#আনকোরা_কাহিনী
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৫
ভাইয়া হাসপাতালের পেছনে ল্যামপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে তেমন লোকজন নেই। পরিষ্কার রাস্তা। ল্যামপোস্টের আলোয় চিরপরিচিত মানুষটাকে বড্ড অদ্ভুত দেখাচ্ছে। একদম অচেনা। তার ডান হাতে একটা ছু’রি চকচক করছে। ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। কি অদ্ভুত সেই হাসি। সারা শরীরের লোক দাঁড়িয়ে যায়। একি! রাস্তাটা এতো দুলছে কেন? রাস্তা কি কখনও দুলতে পারে? না না এ আমার মনের ভুল। আমার মস্তিষ্ক আমায় ভুল দেখাচ্ছে। দু’জনের মাঝে কয়েক মুহুর্তের রাস্তা, অথচ এ পথকে অসীম মনে হচ্ছে। ভাইয়া এগিয়ে এসে আমার হাত ধরলো। মততা মেশানো ভীতু গলায় বললো, ” ঠিক আছিস? এমন কাঁপছিস কেন? জ্বর নাকি?”
উত্তর দিলাম না। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। ভাইয়া কপালে হাত রাখলো। বরফের মতো ঠান্ডা হাত। ব্যস্ত গলায় বললো, ” গায়ে তো জ্বর। জ্বর বাঁধালি কিভাবে?”
” জানি না। কেন ডেকেছো আমায়? খু’ন করতে চাও? বড় আপাকে মা’র’তে পারোনি বলেই কি আমায় মা’র’তে চাইছো?’
ভাইয়া জোরে চিৎকার করে উঠলো। ব্যস্ত গলায় বললো, ” রাতুল কি হয়েছে তোর? বিড়বিড় করে কি বলছিস? চল, ওদিকটায় গিয়ে বসবি। তোর শরীর ভালো নেই।”
কৃষ্ণচূড়া গায়ের নিচে গিয়ে বসলাম দু’জনে। গাছটার নিচ শান বাঁধানো। ভাইয়া হাতের ছু’রিটা আমার দিকে উঁচু করে ধরে বললো, ” এটাকে চিনতে পারছিস? ”
খুব ভালো মতো দেখে বললাম, ” না। চিনতে পারছি না। ”
” মনোযোগ দিয়ে দেখ। এই ছুরিটা আমরা দু’জনে আব্বার সাথে গিয়ে বানিয়ে এনেছিলাম। ছুরিতে আমাদের নামও খোদাই করা আছে। বিয়ের পর বড় আপা এই ছু’রিটা নিয়ে গেছিলো। এই ছু’রি ছাড়া সে কাজ করতে পারতো না।”
” হ্যাঁ মনে পড়েছে। তুমি এটাকে কোথায় পেলে?”
” তিনুদের ঘরের ওদিকে ঝোপের ভেতর। এমনভাবে পড়ে ছিলো যেন কেউ দূর থেকে ছুঁড়ে মে’রেছে। ”
” ছু’রিতে র’ক্ত আছে নাকি? ”
” না নেই। তবে আমার ধারণা আপাকে এই ছু’রি দিয়ে আ’ঘা’ত করা হয়েছে। ”
“কিভাবে বুঝলে?”
” ছু’রিটা আপার বাড়ি থেকে একা একা ওখানে যায়নি। কেউ না কেউ নিয়ে এসেছে। তাছাড়া ওমন ঝোপঝাড়ে কেউ ছু’রি নিয়ে যায় না। ”
” হতেও পারে। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে আছে। খাপছাড়া খাপছাড়া ভাব।”
” কোন কিছু এলোমেলো হয়ে নেই। সবকিছু পরিকল্পনা করা। শুধু আমাদের চোখে পড়ছে না। এ বড় পাকা হাতে কাজ। সহজে বোঝা যাবে না। ”
“কে করবে এমন? তুমি কি কাউকে সন্দেহ করছো? দুলাভাই তো আমায় সন্দেহ করছে। আমার আবার তাকেই সন্দেহ হয়। বিপরীতমুখী ব্যাপার।”
” আমারও দুলাভাইকে সন্দেহ হয়। লোকটা মোটেও সুবিধার না। আপাকে ঘাড় থেকে নামাতে এমনটা করতে পারে। ”
” তালাক দিলেই বা দোষ কি? সোজা মা’রতে চাইবে কেন?”
