আপনিময় বিরহ পর্ব-১১+১২

0
1233

#আপনিময় বিরহ (১১)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
__________________

রাতের ডিনার সেড়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে শিশির। অফিসের কিছু কাজ বাকি আছে তা কমপ্লিট করবে। এরমধ্যেই রুমে আসে অনিমা। চোখে মুখে মলিনতার ছাপ। চোখের নিচে কালো দাগ স্পষ্ট। অনিমা এসে শিশিরের সামনে দাঁড়ায়। শিশির ল্যাপটপে মুখ গুজেই বলে,

‘কিছু বলবে?’

অনিমা জবাবে চুপ থাকে। শিশির অনেকক্ষণ পরেও উত্তর না পেয়ে মুখ তুলে তাকায়। অনিমার চোখের কোণে জল দেখে কিছুটা চমকায়। বলে, ‘কি হয়ছে? কান্না করতেছো কেন?’

অনিমা কান্না করা অবস্থাতেই হাসে। চোখ মুছে ভীষণ শীতল কন্ঠে বলে, ‘আপনার কাছে কিছু চাইলে দিবেন শিশির ভাই?’

শিশির এবারও খানিকটা চমকায়। মেয়েটা তো এভাবে বলে না। আজ হঠাৎ কি হলো! শিশিরকে কিছু ভাবতে দেখে অনিমা হেঁসে বলে, ‘অন্যায় কিছুই আবদার করবো।’

শিশির কিছুক্ষণ অনিমার দিকে তাকিয়ে নড়েচড়ে বসে। তারপর বলে, ‘কি চাও?’

অনিমা ভীষণ আকুতির স্বরে বলে, ‘আমাকে একটা বার জড়িয়ে ধরবেন শিশির ভাই?’

শিশির অবাকের শেষ পর্যায়ে। এতোগুলো দিন বাদে অনিমা এমন কিছু চাইবে তা সে কল্পনাই করেনি। তাদের বিয়ের ৬ মাস পার হলেও কখনো এক বিছানায় ঘুমায়নি যথেষ্ট দূরত্ব ছিলো দুজনের। সেখানে আজ অনিমার এমন চাওয়া অবশ্যই ভাবনার বিষয়। শিশিরকে অনেকক্ষণ চুপ থাকতে দেখে অনিমা ধরে আসা গলায় বলে, ‘প্লিজ! শুধু একবার।’

শিশির আর কিছু বললো না। এতদিন পর মেয়েটা কিছু চেয়েছে সে না হয় দিক। তাদের মধ্যেও তো পবিত্র সম্পর্ক অথচ কত কত দূরত্ব। শিশির ল্যাপটপ ছেড়ে উঠে আসে। অনিমার কাছাকাছি দাঁড়াতেই অনিমা ছলছল দৃষ্টিতে তাকায়। শিশির নিজেই কাঁপা কাঁপা হাতে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয় অনিমাকে। অনিমা ভীষণ শক্ত করে আঁকড়ে ধরে তাকে। ঠোঁট চেপে কান্না আটকায় তবুও চোখ থেকে পানি পড়ে শিশিরের টি-শার্ট ভাসিয়ে দেয়। শিশির কিছু বলে না। অনিমা নিজেই একসময় ছেড়ে দেয়। তারপর শিশিরের সামনে দাঁড়িয়ে পা উচু করে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। শিশির কিছু বলতে গিয়েও চুপ থাকে। অনিমা কেমন করে হেঁসে বলে,

‘ধন্যবাদ। এখন আপনি কাজ করুন। আমি আসি!’

বলেই চলে যায়। অনিমার হঠাৎ এহেন আচরণ হজম করতে পারে না শিশির। কি এমন হলো! এতোদিনের সব ঘৃণা উগলে আজ ভালোবাসার ছোঁয়া! কেন? শিশির ভাবতে পারলো না। মাথা চেপে বসে রইলো।

গভীর রাতে ঘুম নেই প্রিয়তা আর তনিমার চোখেও। দুজনেই চুপ করে বসে আছে ব্যালকনিতে। সারাদিন সব কিছু হজম করে থাকলেও এই রাতটা ভীষণ প্যারা দেয়। রাত আসলেই সব স্মৃতি, ক্ষত একসাথে জড়ো হয়। প্রিয়তাকে চুপ করে থাকতে দেখে তনিমা কি মনে করে বলে,

‘একটা গান শোনা তো প্রিয়ু।’

প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে, ‘আমার ঠ্যাকা পড়ছে এতো রাতে তোরে গান শুনাবো!’

‘আরে এমন করিস কেন? শোনা না! প্লিজ প্লিজ প্লিজ।’

প্রিয়তা আর কিছু বলে না। গিটার ছাড়াই গান ধরে,

”তুমি আর তো কারো নও, শুধু আমার
যতো দুরে সরে যাও রবে আমার
স্তব্ধ সময়টাকে ধরে রেখে
স্মৃতির পাতায় শুধু তুমি আমার
কেন আজ এতো একা আমি
আলো হয়ে দুরে তুমি
আলো আলো আমি কখনো খুঁজে পাবো না
চাঁদের আলো তুমি কখনো আমার হবে না
আলো আলো আমি কখনো খুঁজে পাবো না
চাঁদের আলো তুমি কখনো আমার হবে না..’

গান শেষ করতেই তনিমা হাত তালি দিয়ে বলে, ‘বাহ বাহ তোর কাউয়ার মতো গলা দিয়ে এতো সুন্দর গান। যাক ভালোই গেয়েছিস যদিও কাউয়ার কা কা মনে হয়ছে তবুও ঠিক আছে।’

কথা বলতে দেড়ি কিন্তু তনিমার পিঠে মাইর পড়তে দেড়ি না। সামনের বিল্ডিং থেকে পুরোটাই প্রিয়ম দেখলো। চোখ বুজে শ্বাস নিয়ে প্রিয়তার দিকে তাকায়। মেয়েটা কে তার লাগবেই। এই টুনটুনি ছাড়া তার বাঁচাটা অসম্ভব প্রায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে পুরো চাঁদ উঠেছে। চোখ বন্ধ করে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘চাঁদের আলো তুমি কখনো আমার হবে না…’

প্রিয়তা তনিমাকে মাইর দিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আচ্ছা তনু জীবনকে যদি আরেকটা সুযোগ দেয় তাহলে কি খুব ভুল হবে?’

তনিমা তখন পিঠে হাত বুলাতে ব্যস্ত। প্রিয়তার কথায় হাত থেমে যায়। অবাক চোখে বলে, ‘কি বললি? আবার বল!’

প্রিয়তা রাগী চোখে তাকায় তার দিকে। তনিমা আরো একটু এগিয়ে আসে প্রিয়তার কাছে। তারপর কপালে, গালে হাত দিয়ে বলে, ‘তোর শরীর ঠিক আছে বইন?’

প্রিয়তা রাগী কন্ঠে বলে, ‘তোর সাথে সিরিয়াস কথা বলার থেকে কু’ত্তার সাথে বলা ভালো। সর।’

তনিমা হেঁসে বলে, ‘তোর ভাইও কিন্তু কু’ত্তার চেয়ে কম না। যা ওর কাছে গিয়ে সিরিয়াস কথা বল।’

প্রিয়তা জবাবে কিছু বলে না। চোখ বন্ধ করে থাকে। তনিমা প্রিয়তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘অনেকদিন পর ভালো একটা ডিসিশন নিয়েছিস। তা সুযোগটা কাকে দিচ্ছিস?’

প্রিয়তা সামনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তোর কি মনে হয়?’

তনিমা কিছুক্ষণ চুপ করে প্রিয়তার চোখের দিকে তাকায়। দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকিয়ে অবাক স্বরে বলে, ‘প্রিয়ম ভাই!’

প্রিয়তা নিঃশব্দে হাসে। তনিমা অবাক হয়েই বলে, ‘তার মানে তুই সব…

‘আমাকে কি তোর গাধা মনে হয়? যেখানে কোনো ছেলে তাকালেও মেয়েরা বুঝতে পারে সে কোন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেখানে আমি এতোকিছুর পরও বুঝবো না? হ্যাঁ প্রথমে ভাবতাম হয়তো আমাকে স্বাভাবিক করার জন্য উনি এতো কেয়ার করেন। এতোকিছু করেন। কিন্তু সেদিন আমার ধারণা প্রথম বদলে গেছে যেদিন শিশির ভাইকে দেখে উনি ভীষণ রেগে গেছিলো। সেদিন থেকে কিছুটা সন্দেহ হলেও পাত্তা দিতাম না৷ কিন্তু আজ ভার্সিটিতে যা যা হলো তারপর আমি ১০০% সিউর আমার প্রতি উনার প্রখর অনুভূতি আছে। তোর কি মনে হয়?’

তনিমাও হাসে। সেও তো বুঝে প্রিয়ম ভাই প্রিয়তাকে অনেকটা ভালোবাসে। কিন্তু প্রিয়তা রাগ করবে ভেবে কিছুই বলতো না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, ‘আমি ভাবতাম তুই কিছুই বুঝিস না। এতো কিছু বুঝেও চুপ থাকতি কেন?’

প্রিয়তা মলিন হেঁসে বলে, ‘কিছু কিছু সময় বুঝেও অবুঝ হয়ে থাকতে হয়। যে কারণে শিশির ভাই আমাকে ছেড়েছে ঠিক একই কারণে যদি প্রিয়ম ভাইও আমাকে কখনো ছেড়ে দেয়!’

তনিমা চমকে তাকায়। প্রিয়তার চোখ ততক্ষণে ঝাপসা হয়ে গেছে। অতীত বড্ড পোড়ায়। এই অতীতের জন্য সে কত রাত ঘুমহীন কাটিয়েছে। তনিমা জড়িয়ে ধরে প্রিয়তাকে। বলে,

‘সবাই এক না। তুই নিজেকে একটা বার সুযোগ দিয়ে দেখ। তাছাড়া প্রিয়ম ভাই তোকে ভীষণ ভালোবাসে রে। অতীতটা ভুলে বর্তমান আঁকড়ে ধর। নতুন সূর্যের, নতুন ভোরের অপেক্ষা কর।’

প্রিয়তাও তনিমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। অনেক তো হলো অতীতের মাপকাঠি এবার না হয় বর্তমানটা নিয়ে একটু ভাবা যাক! তাছাড়া অতীতে যে তার প্রিয় বর্তমানে সেই মানুষটাই তার বোনের স্বামী। তাকে নিয়ে অনুভূতি রাখা শুধু ভুল না চরম অন্যায়। ওরা যেভাবেই পবিত্র সম্পর্কে জড়াক! জড়িয়েছে তো। ওরা না হয় ওদের মতো সুখী থাক। আর সে না হয় এবার নতুন কিছুর অপেক্ষা করুক। নতুন দিন, নতুন অনুভূতি আর নতুন সম্পর্কের অপেক্ষায় থাক।

______________

এলার্মের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় শিশিরের। লাফিয়ে উঠে বসে। আজ হঠাৎ এলার্ম কেনো! পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে দেখে অনিমা নেই। উঠে ওয়াশরুমও চেইক করে। অনিমা তো সকালে উঠলেও বের হয় না। তার মা’কে দিয়ে ইচ্ছে করে সব কাজ করায়। শিশির রুমের দরজা খোলা দেখে বাহিরে আসে। কিচেনে এসে দেখে অনিমা নেই। পুরো বাড়ি খুঁজেও সে অনিমার খোঁজ পায় না। চিন্তার রেখা কপালে ফুটিয়ে নিজের মায়ের দিকে এগিয়ে আসে। শিলা বেগম তখন রান্নায় ব্যস্ত। পেছন থেকে শিশিরের গলা পেয়ে তিনি ছেলের দিকে তাকান। ছেলে হঠাৎ কিচেনে কেন? ভাবতে ভাবতেই শিশির জিজ্ঞেস করে,

‘অনিকে দেখেছো?’

শিলা বেগম বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে তোলেন কপালে। বলে, ‘সে মেয়ে এতোদিনে কখনো রান্নাঘরের আশেপাশে এসেছে?’

‘অনিমা পুরো বাড়ির কোথাও নেই।’

কথাটা কানে যেতেই পিলে চমকে উঠে শিলা বেগমের। অবাক চোখে বলে, ‘কোথাও নেই মানে কি? আমি তো সেই কোন সকালে উঠছি ওকে তো কোথাও দেখিনি।’

চিন্তাটা আরো প্রখর হয় শিশিরের। শিলা বেগমকে কিছু না বলে নিজেই রুমের দিকে এগিয়ে যায়। ফোন হাতে নিয়ে কল দেয় অনিমার মায়ের কাছে। সেখানেও যায়নি শুনে আরো বেশি চিন্তায় পড়ে যায়। মেয়েটা গেলো কই! এদিক ওদিক পায়চারি করতেই নজর যায় টেবিলে চাপা দেওয়া একটা কাগজের ওপর। সন্দেহবশত এগিয়ে যায় সেদিকে। কাগজটা হাতে নিতেই থমকে যায়। অনিমার হাতের লিখা চিনতে বেগ পেতে হয়নি। ছোট ছোট অক্ষরে লিখা,

‘শিশির ভাই..

আমি আজও আপনাকে ‘শিশির ভাই’ বলেই সম্বোধন করলাম। আপনার আর আমার সম্পর্ক স্বামী স্ত্রীর হলেও কখনোই আমরা স্বামী স্ত্রীর মতো থাকিনি৷ সব সময় একটা দূরত্ব ছিলো। আজ সব দূরত্ব খুইয়ে আপনাকে আর আপনার পরিবারকে মুক্তি দিয়ে আমি চলে যাচ্ছি। আপনাকে ভালোবাসতাম ঠিকই তবে আপনাকে পাওয়ার লোভ আমার ছিলো না। যখন বিয়ের জন্য আপনি এতোকিছু করলেন তখন হঠাৎ করেই স্বার্থপর হয়ে উঠলাম। ভুলে গেলাম ছোট বোনের কথা। যাকে এতো ভালোবেসেছি তার ভালোবাসায় আমি কেড়ে নিলাম। তার ছোট মনটা ভেঙে গুড়িয়ে দিলাম। তার আকাশ সমান ভালোবাসা, স্বপ্ন সবটা শেষ করে দিলাম। এটা ভাবলেও আমার কি যে যন্ত্রণা হয় বলে বোঝানো যাবে না। হ্যাঁ আমি দোষী আর আমি নিজের কাজে ভীষণ লজ্জিত, অনুতপ্ত। তাই নিজের শাস্তিটা নিজেই নিলাম। চাইলেই আপনার সাথে সংসার করতে পারতাম কিন্তু তাতে যে.. যাক ছাড়েন সেসব। ভালো থাকবেন সব সময়। প্রিয়তার মতোই আপনিও আমার আপনিময় বিরহ। আমি আমার বিরহ নিয়েই সুখী হবো।

অনিমা…’

শিশির স্তব্ধ। অনিমা সত্যিই তাকে ছেড়ে চলে গেছে? মেয়েটা তাকে অনেকটাই ভালোবেসেছে কিন্তু বরাবর সে তাকে অবহেলা করে গেছে। সম্পর্কের মর্যাদা তো রাখেনি। তাহলে অনিমা তার কাছে, তার সাথে থাকবে কেনো? শিশির চিঠিটা হাতেই এগিয়ে যায় রান্নাঘরের দিকে। ততক্ষণে শিলা বেগম চেচামেচি শুরু করেছে। চেঁচাচ্ছে আর বলছে,

‘এই মেয়েকে বউ করে নিয়ে আসাই জীবনের চরম ভুল। ভেবেছিলাম শান্তশিষ্ট লক্ষী একটা মেয়ে। লক্ষীর ‘ল’ টাও নেই। এর থেকে ঢের গুণ ভালো ছিলো প্রিয়তা। ওকে বউ করে আনলেও শান্তি পেতাম।’

শিশির মায়ের কথা শুনে তাচ্ছিল্যের সুরে হাসে। পেছন থেকে বলে, ‘প্রিয়তা তোমার চক্ষুবিষ ছিলো তাই ওকে তাড়িয়েছো আর এখন অনিমা তোমার চক্ষুবিষ। চিন্তা করো না! তোমার আর তাড়াতে হবে না। ‘ও’ একাই চলে গেছে।’

জীবন কত বৈচিত্রময়। একজন নতুন ভোরের অপেক্ষা করলো নতুন ভাবে সব শুরু করবে বলে আরেকজন নতুন ভোরের অপেক্ষা করলো সব ছেড়ে যাবে বলে। জীবন তো এমনই। কেউ নতুন ভাবে সব শুরু করে, ভালোবাসা খুঁজে নেয় আর কেউ সব ছেড়ে চলে যায়। ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে যায়। কেউ পরিস্থিতির জন্য তো কেউ ইচ্ছে করে….

