#আনকোরা_কাহিনী
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট-৬
আজ-কাল বড্ড অদ্ভুত লাগে সবকিছু। হঠাৎ চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে যায়। চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে। যেন কত হাজার বছর না ঘুমিয়ে আছি। কি তীব্র সেই ঘুমের তেষ্টা! ভাইয়ার ঠোঁট থেকে হাসির রেখা মুছে গেছে। একরাশ কালো মেঘ এসে ভীড় করেছে হাস্যজ্বল মুখে।
“ শরিফের সাথে কি কথা বলছিলে?”
ভাইয়ার প্রশ্নে ভাবী একটু ঘাবড়ে গেল। আমতা আমতা করে বললো, “তেমন কিছু না। এমনি খোঁজ নিচ্ছিলো। তুমি কোথায় আছো জানতে চাইলো।”
“ তুমি কি বললে?”
“ বলেছি বাড়িতেই আছো। কিন্তু শরিফ হঠাৎ তোমার কথা জানতে চাইলো কেন বুঝলাম না।”
“ আমাদের বের হতে হবে। খাবার রেডি করো।”
ভাইয়া আমার হাত ধরে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। চাপা গলায় বললো, “ আজ অনেক কাজ আছে। তাড়াতাড়ি খেয়ে বের হতে হবে। না হলে অনেক দেরি হয়ে যাবে।”
“ কোথায় যাবো আমরা? আর তুমি ভাবীর কথা বিশ্বাস করে নিলে? হয়তো শরিফের সাথে অন্য ব্যাপারে কথা হচ্ছিলো।”
“ হলেও জানতে পারতাম। কল রেকর্ড করা থাকবে। চিন্তা করিস না। আজ অপরাধী ধরা পড়বে।”
“ ভাবীকে লাল জামার কথা জিজ্ঞেস করেছিলে?”
“ হ্যাঁ। তার কিছু মনে নেই।”
ভাইয়া নিজের রুমে চলে গেল। ভাবীর ব্যাপারটা আমি বিশ্বাস করলাম। ভাবী কখনও মিথ্যা কথা বলে না। সেবার মা’য়ের ব্যাগ থেকে পাঁচ হাজার টাকা হারিয়ে গেল। মায়ের ভীষণ মন খারাপ। কোথায় না কোথায় রেখেছে মনে করতে পারছে না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভাবী বললো, “ টাকাটা আমি নিয়েছি। খুব প্রয়োজন ছিলো। আপনাকে খুঁজেছিলাম কিন্তু পাইনি। বেতন পেলে দিয়ে দেবো।”
সবাই মনে করেছে ভাবী মা’কে স্বান্তনা দিতে চাচ্ছে। কিন্তু না, সে সত্যি বলেছিলো। মা’য়ের ব্যাগ থেকে টাকা নিতে আমি দেখে ফেলেছিলাম। ভাবী অবশ্য আমাকে দেখেনি।
সকালের রান্না শেষ। গরম ভাতের সাথে দুই রকমের ভর্তা, ডিম ভাজা আর পাতলা ডাল। খাবারগুলো টেবিলের ওপর খুব সুন্দর করে সাজানো। দেখলেই খেতে ইচ্ছে করে। তবে ভাইয়া খাওয়ার সময় দিলো না। হাত ধরে টানতে টানতে বললো, “ চল। দেরি হলে আর পাবো না।”
ভাবী হা করে আমাদের চলে যাওয়া দেখলো। ছোট আপা মাত্রই ঘুম থেকে উঠেছে। এ দৃশ্য দেখে সে খুব হাসছে।
“এমন তড়িঘড়ি করে নিয়ে এলে কেন? কোথায় যাচ্ছি?”
“ আপাতত বাসস্ট্যান্ডে, সেখান না পেলে বিমানবন্দর যেতে হবে। সেরকম হলে তুই যশোর যাবি, আমি ঢাকা যাব।”
“ কেন যাবো?”