” আপা প্রথম থেকেই স্বামী ভক্ত। স্বামীকে ভালোবেসে বাপের বাড়ি থেকে যা পেয়েছে দু’হাতে নিয়ে গিয়েছে। দাদির গহনা থেকে শুরু করে মা’য়ের আংটি পর্যন্ত। এমনকি ওর বরের কথায় ছোট আপার হীরের আংটিও চু’রি করেছে। সবকিছু মিলিয়ে এমন বউকে তালাক দিলে সেসব জিনিসপত্র নিয়েছে সবকিছু ফেরত দিতে হবে। এতে তার অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। ”
” ছোট আপার আংটির ব্যাপারটা তুমি জানো? ”
” শুধু জানি না। ছোট আপাকে অমন একটা আংটিও বানিয়ে দিয়েছি। ব্যাপারটা আমি আর ছোট আপা বাদে আর কেউ জানে না। আমি কখনও ভাইবোনের সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইনি। নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেছি। ভালো-মন্দ পর্যন্ত বিচার করিনি। চেয়েছি যেন সবাই ভালো থাকে। ”
” বড় আপা বলছিলো হামলাকারীর পরনে আমার লাল শার্ট ছিলো। সেই শার্ট আবার বড় আপা ভাবীর কাছে দিয়েছিলো। ”
” এ ব্যাপারে কিছু জানি না। তদন্তের ব্যাপারে নিজেকেও বিশ্বাস করতে নেই। বাড়ি গিয়ে ভাবীর কাছে জিজ্ঞেস করে দেখিস। ”
” আচ্ছা বেশ। আমার কি মনে হয় জানো? সবকিছুর সাথে তিনুর মা’য়ের কোন না যোগসাজশ আছে। না হলে এতো জায়গা থাকতে ওর বাসার কাছেই কেন?”
” সবদিক থেকে দুলাভাইকে সন্দেহ হয়। এখন দরকার প্রমাণ। আমি পুলিশে সবকিছু জানিয়েছি। ওরা তদন্ত করছে। দেখা যাক কি হয়!”
” ভাইয়া!”
” বল। ”
” একটু আগে সেই মহিলা পুলিশকে দেখলাম, যে আমাদের বাড়িতে গেছিলো। ”
” আগে বলবি না। চল। কোথায় দেখেছিস?”
সে জায়গায় কাউকে পেলাম না। লোকজনের ভীড়ে মেয়েটা হারিয়ে গেছে। এতোটা দৌঁড়ে আসার ফলে ভাইয়া খুব হাঁপাচ্ছে।
” রাতুল, দু’টো ঠান্ডা কিনে নিয়ে এসে রিকশায় ওঠ। বাড়ি যেতে হবে। ”
” বাড়িতে ভাবী কাঁদছে। তুমি নাকি কোন মেয়ের সাথে পালিয়ে গেছো! ”
” হা হা হা। জানি আমি। ”
” জেনেশুনে এমন করো কেন?”
” ভালো লাগে। ”
” ভাবীকে কাঁদাতে তোমার ভালো লাগে? তুমি তাকে ভালোবাসো না?”
” উহ! আমায় হারানোর ভয়ে কাঁদলে বেশ ভালো লাগে। অন্য ব্যাপারে নয়। তুই এখন বুঝবি না। পরে বুঝছি। তোকেও বিয়ে দিতে হবে দেখছি। ”
একি! আমার এমন অদ্ভুত লাগছে কেন? বিয়ের কথা শুনে লজ্জা পাচ্ছি না তো? আয়না থাকলে একবার দেখে নিতাম গাল লাল হয়েছে কি-না। নাকি ছেলেদের গাল লাল হয় না? এটা কি শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রে?
ফজরের আজান হয়েছে বেশ আগে। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। চারদিকে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। জানালা গলে ঠান্ডা হাওয়া আসছে। দরজার ওপাশ থেকে ভাইয়ার গলা শোনা গেল। ফিসফিস করে কথা বলছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না।
” কি হয়েছে? এতো সকালে ডাকছো কেন?”
” তিনুর মা’য়ের সাথে কথা বলতে যাব৷ তোর ভাবী কাল রাতে এলার্জির ওষুধ খেয়েছে। আটটার আগে উঠবে না। ছোট আপার কথা তো জানিসই। চলে আয়। ”
ভাইয়ার সাথে তিনুদের ঘরের দিকে গেলাম। তিনুর মা দরজার পাশে বসে কুরআন শরীফ পড়ছে। আমাদের দেখে ঘোমটাটা একটু টেনে দিলো। স্বাভাবিক গলায় বললো, ” কিছু বলবেন? ”
ভাইয়া স্বর নিচু করে বললো, ” তোমার সাথে কথা আছে। খুব জরুরি। ”
” কি কথা? বলেন। ”
” আপার ঘটনার দিন তুমি কোথায় ছিলে?”
” তিনুর সাথে স্কুলে গেছিলাম। চাইলে মাস্টারের কাছে জিজ্ঞেস করতে পারেন। তারা সবাই আমাকে দেখেছে।”
” আহা। আমরা তোমায় বিশ্বাস করছি। তোমার সাথে কি কারো শত্রতা আছে?”
” কেমন শত্রুতা?”
” এমন কেউ যে তোমার ক্ষতি করতে চাইবে। ”
” না ভাই। তেমন কেউ নেই। ”
” মনে করে বলো। একজন মানুষ ম’রতে বসেছিলো। ”
” সত্যি কথা বলতে সবাইকেই আমার শত্রু মনে হয়। তিনুর বাবা মা’রা যাওয়ার পর শশুর মশাই খুব অশ্লীল কাজ করতে চেয়েছিলো। সেই থেকে কাউকে বিশ্বাস করি না। সে বাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়িতে গিয়ে উঠলাম। তারা আমায় আবার বিয়ে দিতে চায়। কতই বা বয়স আমার, পোলাডা তাদের কাছে থাকবে। কিন্তু আমার মন তাতে সায় দেয়নি। বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেছি। কিন্তু এই রূপ বড্ড বেশি সমস্যা করেছে আমার জীবনে। কতশত প্রস্তাব পেয়েছি। বিয়ের, প্রেমের। কিছুই ভালো লাগে না। ”
” দুলাভাইও তোমায় কুপ্রস্তাব দিয়েছিলো তাই না?”
তিনুর মা বোধহয় খানিকটা বিব্রতবোধ করলো। স্বর বদলে বললো, ” হ্যাঁ। কিন্তু ঝগড়ার পরে আর দেয়নি। তবে উনার ভাইও খুব অসভ্য। ”
” কে? শরিফ? ”
” হ্যাঁ। আমায় অনেকবার প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে। বিয়েও করতে চেয়েছে। একদিন উপায় না দেখে বড় আপার কাছে নালিশ করলাম। তারপর থেকে সব ঠিকঠাক। ”
” শরিফ তোমায় কোথায় বিরক্ত করতো? সে তো আমাদের বাড়ি আসে না। ”
” সব জায়গা। রাস্তাঘাট। তিনুর স্কুলের পথে। ”
” তোমায় অনেক ধন্যবাদ। ”
তিনুর মা ভালো-মন্দ কিছু না বলে ঘরের ভেতর চলে গেল। বোধহয় সে এখন কিছুক্ষণ কাঁদবে। অশ্রুভেজা চোখ কাউকে দেখাতে চায় না। ভাইয়া চোখ-মুখ চকচক করছে। যেন বিরাট কিছু করে ফেলেছে।
” রাতুল চল। পুকুর পাড়ে গিয়ে খানিকক্ষণ বসি। ”
সিঁড়ি বাঁধানো পুকুর। পুকুরের দু’পাশে ফুল গাছ। সবকিছু ভাইয়ার নিজ হাতে করা। মানুষটা বড্ড গোছালো স্বভাবের৷
” কিছু বুঝতে পারছিস?”
” না। ”
” বিশ্বাস হলো না। যাইহোক, আমিই বলছি। আমার মনে হয় এসবের পেছনে শরিফ জড়িয়ে আছে। তার সাথে দুলাভাই। দু’জনে মিলে এসব করেছে। সম্পূর্ণ দোষ তোর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার জন্য তোর মতো সেজে এসেছিলো। ”
” শরিফ এসেছিলো নিশ্চয়ই। দুলাভাইয়ের যে ভুঁড়ি!”
দু’জনেই শব্দ করে হেসে উঠলাম। ভালো লাগছে। বেশ ভালো। দু’জন মিলে সোজা রান্নাঘরে চলে গেলাম। ভাবী চুলার পাশে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। খানিকটা চুপিসারে বলা চলে। ভাইয়া ভাবীকে হাসতে হাসতে বললো, ” শরিফের সাথে কথা বলছো নাকি? ”
ভাবী চমকে উঠলো। তার হাত থেকে মোবাইল পড়ে গেলো। ভাইয়া স্বযত্নে মোবাইলটা হাতে তুলে নিলো। কল লিস্ট বের করে আমায় দেখিয়ে বললো, ” কার কল দেখছিস?”
কল লিস্টের শেষ নম্বরটা শরিফ ভাই নামে সেভ করা। কয়েক সেকেন্ড আগেই কথা হয়েছে। আমি হকচকিয়ে গেলাম। কিন্তু ভাইয়া তখনও হাসছে। কি সুন্দর সেই হাসি৷ এই মুহুর্তে কেউ এতো সুন্দর করে হাসতে পারে কিভাবে? নাকি ভাইয়া আগে থেকেই সবকিছু জানে। এসব ওদের পরিকল্পনা নয় তো? ভাবীর মুখেও ভয়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে না। ছোট আপা কোথায়? আমি তাকে ডাকবো? চিৎকার করবো? মস্তিষ্ক কাজ করছে না কেন? ভালো একটা ডাক্তার দেখাতে হবে। আজ-কাল বড্ড অদ্ভুত লাগে সবকিছু।
চলবে