চলবে…

#আপনিময়_বিরহ (১২)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_________________

স্নিগ্ধ সকালের বাতাসে মন ফুরফুরে হয়ে যায় প্রিয়তার। সকালটাও যেন তাকে নতুন জীবনের জন্য শুভ কামনা দিচ্ছে। উল্টা পাল্টা চিন্তা করে নিজেই নিজের মাথায় গাট্টা মারে। চোখ বন্ধ করে বাতাস অনুভব করতে থাকে। কিছুক্ষণ যেতেই তনিমার ডাক। প্রিয়তা ‘আসছি’ বলেই ছাঁদ থেকে নেমে যায়৷ লিভিং রুমে আসতেই দেখে সেখানে উদয়, তনিমা, প্রিয়ম আর সিমি বসে আছে। সিমিকে দেখেই চোখ মুখ কুঁচকালো প্রিয়তা। সব সময় এই মেয়েটার কেন থাকতেই হবে! এতো সুন্দর মুডটা ঠাস করে অফ হয়ে গেলো। কেন যেনো এই সিমিকে তার সহ্যই হয় না। অকারণেই। প্রিয়তা এগিয়ে আসতেই প্রিয়ম ফোন থেকে চোখ তুলে তার দিকে তাকায়। তারপর কিছু না বলে প্রিয়তার হাত ধরে। প্রিয়তা হকচকিয়ে যায়। চমকে তাকায় প্রিয়মের দিকে। প্রিয়ম পাত্তা না দিয়ে বললো,

‘উদয় তুই সিমি আর তনিমাকে নিয়ে গাড়িতে যা। আমরা আসছি।’

সিমির মুখটা মলিন হয়ে গেলো। কিন্তু উদয় আর তনিমা মিষ্টি করে হাসলো। উদয় উঠতে উঠতে বললো, ‘ওকে সাবধানে আসিস। তনু আয়। সিমি আপু আসো।’

সিমি হাসার চেষ্টা করে কয়েকবার পলক ফেলে প্রিয়ম আর প্রিয়তার ধরে থাকা হাতটার দিকে তাকালো। তারপর নিঃশব্দে চলে গেলো। প্রিয়তাকে কিছু বলতে না দিয়েই প্রিয়ম তার হাত ধরে বাড়ির বাহিরে নিয়ে আসে। এতক্ষণে মুখ খোলে প্রিয়তা। বলে,

‘আজ হঠাৎ বাইকে যাবো কেন?’

‘সার্কাস দেখাতে।’

প্রিয়মের ত্যাড়া উত্তরে ভেংচি কাটে প্রিয়তা। লোকটা আগে কত ভালো ছিলো আর এখন! গম্ভীর, পেটমোটা একটা।হুহ! বিড়বিড় করে প্রিয়মের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে ফেলে। প্রিয়ম সব শুনে নিঃশব্দে হাসে। তারপর গাড়ির হর্ন দিয়ে বোঝায় যে ‘অনেক আমার গোষ্ঠী উদ্ধার করছেন এখন উঠেন’। প্রিয়তা উঠে পড়ে। বাইকে উঠে বলে, ‘আমরা কই যাবো?’

‘উগান্ডায়।’

রাগে আর প্রিয়তা কিছু জিজ্ঞেস করে না। প্রিয়ম বাইক স্টার্ট দেয়। শো শো করে চলে আসে ভার্সিটিতে। প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলে, ‘আসলেন তো সেই বাইকেই তাইলে শুধু শুধু কেন বাইক নিলেন?’

‘তোর কোনো সমস্যা?’

প্রিয়তা কিছু বলে না। একে কিছু বলে লাভ নাই। চুপচাপ নেমে নিজের ক্লাসের দিকে যেতে থাকে। হুট করেই সামনে সাদাফ এসে দাঁড়ায়। চমকে উঠে প্রিয়তা। সাদাফ হেঁসে বলে,

‘ভয় পাইছো?’

প্রিয়তা কিছু না বলে সাদাফের মুখের দিকে তাকায়। তারপর বলে, ‘আমার ক্লাস আছে ভাইয়া। আসছি।’

প্রিয়তা দুই পা এগোতেই সাদাফ বলে, ‘প্রিয়মের সাথে জড়াজড়ি করে আসতে তোমার সমস্যা হয় না আর আমি সামনে আসলেই তোমার যত বাহানা!’

প্রিয়তা থেমে যায়। তারপর সাদাফের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলে, ‘আমি প্রিয়ম ভাইয়ের সাথে জড়াজড়ি করে আসবো না কি করবো তা একান্ত আমার ব্যাক্তিগত ব্যাপার। আর যখন বুঝেনই আমি আপনাকে ইগনোর করি তখন আসেন কেন কথা বলতে?’

সাদাফের মুখটা মুহুর্তেই থমথমে হয়ে যায়। প্রিয়তা আর না দাঁড়িয়ে নিজের ক্লাসের দিকে চলে যায়। প্রিয়তা যেতেই হাজির হয় প্রিয়ম, রিমা, নিতু, নোমান আর সামি। প্রিয়ম শান্ত কন্ঠে বলে, ‘প্রিয়তার পেছনে পড়ে আছিস কেন?’

সাদাফ বাঁকা হেঁসে বলে, ‘তুই আমার ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছিস আর আমি তোরটা। সিম্পল!’

প্রিয়ম দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্যদিকে তাকায়। সাদাফ প্রতি’শো’ধের নেশায় বুদ হয়ে আছে। তাকে যায় বলুক বুঝবে না আর। রিমা বলে, ‘সাদাফ তুই কিন্তু সত্যিটা না জেনে ওকে দোষ দিচ্ছিস!’

সাদাফ গায়ে মাখে না সে কথা। নিজের মতো চুপচাপ চলে যায়।

প্রিয়তা ক্লাসে আসতেই তনিমা চেপে ধরে। ওরা আলাদা আসলো কেন? প্রিয়ম কি ওকে প্রপোজ করছে নাকি? মানে যত প্রশ্ন আছে সব করতেছে। প্রিয়তা চোখ গরম দিয়ে বলে, ‘তুই চুপ করবি এবার!’

সাইমা এতক্ষণ চুপচাপ এদের দেখছিলো। এবার ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘ব্যাপার কি তোদের?’

তনিমা বলে, ‘অনেককিছু দোস্ত।’

‘মানে?’

তনিমা কিছু বলার আগেই প্রিয়তা বলে, ‘আরে কিছু না। ওর কথায় কান দিস না।’

তনিমা গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। সাইমা সন্দেহের চোখে তাকায় প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা জোড় করে হেঁসে প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলে, ‘আচ্ছা তুই কি প্রিয়ম ভাইকে চিনিস?’

সাইমা বুঝে প্রিয়তা প্রসঙ্গ পাল্টাচ্ছে তাই সেও আর না ঘেটে বলে, ‘হ্যাঁ চিনবো না কেন! আমি তো এই কলেজেই পড়ছি। মানে আমাদের ভার্সিটিতে তো কলেজ+ভার্সিটি। তো আমি আগে থেকেই এখানে পড়ি। আমি যখন এডমিট হয় তখন প্রিয়ম ভাইয়ারা অনার্স ৩য় বর্ষ। প্রিয়ম ভাইয়ার গ্যাঙ তো ফ্যামাস। বিশেষ করে সাদাফ ভাই আর প্রিয়ম ভাইয়ের বন্ধুত্বের জন্য। আমি তো উনাদের ফ্রেন্ডশীপ দেখেই ফিদা।’

প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এত ভালো বন্ধুত্ব অথচ এখন উনাদের সম্পর্ক এমন কেন? প্রিয়তার ভাবনার মাঝেই সাইমা বললো, ‘কিন্তু মাঝখানে সাদাফ ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড মারা যাওয়ার পর থেকে প্রিয়ম ভাই আর সাদাফ ভাইয়ের সম্পর্কও বদলে গেছে।’

কথাটা বলতে গিয়ে সাইমার গলা কেঁপে কেঁপে উঠলো। তা লক্ষ্য করে তনিমা বলে, ‘এই কথাটা বলতে তোর গলা কাঁপলো কেন?’

‘আরেহ না কিছু না।’

‘বল বল। তাড়াতাড়ি বল।’

তনিমা আর প্রিয়তার জোড়াজুড়িতে সাইমা বললো, ‘ঠিক আছে বলতেছি।’

তনিমা আর প্রিয়তা মনোযোগী দর্শকের মতো সাইমার দিকে তাকিয়ে আছে। সাইমা অন্যদিকে তাকিয়ে ধীরে বললো, ‘আমি যখন প্রথম সাদাফ ভাইকে দেখি তখনই ক্রাশ খায়ছিলাম। প্রিয়ম ভাইয়ের ওপর অনেক মেয়ে ক্রাশ খাইলেও আমার ভালো লাগলো সাদাফ ভাইকে। কিন্তু উনি একটা আপুকে অসম্ভব ভালোবাসতেন তাই কোনো মেয়েকেই পাত্তা দিতেন না। আমি ভাবতাম উনি শুধুই আমার ক্রাশ। কিন্তু কখন যে ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা হয়ে গেছে নিজেও বুঝিনি। উনাকে আপুটার সাথে দেখলেই আমার ভীষণ কষ্ট হতো কিন্তু তবুও আমি উনার কাছে নিজেকে প্রকাশ করিনি। কারণ আমি উনাদের মধ্যে ৩য় ব্যাক্তি। আমি সরে যাওয়ায় ভালো। এরপর দেড় বছর পরেই হঠাৎ শুনলাম আপুটা মারা গেছে তখন আমি নিজেই স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। সাদাফ ভাই তো পাগল হয়ে গেছিলো রীতিমতো। তখন থেকেই উনার আর প্রিয়ম ভাইয়ের মাঝে মিল নাই। কেমন শত্রু শত্রু ভাব!’

প্রিয়তা আর তনিমা দমে যায়। তনিমা নিজেও তো এই একপাক্ষিক ভালোবাসার বিরহ নিয়ে আছে। সে তো খুব ভালো ভাবেই জানে এই বিরহটা কত কষ্টের। সবাই বলে একপাক্ষিক ভালোবাসাতেই মানুষ সুখী কিন্তু এটা ভুল। হয়তো মানুষ একপাক্ষিক ভালোবাসায় হারানোর ভয় পায় না কিন্তু নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্যের পাশে দেখে নিজের ভেতরের ক্ষত গভীর করে। ভালোবাসার মানুষকে না পাওয়ার আক্ষেপে পুড়ে। সাইমা নিজেকে সামলে হেঁসে বলে,

‘শুধু যে সাদাফ ভাই একটা মেয়েকে অসম্ভব ভালোবাসে এমন না কিন্তু প্রিয়ম ভাইও কিন্তু একটা মেয়েকে অসম্ভব ভালোবাসতেন এবং সম্ভবত এখনো বাসে। পুরো ক্যাম্পাস জানে এটা।’

চমকে তাকায় প্রিয়তা আর তনিমা। তনিমা অবাক হয়ে বলে, ‘মানে?’

‘মানে আবার কি? আমি তো সেই প্রথম থেকে শুনতেছি প্রিয়ম ভাই বুকড মানে উনি নাকি কাকে ভীষণ ভালোবাসে। তবে ক্যাম্পাসের কেউ সেই মেয়েকে চিনেও না জানেও না।’

প্রিয়তা কেমন করে যেনো হাসে। সেই ২ বছর আগে তো প্রিয়তা ছিলো না প্রিয়মের লাইফে তার মানে কি প্রিয়ম অন্য কাউকে ভালোবাসে? তার এতো কেয়ার এতো রাগ শুধু এমনিতেই! রাতে ভাবা তার নতুন স্বপ্ন নতুন জীবন মুহুর্তেই নিভে যায়। তনিমা তাকিয়ে থাকে প্রিয়তার দিকে।

_____________

ক্লাস শেষ করে ক্যান্টিনের দিকে যায় ৩ জন। প্রিয়তা আর সাইমা ক্যান্টিনের ভেতর যায়। তনিমাকে নোমান ডাকে বলে সে সেখানেই দাঁড়ায়। নোমান হাসিমুখে কাছে এসে জিজ্ঞেস করে,

‘কি ব্যাপার? কেমন আছো?’

তনিমার যা স্বভাব তাতে সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘ডাকলেন কি কেমন আছি জিজ্ঞেস করার জন্য?’

‘নাহ। তোমার সাথে কথা বলতেই আসলাম।’

‘ওহ আচ্ছা।’

‘বললে না কেমন আছো?’

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?’

‘আলহামদুলিল্লাহ। তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?’

‘করেন।’

নোমান আমতা আমতা করে বলে, ‘তোমার কি বয়ফ্রেন্ড আছে?’

তনিমা ভ্রু কুঁচকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে নোমানের। তারপর সরাসরি বলে, ‘কেন? না থাকলে প্রেম করবেন নাাকি আমার সাথে?’

নোমান থতমত খায়। এ মেয়ে তো ডেঞ্জারাস! কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে কোনোরকম বলে, ‘তুমি যাও তো।’

বলেই চলে যায়। তনিমা ভেংচি কেটে এগোতে নিলে কোথা থেকে উদয় এসে হাজির হয়। থতমত খায় তনিমা। মানে ভুল টাইমে এই ছেলে এখানে কেন? আজিব! তনিমা কিছু বলতে যাবে তার আগেই উদয় দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘ওর সাথে তোর কি?’

তনিমা ঢোক গিলে। উদয়কে সে ভীষণ ভয় পায়। রেগে গেলে চ’ড় থা’প্পড়ও মে’রে দিতে পারে। তাই ভয়ে ভয়ে বলে, ‘উনি ডাকছিলো তাই।’

‘কেউ ডাকলেই তোর আসা লাগবে? এক থা’প্পড়ে তোর দাঁত ফেলে দিবো।’

তনিমা মিনমিন করে বলে, ‘এক থা’প্পড়ে দাঁত পড়ে না।’

উদয় কিছু বলতে যাবে তার আগেই রিনি এসে হাজির হয়। তনিমা অদ্ভুত ভাবে হেঁসে বলে, ‘তুমি যার তার সাথে সারাদিন থাকতে পারো আর আমি কাারো সাথে ২ মিনিট কথা বললেও দোষ! বেশ। আরো বেশি করে বলবো। পারলে আটকাও। দরকার পড়লে ১০/১২ টা বয়ফ্রেন্ড নিয়ে ঘুরবো। তোমার কি?’

উদয় কিছু বলবে তার আগেই তনিমা গটগট করে চলে গেলো। উদয় কটমট করে তাকায় তনিমার যাওয়ার দিকে। তারপর রিনির দিকে তাকায়। রিনি ভয়ে ঢোক গিলে বলে,

‘আমার দিকে ওভাবে তাকাচ্ছিস কেন? আমি কি করছি!’

‘তুই তোর বয়ফ্রেন্ডের কাছে যা বইন। আমার সামনে থেকে যা নাহলে তোর কপালে দুঃখ আছে।’

_____________

বাস থেকে নেমে চুপচাপ ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে থাকে অনিমা। নতুন শহর, নতুন জীবন নিয়ে অজানা গন্তব্যে পাড়ি জমিয়েছে। তার ভুল, অন্যায় সব থেকে নিজেকে সরিয়ে এনেছে। এড্রেস ঠিকমতো চেইক করে বান্ধবীর বাসার দিকে রওনা দেয়। বাসার সামনে এসে কলিং বেল বাজায়। দরজা খুলে দেয় তানিয়া। তানিয়া অনিমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে। অনিমা মলিন হাসে। তানিয়া বলে,

‘তোর কোনো অসুবিধা হয় নি তো?’

অনিমা মাথা নাড়ায়। তারপর ভেতরে ঢোকে। তানিয়া একা থাকে ফ্ল্যাটে। তাই দুজনের কোনো অসুবিধা নেই। তানিয়ার দেখানো রুমে লাগেজ রেখে শাওয়ার নিয়ে নেয়। শাওয়ার শেষে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে নিজের অতীতের হিসাব কষে নেয়। তারপর চোখ বন্ধ করে বলে,

‘আমার জীবনে আর আপনার জায়গাটা নেই শিশির ভাই। প্রথমেই যদি আপনাকে ফিরিয়ে দিতাম তাহলে হয়তো আজ আমার এমন দিন আসতো না।’

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে