#আনকোরা_কাহিনী
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৩
আমি ভালো-মন্দ কিছুই বললাম না। মা আপার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কি অসহায় সেই দৃষ্টি!
দুলাভাই নিজের কথা রাখলেন। সকাল হতে না হতে পুলিশ নিয়ে হাজির হলেন। তার ধারণা আপাকে যে খু’ন করতে চাইছে সে আবার চেষ্টা করবে। পুলিশের হাতে ব্যাপারটা থাকলে হয়তো কিছুটা ভরসা পাওয়া যেতে পারে। দারোগা সাহেব দুলাভাইয়ের পরিচিত। দু’জন কনস্টেবল সাথে নিয়ে তিনি নিজেই এসেছেন। এসে থেকে আপাকে নানান রকমের প্রশ্ন করছেন। আপা সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে চাইছে না। মুখ বেজার করে মা’য়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মা দুলাভাইয়ের কাজে বেশ সন্তুষ্ট। আগ্রহ নিয়ে সব কথা শুনছে। নিজেও কিছু উত্তর দিতে চাইছে।
দুলাভাই কেবিনের ভেতর থাকলেন না। বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছেন। মাঝেমধ্যে দরজায় উঁকি কথা বলছেন। কর্কশ গলা। খানিকটা কাকের মতো। আমি নিরস মুখে দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি৷ শরীরটা ভালো লাগছে না। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। খানিক বাদে নার্সের সাথে দুলাভাইয়ের কথা কাটাকাটি শুরু হলো। সেসব কথার কিছুটা আমার কানেও এলো।
নার্স মেয়েটা কর্কশ গলায় বলছে, ” আপনার হাসপাতালে পুলিশ নিয়ে এসেছেন কেন? পারিবারিক সমস্যা বাড়িতে মেটাতে পারেন না। ”
দুলাভাই গম্ভীর গলায় বললো, ” আমার স্ত্রীকে খু’ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। এতে খানিকটা উদ্বিগ্ন হয়ে আছি। এসব সেন্টিমেন্টাল ব্যাপার আপনি বুঝবেন না। তাছাড়া আমরা কেবিন নিয়েছি। আপনাদের সমস্যা হওয়ার কথা না। ”
” না বুঝলে না বুঝবো। কিন্তু এভাবে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করছেন কেন? কেবিন নিয়েছেন কেবিনের ভেতর যান। ”
” কেবিনের ভেতর এতো লোক ধরে না। ”
” না ধরলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন। আপনার চিৎকারে অন্য রোগীদের অসুবিধা হচ্ছে। ”
দুলাভাই শেষ পর্যন্ত সুবিধা করতে পারলেন না। মেয়েটার কথায় অন্য রকম ঝাঁঝ আছে। এসব মেয়েদের সাথে কথায় পারা যায় না। দুলাভাই গোমড়া মুখে কেবিনে ঢুকলেন। তেঁতো গলায় বললেন, ” আমার ছোট শালাকে সন্দেহ হয়। ওই পরিকল্পনা করে আমার বউকে ও বাড়িতে নিয়ে গেছিলো। ব্যাপারটা একটু দেখবেন। ”
দারোগা সাহেব আমার দিকে তাকালেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন, ” সত্যি নাকি? এসব তুমি করেছো?”
” না। আমি কিছু করিনি। আর করলেও আপনারা খুঁজে বের করুন। অপরাধী শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজের দোষ লুকিয়ে রাখতে চায়। আমি অপরাধী হলে আমিও তাই করার চেষ্টা করবো।”
দারোগা সাহেব হাসলেন। সেই হাসিতে তৃপ্তি লুকিয়ে আছে। মা’য়ের মুখে আগের মতো খুশি খুশি আভা দেখা যাচ্ছে না। পুলিশরা বেরিয়ে যাওয়ার পর মা বললো, ” বাবা তুমি কেমন কথা বললে? রাতুল কেন মিতালিকে খু’ন করতে চাইবে?”
” মা আপনার কাছে নিজের ছেলে-মেয়ে সমান হলেও আমার কাছে আমার বউ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কাল সকালে আপনার ছেলে আমায় কল দিয়ে বললো সে নাকি আপনার বিয়ে ঠিক করেছে। আপনি খুব একা অনুভব করেন। আগামী শুক্রবার বিয়ে। আমি যেন পরিবার নিয়ে দাওয়াত খেতে আসি। এমন অস্বাভাবিক কথায় কোন মানুষের পক্ষে শান্ত থাকা সম্ভব না। আমিও পারলাম না। রেগে গিয়ে আপনার মেয়েকে পাঠালাম সবকিছু সামলানোর জন্য। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল! যাইহোক পুলিশ সত্য বের করবে। আমার ধৃষ্টতায় কিছু মনে করবেন না। এখন আপনাদের বাড়িতে যাবো। পুলিশ সেখানে তদন্ত করতে যাবে। আপনি চাইলে আমার সাথে যেতে পারেন।”
মা দুলাভাইয়ের সাথে বেরিয়ে গেল। মা’য়ের কোমরে ব্যাথা করছে। ছোট আপা আসছে। সে আসলে আমিও বাড়ি যেতে পারি। সবাই চলে যাওয়ার পর আপা অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। নরম গলায় বললো, ” আমি ম’রে গেলেই বা কি হতো! এতো বছর বিয়ে হয়েছে এখনও বাচ্চা হয়নি। কত লোকের কত কথা, কত অপমান। এ জীবনের কি দাম আছে বল তো?”
“বাজে কথা বলো না তো। মেজাজ ভালো নেই।”
” আমার জন্য তোর এতো সমস্যায় পড়তে হলো। আমাকে মাফ করে দিস ভাই। ”
” এভাবে বলছো কেন? আমার কি কিছু হয়েছে নাকি? তাছাড়া তুমি কি করেছো?”
” হতে কতক্ষণ? তুই ওই মানুষটাকে চিনিস না। তোর ক্ষতি করতে ওর বিন্দুমাত্র দ্বিধা কাজ করবে না। ”
” তুমি কি আমাদের সাথে থাকতে পারো না? এতো অপমান, অত্যাচার সহ্য করে ওখানে পড়ে আছো কেন? তাছাড়া একটা বাচ্চা কি সংসারের সব? স্বামী-স্ত্রী মহব্বত বলে কি কিছুই নেই?”
” সংসারে বাচ্চা সবকিছু না হলেও বেশি অনেকটা। আর স্বামী-স্ত্রীর মহব্বত সবার ভেতর থাকে না রে। সময়ের সাথে সাথে ফিকে হয়ে যায়। ”
” তোমরা ডাক্তার দেখাতে পারো না? আজকাল কতশত সমাধান আছে। ”
” তোর কি মনে হয় ভাই? ওরা আমায় ডাক্তার দেখায়নি? এ শহরের এমন কোন ডাক্তার নেই যে দেখাইনি। শুধু এ শহর কেন? খুলনা, বরিশাল, ঢাকা কোথাও হয়তো আর কোন ডাক্তার বেঁচে নেই। সমস্যা আমার নয়, ওই মানুষটার। সেজন্যই ও বাড়িতে থাকতে পারি। না হলে কবেই আমায় বের করে দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করতো। ”
আপা আদর্শ স্ত্রী মতো স্বামীর সব কথা মেনে চলে। শশুরবাড়ির প্রতি তার অশেষ দরদ। এতো বছর বিয়ে হয়েছে এখনও বাচ্চা হয়নি। তবুও দুলাভাই আপাকে চোখেচোখে রাখে। একা একা কোথাও যেতে দেয় না। আমাদের বাড়িতেও আসতে দেয় না। কয়েকদিন আগে আপার খোঁজ-খবর নেওয়ার জন্য কল দিয়েছিলাম। ভাগ্যক্রমে দুলাভাই তখন বাড়ি ছিলো না। কথা বলার এক পর্যায়ে আপা অভিমানী গলায় বললো, ” তোরা তো আমায় ভুলেই গেছিস। কখনও দেখতে আসিস না। তোর দুলাভাই সময় পায় না। আমিও যেতে পারি না।”
” তুমি খুব আসো মনে হয়। তুমি কি কচি খুকি? একা আসতে পারো না? ”
” কি করবো! তোর দুলাভাই তো সময়ই পায় না। সে আমাকে কখনো একাও ছাড়ে না। ”
” দুলাভাই তোমায় একা ছাড়বে। বাজি ধরতে পারো। ”
” আচ্ছা বাজি। জিতলে তুই যা বলিস তাই। ”
সেদিনের কথা রাখতেই দুলাভাই কল দিয়ে মা’য়ের বিয়ের কথা বলেছিলাম। বড় জামাই হওয়ার সুবাদে বাবা-মায়ের সঙ্গে ওনার সম্মানও বেশ অনেকটা জড়িয়ে আছে। মা’য়ের বিয়ের ব্যাপারটা উনি একদম মেনে নিতে পারবেন না। কিন্তু এমন কিছু হবে ভাবতেও পারিনি। বড় আপাকে কিছু বলতে যাব এমন সময় ছোট আপা কেবিনে ঢুকলো। ব্যস্ত গলায় বললো, ” রাতুল বাড়ি যাও তো। দুলাভাই পুলিশ নিয়ে গেছে। একটু আগে ভাইয়া কল দিলো। দুলাভাই যে কি করে না!”
তড়িঘড়ি হাসপাতালে থেকে বেরিয়ে এলাম। এই ঝামেলা কোথায় গিয়ে শেষ হবে বুঝতে পারছি না।
বাড়ির অবস্থা দেখার মতো। দারোগা সাহেব দু’জন কনস্টেবল আর একজন মহিলা পুলিশ নিয়ে এসেছেন। মহিলা পুলিশটা তিনুর মা আর ভাবীর সাথে কথা বলছে। ভাবী সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কাঁদছে। একবিংশ শতাব্দীর ক্যারিয়ার সফল নারীর এমন কান্না বড্ড বেমানান লাগছে। কনস্টেবল দু’জন বাড়িঘর তল্লাশি করছে। ভাইয়া আর দুলাভাই দারোগা সাহেবের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তিনজনই চুপচাপ। নিরবতা কাটিয়ে দুলাভাই বললে উঠলেন, ” স্যার, আপনাকে যা বলেছিলাম। রাতুলের ব্যাপারটা। ওদিকটায় একটু নজর দিবেন। ”
ভাইয়া কৌতুহলী হয়ে বললো, ” রাতুলের কোন ব্যাপার?”
” আপনার দুলাভাই রাতুলকে সন্দেহ করছে। এ ব্যাপারে আপনার কি মত?”
ভাইয়া গম্ভীর গলায় বললো, ” আমাদের চার ভাই-বোনের মধ্যে কোন সমস্যা নেই। এসব অবান্তর কথায় কান দিবেন না। আর দুলাভাই আপনি এমন কথা ভাবেন কি করে?”
দুলাভাই উত্তর দিলেন না। শুকনো মুখে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলেন। ভাইয়া ভাবীকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। তাদের নাকি অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। শুক্রবার কিসের অফিস কে জানে!
কথাবার্তার এক পর্যায়ে জানতে পারলাম তিনুর মা সেদিন বাড়িতে ছিলো না। এসব কে’সের সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই। তাছাড়া আপার সাথে তার কোন প্রকার শত্রুতা নেই। তাকে যেন এসব বিষয়ে না জড়ানো হয়। ভাবীও বিশেষ কিছু বলতে পারেনি। দুলাভাই আমার ব্যাপারে কোন প্রমাণ দিতে পারছে না। সবকিছু দেখে দারোগা সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। পরক্ষণেই ঝলমলে গলায় বললেন, ” সব কে’সের শুরুতে এমন অবস্থা থাকে। আস্তে আস্তে ধোঁয়াশা কেটে যাবে। আর একবার হাসপাতালে যেতে হবে। উনার সঙ্গে কথা বলা খুব জরুরি। তবে আজ আর সময় পাবো না। ”
দুলাভাই দারোগা সাহেবের সাথে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় একবার আড়চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমি মুচকি হাসলাম। রহস্যময় হাসি। এ হাসি উনাকে বেশ অস্বস্তিতে রাখবে।
সন্ধ্যা নাগাদ আবার হাসপাতালে গেলাম। আপা অবস্থা আগের চেয়ে বেশ ভালো। এন্টিবায়োটিক ইনজেকশনের কারণে ব্যাথা খানিকটা কমে আসছে। ক্ষত শুকাতে শুরু করেছে। গিয়ে আপার পাশে বসলাম। কপালে হাত রেখে কোমল গলায় বললাম, ” আপা সেদিন তোমায় কে আ’ঘা’ত করেছিলো? তুমি কি তাকে দেখোনি?”
আপা স্বর নিচু করে বললো, ” না দেখিনি। তবে তার গা থেকে তোর গায়ের গন্ধ আসছিলো। পরনে ছিলো তোর লাল শার্ট। লোকটার হাতে তোর মতো তিল। তবুও আমার বিশ্বাস ওটা তুই ছিলি না। সেজন্যই পুলিশকে কিছু বলতে পারছি না। ”
দুলাভাই দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বললো, ” ভালোই চলছে তাহলে। আমি ম’রি তার জন্য, আর সে ম’রে। এই কথাটা সত্যি হলেও নেহাৎ কুরুচিপূর্ণ। না হলে শেষ করতে পারতাম। ”
মা দুলাভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে হতাশ চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। মা’য়ের চোখ দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি পানি বেরিয়ে আসবে। কি মমতা সেই চোখে! যেন সাগরের সব পানি দু-চোখে লুকিয়ে আছে।
চলবে