আগুনের দিন পর্ব-২+৩

0
549

আগুনের দিন ২ ও ৩।

৫.
মেঠো রাস্তার একপাশে কাউন আর পেঁয়াজের ক্ষেত। ফসল তোলা হয়ে গেছে অধিকাংশ। যা কিছু এখনো কৃষকের উঠোনে পৌঁছায়নি তা পাহারা দেওয়ার জন্য লোক আছে ক্ষেতেই। পালা করে সবার ফসল পাহারা দেওয়া হয়। একজন পাহারাদার দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত ফসলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। তার হাতে থাকে শক্ত বাইন কাঠের লাঠি আর সূচালো বল্লম। একটা রাত কেউ না থাকলেই মাঠ উজার হয়ে যাবে। রাস্তার অন্যপাশের মাঠ জুড়ে পাট বোনা হয়েছে। চারাগুলো মাথা উঁচু করতে শুরু করেছে। চার পাঁচদিন বয়স হবে এদের। মাথার উপরে মেঘহীন আকাশের মস্ত চাঁদের আলোয় ওদেরকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তবুও নিশা ভয়ে ভয়ে ময়নার হাত চেপে ধরে আছে। ময়না হাসছে, ‘তুমি এত্ত বড় হইছো, তাও ডরাও বুঝি? ভুত ভয় পাও, এখনো?’

ভুতের ভয় অনেক বেশি নিশার। কিন্তু হরর মুভিগুলো পছন্দের লিস্টে সবার আগে। এক্সরজিস্ট সিরিজ, কনজ্যুরিং দেখার লোভ সামলাতে পারে না, দেখতেই হয়। মুভিগুলো স্ক্রিনে থাকার সময় ভয় লাগে না। ও তো জানেই এগুলো সব মেকআপ, আলোর কারসাজি আর দারুণ দারুণ সব ভিজ্যুয়াল গ্র‍্যাফিক্সের কারসাজি। কিন্তু লাইট বন্ধ হলেই সব যুক্তি মাথা থেকে উড়ে যায়। খাটের নিচে কারো অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়, পাশ ফিরলেই হয়তো কোনো কদাকার মুখ দেখা যাবে সেই ভয় লাগে বলে সোজা হয়ে শুয়ে থাকে। ভয়ের নাটক সিনেমা অধিকাংশতেই দেখা যায়, বাথরুমের ট্যাপ থেকে টাটকা রক্ত আসছে, এই ভয়ে প্রাকৃতিক বেগ সামলে সুমলে রাখা লাগে। সিনেমা দেখার গরম গরম রাতগুলোতে ঘুমও যেন পালায়, পিপাসায় গলা কাঠ হয়ে থাকে। রাত তিনটের ঘন্টা বাজার সাথে সাথেই মনে হয় এই বুঝি রক্তপিপাসু আত্মারা ছুটে ছুটে এলো! এখনও এই মাঝরাতে দলে ভারী হলেও বুক ভয়ে টিপটিপ করছে, এই যদি কেউ একটু পেছনে পড়ে যায় আর ভয়ংকর কোনো আত্মা তাকে ‘পজেশনে’ নিয়ে নেয়! সাহেব, ময়না, রিমা, কান্তা, আরজিনা, বাশার, চৈতি, বন্যা এরা সবাই পাশাপাশি বাড়িতেই থাকে।

‘ওই বাশার, কথা বলিস না ক্যান? যাত্রা ভাল্লাগে নাই?’

‘সাহেববাই, ব্যাপক লাগছে। বাজনাগুলা ক্যামনে দেয় দেখছ? একেবারে খাপে খাপ!’

‘বাংলা সিনেমা যেগুলা বিটিবিতে দেখায়, তার চাইতে তো ভালোই, কী বলিস নিশা?’

কান্তার কথার উত্তর নিশা না দিলেও ময়না বলে উঠল ‘তয় নাইকাটারে কী সাজ দেয় এইগুলা! আর নাইকাটাতো মেয়েই ছিলো, কিন্তু ক্যামন জানি মরদের মতো, না?’

‘হ্যাঁ, নায়িকাটা সুন্দর না। কিন্তু ডাকাত সর্দারটারে দেখছ, কেমন পালোয়ান?’

‘আমার কাছে খারাপ লাগেনি। যেটা যেরকম সেটার প্রতি এক্সপেকটেশনও সেরকমই থাকে। এখন যাত্রা দেখতে এসে টলিউডের ঋতুপর্ণর সিনেমা দেখব সেটা আশা করলে তো হবে না।’ নিশা নিজের মতামত জানায়।

‘ঋতুপর্ণারে আমারও খুব ভালো লাগে। প্রসেনজিৎ এর সাথে সব সিনেমা করে।’

ময়নার কথার উত্তরে নিশা আবার বলে ‘ঋতুপর্ণা না ঋতুপর্ণ। ঋতুপর্ণ ঘোষ।’

‘ওই ব্যাটাটা যেইটা মাইয়া সাইজা থাকে?’ বাশার অবাক হয়েছে এমনভাবে বলল। ‘হিজরা লাগে ওইটারে পুরাই।’

‘ছিঃ, বাশার ভাই। মানুষকে তার কাজ দিয়ে মূল্যায়ন করতে হয়। সে কেমন দেখতে, কী পোশাক পরে বা কীভাবে কথা বলে এটা ইম্পর্ট্যান্ট না। সে খুব সুন্দর সুন্দর সিনেমা বানায়, তাই তাকে পছন্দ করি।’

‘আতামাথা সিনেমা বানায়। ঘুম আসে হের সিনেমা দেখতে বসলে। ফাইট নাই, গান নাই!’

নিশা হাসে। উত্তর দেয় না। সবাই যে সমান শিল্পবোদ্ধা হবে এমন ভাবাটা বোকামি। নিশা নিজেকে বোকা ভাবে না। তাই অকারণ তর্ক করে না।

মাঠ ফেলে গ্রামে ঢুকতেই ভয় আরও বেড়ে গেলো নিশার। ঠিক মোড়ের মাথায় ছোটো মাঠটার কোণা ঘেঁষে পরিত্যক্ত কুয়োর পাড়ে ঝাঁকড়া তেঁতুল গাছ। তার পাশে ছোটো ছোটো ডুমুর গাছ আর কাঁটাঝোপের জঙ্গল, খানিকটা জায়গা আড়াল করে রেখেছে। সেই মোড়টা পার হলে ঘন গাছপালাঘেরা সাগরের বাগান। দিনের বেলায় ঢুকতেই ভয় হয়। সেই বাগানের সীমানা লাগিয়ে তিনটে তালগাছ, একটা আবার আরেকটাকে পেঁচিয়ে উঠে গেছে। এই তালগাছের অনেক গল্প আছে, ময়না আর নিশার দাদির ঝুলিতে। সব গল্পই ছমছমে রহস্যময়তা নিয়ে শেষ হয়। পল্লী বিদ্যুৎ এর সুবিধা পৌঁছে গেছে সবখানেই, ইলেকট্রিক আলো সব ঘরে। কিন্তু বিদ্যুৎ খরচ বাঁচাতে জিরো পাওয়ার নামে এক বালবের প্রচলন আছে, ঘুটঘুটে অন্ধকারকে যা আরও বাড়িয়ে তোলে। নিশার হাতে তিন ব্যাটারির বড় টর্চলাইট। সেই আলো ও হিসেব করে ফেলছে, যেন রাস্তা ছেড়ে কোনোভাবেই পাশের বাগানগুলোর দিকে আলো না যায়। আলো গেলেই কোনো অশরীরী দেহধারী হয়ে উঠবে এ ও নিশ্চিত জানে! সবাই সবার মতো করে কথা বলছে, কিন্তু না চাইতেও নিশার চোখ রাস্তার পাশে পাশে অন্ধকারে চলে যাচ্ছে। কী একটা অদ্ভুত রকম জিনিস দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে রাস্তার উপর কিছু একটা আছে। কেউ একজন গবরের বোড়ে বানিয়ে শুকোতে দিয়েছে রাস্তার উপরেই। বাঁশের আড়ে ঠেস দিয়ে একেকটা বোড়ে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দেওয়া আছে। এরই আড়ালে কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। ভয় পেলে ওর এড়িয়ে যাওয়া উচিত, কিন্তু নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতিই মানুষের আকর্ষণ প্রবল। ও খুব ভালোভাবে টর্চের আলো ওইজায়গায় ফেলতে লাগল আর কেউ একজন খেঁকিয়ে উঠল ‘এই কে রে? কে আলো ফেলে? একদম চোখের উপর আলো ফেলতেছে। জ্ঞানবুদ্ধি নাই কিছু? বেআক্কেল নাকি?’

নিশা হতভম্ব হয়ে যায়। ওখানে দুটো ছেলে দাঁড়ানো। একজন বসে আছে আর একজন দাঁড়িয়ে। নিশার টর্চের আলো বসে থাকা ছেলেটার চোখে লেগেছে। নিশা চিনতে পারল ওকে। যাত্রায় নায়িকার সখি সেজে থাকা ছেলেটা। লজ্জায় নিশার ঠোঁট ফুলতে থাকল। এভাবে বলে কেউ?

সাহেব উত্তর দিলো ‘ওই আকাইম্মা? তুই ওইখানে পলায় আছিস, ও জানবে কেমনে?’

নিশাও কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল ‘সরি। আমি বুঝতে পারিনি।’

ছেলেটা অতিমাত্রায় অসভ্য। নিশার সরি বলাটা ওর উপর কোনো প্রভাব ফেলল না। ‘ওহ তুমিই মইন কাকার মেয়ে? শহর থেকে এসে ভাব নেও? আমরা কেউ যেন শহরে যাইনাই কোনোদিন? গ্রামে এসে শহরের ভাব মারাবা না। এইভাবে চোখে আলো ফেলাটা বেয়াদবি। মেয়েমানুষ না হলে এখনই হাত ভেঙে থুয়ে দিতাম! শিখে রাখো এইগুলা!’

‘ওই শফিইক্যা? কী বলস এইগুলা? ভালো কইরা কথা বল? কাক্কায় জানলে তোর খবর আছে।’

‘হুহ!’ বলে শফিক নামের ছেলেটা, সাথে থাকা অন্যজনকে নিয়ে ওদের আগে আগে হনহন করে হেঁটে চলে গেলো।

এই বয়সটাতে আত্মসম্মানবোধ থাকে চড়া। সমবয়সী ভাইবোন আর বন্ধুদের সামনে এভাবে অপমানিত হয়ে নিশা একেবারে মিইয়ে গেল!

রাত বারোটা বাজে। এমন কোনো দেরি না, কিন্তু গ্রামে এটাই ভয়াবহ রকম নিশুতি রাত। ডান হাতে শূণ্য গোচারণভূমি। হুহু করছে। এখানে নাকি চারটা আমগাছে কখনো আম হতে দেখা যায়নি। রাস্তার উপর বড় বড় অর্জুন,বহেরা,হরিতকি গাছ। সরকারি বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির আওতায় রাস্তার দুপাশে নানারকম ওষধি গাছ লাগানো হয়েছে। যার যার বাড়ির সামনের গাছগুলো সেই বাড়ির লোকেরাই দেখাশুনা করে। বলা আছে, এই গাছ বিক্রির টাকা অর্ধের যাবে সরকারি কোষাগারে আর অর্ধেক গ্রামবাসিরা পাবে। গাছগুলোর কারণে রাস্তাটা আরও অন্ধকার হয়ে আছে। ভরা চাঁদ আকাশে ভেসে বেরালেও নিচে ঘুটঘুটে আঁধার। টর্চটা ময়নার হাতে দিয়ে দিয়েছে নিশা। একটু আগের অপমানটা বারবার মনে আসছে। সামান্যতেই গলা ফেনিয়ে আসে ওর এখনো। ময়নার হাত ধরে আনমনা হয়ে যায়।

ওরা অর্জুন গাছগুলোর নিচে যেতেই গাছগুলো ভয়াবহভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। মনে হলো কোনো দৈববলে গাছগুলো ধরে নাড়া দেওয়া হয়েছে। কোনো বাতাস নেই, মানুষ নেই কিছু নেই, এমন হলো কেন? নিশা পাথর হয়ে গেল। ময়নাও ‘আল্লাহ গো’ ‘মা গো’ বলে কাঁদতে লাগল। ঠিক পেছনে ছিলো সাহেব, গালি দিয়ে চিৎকার করে উঠল ‘এই শুয়োরের বাচ্চা! এইভাবে ভয় দেখানির মতো চেংড়া আছিস তুই এখনো?’

বলতে না বলতেই দুটো ছেলে ধুপ ধুপ করে লাফ দিয়ে গাছ থেকে নেমে দৌড়াতে দৌড়াতে আর হুউউ, আয়ায়া করে আওয়াজ করতে করতে বলে উঠল ‘শহরের মানুষ নাকি ভীতু হয়, সেইটা পরীক্ষা করলাম। একটু আগে আমাদের বিরক্ত করছিলা – শোধবোধ!’ হিহিহি করতে করতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল ওরা। বাশার সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে, ‘আদদামড়া বেটা, ছোটো ছেলেদের মতো লাফাস। বান্দরের বাচ্চা। দাঁড়া তোর বাপেরে কচ্ছি। কী হাল হয় তোরা দেখিস।’

‘বাপে মেম্বার বলে শফিইক্যার এত বাইড় বাড়ছে। শয়তান একটা!’ সাহেব উষ্মা প্রকাশ করে।

‘বাপের জন্য না। ওর মায় এমন আল্লাদ দেয়, এইজন্যই পোলাডা এমন আখাস্তা হইছে।’ বলতে বলতে ময়না জড়িয়ে নেয় ভয়ে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া নিশাকে।

আগুনের দিন ৩।

শহরে থাকেন শুনলেই গ্রামের মানুষেরা খুব কেউকেটা কেউ মনে করে ফেলে। আদতে মইনুল ইসলাম খুব সাধারণ, একেবারেই ছাপোষা মানুষ। প্রাইমারি স্কুলের সহকারী শিক্ষক। স্কুলের নামমাত্র বেতন আর কয়েকব্যাচ ছাত্র পড়িয়ে শহরের এক প্রান্তে, এক চিলতে জমি কিনে চার কামরার ঘর উঠিয়েছেন। তাও ছাদ দিতে পারেন নি, টিনের চারচালা। সেটুকু ওঠাতেও ধারদেনা হয়ে আছে – ইট,সিমেন্টের দোকানে। প্রতি মাসেই কিছু কিছু করে শোধ দেন। আবার তিনছেলেমেয়ে নিয়ে সংসারের আর দশটা প্রয়োজন মেটাতে সবসময়ই ধারদেনার উপর থাকতে হয়। এইমাসে ধার করে পরের মাসে বেতন পেয়েই শোধ দেন। আবার মাসশেষের টানাটানিতে, মাসের শেষ সপ্তাহে কারো কাছে হাত পাততে হয়। স্ত্রী রেজিনা খুব হিসেব করে সংসার সামাল দেন, একটা পাইপয়সা অতিরিক্ত খরচ করেন না; উলটে বাপের বাড়ি থেকে এটা ওটা এনে গ্যাটিস দিতে থাকেন। মইন সাহেব জানেন ভালো করেই, তবু খরচ বেশি হচ্ছে বলে পরোক্ষ চাপ তৈরি করেন আর নিজের মনে স্বান্তনা খোঁজেন। রেজিনা মাঝেমঝেই ফোঁস করে ওঠেন, তবুই হাজারটা সামাজিকতা, লৌকিকতা মেনে সংসারের নৌকা টালমাটাল হতে দেন না। বাচ্চাদের নিয়েও মইন সাহেবের কোনো অভিযোগ নেই। মেয়েগুলো ভারী মিষ্টি স্বভাবের, শান্ত, চাহিদা কম। ছেলের আকাংক্ষায় সংসার বড় করেছেন, অথচ ছেলেটাই উড়নচণ্ডী, কিন্তু ছেলেরা তো একটু এরকমই হয়। দুটো বকাবাজি করেই মইন সাহেব কর্তব্য শেষ করেন। বড়মেয়েটা বাবা অন্তপ্রাণ। বাবার ভালো খাওয়া, ভালো থাকার দিকে চিলের মতো নজর থাকে। মইন সাহেব একবিন্দু টেনশন বেশি করলে মেয়েটা চোখ দেখেই বলে দিতে পারে। তখন বাবার মাথা মালিশ করে চিন্তাগুলো সব বাতাসে মিলিয়ে দেয় সে। কয়েকদিন হলো মেয়েটা দাদাবাড়ি গেছে। বাড়িতে ঢুকেই মেয়েটার মুখ দেখতে না পেলে মইন সাহেব অস্থির থাকেন। কিন্তু কিছু বলতেও পারেন না। রেজিনা মেয়েকে গ্রামে পাঠানোর ঘোর বিরোধী। মা ছাড়া উঠতি বয়সের মেয়েদেরকে একা রাখা একেবারেই পছন্দ না তার কিন্তু মেয়েরও ইচ্ছে ছিলো আর শাশুড়িও নাতনিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য জেদ করেছিল।

বাড়িতে ঢুকেই মইন সাহেব দুবার ডাক দিলেন ‘নিশা? ও মা নিশা?’

ছোটোমেয়ে ঊষা দৌঁড়ে এলো। ‘আব্বু শুধু বুবুরেই ডাকো?’

অভিমানী মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসবার চেষ্টা করেন মইন সাহেব। তার দুটো মেয়েই তার মতো গায়ের রঙ পেয়েছে। নাক মুখও বাবার মতোই। কী হতো রেজিনার মতো উজ্জ্বল রঙ হলে? দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি। এই মুখগুলো তার কাছে দিনশেষে শান্তির উৎস অথচ বিয়ে দেবেন কীভাবে সেই ভাবনাতেই রাতের ঘুম কমে এসেছে।

‘তোমার বুবুরে না দেখলে শান্তি পাই না গো মা! তুমি আর তোমার বুবু এই দুইজনই তো আমার দুই চোখের দুইটা মণি?’

‘আর ছোটোভাই?’ জিজ্ঞাসু হয় ঊষা। যদিও সে উত্তরটা জানে। একমাত্র পুত্রকে মুখে মুখে গালিগালাজ করলেও সে যে বাবা-মায়ের কলিজা সেটা দুইবোনই ভালো জানে।

‘সে তো তোমার আম্মু আর তোমাদের দুই বোনের মাথার মুকুট। ধাড়ি ছেলে, এখনো মুখে তুলে খাবার খাওয়ানো লাগে। এই তোমার মায়ের জন্যই ও উচ্ছ্বনে যাচ্ছে। কোনোদিন কিছু করে খাওয়া লাগবে না। বাপের হোটেলে বসে বসে অন্ন ধ্বংস করবে শুধু।’

ঊষা এইচ এস সি দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভাইয়ের উচ্ছনে যাওয়ার জন্য অতি আদরই যে একমাত্র কারণ তা সে ভালমতোই বোঝে আর এই অতি আদর দিয়ে তাকে অকর্মণ্য করে রাখার পেছনে মা-বাবা দুজনেরই যে সমান অংশীদারিত্ব তাও বেশ জানে। তাই ও কিছু বলল না। সংসারের বিষয় ও একটু বেশিই ভালো বোঝে। অকারণ কথাও বলে না। বড়বোন নিশার মতো অতিআবেগীও না।
‘তোমার মা কই, মাগো?’

‘আম্মু মুড়ি ভাজছে। মেজাজ অনেক হাই দেখলাম। তুমি কি কিছু করেছ, আব্বু?’

‘না, মাগো! আমি তো আসলামই এখন। আর মেজাজের কী? উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত। যেমন তোমার নানি ছিলো, তেমনি তোমার আম্মু। মেজাজ একখান। খানদানী। সবসময়ই চুলার পিঠের মতো গনগনে।’

মইন সাহেবের এভাবে রেজিনার মা তুলে কথা বলাটা ঊষার পছন্দ না একেবারেই। কিন্তু কথা বাড়াতে ওর ভালো লাগে না। আর রেজিনাই যখন প্রতিবাদ করে না, তখন উপযাচক হয়ে কিছু বলতেও ওর বাধে।

পেঁয়াজ, মরিচ আর প্রচুর রসুন দিয়ে তেলেভাজা মুচমুচে মুড়ি আর লেবু দেওয়া রংচা – সন্ধ্যায় রেজিনার আয়োজন। অল্প খরচে খাবার সুস্বাদু করতে তার জুড়ি নেই। মইন সাহেব একমুঠো মুড়ি দাঁতের তলায় চালান করে দিয়েই তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। রেজিনা সেই আরামে সিঁদ কাটলেন। ‘শুনছ?’

‘হুম!’

‘আসিয়ার জাল আসছিল।’

‘আচ্ছা!’

‘নিশার জন্য একটা প্রস্তাব এনেছে।’

‘কার জন্য?’

‘কার আবার? নিশা।’

‘আমাদের নিশা?’

‘আর কে?’

‘তুমি বলোনাই, মেয়ে পড়াশুনা করছে?’

‘বলেছি। একেবারে না করেই দিয়েছি। কিন্তু.. ‘

‘এর মধ্যে আবার কিন্তু কোথায়?’

‘ভালো বংশীয় পরিবার। ঢাকায় ভালো চাকরি করে। বাড়িও আছে ঢাকায়। বয়সও বেশি না। দেখতেও সুন্দর… ‘

‘ছবিও দেখে নিয়েছ?’

‘না। শুনছি শুধু। আমি একেবারেই না করে দিয়েছি কিন্তু ভাবছি মেয়ে বিয়ে তো একদিন দিতেই হবে। বছর কয় আগে হলে সমস্যা কী?’

‘সমস্যা নিয়ে তোমার ভাবা লাগবে না। অশিক্ষিত মহিলা, শিক্ষাদীক্ষার গুরুত্ব তুমি কী বোঝো? পারো খালি দুনিয়ার তেল দিয়ে তরকারি রানতে। আর আমার মা বোনরে নিয়ে কুটনামি করতে। যা পারো সেইটাই করো? আমার মেয়েদের বিয়ে নিয়ে তোমার ভাবনাচিন্তা করা লাগবে না।’

‘নিজে কী পারো যে আমার পারার হিসাবের খাতা খুলে বইছো। দুইটা ভাত দেওয়া ছাড়া আর কী দেও? ঈদে চান্দে পরনের কাপড়ের জন্যও তো ভাইগো কাছে হাত বিছায়া রাখি। লজ্জা নাই, পুরুষমানুষ? আবার বড় কথা!’

‘কী বললি হারামজাদি?’

‘খবরদার বাপ মা তুলে গালি দিবা না!’

রেজিনার বলতে দেরি হয়, মইনুল ইসলাম মেলে রাখা কাঠের বাটলাগানো ছাতাটা তুলে, রেজিনাকে আচ্ছামতো দুঘা লাগাতে ভুল হয় না!


মইনুল ইসলামের চার কামরার বাড়িতে একটা ঘর স্বামী-স্ত্রীর শোবার ঘর। বিছানা ছাড়াও আলমারি, শোকেস, লেপ,কাঁথা, শীতের কাপড় রাখার ট্র‍্যাংক, আলনা এই ঘরের শোভাবর্ধক। দুই মেয়ের জন্য একটা ঘরই বরাদ্দ, ছেলে মাহিন ক্লাস সেভেনে পড়ে – তার পড়ার সুবিধার্তে আলাদা একটা ঘরের মালিকানা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর একটা ঘর আলাদা করে বসার ঘর হিসেবে ব্যবহার করা হয়, বেশ কেতাদুরস্ত ফিটফাট সেটা। দেয়ালে দেতালে সূচিকর্ম করে ওয়ালমেট, রুমালে সাজানো সোফাসেট, টেবিলে রঙচঙে টেবিলক্লথ, ফুলদানিতে প্লাস্টিকের ফুল – মেয়েদের সখে সাজে ঘরটা। বাইরের ঘরে মা-বাবার লংকাকান্ড দেখে মাহিন দৌঁড়ে আসে ঊষার কাছে ‘ছোটোবুবু, আব্বু মারছে আম্মুকে। তুমি যাও আটকাও।’

‘কেন? আগে কোনোদিন দেখিসনি?’

‘যাও না ছোটোবুবু? বুবু থাকলে তো ঠিকই আটকাতো?’

‘তোর বুবু মাথায় এক বালতি আবেগ নিয়ে ঘোরে। সেই বালতি সবসময় টাপেটুপে ভরা থাকে। মাথা বেয়ে বেয়ে অতিরিক্ত আবেগ চুইয়ে চুইয়ে পড়ে!’

‘তুমি যাও না?’

‘এদিকে শোন। চুপ করে বসে থাক। এইযে আম্মু মার খাবে। কাঁদবে কিছুক্ষণ। রাতে খাবে না। তারপর অসুস্থ হওয়ার নাটক করবে। তখন আব্বু ভয় পাবে। না, আম্মুর অসুস্থতার ভয় না। লোকে কী বলবে, সেই ভয়। তাকে তো মানুষ ভদ্রলোক বলে জানে, সে যে নির্মমভাবে বউ পেটায় সেটা তো মানুষ জানে না। সেটা যদি জেনে যায়, সেই ভয় পাবে আব্বু। আর তারপর গিয়ে আম্মুকে তেলাবে। আদর করে খাওয়াবে। ব্যাস, আমাদের আম্মু গলে জল! কিছু মানুষ আছে যারা কেঁদেকেঁদে জিততে চায়। আম্মু হচ্ছে সেই দলের। তার উপর যে অন্যায় হচ্ছে সেই বোধই তার নেই। সে সকালে সুখি সুখি মুখ নিয়ে, আঁচলে বাড়ির চাবি ঝুলিয়ে, সামনের বাড়ির রুম্পার মায়ের কাছে যাবে – পরের বছর টিন ফেলে ছাদ দেওয়ার গল্প জুড়তে, নইলে কোরবানির আগে কেমন ফ্রিজ কিনবে সেই পরামর্শ করতে। আম্মুর জন্য আমার কোনো সহানুভূতি নেই।’

‘তো আব্বুকে কিছু বল?’

‘কেন? তাদেরকে আমি বিয়ে দিয়েছিলাম? একসাথে থাকতে বলেছিলাম?’

‘এইজন্য আব্বু আম্মুর ঝগড়া হবে আর তুই কিছু করবি না?’

‘না। এটা যদি নতুন নতুন হতো বা হঠাৎ করে একদিন ঘটত তবে কিছু করতাম। একসময় আমি আর বুবু অনেক কান্নাকাটি করতাম, ভয় পেতাম। আব্বুকে আটকাতাম। আম্মুর মাথায় তেল দিয়ে দিতাম। বুবু এখনো করে। কিন্তু আমার উপর এসবের কোনো প্রভাব পড়ে না। এসব আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। আব্বুরও অভ্যাস আম্মুকে মার দেওয়া, আম্মুরও অভ্যাস মার খাওয়া। তুইও অভ্যাস করে নে। মনে কর কিছু হচ্ছে না, কিছু শুনছিস না।’

‘তুই অনেক স্বার্থপর, ছোটোবুবু! বুবু এরকম না।’

‘একটু স্বার্থপর না হলে দুনিয়ায় টেকা মুশকিল রে। আর তোর বুবুর কপালেও এরকম পড়ে পড়ে মার খাওয়া লেখা আছে। আগাবেও না, পথও ছাড়বে না। একজায়গায় খুঁটি গেঁড়ে মার খাবে।’

‘এহ, তুইতো একেবারে জ্যোতিষী হয়ে গেছিস?’

‘যা তো যা! আমাকে বিরক্ত করিস না। পড়ালেখার নামগন্ধ নাই, সারাদিন বন্ধুবান্ধব নিয়ে আড্ডা দিয়ে বেড়াচ্ছিস, এই বয়সেই- আবার ঘরের সমস্যা দেখতে আইছে! যা, যা!’

চলবে…

আফসানা আশা
(কত বানান ভুল করতাম রে বাবা)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে