আগন্তুক
পর্ব – ৫
লাবণ্যর চিৎকার শুনে নিচে থেকে ছুটে এলো মল্লিকা আর প্রত্যয়। তার দৃশ্য অনুসরণ করে ঘরে তাকানো মাত্র মুখে হাত চাপা দিয়েছে সে৷ প্রত্যয়ের চোখ বিস্ফোরিত। ততক্ষণে কোমরে তোয়ালে পেচিয়ে চয়নও বেরিয়ে এসেছে। লাবণ্য আর দাঁড়াতে পারছিলো না। মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার আগ মুহুর্তে তাকে ধরলো চয়ন৷ প্রায় টেনে সরিয়ে নিয়ে এলো ঘরের দরজা থেকে। মল্লিকা ফুপিয়ে কেঁদে উঠেছে। বিড়বিড় করে বলে চলেছে, এটা কি হলো! কিভাবে হলো!
প্রত্যয় চট করে সামলে নিয়েছে নিজেকে। রূপমকে ফোন করা দরকার৷ ফোন অবশ্য দেওয়া লাগলো না৷ তার আগেই বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে রূপমকে ঢুকতে দেখা গেল। শিস দিতে দিতে মূল ফটক পেরিয়ে এগিয়ে এলো সে৷ প্রত্যয়কে রেলিঙের কাছে দাড়িয়ে থাকতে দেখে হাত নাড়লো৷ প্রত্যয় উত্তর করল না। আর আর কয়েকটা সেকেন্ড, তারপর অনিন্দিতাকে দেখে কি অবস্থা হবে তার ভাবতেই হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। রূপম ধীরে সুস্থে উপরে এলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,
– কি হয়েছে তোদের? সব দাঁড়িয়ে যে?
প্রত্যয় অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে হাত দিয়ে দেখালো ঘরের দিকে। ঘরের দরজায় তখনও মুখ ঢেকে বসে আছে মল্লিকা। রূপম এগিয়ে গেল,
– কি হয়েছে রে মল্লি…কথা শেষ হলো না। তার আগেই গগন বিদারী চিৎকার সকলের কানে পৌছেছে। রূপম ছুটে গেছে অনিন্দিতা কাছে। অনিন্দিতার পা দুটো নিজের কাঁধে নিয়ে হাউমাউ করে উঠেছে।
– এ কি সর্বনাশ হলো! কি ঘটে গেল এটা!! অনি! অনি! কি হয়েছে তোমার! অনি…
বলতে বলতে ঢলে পড়েছে৷ প্রত্যয় দৌড়ে এসে ধরলো রূপমকে৷ ছুটে এসেছে চয়নও। নাহ! জ্ঞান নেই। মূর্ছা গেছে রূপম। মল্লিকা ছুটে এলো পানির বোতল হাতে। মুখে পানি ছেটালো ছটাস ছটাস। মিনিট সাত- আট পরেই জ্ঞান ফিরলো রূপমের৷
বেলা এগারো বাজতে না বাজতেই ফাল্গুনের রোদ চড়া এখন। ফাল্গুন বোধহয় শেষ প্রায়। চৈত্র পড়েও যেতে পারে৷ হিসাব নেই লাবণ্যর৷ অনিন্দিতার লাশ নামানো হয়েছে৷ রূপম প্রায় অজ্ঞান। দুজনের প্রেমের বিয়ে ছিলো৷ বিয়ের আগে অনেক বছরের সম্পর্ক৷ ভালোবাসার মানুষের চলে যাওয়া মেনে নেওয়া কি এতই সহজ ব্যাপার? কখনো না। রূপমও এখনো কিছু বোঝার মতো অবস্থা নেই। ওর কথা মতো সব কিছু ঠিক ছিলো দুজনের। ভোরের আলো যখন কেবল ফুটতে শুরু করেছে, তখন উঠে রূপম বেরিয়েছিলো। এপাশে নাকি একটা বিল আছে। ভোর রাত থেকে জেলেরা মাছ ধরে। সকাল সকাল টাটকা মাছ নিয়ে আসা যাবে ভেবেই বেরিয়েছিলো। অনিন্দিতা তখনও গভীর ঘুমে৷ এর মধ্যে এটা কি হয়ে গেল, ভেবেই পাচ্ছে না কেউ। আরেকটা বিষয় চোখে পড়ার মতো। বিছানা জুড়ে অজস্র নয়নতারা ফুল। এত ফুল কে আনবে? আশেপাশে নয়নতারার বাগানও চোখে পড়েনি। চয়ন বলেছিলো পুলিশে খবর দিতে হবে৷ মৃত্যুটা অস্বাভাবিক। একসাথে মল্লিকা আর প্রত্যয় দুজনই বাঁধা দিয়েছে। এ বাড়িতে তারা ছাড়া আর কেউ আসেনি। কেউ নেইও সাথে। পুলিশ কি তাদের ছেড়ে দিবে? শেষে তো হাত কড়া পরবে তাদেরই হাতে। মল্লিকা আমতা আমতা করে বলেই ফেলেছে,
– তোমরা কি একটা বিষয় খেয়াল করেছো? ভাবীর মৃত্যুর সাথে অদ্ভুত ভাবে লাবণ্যর গল্পটা মিলে যায়। প্রায় সম্পূর্ণটায়।
– কোন গল্প?
চয়ন অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো।
– কেন? কাল রাতে অনিন্দিতা ভাবী বলেছিলো না, লাবণ্য একটা গল্প দিয়েছে ফেসবুকে? তোমরা কি ভাবছ জানি না, কিন্তু ওই গল্পের সাথে কিভাবে যেন ভাবীর মৃত্যুটা মিলে যাচ্ছে।
প্রত্যয় বললো,
– তাহলে কি এটা আত্মহত্যা? ভাবী গল্পটা থেকে কোনভাবে ইনফ্লুয়েন্স হয়ে আত্মহত্যা করেছে বলছো?
– আত্মহত্যা ছাড়া কি হবে? আমরা নিশ্চয় কেউ ভাবীকে খুন করব না?
চয়ন ঠোঁটের নিচটা কামড়ে ধরে আছে অনেকক্ষণ। ভাবছে কিছু৷ অনেকটা আনমনেই বললো,
– এই বাড়ির ছাদটা উঁচুতে অনেক। টেবিল চেয়ার ছাড়া কড়িকাঠে হাত পাওয়া সহজ নয়। আর যদি টেবিল চেয়ারের সাহয্য নেয়, বিছানার উপর তো থাকবে কিছু। কোথায় সেগুলো?
– তাহলে কি বলছো চয়ন ভাই? আমরা কেউ খুন করেছি ভাবীকে? কথাটা তো তোমার বউয়ের উপরেই বর্তায় তাহলে। ওরই মাথায় ওই দৃশ্যটা ঘুরছে। কারণ গল্পের দৃশ্যপট তার সৃষ্টি…
লাবণ্য ঘর থেকে সব শুনতে পাচ্ছিলো। হাত পা কাঁপছে তার। সত্যিই কি এর সাথে অন্য কিছু জড়িত। এ বাড়িতে অন্য কেউ আছে? কাল রাতে কাকে দেখেছিলো সে? কেউ বিশ্বাস করুক কিংবা না করুক। সে তো জানে। কেউ একজন ছিলো এখানে। নিশ্চয় কেউ ছিলো।
– ও আল্লাহ গো!! এই মাইয়াডার কি হইসে? ওমা! এইটা বউ না? মইরা গেসে? আল্লাহ গো! কি ভাবে মরলো? তোমরা সব বইসা রইসো ক্যান? কিছু করছ না ক্যান?
হঠাৎ এমন গগনবিদারী কণ্ঠের হাহাকারে সচকিত হয়ে উঠলো সবাই। সবার হতমান অবস্থার মধ্যে কখন যেন কালকের সেই বৃদ্ধ মহিলাটি উপরে উঠে এসেছে। গত কয়েকদিন ধরে তিন বেলার রান্নার দায়িত্বে তিনিই আছেন। চয়ন এবার উঠে দাড়িয়েছে।
– আমার মনে হয় পুলিশকে খবর দেওয়া উচিত। সে আসার পর যা সবার তাই হবে। প্রত্যয় আর মল্লিকা এবার আর বাঁধা দেওয়ার সুযোগ পেল না। তার আগেই চয়ন নেমে গেছে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে। মল্লিকা অনেক কষ্টে বৃদ্ধাকে শান্ত করেছে। সে এখনো বিড়বিড় করে কেঁদে চলেছে। রূপম আগের মতোই ঠাঁয় বসে আছে। বৃদ্ধা কাঁদতে কাঁদতে লাবণ্যর কাছে এলেন। মাথায় হাত রাখলেন, তারপর বিড়বিড় করে বললেন,
– বলসিলাম কাইল রাতে, সে দেখা দিব। তাই বইলা এমনে দেখা দিবে ভাবি নাই৷
লাবণ্য চমকে ফিরে তাকালো বৃদ্ধার দিকে। বললো,
– কার কথা বলছেন?
বৃদ্ধা চোখ মুছে বললো,
– ক্যান, নয়নতারা!!
(চলবে)