“ শরিফকে ধরতে। ও দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।”
“ তোমায় কে বললো?”
“ সকালে তোর ভাবীকে কল দিয়ে বলেছে। আমাদের সন্দেহের ব্যাপারে শরিফের ধারণা নেই।”
“ তুমি এতোটা নিশ্চিত হচ্ছো কিভাবে? এটা তো ওর চাল হতে পারে।”
“ পারে না। কাহিনীর খানিকটা আমার কাছ পরিষ্কার হয়ে গেছে। এসব কাজের পিছনে শরিফ দায়ী। কিন্তু কেন তা জানি না। দুলাভাই নিজের ভাইকে বাঁচানোর জন্য নকল পুলিশ নিয়ে এসেছে। ক’দিন পুলিশ পুলিশ খেলা চলবে। এই সুযোগে ভাইকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবে।”
“ এতোসব খবর তোমায় কে দেয়?”
“আমার এক বন্ধু দেয়। ওকে একটু খোঁজ নিতে বলেছিলাম।”
“ বাবাহ! পাকা গোয়েন্দা হয়েছো দেখি।”
“ বলছিস?”
“ হ্যাঁ। বললাম। আপার অবস্থা জানো? দুলাভাই কোথায়?”
“ আপা আগের থেকে বেশ ভালো। ক্ষত শুকাতে শুরু করেছে। ক’দিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে যাবে।”
সকালের রোদ এতো তীব্র হয় জানা ছিলো না। গা পুড়ে যাওয়ার মতো রোদ। অথচ ঠান্ডা হাওয়া বইছে। রিকশা নিয়ে বাসস্ট্যান্ড চলে গেলাম। ভাইয়ার সন্দেহ শতভাগ ঠিক। দুলাভাই শরিফকে নিয়ে একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শরিফ যতটা সম্ভব নিজেকে আড়াল করে রেখেছে। ভাইয়া ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে সালাম দিলো। হাসি মুখে বললো, “ বেয়াই সাহেব কোথাও যাচ্ছো নাকি?”
শরিফ হাসতে চেষ্টা করে বললো, “ হ্যাঁ বেয়াই। ঢাকায় একটা চাকরি পেয়েছি। ওখানেই থাকবো।”
“ কেমন চাকরি?”
“ ভালো চাকরি। মেয়ের বাপরা এক চান্সে মেয়ে বিয়ে দেবে এমন ভালো।”
“ আমি তোমার বিনা পয়সায় খাবার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। যদি তুমি চাও।”
দুলাভাই পাশে দাঁড়িয়ে উসখুস করছে। হয়তো কোন দুশ্চিন্তায় আছেন। ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হাসলো। আমি স্বাভাবিক গলায় বললাম, “ দুলাভাই শুধু নিজের ভাইকে চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন। আমি কি আপনার পর?”
দুলাভাই হাসলেন। বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে মানুষ এমন করে হাসে। তরল গলায় বললেন, “ তোমার জন্যও ব্যবস্থা করবো। সময় আসুক। তোমার আপা সুস্থ হোক।”
আমি হাসলাম। দুলাভাই কিছু একটা ভেবে বললেন, “ তোমায় সন্দেহ করে ভুল করেছিলাম। পুলিশের সাথে আমার কথা হয়েছে। ওরা তোমার ব্যাপারে কোন সূত্র পায়নি। কিছু মনে করো না ভাই। ওই পরিস্থিতিতে কিছু খেয়াল ছিলো না।”
ভাইয়া দুলাভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বললো, “ নাকি নিজের ভাইকে বাঁচাতে আমার ভাইকে ফাঁসিয়ে দিচ্ছিলেন। কাজটা কি ঠিক?”
“ এসব কি বলছো তুমি? মাথা ঠিক আছে তোমার?”
“ খুব আছে।”
চার-পাঁচজন পুলিশ এসে আমাদের ঘিরে ধরলো। শরিফ বোধহয় খুব ভয় পেয়েছে। দৌঁড়ে পালাতে গেলো। কিন্তু লাভ হলো না, একজন পুলিশ ওর হাত চেপে ধরলো। পুলিশটার মুখ দেখে মনে হচ্ছে হাত ভেঙে ফেলবে।
“ দুলাভাই সব খেলা শেষ। আপনার ভাই যেমন আপনার কাছে প্রিয়। আমার ভাই-বোনও আমার কাছে প্রিয়।”
দুলাভাইয়ের চোখেমুখে আতঙ্ক। শেষ রক্ষা করতে না পারার আফসোস। পুলিশের জিপে করে থানায় গেলাম। ওখানেই জিজ্ঞেসাবাদ হবে। দারোগা সাহেব নিজেই আমাদের যেতে বললেন।
দুলাভাই আর শরিফ চেয়ারে বসে আছে। একজন কনস্টেবল লাঠি হাতে ওদের পাশে দাঁড়ানো। দারোগা সাহেব বরফ শীতল গলায় বললেন, “ আশা করি, পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারে ধারণা আছে। যদি সত্যিটা বলে দাও তাহলে কষ্ট কিছুটা কম হবে। না হলে তো বুঝতেই পারছো।”
শরিফ চাপা গলায় বললো, “ ভাইয়ার কোন দোষ নেই। সব দোষ আমার।”
“অপরাধীকে বাঁচানোর চেষ্টা করাও একটা অপরাধ। যাইহোক তুমি তোমার কথা বলো।”
“ ভাবীদের বাড়িতে এক মহিলা ভাড়া থাকে। অসম্ভব রূপবতী। আমি তাকে খুব পছন্দ করি। ভালোও বাসি। নানানভাবে প্রস্তাব দিয়েছি। কখনও রাজি হয়নি। ভালোভাবে বুঝিয়েছি, ভয় দেখিয়েছি। কিছুতেই কিছু লাভ হয়নি। শেষ পর্যন্ত সে ভাবীর কাছে আমার ব্যাপারে নালিশ করলো। ভাবী খুব বাজে ভাষায় আমাকে গা’লা’গা’লি করলো। থা’প্প’ড় মা’রলো। এই পর্যন্ত হলেও ঠিক ছিলো। কিন্তু না, ভাবী থামলো না। মা’কে নালিশ করলো, ভাইয়াকে যা ইচ্ছে তাই বললো। সেদিন থেকে প্রতিজ্ঞা করেছি ওই মহিলাকে আমি জব্দ করে ছাড়বো। কিন্তু ভাইয়ার কারণে কখনও ভাবীর কিছু করতে পারিনি।
এরপর থেকে অন্য পরিকল্পনা করলাম। যে ভাবীকে নালিশ করছে তাকে চরম শিক্ষা দেবো। এমন দশা করবো যে সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না। পথের ফকির বানিয়ে দেবো একদম।
কিন্তু ও বাড়িতে তেমন যাওয়া-আসা ছিলো না। ভাবীর রাগারাগি পর একদমই যেতাম না। ভাবলাম রাতুলের মতো সেজে কাজটা করলে কেমন হয়। রাতের অন্ধকারে সবাই আমাকে রাতুলই ভাববে।
পরিকল্পনা মতো ভাবীদের বাড়ি গেলাম। আমার রাতুলের একটা জামা প্রয়োজন ছিলো। যাতে দূর থেকে আমায় রাতুল মনে হয়। একই পারফিউম, হাতের ওর মতো তিল। দিন-রাত ওকে ফলো করা শুরু করলাম। কিভাবে হাঁটে, কেমন কথা বলে। পরিকল্পনা তৈরিই ছিলো। দরকার ছিলো সুযোগে। কয়েকদিন আগে জানলাম রাতুল নাকি কিসব কান্ড করেছে, ভাই প্রচন্ড রেগে গেছে। তক্ষুনি ভাবীকেও ও বাড়িতে পাঠিয়ে দিলো। আমি ভাবলাম এই সুযোগে মিস করা যাবে না। রাতের থেকে দিনের বেলা বেশি সুবিধা হবে। মুখে চাদর জড়িয়ে নেবো। দূর থেকে কেউ দেখে ফেললে রাতুল ভাববে। ভাবনা মতো রাতুলের জামা গায়ে চড়িয়ে বেরিয়ে পড়ালাম।
ইচ্ছে ছিলো তিনুদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেবো। হাঁস-মুরগি টাকা পয়সা শেষ করে দেবো। তারপর অন্য পরিকল্পনা।
কিন্তু ভাগ্য আমার সহায় ছিলো না। ভাবী আমাকে তিনুদের ঘরের কাছে দেখে ফেললো। ভাবীকে পুরনো রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। কেন না আজ এই মহিলাকেই শেষ করে ফেলি। কোমরের গোঁজা ছু’রিটা বের করে দিলাম কাজ হাসিল করে।”
শরিফ থামলো। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। এক নাগাড়ে কথা বলায় হাঁপিয়ে গেছে। দারোগা সাহেব ওর দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলেন। দুলাভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “ এবার আপনি বলুন। চুপ করে লাভ নেই। আমাদের কথা আদায় করার ধরণ জানা আছে। এর চেয়ে নিজে থেকে বলে দিলেই লাভ।”
দুলাভাই কটমট দৃষ্টিতে শরিফের দিকে তাকালেন। বিড়বিড় করে কয়েকটা গা’লিও দিলেন। হয়তো তিনি এমনটা আশা করেননি। দারোগা সাহেব হাসলেন। ঝলমলে গলায় বললেন, “ এ লোক ভালো কথায় শুনবে না। সেল রেডি করো।”
“ বলছি।”
“বেশ তো শুরু করুন।”
দুলাভাই জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন –
“ সকাল থেকেই মাথা গরম ছিলো। খাটে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। এমন সময় শরিফ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। ভিতু গলায় বললো, “ সর্বনাশ হয়ে গেছে। খুব বড় ঝামেলা করে ফেলেছি।”
“ কি হয়েছে? কি করেছিস?”
“ ভাবীকে ছু’রি মে’রেছি।”
“ মজা করিস না। মেজাজ গরম৷”
“ সত্যি কথা বলছি। এক্ষুনি আমায় দেশের বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করো। না হলে”
“ না হলে কি? কি করবি তুই? তোকে তো পুলিশে দেওয়া উচিত।”
“ তোমার মা’দ’কের ব্যবসার খবরটাও পুলিশে দেওয়া উচিত। ফাঁ’স’লে একসাথে ফাঁসবো। তাছাড়া ভাবীর ওপর এতো প্রেম এলো কবে থেকে? সে ম’র’লে তো তুমিও বেঁচে যাও।”
“ শরিফ! সীমা ছাড়িয়ে যাস না।”
“হাতে সময় নেই। ওরা পুলিশে খবর দিতে পারে। চিন্তা করো না। ভাবীর বেশি লাগেনি। ওরা হাসপাতালে নিয়ে যাবে। তোমার বউ ম’র’বে না। আমাকে বাঁচাও।”
হাসপাতালে এলাম। মিতালির অবস্থা দেখার পর মনে হলো শরিফের কথা মেনে নেওয়াই ঠিক। মিতালির তেমন কিছু হয়নি। ঠিকমতো ওষুধ খেলে সেরে উঠবে। কিন্তু এসব ব্যাপার নিয়ে জলঘোলা হলে সমস্যা। শরিফ আমার গোপন ব্যাপার ফাঁস করে দিতে পারে। তাই কয়েকজন লোক ভাড়া করলাম। তাঁদের পুলিশ সাজিয়ে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো কই!”
ভাইয়া শান্ত গলায় বললো, ” দুলাভাই, অপরাধী ঠিকই শা’স্তি পায়। শুধু সময়ের অপেক্ষা।”
দুলাভাই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
চলবে