আগন্তুক পর্ব-১৫ এবং শেষ পর্ব

0
1534

আগন্তুক
– সাবিহা বিনতে রইস

শেষ পর্ব

অন্তু ভেবেছিলো তনিমাকে বাসায় ছেড়ে তবে লাবণ্যদের বাসায় যাবে৷ তবে মাঝ পথে সে গোঁ ধরেছে, কিছুতেই বাড়ি ফিরবে না। সেও তার সাথে থেকে পুরো ব্যাপারটা জানতে চায়৷ এমনিতে অবশ্য বাড়িতে লাবণ্যদের পুরো পরিবার আছে। তাছাড়া এই বিষয়ের তদন্তে তনিমাও কম কষ্ট করেনি৷ তাই সাতপাঁচ ভেবে তাকে নিয়ে অন্তু লাবণ্যদের বাসার কাছাকাছি এসে পৌছুলো৷ আজ দুপুরে তনিমালা ফোন নিয়ে বেরিয়ে এসেছে শুনে, সাথে সাথেই লাবণ্যদের বাসায় সাদা পোশাকের ফোর্স পাঠিয়েছিলো সে। প্রায় ১৫ জনের একটা দল ছদ্মবেশে ঘিরে রেখেছে বাড়ি। শ্রাবনের আকাশে আজ পূর্ণিমা। মেঘলা অম্বরে চকচকে সুন্দর চাঁদটার মুখ কালিমাখা। অন্তু গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো লাবণ্যদের বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে। তনিমা তার পাশের সিটে বসা। প্রায় নিস্তব্ধ৷ বাক্যহীন। তার ফাঁকা দৃষ্টি কাচের ওপারে অন্ধকার দেখছে। অন্তু তার হাতে হাত রাখলো৷ চকিতে একটু কেঁপে উঠলো সে। পলকের চুল সরানোর ভঙ্গিমায় দুই হাতের আঙ্গুল ঘুরিয়ে মুছে নিল কান্না। এই চাপ চাপ অন্ধকারেও অন্তুর চোখ এড়ালো না বিষয়টা।

– স্যার!

অন্তু গাড়িজানালার কাঁচ নামিয়ে তাকালো৷ তার অফিসের জুনিয়র এক কর্মকর্তাকে আজকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সে স্যালুট ঠুঁকে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। পলকে একবার তাকালো তনিমার দিকে। তারপর আবার দৃষ্টি ঘুরিয়েছে অন্তুর চোখে।

– সব ঠিক আছে?

– একদম স্যার! উনি একবার শুধু বাড়ি থেকে বের হয়ে লোকাল থানায় গিয়েছিলেন। ফোন চুরি গেছে বলে থানায় ডাইরি লিখিয়েছেন। তারপর ফিরে এসে আবার বাসায় ঢুকেছেন। শুধু মাত্র মাওলানা সাহেবারা ছাড়া, আর কেউ বাসা থেকে বের হয়নি।

– আর আসামী কে নিয়ে আসা হয়েছে?

– জ্বি স্যার। পুলিশসহ পেছনের গাড়িতে রাখা হয়েছে তাকে।

অন্তু মাথা ঝাঁকালো।

– ওকে, আমি ভেতরে যাচ্ছি৷ তোমরা রেডি থেকো। যখন তখন আমি সংকেত দিব।

– ওকে স্যার।

জুনিয়ার কর্মকর্তা স্যালুট দিতেই জানালার কাঁচ তুলে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেল অন্তু। গেটের কাছে বার দুয়েক হর্ণ দিতেই দারোয়ান বেরিয়ে এলো। তনিমাকে এক ঝলক দেখে, কোন কিছু চিন্তা না করে দৌড়ে গিয়ে গেট খুলে দিল। অন্তু গাড়ি নিয়ে সরাসরি গিয়ে দাড়ালো গাড়ি বারান্দায়। তনিমার ততক্ষণে বুকের ভেতর ধুকপুকানি বেড়ে গেছে। বারবার মনে হচ্ছে যা হচ্ছে, তা কি ঠিক হচ্ছে? কোন ভুল হচ্ছে না তো? কাঁপা কাঁপা পায়ে সে দাড়ালো গেটের সামনে। এই জায়গাটা সকালের মতোই সাজানো আছে। কোন কিছু খোলা হয়নি। শুধু সকালের সেই লোকজন গুলো নেই৷ সব ফাঁকা। অন্ধকারে যেন এক মৃত্যুপুরী।

দরজাটা ভেজানো ছিলো৷ তনিমা প্রথমে পা রাখলো, তার পেছনে অন্তু। ভেতরে ঢোকা মাত্র, সামনে লাবণ্যর মা৷ তাকে দেখা মাত্র এগিয়ে এসেছে।

– কি ব্যাপার মামনি? হঠাৎ কোথায় চলে গিয়েছিলে? দুপুরে কতবার ফোন দিলাম, পেলাম না। এভাবে না বলে কেউ যায়?

তনিমার বড্ড বিব্রত লাগছিলো। কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

– সরি আন্টি৷ আসলে একটা কাজ পড়ে গিয়েছিলো। দেখুন না, আমার সাথে কে এসেছে?

লাবণ্যর মা পেছনে তাকালেন। এতক্ষনে তিনি একবারও পেছনে খেয়াল করেননি। অন্তুর উপরে চোখ পড়তেই বেশ হাসিখুশি মুখে এগিয়ে গেলেন,

– আরে, অন্তু নাকি? অনেকদিন পরে দেখলাম৷ সেই কবে একবার এসেছিলে! আর আমরাও পরে এমন একটা অবস্থায় পড়লাম, তোমাকে আসতেও বলা হয়নি। এই দেখো। দাঁড়িয়ে রেখে কথা বলছি। এসো না, বসো!

– ব্যাপার না! ঠিক আছে আন্টি। আমি বসছি। চয়ন ভাই আছে?

– হ্যা, চয়ন তো বাসাতেই আছে। আজ আবার আরেক কাণ্ড ঘটেছে, জানো? চয়নের ফোনটা হারিয়ে গেছে। কি যে একটা অবস্থা!

তনিমা আড়চোখে তাকালো অন্তুর দিকে৷ সে ভাবলেশহীন মুখে কথা শুনছে আন্টির। শুধু তনিমা স্বাভাবিক হতে পারছে না৷ হার্টবিট বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে। নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক করে বললো,

– আন্টি, লাবন্য এখন কেমন আছে?

লাবণ্যর মায়ের মুখে সাথে সাথে চোখা বিষাদ।

– ঘুমাচ্ছে। শান্ত আছে এখন। তোমরা বসো৷ একটু চা খেয়ে যাও। আর আমি চয়নকে পাঠাচ্ছি।

সাথে সাথে থামিয়েছে অন্তু।

– আন্টি, এক মিনিট! চায়ের ব্যবস্থা করতে হবে না। আজ আমরা একটা অফিসিয়াল কাজে এসেছি।

লাবণ্যর মা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। তার চোখে জিজ্ঞাসা,

– অফিসিয়াল কাজ? ঠিক বুঝলাম না!

অন্তু উঠে দাড়ালো৷ মৃদু হেসে, স্বভাব সুলভ মিষ্টি স্বরে বললো,

– আপনি তো জানেন, আমি কি কাজ করি? বাসার সবাইকে ডাকুন। প্রত্যেকে যেন উপস্থিত থাকে। হাতে সময় কম আমাদের!

——————————————————

সচরাচর অন্তু কারো সামনে সিগারেট খায় না। আজ একদম ব্যতিক্রম। তনিমার মনে হচ্ছিলো সে নতুন কাউকে দেখছে। পুরোদস্তুর পেশাদার একজন মানুষ। সাজানো ড্রয়িং রুমে সবাই এসেছে বসেছে। লাবণ্যর বাবা, মামা, চাচা, চাচী, ফুপু, আর চয়ন। লাবণ্যকে আনা যায়নি৷ সে ঘুমাচ্ছে ঘরে। চয়নের পরনে সকালের সেই সাদা পাঞ্জাবী। চোখ মুখে ক্লান্তি। কেমন যেন বিপর্যস্ত ভাব। তনিমা দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্তু সিগারেটটা সামনের এ্যাশট্রে তে গুজে দিয়ে চয়নের দিকে ফিরলো।

– তা চয়ন ভাই, সব কিছু আপনি নিজের মুখে বলবেন? নাকি আমাকে দিয়ে কষ্ট করাবেন?

চয়ন পাশের ছোট টেবিলে রাখা টিস্যুবক্স থেকে একটা টিস্যু তুলে নিয়ে কপাল মুছলো৷ তারপর গম্ভীর গলায় বললো,

– আমি কিছুই বুঝতে পারছি না অন্তু। আমার স্ত্রী অসুস্থ। তোমরা সব কিছু জানো। তারপরও এইসবের মানে কি?

অন্তু হাসলো,

– মানে আমি কিভাবে বলব? খুন কি আমি করেছি? খুন তো করেছেন আপনি। আপনাকে বলতে দেওয়াটা যুক্তিসঙ্গত।

লাবণ্যর বাবা চমকে উঠেছে।

– খুন? কিসের খুন? চয়ন, ওরা কি সব বলছে?

চয়ন ঝট করে উঠে দাঁড়িয়েছে।

– আমি জানি না বাবা!! কি শুরু করেছে এরা? শোনো অন্তু, আমার সময়ের দাম আছে। আমি তোমাদের গাল গপ্প শুনতে ইন্টারেস্টেড নই।

– কুল ডাউন চয়ন ভাই। এত অল্পতে ক্ষেপে গেলে চলবে? দেখুন, আমি আপনাকে সুযোগ দিলাম একটা। আমি যখন বলা শুরু করব, তখন কিন্তু আর একটা বাক্য বলারও সুযোগ দেব না।

লাবণ্যর মা সরে এসে দাঁড়ালো তনিমার কাছে। কিছুটা রাগত স্বরে বললো,

– তোমরা কি শুরু করেছো এগুলো? আমাদের মানসিক অবস্থা জানো না? এর মধ্যে এইসব কি?

অন্তু আড়মোড়া ভাঙলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

– তবে আমাকেই বলতে হচ্ছে সব! ঠিক আছে, ব্যাপার না! শুধু আমার কথা শেষ হওয়ার আগে, এখানে কেউ কিচ্ছু বলবে না। আংকেল, আপনার জামাই মহা ধুরন্ধর। মেয়ের বিয়ে দেবার আগে আরেকটু খোঁজ নেওয়া উচিৎ ছিলো৷

লাবণ্যর বাবা, মা, সহ প্রত্যেকের দৃষ্টি স্থির। চোখে মুখে জিজ্ঞাসা৷ অন্তু ফস করে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে সোফায় এসে বসলো, তারপর বললো,

– আপনাদের জামাই, মানে চয়ন ভাইয়ের প্রথম খুনটা ঘটেছিলো তার চৌদ্দ বছর বয়সে৷ কাকে খুন করেছিলো জানেন? নিজের বাবাকে।

সাথে সাথে ঘরের প্রত্যেকে আৎকে উঠেছে। তনিমা নিজেও চমকেছে অনেকখানি। চয়ন কিছু বলতে যাচ্ছিলো, অন্তু সুযোগ দিলো না।

– উহু! আমি বলেছিলাম, আমি কথা বলা শুরু করলে, আর কেউ বলবে না৷ আপনার বলার পালা শেষ। আপনি নিজের হাতে আপনার বাবাকে খুন করেছিলেন। কেন? কারণ তিনি অত্যাচারী ছিলেন। আপনার মায়ের উপর ক্রমাগত অত্যাচার করতেন। আপনার মা অপলা আনাম। যিনি বৃদ্ধাশ্রম থাকেন এখন, একসময় তিনি দারুণ লিখতেন। নিয়মিত পেপার পত্রিকায় তার লেখা বেরুতো। আর আপবার বাবা সেটা পছন্দ করত না। লেখা থামানোর জন্য অত্যাচার করত। এমনিতেও উনি ভালো মানুষ ছিলো না, যদ্দুর জেনেছি। নেশাগ্রস্ত ছিলেন। মেরে একদিক দিয়ে ভালোই করেছেন, নাকি? তবে কাজের কাজ কিছু হয়নি। আপনার মা এই ঘটনার পর বিকারগ্রস্ত হয়ে যান। আপনার ফুপু আপনাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি ঘটনা ধামাচাপা দেন, ভাইয়ের মৃত্যুটা স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে চালিয়ে দেন। আর আপনাকে দত্তক নিয়ে বড় করে তোলেন নিজের সন্তান হিসেবে, ঠিক বলেছি?

চয়ন খানিকটা নড়েচড়ে উঠতেই অন্তু আবার বলে উঠেছে।

– সরি! সরি! আপনার কথা বলা যাবে না। আগে শেষ করে নিই। আপনার মায়ের অনেক গুন আপনি পেয়েছেন। তার মতো সুন্দর হয়েছেন। সেই সাথে মাশাআল্লাহ দারুণ লেখার হাতও! আর সমস্যাটা শুরু তখনই। আপনার মা বড় লেখক হতে পারেননি। তাই আপনি চেয়েছিলেন, সবাইকে টক্কর দিয়ে এক নাম্বার হতে। কিন্তু সেখানে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো লাবণ্য রহমান। একটুর জন্য বার বার তার থেকে পিছিয়ে যেতে থাকলেন। তাই রাগ টা সামলাতে পারলেন না। বিশাল একটা ফাঁদ পাতলেন। প্রথমে প্রেম, তারপর বিয়ে, তারপর তারই লেখার জালে তাকে ফাঁসাতে খুন করে ফেললেন অনিন্দিতা আর মল্লিকাকে। দারুণ, চমৎকার! আপনার প্ল্যানে কাজ হলো। লাবণ্য মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে গেল। আর আপনি তাকে সেবার নাম করে, আরো বেশি অসুস্থ করে দিলেন। তাকে তিলে তিলে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করালেন। আপনি সফলও হলেন, সেরার সেরা এওয়ার্ড পেলেন। দারুণ ছদ্মবেশ নিয়ে পৌছে গেলেন মঞ্চে। লোভ সামলাতে পারেননি পুরস্কার নেওয়ার, তাইনা? তবে গলার স্বরটা বোধহয় আরেকটু পরিবর্তন করতে হতো। নাহলে আমি সন্দেহ করতাম না৷ মেকআপ ভালো ছিলো।

লাবণ্যর বাবা এবার আর নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারলেন না। হৈ হৈ করে বলে উঠলেন,

– কি যা তা কথা বলছো? আমার জামাইকে আমরা চিনি না? তার মতো ছেলে হয় না।

সাথে সাথে লাবণ্যর চাচাও কথা বললেন,

– কিসের প্রমাণ আছে তোমার কাছে? কেন বিশ্বাস করব তোমার কথা?

অন্তু বুক পকেট থেকে খাম বের করে মেইলের রিপোর্ট টা রাখলো টেবিলের উপর। বললো,

– দেখে নিন, আপনার জামাইয়ের মেইলে পাওয়া গেছে এইগুলো। প্রকাশকদের সাথে সব কথাবার্তার ডিটেইল আছে। আর একবার খোঁজ নিয়ে দেখুম, সেরার সেরা এওয়ার্ডের দিন আপনার জামাই অফিসে ছিলো কি না? এ্যাম শিওর সেদিন সে বাসায় ছিলো না। কি চয়ন ভাই? বলবেন কিছু? আপনার বন্ধু প্রত্যয় গাড়িতে বসে আছে। সব স্বীকার করেছে সে। তাকেও নিয়ে আসা লাগবে?

লাবণ্যর বাবা, চাচা বাকরুদ্ধ। লাবণ্যর মা ধপ করে পড়ে গেলেন মেঝেতে। সাথে সাথে ফুপু আর চাচী ধরলেন তাকে। তনিমা চট করে জগ নিয়ে এগিয়ে গেল, পানি ছেটালো চোখে মুখে। লাবণ্যর বাবা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। চয়ন তখনও মাথায় হাত দিয়ে ঝুকে বসে আছে। অন্তু কথা বললো,

– কিছু বলবেন? নাহলে চলুন, যাওয়া যাক। অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট নিয়ে এসেছি আমি। এইসব করে কি হলো বলুন তো? আপনার আরেক বন্ধু রূপম, তার লাইফটাও হেল করে দিলেন। তার বাসাতেও গিয়েছিলাম। বেচারা! আপনার স্ত্রীর মতো শারিরীক ভাবে এতটা খারাপ না হলেও, মানসিক ভাবে একদম শেষ করে দিয়েছেন।

চয়ন উঠে দাড়ালো। একবার তাকালো সবার দিকে। কি ঘেন্না সকলের চোখে। মৃদু স্বরে সে বললো,

– আমার কিছু বলার আছে। তার আগে একবার লাবণ্যর সাথে দেখা করতে চাই।

– চয়ন ভাই, পালানোর পথ নেই৷ পুরো বাড়ি পুলিশ ঘিরে রেখেছে। খামোখা চেষ্টা করার কি দরকার। ক্রশ ফায়ারে মরা লাগবে। চলেন আমার সাথে। ভালো ভাবে নিয়ে যাব।

– পালাবো না অন্তু। আমার সত্যিই কিছু বলার আছে, দেখানোর আছে।

অন্তু মাথা নাড়লো, বললো,

– যান, অনুমতি দিলাম।

লাবণ্যর বাবা তখনও কাঁদছেন। নির্ভেজাল মানুষ তিনি। শিক্ষক। মানুষ গড়ার কারিগর। কোন উশৃংখলতা নেই, তেজ নেই। মানুষটাকে দেখে কষ্ট হচ্ছিলো ভিষণ। লাবণ্যর মায়ের জ্ঞান ফেরেনি। তনিমা তাকে নিয়ে ব্যস্ত। অন্তুর ঘড়ির দিকে তাকালো। স্টপ ওয়াচ চলছে। চয়নের ঘরে যাওয়ার পাঁচ মিনিট, সাত মিনিট, দশ মিনিট, বারো মিনিট। ও ঘর থেকে সাড়া শব্দ নেই। অন্তু এগিয়ে গেল লাবণ্যর ঘরের দিকে৷ আলো জ্বলছে ঘরে। ঘুমন্ত লাবণ্য বিছানায়৷ পাশের টেবলে চেয়ার নিয়ে বসে আছে চয়ন। মাথা রাখা টেবিলের উপর। কাছে যাওয়া মাত্রই অন্তু চমকে উঠলো! অস্ফুটে বললো,

– ওহ! শিট!

চিরকুটটা টেবিলের উপরেই রাখা ছিলো৷

” আমি স্বীকার করছি, সব কিছুর জন্য আমি দায়ী। ”

পাশেই নিথর দেহ পড়ে আছে। সায়ানাইড খেয়ে চয়ন আত্মহত্যা করেছে।

——————————————————

বছর ঘুরে আবার বসন্ত এসেছে পৃথিবীতে। ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে চারিদিক। শিমুল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়ার ডালে লেগেছে রঙের আগুন। প্রকৃতিতে ফুরফুরে হাওয়ার আনাগোনা। তনিমা আর অন্তুর বিয়ে হয়ে কয়েকমাস আগে। বেশ ভালো আছে তারা। প্রত্যয়ের জেল হয়েছে চয়নের সাথে খুনের সহযোগিতা করার জন্য। লাবণ্য ছেড়ে গেছে পৃথিবী, চয়নের মৃত্যুর মাসখানেকের মধ্যেই৷ রিপোর্ট অনুযায়ী, দীর্ঘদিনের রোগে ভোগা, ভঙ্গ স্বাস্থ্য, আর উচ্চ রক্তচাপের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে।

গভীর রাত। এক লেখক লিখছেন কম্পিউটারের সামনে বসে। সবে মাত্র নতুন উপন্যাস শেষ করলেন। এখন দরকার লেখকের একটা নাম। ছদ্মনাম। সবার কাছে আগন্তুক মারা গেছে। সুতরাং সেই নামে লেখা সম্ভব নয়। আচ্ছা, মৃত্যুঞ্জয় নামটা কেমন? মৃত্যুকে যে জয় করেছে, সেই তো মৃত্যুঞ্জয়। আর আগন্তুক তো মৃত্যু থেকেই জেগে উঠছে আবার।

পরিকল্পনাটা ভালো ছিলো ছিলো তার। চয়ন যেদিন গল্পে মগ্ন হয়ে তার সামনে নিজের বাবাকে হত্যা করার কথা বলে ফেলেছিলো, সেদিনই নিজের খেলাটা সাজিয়ে ফেলেছিলো সে। বুদ্ধির ছলে জেনে নিলো তার আসল মা এক বৃদ্ধাশ্রমে থাকে। পাগল। দুঃখের জীবন। তারপরই শুরু করলো ব্ল্যাকমেইল। যদি সে তার কথা মতো না চলে, তাহলে খুনের কথা ছড়িয়ে দিবে চারিদিকে। ফাঁসিতে ঝোলাবে চয়নকে। আর তার কথা যদি মেনে নেয়, তাহলে বিন্দাস লাইফ। তার লেখা থেকে পাওয়া সব টাকা চয়নের মায়ের জন্য ব্যয় করবে সে। পাগল মহিলার লাইফটা সুন্দর করে দিবে। চয়নের হাতে আর কোন অপশন ছিলো না৷ সব মেনে নিয়ে তার কথা মতোই লাবণ্যর সাথে প্রেম করেছিলো। বিয়েও হলো৷ কিন্তু ঝামেলা বাঁধলো তখন, যখন শালা চয়ন দুম করে ওই মেয়ের প্রেমে পড়ে গেল৷ তার হাত পা ধরে অনুনয় করলো, যেন লাবণ্যকে জানে না মারা হয়। সে চেষ্টা করবে লাবণ্যকে লেখা থেকে সরিয়ে দিতে! আহা প্রেম! তার কথা রাখতে গিয়ে পরিকল্পনা পালটে উল্টো দিক দিয়ে খেলা শুরু করতে হলো৷ নয়নতারা সেজে ভয় দেখিয়ে, বশে এনে জোর করে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করলো অনিন্দিতা আর মল্লিকাকে। জন্ম থেকে তার দারুণ একটা গুন আছে। মেয়েদের মতো গলার স্বরে কথা বলতে পারা। এই বিষয়টা দুজনকে ভয় দেখাতে দারুণ কাজে এসেছে। অবশেষে সফল হলো। সেরার সেরা এওয়ার্ড হাতে এলো৷ বুদ্ধি করে চয়নকে পাঠালো পুরস্কার নিতে। আরেকটা কাজও বুদ্ধিমানের মতো করেছে। তার যত দরকারি মেইল, সব চয়নের ফোন থেকে পাঠানো। চয়ন আসলে ছিলো সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মতো। তাকে মেরে ফেরার একদম ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু উপায় কি? ফোন হারানোর খবর কানে যেতেই সে লুকিয়ে দেখা করতে এসেছিলো চয়নের সাথে। ঘাপটি মেরে বসে ছিলো লাবণ্যর ঘরে। চয়ন শেষ মুহুর্তে ঘরে এসে চাপা স্বরে বলেছিলো, সব জানিয়ে দিবে পুলিশকে। তাই উপায় না পেয়ে সায়ানাইড মুখে পুরে দিয়ে তাকে জোর করে মেরে ফেলতে হলো৷ আহারে বেচারা! লাবণ্য বাঁচবে না এটা সে আগেই জানতো। বোরখা পরে মেয়েদের বেশে একটু একটু করে নানা অছিলায় আর্সেনিক খাওয়াতো লাবণ্যকে। মেয়েটা অবশ্য চালাক ছিলো। শরীরের ওই দশা নিয়েও কিভাবে যেন বুঝে ফেলেছিলো সব। তবে বলার সুযোগ হলো না। আফসোস! নিজের মনে ভাবতে ভাবতে হাসলো লেখক। পানির বোতল হাতে নিয়ে জানালায় এসে দাঁড়ালো। বাইরের ল্যাম্পপোস্টের আলো তার মুখে এসে পড়ছে। হলুদ আলোয় চকচক করছে রূপমের মুখ।
রূপম। তার একটাই নেশা। জীবন নিয়ে খেলার নেশা। আর এই খেলায় জিততে খুন হাতের ময়লা। ইদানীং খেলার কাউকে পাচ্ছে না। তাই মন ভালো নেই। ফেসবুকে ঢুকে লেখক লিস্ট গুলো চেক করলো আনমনে। আগন্তুক নেই । লাবণ্য রহমানও নেই। তাদের স্থানে নতুন একটা নাম দেখা যাচ্ছে। পৃথুলা রায়। মেয়েটি ভালো করছে ইদানীং। এর সাথেই তো খেলতে নামা যায়, নাকি? আহা! আবার নতুন পরিকল্পনা, আবার সেই থ্রিল! আপাতত একটু ঘুমিয়ে নেয়া যাক। কাল সকালে উঠে নতুন খেলা সম্পর্কে ভাবা যাবে। রূপম খুশি মনে গড়িয়ে পড়লো বিছানায়, নতুন সকালের আশায়।

——– সমাপ্ত———

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে