানুষ নিজের স্বামীকে কীভাবে অত অবিশ্বাস করে!’
রবিন মৃদু হেসেছিলো।আর আমার কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলেছিলো,’তিশা, তুমি খুব ভালো!’

এরপর একদিন হঠাৎ করে আমি একটা কাজে বাইরে গিয়েছিলাম। ওখান থেকে ফিরে এলে মা আমায় আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললেন,’বউমা, ঘটনা ভালো না গো মা! ছিঃ ছিঃ ছিঃ!’
আমি অবাক হয়ে বললাম,’কী হয়েছে মা?’
মা বললেন,’অবনীর সাথে রবিন দরজা আটকে কী সব করেছে!’
আমি রেগে গিয়ে মাকে বললাম,’মা, আপনি এমন মানুষ কেন?সব সময় অবনীকে নিয়ে খারাপ খারাপ কথা বলেন?’
মা তখন রাগত স্বরে বললেন,’কারোর ভালো করতে নাই! যেদিন নিজের কপাল পোড়বো তখন বুঝবা!’
আমি মার দিকে তাকিয়ে খুব হেসেছিলাম।কারণ আমি জানতাম মা এসব বানিয়ে বানিয়ে বলে।মার এটা একটা রোগ। সন্দেহ রোগ!

আজকেও যখন মা কথাটা বললেন তখন আমি মৃদু হাসলাম। হেসে বললাম,’মা আপনার বানানো কথা রাখেন আর সুখবরটা শুনেন!’
মা চুপ করে রইলেন।
আমি মাকে জাপটে ধরে বললাম,’মা, আমার পেটে আপনার নাতী!’
মার হাতটা নিয়ে আমার পেটে চেপে ধরলাম।
মা সঙ্গে সঙ্গে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন।আর বললেন,’মা,মাগো, বিশ্বাস করো মা তোমার কপাল পোড়ে গেছে। তোমার অনাগত সন্তানের কপালও পোড়ছে! রবিন সত্যি সত্যি অবনীরে নিয়ে পালিয়ে গেছে!’
আমি অবাক হয়ে মার চোখের দিকে তাকালাম।জলে ভিজে আছে সেই চোখ।
মা তখনও বলছেন,’তোমার কপাল পোড়ে গেছে গো মা!’
আমার তবুও বিশ্বাস হতে চাই না।আমি এসব বিশ্বাস করতে চাই না।অবনীকে যে আমি নিজের বোনের মতো করে দেখি!আর রবিনকে যে নিজের চেয়েও বেশি বিশ্বাস করি!
আমি এবার দৌড়ে গেলাম ঘরে।ডাকলাম অবনীকে।ডাকলাম রবিনকে। ওরা সাড়া দিলো না।কারণ ওরা কেউই ঘরে নাই!
তারপর কম্পিত শরীর নিয়ে টেবিলের উপর তাকাতেই দেখলাম একটা সাদা কাগজ। সেই কাগজের উপর কলমটা রাখা।আমি ধীরে ধীরে টেবিলের কাছে গেলাম। তারপর কাগজটা হাতে নিতেই মনে হলো আমার পায়ের নীচে আর কোন মাটি নেই।এসব কী লিখা এই কাগজে!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে