আনকোরা কাহিনী পর্ব-০১

0
448

#আনকোরা_কাহিনী
সূচনা পর্ব
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল

ভরদুপুরে বড় আপা বাড়িতে এসে তীক্ষ্ণ গলায় বললো, ” এসব কি শুনছি রাতুল? তুই নাকি মা’য়ের বিয়ে ঠিক করেছিস? এখন কি মা’য়ের বিয়ে বয়স? ”

” বিয়ের আবার বয়স আছে নাকি? তাছাড়া মা’য়ের বয়স কত হবে! বড়জোর আটচল্লিশ। ”

” তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। অকারণে তুই আমাদেরকে বিব্রত করছিস। ”

” আমি অকারণে কোন কাজ করি না। তোমার হীরার আংটি চুরির ব্যাপারটাও কাউকে বলিনি। ”

আপা খানিকটা আৎতে উঠলো। ঝাঁঝালো গলায় বললো, ” এসব কি বলছিস তুই? কোন আংটি?”

আপার চিৎকার শুনে বাড়ির সকলে বারান্দায় জড় হয়েছে। তারাও খানিকটা অবাক হয়ে বললো, ” কিসর কথা বলছিস তুই?”

” ছোট আপার বিয়ের সময় যে আংটিটা চুরি হয়েছিল সেটার কথা বলছি। ”

মা বললো, ” এসব কি বলছিস? মিতালি কেন আংটি চুরি করতে যাবে? সে আংটি নিয়ে কত খোঁজাখুঁজি চললো। পুলিশ ডাকলো। পুলিশও তো কোন সন্ধান দিতে পারেনি। ”

” কেন চুরি করেছে তা তো জানি না। আর পুলিশের ব্যাপারটাও বলতে পারবো না। ”

বড় আপা রাগী গলায় বললো, ” দেখেছো মা? তোমার ছেলের কান্ড দেখেছো? সকালে তোমার জামাইকে কল দিয়ে বলেছে -ও নাকি তোমার বিয়ে ঠিক করেছে। এখন আবার আংটি চুরির কথা বলছে। তোমার ছেলে পাগল হয়ে গেছে। ভালো কোনো ডাক্তার দেখাও। ”

মা অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। বোধহয় আপার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। মা বিয়ের ব্যাপারে এখনও কিছু জানে না। সকালে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মনে হলো মা’য়ের বিয়ে দেওয়া দরকার। কথাটা মনে আসতেই বড় দুলাভাইকে কল দিয়ে পাত্র খুঁজতে বললাম। মা’য়েরও একটা জীবন। সারাদিন সংসারের কাজ করতে করতে মানুষটা বড্ড হাঁপিয়ে উঠছে। ফজর থেকে এশা পর্যন্ত সারাদিন কাজ। দু’দন্ড বিশ্রাম নেওয়ার সময় নেই। চার ভাই-বোনের মধ্যে বড় দু’বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামী সংসার নিয়ে ব্যস্ত জীবন তাদের। ভাইয়ের বিয়ে হয়েছে। ভাই-ভাবি দু’জনেই চাকরি করে। সংসারে দেওয়ার মতো সময় তাদের নেই। আমিও বেকার জীবনের রস আস্বাদন করতে খানিকটা ব্যস্ত থাকি। বাবা নেই। তাই মা’কে দেওয়ার মতো সময় কারোর হাতে অবশিষ্ট নেই। বাবা বেঁচে থাকলেও বোধহয় মা’য়ের তেমন লাভ হতো না। শেষ বয়সে বাবার জীবন খবরের কাগজ আর বাজারের থলেতে আটকে গেছিলো। এই দুই থেকে তিনি বের হতে পারেনি। মৃত্যুর সময়ও মুখের ওপর খবরের কাগজ পড়ে ছিলো। মা সেই কাগজ সরিয়ে জানতে পারলেন বাবা আর বেঁচে নেই। সে অনেকদিন আগে কথা, গত আশ্বিনে সাত বছর হয়েছে।

খানিকক্ষণ নিরবতায় কাটিয়ে মা আবার প্রশ্ন করলো, ” এসব কি শুনছি রাতুল? তোমার সাহস দেখে তো আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। তুমি বড় জামাইকে এসব কথা বলেছো কেন? ”

মা আমায় সাধারণত তুই তুই বলে, প্রচন্ড রেগে গেলে তখন তুমি করে কথা বলে। যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে বললাম, ” এমনি বলেছি। মজা করেছি। ”

বড় আপা তিরিক্ষি গলায় বললো,” এসব কোন ধরনের মজা? শশুরবাড়িতে আমার একটা মান-সম্মান আছে। আমি তোর মতো অকর্ম না যে বাপের টাকায় খেয়ে ফালতু কাজ করে বেড়াবো। ”

” বাপের টাকা খাওয়ার প্রসঙ্গ টানছো কেন? তোমার বিয়ের সময় বাবা দশ লাখ টাকা খরচ করেছে। দাদির দেওয়া সাত ভরি সোনার সীতা হারটাও তোমাকে দিয়েছে। এতোকিছুর পরেও তোমার মন ভরেনি। শেষ পর্যন্ত ধার করে তিন লাখ টাকা দিতে হয়েছে তোমার বরকে। সে নাকি ব্যবসা করবে। সেই তুলনায় আমি সামান্যই খরচ করি। ”

” খোঁটা দিচ্ছিস নাকি? আমাকে আমার বাপ দিয়েছে তুই বলার কে? তুই তো আর দিসনি। ”

” আমিও আমার বাপের টাকা খাই। তুমি খোঁটা দেওয়ার কেউ না। ”

আপা খানিকটা চুপসে গিয়ে মা’য়ের দিকে তাকালো। মায়ের চোখে-মুখে মমতা উপচে পড়ছে। সেদিকে এক বার তাকিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। কথোপকথনের গোটা সময়টা ভাই আর ভাবি চুপ করে থাকলেও এখন তারা মুখ খুলবে। সেখানে আমার থাকাটা মোটেও শোভা পায় না। আমি থাকলে কথা বাড়বে। ঝগড়ার পর্যায়ে চলে যেতে পারে। তাই এখন বাড়িতে না থাকাই ভালো।
বাইরের প্রচন্ড রোদ। টবের গাছগুলো নেতিয়ে পড়েছে। এমন রোদের ভেতর আপা এ বাড়িতে চলে এসেছে। অথচ সেদিন মা’য়ের অসুস্থতার কথা শুনেও আসতে পারলো না। রোদে পুড়লে তার মাথা ধরে, বমি হয়। সেই মানুষ আজ কাঠফাটা রোদের মধ্যে এ বাড়িতে চলে এলো। ভাবা যায়! হাঁটতে হাঁটতে পার্কের দিকে চলে এলাম। পার্কের কোথাও তেমন ছায়া নেই। বট গাছের নিচে খানিকটা ছায়া থাকলেও সেখানে দু’জন ছেলেমেয়ে বসে আছে। মেয়েটার চোখে-মুখে লাজুক হাসি। ছেলেটাও হাসছে। সেই হাসি আমার কাছে ভালো লাগলো না।

” রাতুল না? ভরদুপুরে পার্কের সামনে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”

পাশ ফিরে দেখি মুনসুর ভাই দাঁড়িয়ে আছে। আমার কলেজের সিনিয়র। লোকটার গলার স্বর খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে। হাসার চেষ্টা করে বললাম, ” একজনের জন্য অপেক্ষা করছি। এক্ষুনি এসে পড়বে। ”

” গার্লফ্রেন্ড নাকি? তা রোদের মধ্যে পার্কে কেন? অন্য কোথাও যেতে। ”

” না ভাই, তেমন কেউ না। পরিচিত একজন। এদিকটায় বাড়ি। ”

” চালিয়ে যাও। হয়ে যাবে।”

মনসুর ভাই হাসতে হাসতে আমার পিঠে একটা চাপড় মারলো। তারপর চলে গেল। কি অদ্ভুত লোক! জানা নেই শোনা নেই, নিজের মতো অনুমান করে নিলো।
অবশ্য আজকাল বেশিরভাগ লোকের স্বভাবই এমন। কিছু একটা বলে দিতে পারলে বেঁচে যায়। তবে উনি একটা কথা মন্দ বলেনি। অন্য কোথাও যেতে পারলে বেশ ভালো হতো। রোদের মধ্যে দাঁড়ানো যাচ্ছে না। সূর্যের তাপে রাস্তা গরম হয়ে গেছে। বেশ ক’দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে না। পিপাসাও লেগেছে। মিনিট দুয়েক সামনে হাঁটলে একটা মুদি দোকান। সেখানে গিয়ে এক বোতল পানি কিনলাম। পনেরো টাকা দাম। পানির স্বাধ বেশ ঝাঁঝালো। খানিকটা বৃষ্টির পানির মতো।

” এসেছো কতক্ষণ? ”

কাক্ষিত মানুষটাকে দেখতে পেয়ে মুখে হাসি ফুটে উঠলো। ঝলমলে গলায় বললাম, ” বেশিক্ষণ হয়নি? তোমার আসতে অসুবিধা হয়নি তো?”

” না, তেমন কোন অসুবিধা হয়নি। তুমি তো দেখছি পাক্কা খিলাড়ী। এক কথায় ঝামেলা শুরু করে দিয়েছে। ”

” বেশিরভাগ ছেলে-মেয়ে দ্বিতীয়বার মা’য়ের বিয়ে মেনে নিতে পারে না। সমাজও ব্যাপারটা একটু বাঁকা চোখে দেখে। তাই চেষ্টা করে দেখলাম। ”

” এসব করে লাভ হবে তো?”

” লাভ না হোক লস হবে না। তাছাড়া চেষ্টা করতে দোষ কী? ”

” চেষ্টায় দোষ কিছু নেই। আংটির ব্যাপারটা কি সত্যি নাকি? বড় আপা আংটি চুরি করেছিলো?”

” খানিকটা সত্যি। যাইহোক চলো কোথাও গিয়ে বসি। পরিচিত কেউ একসাথে দেখলে প্রশ্ন করতে পারে। বাড়ির অবস্থা কি?”

” বড় আপা কাঁদছে। মা তাকে স্বান্তনা দোওয়ার চেষ্টা করছে। মা বরাবর তার বড় মেয়ের প্রতি একটু বেশি দূর্বল। ”

” প্রথম মেয়ে। খানিকটা আহ্লাদী। ”

” কি জানি। মা তোমার বিয়েসাদির কথা বলে না? ”

” বেকার মানুষের বিয়ে কিসের! নিজে খেতে পাই এটাই অনেক। ”

” চাকরির চেষ্টা করো। ”

” চেষ্টা! তা করছি বটে। লাভ হচ্ছে না। ”

” চেষ্টা চালিয়ে যাও। ”

মোবাইল বাজছে। হয়তো বাড়ি থেকে কল দিয়েছে। দুপুরে খাওয়া হয়নি। বোধহয় সেজন্যই। পকেটে থেকে মোবাইল বের করতে করতে কল কেটে গেল। ভাইয়া কল দিয়েছে। কয়েক মুহূর্ত পরে আবারও কল। চেনা রিংটোন। কল রিসিভ করতে ওপাশে থেকে ভাইয়ার আতংকিত গলা শোনা গেল।

” রাতুল কোথায় তুই?”

” হাঁটতে বের হয়েছি। কেন? ”

” ভর দুপুরে কোথায় হাঁটতে গেছিস? কেউ একজন বড় আপাকে মা’র’তে চেষ্টা করেছে। ছু’রি দিয়ে পেটে আ’ঘা’ত করেছে। আপার অবস্থা খুব খারাপ। হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। তুই তাড়াতাড়ি আয়। ”

ভাইয়া এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো শেষ করে কল কেটে দিলো। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে। কে এমন করতে পারে? জানা মতে আপার তো কোন শত্রু নেই। শশুরবাড়ির লোকজনের সাথেও তার মিষ্টি মধুর সম্পর্ক।

” কোন সমস্যা? ”

” বড় আপাকে কেউ মা’র’তে চেষ্টা করেছে। আপার অবস্থা খুব খারাপ। আমাকে এক্ষুনি হাসপাতালে যেতে হবে। ”

” মা’রার চেষ্টা বলতে?”

” খু’ন করতে চেয়েছে। ”

” কি বলো? কে করেছে?”

” জানি না। ”

পাশ দিয়ে একটা রিকশা যাচ্ছিলো, লাফ দিয়ে তাতে চড়ে বসলাম। বড় আপা কেমন অবস্থায় আছে কে জানে। পেছনে তাকানোর সময় হলো না। পেছনে তাকলে হয়তো দেখতে পেতাম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত একটা মুখ। কি জানি! সেই মুখে রহস্যময় হাসিও লেগে থাকতে পারে।

ভাইয়া হাসপাতালের বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছে। ভেতরে ডাক্তার এসেছে। রোগীর অবস্থা জানা যায়নি। ভাইয়া আমায় দেখে এগিয়ে এলো। ধরা গলায় বললো, ” কি একটা অবস্থা দেখেছিস। গতকাল তোর ভাবীকে নিয়ে কক্সবাজার যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম আর আজ এইসব। এখন তো মাসখানেক ভেতরও যাওয়া হবে না। ”

” বড় আপার চেয়ে ঘোরাঘুরি করাটা তোমার কাছে বেশি জরুরি নাকি?”

” বুঝতে পারছিস না? আমার বোন হাসপাতালের বেডে জীবন-মরণ খেলা খেলছে আর আমি নাকি ঘুরতে চাচ্ছি। কি অদ্ভুত কথা বলিস! ”

” নিজেই তো বললে মাসখানেক ভেতর যাওয়া হবে না। ”

” কখন বললাম? ওই যে দুলাভাই এসেছে। ”

দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সত্যিই দুলাভাই এসেছে। পরনে নীল পাঞ্জাবি, পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে ফেলেছে। চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। ভাইয়া প্রায় ছুটে তার কাছে গেল। দু’জনের কি কথা হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। নতুন রোগী এসেছে। রোগীর আত্মীয় স্বজনরা ডাক্তারের সাথে ঝগড়া করছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা ভাঙা চেয়ারে বসে পড়লাম। দুপুরের খিদেটা চাগাড় দিয়ে উঠেছে। শরীরটাও বেশি ভালো লাগছে না। বাইরে রোদ নেই, অন্ধকার হয়ে গেছে। হয়তো বৃষ্টি নামবে। বলতে না বলতেই ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হলো। দুলাভাই আমার কাছে এসে বললো, ” তোমার জন্য তোমার বোনের এই দশা। এই খু’নের সাথে তুমি জড়িয়ে নেই তো?”

” আপার সাথে আমার কিসের শত্রুতা? ”

” সাত ভরি সীতাহার। ভুলে গেলে নাকি?”

” দুশ্চিন্তায় আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ঠান্ডা হাওয়ায় বসুন। মাথায় পানি ঢালুন। ”

দুলাভাই আমার দিকে তেড়ে আসলো। ভাইয়া এসে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো। বারান্দার কোণে ছোট মেয়েটা সেদিকে হা করে তাকিয়ে আছে।

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে