আনকোরা কাহিনী পর্ব-০৪

0
316

#আনকোরা_কাহিনী
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৪

রাত এগারোটা। রাত পেরোলেই আপার হাসপাতালে থাকার চার দিন পূর্ণ হবে। সেদিন ঝগড়া পর দুলাভাই এদিকে আসেনি। মা’কে কল দিয়ে বলেছে, ” আপনার মেয়ে আমার বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে। আমি এমনটা আশা করিনি। কখনও না। সে কিভাবে একজন অপরাধীকে লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করে। হোক সে নিজের ভাই। অপরাধী তো অপরাধীই হয়। সর্বপরি বলতে গেলে আপনার মেয়ে আমায় কখনও আপন ভাবেনি। আপনারা আপনাদের মতো থাকুন। আমার এইসব আর ভালো লাগছে না। ”

এসব কথা শুনে মা খানিকটা বিচলিত হলেও আপা তেমন প্রতিক্রিয়া নেই। বরঞ্চ আনন্দেই আছে।

“রাতুল কি ঘুমিয়ে গেছিস?”

” না আপা। জেগে আছি। কিছু বলবে?”

” তোর লাল শার্টটা হারিয়ে গেছিলো না? মনে করে দেখ তো। ”

আমি তেমন কিছু মনে করতে পারলাম না। লাল শার্ট কেনা বাদ দিয়েছে চার বছর হয়ে গেছে। আগের শার্ট এখন গায়ে লাগে না। আগের চেয়ে খানিকটা মোটা হয়েছি। আগের শার্টগুলো টাইট হয়ে যায়। আমায় চুপ থাকতে দেখে আপা বললো,” কি রে? কথা বলছিস না কেন? মনে নেই তোর?”

আমি বললাম, ” না আপা। মনে করতে পারছি না। মাঝরাতে তুমি লাল শার্ট নিয়ে পড়লে কেন? ঘুমাও। ডাক্তার তোমায় রাত জাগতে নিষেধ করেছে। ”

” তোকে বলেছিলাম না। আমার উপর যে হা’ম’লা করেছিলো তার পরনে তোর লাল শার্টটা ছিলো। ”

” হ্যাঁ বলেছিলে। ”

” কিন্তু হুট করে তোর লাল শার্ট চিনে ফেলার কোন যুক্তি নেই। কতশত শার্টের রং লাল তার ঠিক আছে নাকি! ”

” কি বলতে চাইছো? ”

” শেষবার তোর গায়ে ওই লাল শার্ট দেখেছি আমাদের বাড়িতে। মানে তোর দুলাভাইদের বাড়িতে। ঈদের সময়। বাজি পোড়াতে গিয়ে তোর জামার খানিকটা অংশ পু’ড়ে গেছিলো। আমি সেই জায়গাটা লাল সুতা দিয়ে সেলাই করে দিয়েছিলাম। কিন্তু তুই ভীষণ রাগ করলি। জামাটা না নিয়েই ফিরে গেলি। ”

” মনে পড়েছে। ”

” ওই জামাটা আমি আলমারি তুলে রেখেছিলাম। পরে ভাবীর কাছে দিয়ে দিয়েছিলাম তোকে দেওয়ার জন্য। ”

” কিসব বলছো? ভাবী তো কখনও কোন জামা দেয়নি।”

” আচ্ছা। এসবের সাথে ভাবী জড়িয়ে নেই তো? পুলিশের ওপর আমার কোন বিশ্বাস নেই। তুই একটু নিজের মতো করে খোঁজ লাগা। মনে হচ্ছে এসব কোন গভীর ষড়যন্ত্র। ”

আমি ভালো-মন্দ কোন উত্তর দিলাম না। চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। চাঁদের আলোয় শহরটা অন্যরকম লাগে। অদ্ভুত সুন্দর। তবে সে সৌন্দর্য উপভোগ করাটা খুব কঠিন। রাস্তায় ল্যামপোস্টের আলো জ্বলছে।

সকাল হতে না হতেই দুলাভাই এসে হাজির। এসেই মা’য়ের হাত পা ধরে মাফ চাইতে আরম্ভ করেছে। রাগের কারণে তার মাথা ঠিক ছিলো। ইত্যাদি ইত্যাদি। সেসব কথা শুনতে ইচ্ছে করলো না। চুপচাপ হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলাম। আপার কথামতো কাজ করতে গেলে একজন গোয়েন্দা খোঁজ করতে হবে। আমার পক্ষে এসব কে’স সমাধান করা সম্ভব না। সবাইকে ধরে ধরে পেঁচানো প্রশ্ন করো। কে কি উত্তর দেয় খেয়াল করে শোনো। খুবই ঝামেলার কাজ!

আমার এক বন্ধুর এসব ব্যাপারে বেশ আগ্রহ ছিলো। শুনেছি কয়েকটা কে’সও সমাধান করেছে। কে’স সমাধান করলে নাকি মোটা টাকা পাওয়া যায়। মোবাইল ঘেঁটে তার নম্বর বের করলাম। ওর সাথে যোগাযোগ নেই অনেকদিন। নম্বরটা চালু আছে কি-না কে জানে। আল্লাহর নাম নিয়ে কল দিলাম। নাহ, রিং হচ্ছে। দু’বার রিন হওয়ার পর কল রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে একটা মেয়ের রিনরিনে মিষ্টি গলায় শোনা যাচ্ছে। মেয়েটা খুব সুন্দর করে সালাম দিলো। নরম গলায় বললো, ” কে আপনি?”

” এটা কি পারভেজের নম্বর?”

” হ্যাঁ। নম্বরটা তো ভাইয়ার কিন্তু ভাইয়া আপাতত বাসায় নেই। মাগরিবের আগে তাকে পাওয়া যাবে না। খুব বেশি দরকার হলে নদীর পাড়ে চলে যান৷ ভাইয়া সেখানে মাছ ধরছে। রোগা মতো ফর্সা একটা ছেলে। একটা বকুল গাছের নিচে বসে বরশী দিয়ে মাছ ধরছে। রাখছি। ”

কল কেটে গেল। কি অদ্ভুত মেয়ে রে বাবা। ভালো-মন্দ কিছু বলার সুযোগই দিলো না। হুট করে দুলাভাই আসার কারণে সকালে খাওয়া হয়নি। মানুষটাকে আমার কাছে মাকড়সার মতো লাগে। মেয়ে মাকড়সা। পেটে ডিম নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

খাওয়ার জন্য একটা দোকানে ঢুকলাম। একটা পরোটা দশ টাকা। ডিম ভাজা বিশ টাকা। আজকালকার দিনে টাকার কোন মূল্য নেই। পকেটে মাত্র একশো টাকার একটা নোট পড়ে আছে। বেকার অবস্থা না ঘুচলে পকেটের উন্নতি হওয়ার কোন লক্ষণ নেই।

খাওয়া শেষে বাড়ি ফিরে এলাম। পারভেজের সাথে দেখার করতে নদীর পাড়ে যেতে ইচ্ছে করলো না। একবার সন্ধ্যাবেলা ওদের বাড়ি যাবো। আন্টি খুব সুন্দর চা বানায়। চিনি একদম পারফেক্ট থাকে। চায়ের ওপর সর ভাসে না। ভাবীর মোবাইলটা চেক করতে হবে। আপা বোধহয় ভাবীকেই সন্দেহ করেছে। কিন্তু এসব কাজে ভাবীর কি লাভ? আপাদের সাথে ভাবীর গলায় গলায় প্রেম।

“রাতুল কখন এলে? আপার কি অবস্থা? মা’য়ের কোমরে ব্যাথা করেছে?”

” এইতো এক্ষুনি এলাম। আপার অবস্থা আগের চেয়ে বেশ ভালো। মা’য়ের কোমরে ব্যাথা নেই।”

” যাক ভালোই হলো। সকালে খেয়েছো? না খেলে এসো। বিরিয়ানি রান্না করেছি। ”

” তুমি আজ-কাল রান্নাবান্নাও শুরু করেছো। বেশ ভালো। ”

” কেন তোমার ভাবী বুঝি রাঁধতে পারে না?”

” পারলেও তেমন একটা রান্না করে না। ”

” যাইহোক বাদ দাও। আপার খবর শুনে মনটা ভালো লাগছে। তুমি খেতে আসো। মুখ দেখে মনে হচ্ছে পেট খালি আছে। ”

ভাবি রান্নাঘরে চলে গেলো। আমার পেট খুব একটা খালি নেই কিন্তু বিরিয়ানির নাম শুনে খিদে লাগতে শুরতে করেছে। এই খাবারের সাথে কিছুর তুলনা হয় না। ভাবী প্লেট সাজিয়ে দিলো। খুব সুন্দর পরিবেশনা। প্লেটের কোণায় সালাত, বাটিতে দই। যেন কোন উৎসব বাড়ি। খাবারের স্বাদটাও অসাধারণ।

কয়েক গাল মুখে দেওয়ার পর থেকে অদ্ভুত লাগতে শুরু করলো। কেমন৷ যেন গলা জ্বলছে। শরীরের ভেতর খারাপ লাগছে। বমি পাচ্ছে। খাবার শেষ করতে পারলাম না। তার আগেই বমি শুরু হলো। শব্দ শুনে ভাবী দৌঁড়ে এলো। ব্যস্ত গলায় বললো, ” কি হলো তোমার? খাবারে কোন সমস্যা নাকি?”

” জানি না। খুব খারাপ লাগছে। ”

” মাথায় পানি দিয়ে শুয়ে থাকো। আমি ওষুধ দিয়ে যাচ্ছি। ”

ভাবী দুইটা ওষুধ দিয়ে গেলো। একটা ওষুধের রং সবুজ। দেখলে মনে হয় কোন ফলের বীজ। ওষুধ খেয়ে বিছানায় পিঠ এলিয়ে দিলাম। শরীরটা বড্ড ক্লান্ত লাগছে।

যখন ঘুম ভাঙলো তখন রাত হয়ে গেছে। জালানা দিয়ে চাঁদের আলো ঘরে ঢুকছে। আমার মাথার কাছে একজন নারীমুর্তি। পরনের নীলচে শাড়িটা চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বল করছে। সে আমার কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কত স্নেহ মিশে আছে এ ছোঁয়ায়!

” ছোট আপা কখন এলে?”

” বিকেলে। তোর কেমন লাগছে এখন?”

” ভালো লাগছে। তুমি কষ্ট করে আসতে গেলে কেন? দুলাভাই একা থাকবে। ”

” ওসব চিন্তা করতে হবে না। রান্না করে রেখে এসেছি। অফিস থেকে ফিরে খেয়ে নিবে। কিসব হচ্ছে বল তো।”

” কি হচ্ছে? ”

” পুলিশ বড় আপার ব্যাপারে কোন কিছু করতে পারছে না। দুলাভাই আবার বিকেলে আপার সাথে ঝগড়া করেছে। তুই অসুস্থ। ভাবী সন্ধ্যা থেকে কাঁদছে। ”

” ভাবী কাঁদছে কেন?”

” ভাইয়া আসছে না তাই। ”

” ভাইয়া কোথায় গেছে?”

” কোন মেয়েকে নিয়ে নাকি পালিয়ে গেছে। ”

” এসব কি বলছো তুমি? সত্যি নাকি?”

” জানি না। ”

আমার মোবাইল বাজছে। বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা বের করে কানে ধরলাম। ওপাশ থেকে ভাইয়ার গলা শোনা গেল। ভাইয়া মিনমিনে গলায় বললো, ” রাতুল তুই যেখানেই থাকিস। এক্ষুনি হাসপাতালের পেছনে চলে আয়। কোন প্রশ্ন করবি না। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। চুপচাপ চলে আসবি। কুইক। ”

ফোন নামিয়ে রাখলাম। ছোট আপা বললো, ” কে কল দিয়েছে? ”

” কেউ না। আমার একটু কাজ আছে। আমাকে যেতে হবে। ”

” কোথায় যাবি?”

” পারভেজের সাথে দেখা করতে। ”

” পারভেজ কে? ”

” আমার গোয়েন্দা বন্ধু। টেনশন করো না। তুমি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”

ভাইয়ার সাথে কতবার এমনভাবে দেখা করেছি ঠিক নেই। হুট করে কল দিয়ে তার কাছে যেতে বলে। প্রতিবার কোথাও না কোথাও ঘুরতে গেছি, কিছু না কিছু খেয়েছি। কিন্তু আজ ব্যাপারটা অন্য রকম লাগছে। কেমন একটা ভয় ভয় করছে।
বের হওয়ার আগে পারভেজকে কল দিলাম। এবারও মেয়েটা কল ধরেছে। রিনরিনে গলায় জানালো তার ভাই এখনও বাড়ি ফেরেনি। কখন ফিরবে বলতে পারছে না। বোধহয় আজ কোনো মাছ পায়নি তাই এখনও ফেরেনি। ভাই আসলে তাকে আমার কথা জানাবে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে রিকশায় চড়ে বসলাম। রাত খুব বেশি না। রাস্তায় লোকের ভীড়। কেউ কেউ ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ফুচকা- চটপটি খাচ্ছে। হঠাৎ একটা মেয়ের দিকে চোখ আটকে গেল। সেদিনের সেই মহিলা পুলিশটা। দু-হাত ভরে চুরি পরে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে লাল রঙের সালোয়ার-কামিজ। ওড়নাটা কোমরে বাঁধা। অদ্ভুত লাগলো ব্যাপারটা! পুলিশের এমন সাজ হবে কেন? নাকি কোন অপরাধীকে ধরতে এমন সেজেছে।

ভাইয়া হাসপাতালের পেছনে ল্যামপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে তেমন লোকজন নেই। রাস্তা পরিষ্কার। ল্যামপোস্টের আলোয় ভাইয়াকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। ডান হাতে একটা ছু’রি চকচক করছে। আমায় দেখে মুচকি হাসলো। কি অদ্ভুত হাসি। সারা শরীরের লোক দাঁড়িয়ে যায়।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে