#আনকোরা_কাহিনী
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -২
দুলাভাই আমার দিকে তেড়ে আসলো। ভাইয়া এসে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো। বারান্দার কোণে ছোট মেয়েটা সেদিকে হা করে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার চোখেমুখে আ’ত’ঙ্ক। শেষ পর্যন্ত ভাইয়া কোন রকমে দুলাভাই শান্ত করে আমার কাছে এলো। হতাশ গলায় বললো, ” তুই বাড়ি চলে যা। দুলাভাইয়ের মাথা ঠিক নেই। কখন কি করে বসে বলা যাচ্ছে না। ”
” বৃষ্টির ভেতর কোথাও যেতে পারবো না। তাছাড়া আপার অবস্থা জানা হয়নি। এই মুহূর্তে বাড়ি যাওয়া সম্ভব না। লাগলে দুলাভাইকে চলে যেতে বলো। ”
” ভাই, একটু বুঝতে চেষ্টা কর। দুলাভাই রেগে পুলিশ ডাকলে ঝামেলা হয়ে যাবে। ”
” আচ্ছা বেশ। আমি উনার সামনে থেকে সরে যাচ্ছি। তুমিও আমার সঙ্গে এসো। ”
” আমাকে লাগবে কেন? ”
” বড় আপার ব্যাপারে সবকিছু খুলে বলবে। ভালো কথা, ছোট আপাকে খবর দেওয়া হয়েছে? ”
” বাড়িতে এসেছিল। আবার চলেও গেছে। এদের কান্ডকারখানা বোঝা খুব মুশকিলের কাজ। ”
দুলাভাই চেয়ারে বসে কটমট দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছে। যেন এক্ষুনি চোখের দৃষ্টিতে আমায় উধাও করে ফেলবে। ভাইয়াকে সাথে নিয়ে উনার চোখের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঝামেলা করতে ইচ্ছে করছে না।
” আপাকে পাওয়া গেছিলো কোথায়? তাছাড়া তুমি কিভাবে বুঝলে খু’ন করার চেষ্টা করা হয়েছে?”
” তিনুদের ঘরের পাশে। ফুলের ঝোপের আড়ালে। ”
” আপা তো ওদের সহ্য করতে পারে না। ওদেরকে নামিয়ে দেওয়ার জন্য মা’কে অনেকবার জোরাজুরি করেছে। কিন্তু মা শোনেনি। ”
” আজকালকার বাজারে কেউ অমন ভাঙাচোরা টিনের ঘরের জন্য পাঁচ হাজার টাকা ভাড়া দেয় নাকি? সেজন্য মা চাইলেও ছাড়তে পারছে না। ”
” কিন্তু আপা তিনুদের ঘরের কাছে গেল কেন? সে তো ওদিকে পা-ও মাড়ায় না। ”
” জানি না। তোর ভাবিকে বলেছিলাম তিনুর মা’কে ভাড়ার কথা বলতে। সে গিয়ে দেখে ফুলের ঝোপের আড়ালে কে যেন কাতরাচ্ছে। কাছে গিয়ে দেখে আপা। সারা শরীরের র’ক্ত মাখানো। ”
” কোথায় আ’ঘা’ত লেগেছে জানো নাকি?”
” পেটে। ”
” ডাক্তার কি বলেছে? মা কোথায়?”
” মা গিয়ে আপার জন্য বেড ধরে বসে আছে। সদর হাসপাতালে বেড পাওয়া বেশ মুশকিলের কাজ। ডাক্তার এখনও কিছু বলেনি। ”
বাইরে বৃষ্টি ধরে এসেছে। গাছের পাতাগুলোকে আগের থেকে সতেজ দেখাচ্ছে। ভাইয়াকে বলে বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম। কয়েকটা কাজ বাকি পড়ে আছে। আপার অবস্থা পরে জেনে নেওয়া যাবে।
বাড়ি ফিরে দেখি ছোট আপা চিন্তিত মুখে পায়চারী করেছে। কখন এসেছে কে জানে। কাছে গিয়ে বললাম, ” আপা তুমি কখন এলে? ”
” নাটক করবে না একদম। তুমি কেমন মানুষ? বড় আপার খবর শুনে আমাকে ফেলে রেখে চলে গেলে? বোন কি তোমার একার?”
” না, বোন তোমারও। ভুল হয়ে গেছে। আর কখনও এমন হবে না। ”
” আপার কি অবস্থা তাই বলো। ফালতু সাফাই শুনতে ইচ্ছে করছে না। ”
” তুমি শুধু শুধু রেগে যাচ্ছো। নিজেই সবকিছু বললে আর নিজেই এখন রাগ করছো। ”
” হ্যাঁ। আমি তোমাকে পার্কের সামনে দেখা করতে বলেছিলাম। কিন্তু এটা কখনও বলিনি যে কারো বিপদ-আপদ শুনলে আমাকে ফেলে চলে আসবে।”
” বড় আপার অবস্থা জানা যায়নি। ডাক্তাররা কিছু জানায়নি। পেটে আ’ঘা’ত লেগেছে। আর কিছু জানি না। ”
ছোট আপা মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে পড়লো। আপা আমার চেয়ে চার বছরের বড় কিন্তু আমাদের তুমি তুমি সম্পর্ক। মা’য়ের মুখে শুনেছি, ছোট বেলায় সবাই আমাকে তুই করে বলতো। এ নিয়ে আমি ভীষণ রাগ করতাম। তখন থেকে ছোট আপা তুমি করে ডাকে।
আজ পার্কের সামনে আপার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আপা বলেছিলো আমায় বাড়ির অবস্থা জানাবে। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল বুঝলাম না। এক সমস্যা ঠিক করতে গিয়ে অন্য সমস্যায় পড়ে গেলাম।
” বেশি চিন্তা না করে খেয়ে নাও। আমার আর ভালো লাগছে না। ভাবিও তখন থেকে ম’রা কান্না কাঁদছে। ”
” ভাবি কাঁদছে কেন?”
” জানি না। সে নাকি র’ক্ত দেখে খুব ভয় পেয়েছে। ”
” হতে পারে। ”
” যাইহোক তুমি খেয়ে নাও। তারপর হাসপাতালে খাবার নিয়ে যাবে। ”
” ছোট দুলাভাই কোথায়? ”
” তাকে কিছু জানানো হয়নি। ”
বিশেষ কিছু খেতে পারলাম না। প্লেটে হাত দেওয়া মাত্র খিদে উধাও হয়ে গেল। মনের মধ্যে খচখচ করছে। দুলাভাই উল্টো পাল্টা কিছু করে না বসে। মানুষটা তেমন সুবিধার না। চরিত্রও খুব বেশি ভালো না। আমাদের ভাড়াটে তিনুর মা’কে নাকি কিসব প্রস্তাব দিয়েছিলো। তাই নিয়ে বিশাল ঝামেলা। তারপর থেকে বড় আপা তিনুর মা’কে চোখে দেখতে পারে না। উনি নাকি দুলাভাইয়ের নামে মিথ্যে কথা বলছে। অথচ আমরা সবাই জানি তিনুর মা মিথ্যে কথা বলছে না। মানুষ হিসাবে মহিলা খুব চমৎকার। দারুণ রূপবতী। স্বামী মা’রা যাওয়ার পর থেকে এক ছেলেকে নিয়ে থাকে। আগের বাপের বাড়িতে থাকতো। কোন এক সমস্যার কারণে ভাড়া বাড়িতে এসে উঠেছে। সেলাই মেশিনের কাজ করে, কিছু হাঁস-মুরগি পালে, স্বামীর জমানো কিছু ছিলো। সবকিছু মিলিয়ে বেশ স্বচ্ছল পরিবার। আমাদের বাড়ি না ছাড়ার এটাও একটা কারণ। সব বাড়িতে হাঁস-মুরগী পালতে দেয় না।
চোখের পাতা লেগে এসেছিলো। এমন সময় ছোট আপা এসে ডেকে তুললো। ঝলমলে গলায় বললো, ” বড় আপার তেমন কোন সমস্যা হয়নি। পেটের চামড়া কেটেছে শুধু। সেলাই দিলে ঠিক হয়ে যাবে। তবে অনেক র’ক্ত বের হয়েছে। আপাতত সমস্যা নেই কিন্তু পরে র’ক্ত দেওয়া লাগতে পারে। ”
” ভালো খবর শোনালে। এখন দারুণ ঘুম হবে। ”
” ঘুমানোর সময় নেই। ভাবী রান্না করছে। সেগুলো নিয়ে হাসপাতালে যাবে। আর দুলা ভাইয়ের সাথে ঝালেমা করবে না। ”
” ঠিক আছে। ”
ভাবি বাড়িতে তেমন কাজ করে না। কিন্তু আজ কোমর বেঁধে রান্না করেছে। এইটুকু সময়ের মধ্যে চার পদের রান্না শেষ। এখন চুলার ওপর মুরগির গোশত। সারা ঘর মশলায় গন্ধে ভরে গেছে। ভালোই বুঝতে পারছি এসব খাবার দুলা ভাইয়ের পেটে যাবে। আপা বা মা কিছুই খেতে পারবে না।
হাসপাতালে গিয়ে জানলাম দুলাভাই কেবিন নিয়েছে। ওয়ার্ডে অতো মানুষের ভেতর থাকতে নাকি তার অস্বস্তি লাগবে। তাছাড়া কে কখন বমি করে, থুথু
ফেলে ঠিক নেই। বড়ই ঘেন্নার ব্যাপার!
আপার এখনও জ্ঞান ফেরেনি। পেটে ছয়টা সেলাই লেগেছে। তবুও ভাগ্য ভালো ভেতরে কোন ক্ষতি হয়নি। মা আপার ঘুমন্ত মুখের সামনে বসে দোয়া কালাম পড়ছে। আমায় দেখে ইশারায় চুপ থাকতে বললো। দুলাভাই কেবিনে নেই।
রাতের দিকে আপার জ্ঞান ফিরলো। মা তখন ঘুমচ্ছে। দুলাভাই এখনও ফেরেনি। মা’কে ডাকতে যাচ্ছিলাম। আপা ইশারায় চুপ থাকতে বললো।
” তোকে অনেক ঝামেলায় ফেলে দিলাম। তাই না রে ভাই?”
” না তেমন কিছু না। তুমি একটু শুয়ে থাকো। ”
” যে সমস্যা হয়েছে, তাতে আগামী কয়মাস শুয়ে থাকতে হয় আল্লাহ ভালো জানে। তোর দুলাভাই এসেছিল? ”
” এসেছিলো। কিন্তু এখন কোথায় আছে বলতে পারি না। ”
আপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। হতাশ গলায় বললো, ” আমাদের এসব না করলেই ভালো হতো। মানুষকে ধোঁকা দিতে গেলে এমনই হয়। ”
” তুমি এসব ভেবো না। আমরা ভুল কিছু করিনি। ”
” আমার জীবনটা এমন কেন হলো রে ভাই? বলতে পারিস কিছু? এতদিন বিয়ে হয়েছে অথচ একটা ছেলেমেয়ে নেই। সংসারে অশান্তি। ”
” সব ঠিক হয়ে যাবে আপা। চিন্তা করো না। ”
” কবে ঠিক হবে ভাই?”
মাথা নিচু করে বসে রইলাম। উত্তর দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। খানিকক্ষণ চুপ থেকে আপা বললো, ” আমি ম’র’লে সবকিছু ঠিক হয়ে যেত। আজ কেন বেঁচে গেলাম। ”
” আপা তুমি থামবে?”
আমাদের কথায় মা জেগে গেছে। চোখ খোলা দেখে নিচু হয়ে আপার কপালে চুমু খেলো। শব্দ করে বললো, ” আলহামদুলিল্লাহ। ”
” আচ্ছা আপা, তোমায় ছু’রি মা’র’লো কে? তাছাড়া তুমি ওদিকে গেছিলেই বা কেন?”
” তিনুর মা’য়ের থেকে দুইটা মুরগি কিনতে চেয়েছিলাম। তোর দুলাভাই দেশি মুরগী খাওয়ার কথা বলছিলো সেদিন। ”
আপা কথা শেষ করার আগে একজন নার্স এলো। রোগা লম্বা মতো একটা মেয়ে। একটা কাঁচের বোতল হাতে নিয়ে নাড়াতে নাড়াতে বললো, ” উনাকে দিয়ে কথা বলাচ্ছেন কেন? এতো কথা বললে তো পেটের সেলাই কেটে যাবে। তখন কি করবেন?”
মা খানিকটা লজ্জিত হলো। আমি মুখে কথা বলার সাথে পেটের সেলাই সম্পর্ক নির্ণয় করতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। নার্স মেয়েটা আপাকে ইনজেকশন দিয়ে চলে গেল। এরা প্রয়োজনের বেশি এক মিনিটও দাঁড়ায় না।
দুলাভাই আসলো রাত এগারোটার দিকে। এসেই নিজের ব্যস্ততা বর্ণনা শুরু করলো। ব্যবসার অবস্থা ভালো না। অনেক দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। মা উনাকে ভাত বেড়ে দিলো। খেতে বসেও নানান কথা বলছে। মনে হচ্ছে এটা ওনার বাড়ি অথবা পরিচিত কারো বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। মনেপ্রাণে চাচ্ছিলাম উনি যেন কোন নার্সের ঝাড়ি খান৷ কিন্তু কেউ এদিকে এলো না।
খাওয়া শেষ পকেট থেকে পান বের করে মুখে দিলেন। আঙুলের মাথায় চুন লাগাতে লাগাতে বললেন, ” মিতালিকে যে খু’ন করার চেষ্টা করেছে, তাতে আমি ছাড়বো না। দরকার হলে কাঁকড়ার গর্ত থেকে টেনে বের করবো। কার কলিজায় এতো সাহস জানা দরকার। খুব দরকার। ”
আমি ভালো-মন্দ কিছুই বললাম না। মা আপার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কি অসহায় সেই দৃষ্টিতে!
চলবে