আগন্তুক
– সাবিহা বিনতে রইস
#পর্ব – ১৪
বাইরে গোধূলি লগ্ন। লাল কমলা মেশানো গাঢ় রঙ মেখে আছে প্রকৃতিতে৷ গোলসূর্যটাকে এখন আর দেখা যাচ্ছে না। তবুও পশ্চিম আকাশের কোন সীমানায় বসে এমন রঙ ছড়াচ্ছে, কে জানে! উত্তর আকাশে ছাইরঙা মেঘের দল অহেতুক উড়োউড়ি করছে। প্রকৃতির রঙিনতায় যেন তাদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তনিমা ফাঁকা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে ছিলো কাঁচের বাইরে। প্রকৃতি এত রঙ, এত রূপ কিচ্ছু তাকে ছুঁতে পারছে না। যেন সব ছোঁয়া বারণ। সব অচ্ছুত। তাদের কি করে বোঝাবে তনিমা, তার বুকে বাজছে যুদ্ধের দামামা? অকারণে কেঁপে উঠছে বার বার! হৃদয়ের আজ ভাঙচুর হচ্ছে না, যা হচ্ছে, তার উপমা পাওয়া যাচ্ছে না।
– কফি বলব? খাবে?
অন্তুর কথা শুনে জানালা থেকে সরে এলো তনিমা৷ বসলো সোফায়। বলল,
– তুমি খেলে খাও। আমার ইচ্ছে করছে না৷
– তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? রিপোর্ট পেতে দেরী হবে। বলো তো আমি ছেড়ে আসছি তোমাকে?
তনিমা ভ্রু কুচকে তাকালো।
– শরীর খারাপ কেন হবে? আমি ঠিক আছি। রিপোর্ট দেখেই যাব আজ, যতক্ষনই লাগুক!
অন্তু হাসলো৷
– তনি, একটা সত্যি কথা বলবে?
– কী?
– তুমি আসলে চয়ন ভাইয়ের নামে খারাপ কিছু সহ্য করতে পারো না, তাই না? তোমার চোখে ও বরাবরই অন্যরকম আমি জানি!
তনিমা গাঢ় চোখে তাকালো অন্তুর দিকে। তার মুখে হালকা একটা বিষাদের আভাষ। তার উচিৎ এখন অন্তুকে কিছু একটা বলা৷ তার বলা কথাটির বিপক্ষে যুক্তি দেখানো৷ কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, তনিমার মুখ দিয়ে একটা বাক্যও বের হতে চাচ্ছে না। অসহায় মুখ নিয়ে সে কেবল বসে রইল। উত্তর না পেয়ে অন্তুও সামনে খুলে রাখা ল্যাপটপে ব্যস্ত হয়ে পড়লো৷
তনিমা যে ঘরে বসে আছে, সেটা অন্তুর অফিস চেম্বার। গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়। অন্তুর পেছনে জাতির জনক এবং প্রধানমন্ত্রীর ছবি রাখা। সামনে সুন্দর কাঠের টেবিল। সাজানো গোছানো৷ একটা সাদা ফুলদানীতে এক গুচ্ছ রজনীগন্ধা ও গোলাপ রাখা। টেবিলের বাম পাশে বড় একটা পাতাবাহার গাছ। ঘরের এক পাশে গদিআটা সোফা। পায়ের নিচে পালকের মতো তুলতুলে কার্পেট। ডানপাশের দেওয়ালে বড় কাচের জানালা। ওপাশের প্রকৃতিতে গোধূলি ফুরিয়ে এসেছে। শেষ সময়ের মরা আলো গলে পড়ছে শান্তভাবে৷
আজ দুপুরে অন্তুর মেসেজ পেয়ে চয়নের ফোন হাতে নিয়ে ছুটে এসেছিলো তনিমা। যখন সে পৌছালো, তখন অন্তুও অফিসে এসে পৌছেছে। ফোনটা পাওয়া নাগাদ, তাদের এক্সপার্টের হাতে তথ্য সংগ্রহের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছে। আর তনিমাকে যা খুলে বলেছে, তার সারমর্মটি এইরকম।
শ্বেতমহল৷ যেখান থেকে এই গল্পের সূত্রপাত, সেখানে গিয়েই তনিমা বুঝেছিলো কোন একটা গন্ডগোল আছে। প্রত্বতাত্ত্বিক বিষয় সমূহে তার দারুন আগ্রহ। সেসব পড়াশুনা থেকেই সে জানে, প্রতিটি সময়ের নির্মানশৈলীর কমন কিছু বিষয় থাকে। সেসব নির্মাণশৈলী দেখলে অল্পতেই আঁচ করা যায়, এইসব দালান কোন সময়ের তৈরি। শুধুমাত্র তাজমহল ব্যতিক্রম। তাজমহলের বিশালত্বও অবশ্য আলাদা। তাই শ্বেতমহল দেখে সে কিছুটা হলেও দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলো। ওটা কখনোই দু’শ বছর আগের নির্মাণশৈলী নয়। প্রাচীন প্রাচীন একটা ভাব তৈরি করার চেষ্টা করেছে অবশ্য। কিন্তু আদলটা ঠিক আসেনি। সেসময়ের বাড়িগুলোর একটা কমন বিষয়, দালানের ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় ঠাকুরঘর। এবাড়িতে কোন ঠাকুরঘর নেই। কোন অংশেই মন্দিরের চিহ্নমাত্র নেই। এত বড় জমিদারের বাড়ি, অথচ কোন মন্দির নেই, ঠাকুরঘর নেই, এটা খুবই অদ্ভুত ব্যাপার। দালানের তৈরি করা সিঁড়ি, ঘরগুলো দেখে সন্দেহ হয়েছিলো তার। পরে অন্তু আর তনিমা দুজনে একসাথে আবিষ্কার করে, ঠিক এই বাড়িটার পেছনেই জঙ্গলে ঢাকা একটা জমিদারবাড়ি আছে। প্রায় ধ্বংস স্তুপের মতন পড়ে থাকা এই বাড়িটি গায়ে নয়নতারার নাম খোদায় করা। সময়টাও উল্লেখ করা প্রায় তিনশত বছর আগের। অর্থাৎ শ্বেতমহল বা নয়নতারা ভবন আসলে এই বাড়িটি নয়। আসল বাড়িটি এই নকল দালানের পেছনে অবস্থিত। এই দালানটি তৈরি হয়েছে সাতচল্লিশের দেশ ভাগের পর। রূপমের পূর্বপুরুষেরা এই জমির দখল পাওয়ার পর বাগানবাড়ি হিসেবে এই ভবন নির্মান করে। তবে নয়নতারাকে নিয়ে ভৌতিক যে কথাগুলো শোনা গিয়েছিলো, তা প্রায়ই সত্যি। রূপমের বলা গল্পটাও সত্যি। কিন্তু মিথ্যা হলো, এর কোনটায় এ বাড়ির ঘটনা নয়। মূল বাড়িটি পেছনের জঙ্গলে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওই বাড়িটির ভয়েই গ্রামের লোক এ অংশটিকে এড়িয়ে চলে। বৃদ্ধাশ্রম থেকে ফেরার পর অন্তু প্রথমেই গিয়েছিলো প্রত্যয়ের অফিসে। সেখানে তাকে জিজ্ঞাসাবাদে অনেক কিছু জানা গেছে। প্রত্যয়ের কথা মতো, চয়ন চেয়েছিলো লাবণ্যকে সামান্য ভয় দেখাতে। তার ধারণা হন্টেড হাউজে বসে তার লেখার আসল সৌন্দর্য বেরিয়ে আসবে। বাস্তব অভিজ্ঞতার লেখা নিশ্চয় মন্দ হবার নয়?
আর তাই তাদের সকলের সামনেই চয়ন বলেছিলো, নয়নতারার ঘটনাটি উল্লেখ করার সময়, তারা যেন বলে এই ঘটনাটি শ্বেতমহলেই ঘটেছিলো। লাবণ্যকে বিশ্বাস করানোর জন্য চয়নের উদ্যোগেই বাড়ির সামনে নতুনভাবে ফলক তৈরি করে নয়নতারা নাম আর সালটা লেখা হয়েছিলো। যেন লাবণ্যর মনে না হয় যে বাড়িটি খুব একটা পুরোনো নয়। অনিন্দিতার মৃত্যুর আগের দিন চয়নই প্রত্যয়কে ফুলের ব্যবস্থা করতে বলে। যদিও প্রত্যয় কারণ জানতো না, এমনই জানিয়েছে৷ অনিন্দিতার মৃত্যুর পর প্রত্যয় চেয়েছিলো রূপমকে, সব জানিয়ে দিতে। কিন্তু চয়ন ভয় দেখিয়েছিলো, সে বলেছিলো প্রত্যয়ের যে আরেকজনের সাথে এফেয়ার চলছে এটা মল্লিকাকে জানিয়ে দিবে। আর সে যদি চুপ করে থাকে, তাহলে মল্লিকা যেন কখনো প্রত্যয়ের লাইফে ইন্টারফেয়ার না করে তারও ব্যবস্থা করে দিবে। ঠিক এই কারনেই সে চয়নের ব্যাপারে কাউকে কিছু জানায়নি। প্রত্যয় এখন পুলিশ কাস্টাডিতে আছে। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
অন্তুর মুখ থেকে এইসব ঘটনা শোনার পর থেকে তনিমার মনে হচ্ছিলো পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেছে। বারবার শুধু চয়নের মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। কিভাবে এটা সত্য হতে পারে? হয়ত ভুল করছে তারা? হয়তো প্রত্যয় মিথ্যা বলেছে। নিশ্চয় কোন একটা বিষয় আছে। আজকের ধবধবে সাদা পাঞ্জাবী পরা সুন্দর মুখের মানুষটাকে মাথা থেকে সরাতে পারছিলো না তনিমা। একটা সময় তার মনে হয়েছিলো সে আসলে চয়নকে ভুলে গেছে। তার জন্য আগের সেই ছেলেমানুষী অনুভূতির চিহ্ন মাত্র নেই। কিন্তু সে ভুল ভেবেছে। সব আছে, ষোলআনায় আছে। মুখে কিছু না বললেও অস্থিরতা আর চাপে বুক ফেটে যাচ্ছিলো তার।
– স্যার, আসতে পারি?
আওয়াজ শুনে মাথা উঠালো তনিমা। দরজা দিয়ে এক ব্যক্তি উঁকি দিচ্ছে। অন্তু মাথা নাড়তেই সে ঘরে ঢুকে খামে ভরা একটা কাগজ দিয়ে বেরিয়ে গেল। অন্তু আড়চোখে একবার তাকালো তনিমার দিকে৷ সেও সচকিত। অন্তু খাম খুলে রিপোর্ট বের করলো। চয়নের ফোনের কল লিস্ট, মেইল লিস্ট, সব আছে এই রিপোর্টে। অন্তু চোখ বুলিয়ে নিলো বার কয়েক। তারপর তনিমার দিকে ঘুরে বলল,
– ইন্টারেস্টিং! এসো দেখে যাও রিপোর্ট।
তনিমা উঠে এলো কাঁপা কাঁপা পায়ে। তারপর অন্তুর চেয়ার ঘেষে দাঁড়িয়ে কাগজটা হাতে নিয়ে চোখ বুলিয়ে নিলো। মেইলের ডিটেইলসে দারুণভাবে দুটো আইডি দেখা যাচ্ছে। একটি চয়ন নামে, অপরটি আগন্তুক। আগন্তুক নামের মেইলটি থেকে বিভিন্ন পাবলিশার্সদের সাথে কথা বলা হয়েছে। পান্ডুলিপির ফাইল, রয়্যালটির ব্যাপার স্যাপারে নানান আলোচনা এই মেইলে। আজ প্রথমবার তার নিজের চোখের উপর রাগ হচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে ভিষণ। তার মন সকল আবেগ দিয়ে চিৎকার করে বলছে, এইসব কিছু মিথ্যা। তনিমাকে চুপ থাকতে দেখে অন্তু মুখ খুললো,
– দেখো তনিমা, আমি জানি তুমি কষ্ট পাচ্ছ। হয়তো তোমার মনে হচ্ছে এই বিষয়টি নিয়ে না এগুলেই ভালো হত। কিন্তু কোন কিছুই আর আমার হাতে নেই। অপরাধের প্রমাণ যখন পেয়েছি, তাকে ছেড়ে দিতে পারি না আমি। ফোন হারিয়েছে দুপুরে, এবার সে নিজেই না হারিয়ে যায়! আমাকে বেরোতে হবে। প্রচন্ড ধুরন্ধর তোমার এই চয়ন ভাই। তাকে হাত ফসকে বেরুতে দেওয়া যাবে না। তুমি একা বাসায় যেতে পারবে?
অন্তু তাকালো তনিমার মুখের দিকে। তার চোখে পানি। ঠিক যেন একটা কাঠের পুতুল সে এখন। মুখে কোন আওয়াজ নেই। অন্তু শ্বাস ফেলে উঠে পড়লো৷ ঠিক তখনই তনিমা ঝাপিয়ে পড়লো তার বুকে। তারপর ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। অন্তু বুঝে উঠতে পারছিল না ঠিক কি করবে। সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গীতে সে হাত রাখলো তার পিঠে। তনিমা মুখ ওঠালো। বললো,
– আমি তোমার পাশে আছি অন্তু। সবসময়।