#আগন্তুক
– সাবিহা বিনতে রইস
#পর্ব – ৬
দ্বিতীয় মৃত্যুটি ঘটে গেল অনিন্দিতা মারা যাওয়ার ঠিক দুদিন পর। তবে এবার ব্যতিক্রম সময়ের। বাইরে তখন মনোরম এক বসন্ত দুপুর। ঝুমঝুমে রোদ্দুর। লাবণ্য নিজের ঘরেই ছিলো, সেই শ্বেত পাথরের রাজবাড়িতে। গত দুইদিনে অনেক কিছু ঘটে গেছে। অনেক কিছু মানে, সত্যিই অনেক কিছু। ঠিক যেন একটা প্রলয় বয়ে গেছে। বিশ্ব জুড়ে থমথমে অবস্থা। করোনা ভাইরাস নামক এক প্রাণঘাতী যমদূত ঘুরে বেড়াচ্ছে বাইরে। তারা মানুষকে করেছে প্রকৃতি ছাড়া। সকলে চার দেয়ালের ভেতর বন্দি। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। সরকার কড়াকড়িভাবে ভাবে দেশে লক ডাউন করেছে। সকলের বাইরে যাওয়া বন্ধ। কোনভাবে বাইরে কাউকে দেখলেই শাস্তি। মৃত্যুর মিছিল যে এ দেশেও এড়ানো যাচ্ছে না কিছুতেই। লাবণ্য ভাবছিলো মৃত্যুটা এই ভাইরাসে হলে ভালোই হতো। মৃত্যু থেকে পালাতেই তো এখানে আসা। পরিবার ছেড়ে এত দূরে। একটু নিভৃতে সময় কাটাবে।বলে। কে জানতো এখানে ওঁত পেতে আছে ভয়ানক কিছু?
লাবণ্য চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করলো শেষ দুদিনে কি ঘটেছে। চয়ন থানায় খবর দিয়েছিলো। এই গ্রামের শুরুতেই থানা। বড় রাস্তার ঠিক নিচে। ওই থানা পেরিয়ে তারা গ্রামে ঢুকেছিলো। তারা এসে লাশ নিয়ে গিয়েছিলো। পোস্টমর্টেম শেষে ফেরত দিয়ে গেছে। পুরোটা স্বাভাবিক আত্মহত্যা, রিপোর্ট তাই বলছে। ঘর খুঁজে বিছানার তল থেকে একটা একটা চিরকুটও পাওয়া গেল৷ এলোমেলো কাটাকুটি পুরো কাগজ জুড়ে। তারই ভেতরে কয়েকটি লাইন।
তবু এ মৃতের গল্প; কোনো
নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;
বিবাহিত জীবনের সাধ
কোথাও রাখেনি কোনো খাদ,
সময়ের উদ্বর্তনে উঠে এসে বধূ
মধু— আর মননের মধু
দিয়েছে জানিতে;
হাড়হাভাতের গ্রানি বেদনার শীতে
এ-জীবন কোনোদিন কেঁপে ওঠে নাই;
তাই
লাসকাটা ঘরে
চিৎ হ’য়ে শুয়ে আছে টেবিলের পরে।
কবিতার লাইনে নারী শব্দটি কেটে পুরুষ লেখা, বধূ কেটে স্বামী। থানার বড় বাবু রসিক মানুষ। গালের ফাঁকে একটা বড়সড় পান ঢুকিয়ে খানিক সময় চাবিয়ে নিয়ে রূপমের দিকে ফিরে বললেন,
– জীবনানন্দের ভক্ত ছিলেন নাকি আপনার ওয়াইফ? তা না হলে ঘুরতে এসে কেউ অকারণে সুইসাইড করতে পারে বলে জানা ছিলো না!
রূপম মুখে হাত চাপা দিয়ে কেঁদে উঠল
উঠলো। মল্লিকা জড়িয়ে ধরলো ভাইকে। সান্ত্বনা দিলো বারবার৷
প্রত্যয়ই জিজ্ঞাসা করলো,
– আপনারা কিভাবে এটাকে সুইসাইড বলেন, আমি তো বুঝতে পারছি না। বিছানার উপর ফুল গুলো খেয়াল করেছেন? কেউ যদি আত্মহত্যা করে, সে নিজের বিছানা সাজিয়ে তবে আত্মহত্যা করবে?
অফিসার এবার একটু গম্ভীর হলেন,
– আমি যা খেয়াল করার ভালো ভাবেই করেছি। এটাও দেখেছি, উনি সুইসাইডের আগে ঠিক নতুন কনের বেশে সেজেছিলেন। লাশটা ভুলে গেলেন এত তাড়াতাড়ি? বড্ড শৌখিন মৃত্যু!!
প্রত্যয় আর কিছু বললো না৷ ঘরের একদিকে সোফায় লাবণ্যকে জড়িয়ে ধরে বসেছিলো চয়ন৷ তারদিকে একবার তাকিয়ে অফিসার বেরিয়ে গেলেন। যাবার আগে বলে গেলেন,
– আপনারা কেউ এখান থেকে যাবেন না৷ যদিও এটা সুইসাইড কেস, তবুও সপ্তাহখানেক এবাড়িতেই থাকুন। বেশিরভাগই ঝামেলায় শুরু হয় তিনদিন পর। পোস্টমর্টেম হওয়ার পরও ঝামেলা হয়। আর দেশে এমনিতেই লক ডাউন৷ খামোখা ঝামেলায় পড়বেন৷ লাশ নিয়ে যেতেও সমস্যা হবে। এখানেই সৎকারের ব্যবস্থা করে দিন।
অনিচ্ছা সত্বেও লাবণ্যকে থেকে যেতে হলো এই বাড়িতে। সবাই প্রায় ধরে নিয়েছে মৃত্যুটা আসলেই সুইসাইড। শুধু লাবণ্য জানে এটা সুইসাইড না। অনিন্দিতার মৃত্যুর তৃতীয় দিন চয়নকে একান্তে পেয়ে লাবণ্য বললো,
– প্লিজ, এই বাড়ি থেকে চলো। এই বাড়িটা ভালো নয়। কোন একটা ঝামেলা আছে। আমি এখানে থাকতে চাই না।
চয়ন মাথায় হাত বুলিয়ে লাবণ্যকে শান্ত করার চেষ্টা করলো,
– আমি জানি তোমার ভালো লাগছে না! আমারই কি ভালো লাগছে? এসেছিলাম ছুটির সময়টা ভালোভাবে কাটাতে। কি থেকে যে কি হয়ে গেল!
– শোনো, তোমরা কেন বলছো, অনিন্দিতা ভাবী আত্মহত্যা করেছে? আমি জানি এটা আত্মহত্যা নয়। এ বাড়িতে সত্যি কেউ একজন আছে। নিশ্চিত আছে। তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করছো না৷ কেন করছো না বলো তো?
– লাবণ্য তোমার মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। তোমার একটু রেস্ট দরকার। তুমি একটু ঘুমানোর চেষ্টা করো। আমি আছি তোমার পাশে।
– তুমিও আমাকে বিশ্বাস করবে না, তাইনা?
– আমি বুঝতে পারছি তোমার কথা। এই বিষয়ে আমরা পরে আলোচনা করব।
লাবণ্য শুয়ে পড়লো চয়নের গা ঘেষে। চয়ন তখন বিছানায় আধ শোয়া। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলো জানে না লাবণ্য জানে না। যখন ঘুম ভাঙলো, তখনও দুপুর৷ ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে বাইরে। পাশে চয়ন নেই। লাবণ্যর মনে হলো কেউ যেন হাসছে। খিলখিলিয়ে। তারপরই মনে হলো কেউ একজন নুপুর পায়ে হাঁটছে। লাবণ্য ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। ডাকলো চয়নকে। না পেয়ে নেমে এলো বিছানা থেকে। মৃদু পায়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো৷ বাড়িটা আজ সুনশান, নিস্তব্ধ – নীরব। কোথায় গেল সব? দক্ষিনের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার জন্য পা বাড়ালো লাবণ্য। তার আগে হঠাৎ মনে হলো উত্তর দিকে সিঁড়িতে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। লাবণ্য ঘুরে দাঁড়ালো।
– কে ওখানে? কে?
উত্তর এলো না। কেবল ঝনমনে নূপুরের আওয়াজ কানে এলো। সেও ছুটলো ওদিকে। কেউ একজন সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। তার টকটকে মেরুন রঙের পোশাক এক ঝলক দেখল লাবণ্য। ঠিক সেদিনের রাতের মতো পিছু নিলো সে। দৌড়ে ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো। তিনতলায় এসে থমকে গেছে। কেউ নেই এখানে। তিনতলার ঘরগুলো সব তালা বন্ধ থাকে। এর আগে একদিন ছাদে যাওয়ার পথে দেখেছিলো সে। মেঝেটাও অপরিষ্কার। ধুলো পড়া। সে কি তবে ভুল দেখলো? ফিরে যাবে নিচে? ফিরতে গিয়ে আবার থমকে দাড়ালো৷ কেউ একজন হেঁটে গেছে। ধুলোয় তার পায়ের ছাপ। ঠিক পায়ের ছাপ নয়। যেন পা ছেচড়ে গেছে। ছাপটা টানা দাগের মতো দেখাচ্ছে। লাবণ্য এগিয়ে গেল দুরুদুরু বুকে। কে আছে ওখানে? কাছে গিয়ে অবশ্য দেখলো দরজার তালা খোলা। কেবল ভেজানো আছে। ধাক্কা দিলো লাবণ্য। করকচ শব্দে খুলে গেল পুরানো দরজা। বিশাল এক জলসাঘর। ফাঁকা একদম। কোন আসবাব নেই। ঘরের ঠিক মাঝে, মেঝেতে দারুণ এক আলপনা। আলপনা জুড়ে কেউ ছড়িয়ে দিয়ে অজস্র নয়নতারা ফুল। ঠিক তার উপরে কড়িকাঠ থেকে ঝুলছে মল্লিকার লাশ। লাবণ্য গলা ফাটিয়ে একটা চিৎকার দিলো। তারপর জ্ঞান হারালো।
(চলবে)