আগন্তুক পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0
19

#আগন্তুক
#অন্তিম_পর্ব
#মৌসুমী_হাজরা

অন্তরার যখন জ্ঞান ফিরলো, তখন দেখলো, আর্য তার পায়ের কাছে বসে আছে। হয়তো সারা রাত জেগে থাকার জন্য ভোরের দিকে একটু ঘুমিয়ে গেছে, তাই চেয়ারে বসে থাকা অবস্থায়, অন্তরার বেডে মাথা নামিয়ে রেখেছে। এখন কি ডাকা ঠিক হবে? না থাক একটু এইভাবেই চোখ বন্ধ করে থাকুক। কি যে হয়ে গিয়েছিল নিজেই মনে করতে পারছে না অন্তরা। হঠাৎই কেমন যেন অন্ধকার হয়ে গেল, তারপর আর কিছু মনে নেই। বিশ্বজিৎ এর কাছে বাড়ির একটা চাবি থাকে, ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন করে খবর নেয় ছেলেটা। হয়তো ফোনে না পেয়ে সোজা বাড়ি চলে এসেছিল। পেটে হাত দিয়ে কিছু অনুভব করতে চাইলো অন্তরা, বাচ্চাটা ঠিক আছে তো?

আর্যর ঘুমটা ভাঙতেই দেখলো, অন্তরার জ্ঞান ফিরে এসেছে। হাসিমুখে বললো, গুড মর্নিং।
অন্তরা বললো, সারারাত আমার জন্য কত ক ষ্ট হলো বলো? আর্য বললো, কই না তো, ক ষ্ট কেন হবে? আর তুই এত বেশি ভাবিস বলেই এমন হলো। বিপি এত হাই হলো কিভাবে? নিজের না হোক বাচ্চাটার কথা ভাব। এবার থেকে আমি যা বলবো তাই করবি। অনেক হয়েছে তোর।
অন্তরা মনে মনে হাসতে লাগলো। আজ যদি ও ম্যারেড হতো, সমাজে এই বাচ্চার বাবার পরিচয় থাকতো, কত মানুষ মাথায় হাত বুলিয়ে বলতো, মা এটা করলে বাচ্চার ভালো হবে, এটা করো না, বাচ্চার ক্ষ তি হবে। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে বলার কেউ নেই। গুটিকয়েক বন্ধু ছাড়া, যদিও তারা বেশির ভাগই পুরুষ। সেদিন আর্য ঠিকই বলেছিল, সব পুরুষ এক নয়।

বিশ্বজিৎ চলে এসেছে খাবার নিয়ে, অন্তরাকে সুস্থ দেখে বললো, উফ কি ভ য় খাইয়ে দিয়েছিলে মাইরি! এখনও মনে পড়লে আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। ভাগ্যিস আর্য দার ফোন নাম্বারটা ছিল, নয়তো কি যে হতো। অন্তরা একবার মুচকি হাসি দিয়ে আর্যর দিকে তাকালো। তারপর বললো, আমার আর ভ য় নেই। আমি না থাকলেও আমার বাচ্চা অনেক মা পাবে।
কথাটা শোনা মাত্রই আর্য আর বিশ্বজিৎ একে অপরের দিকে তাকালো।

গাড়ি থেকে নামতেই, পাশের বাড়ির আন্টিরা সবাই দেখা করতে এলেন। অন্তরা বেশ অবাকই হলো। কেউ কেউ ধমকের সুরে বললেন, এই সময় কেউ এত স্ট্রেস নেই? কেউ কেউ বললেন, খাবার-দাবার কেমন খাচ্ছে কে জানে? ওনারাই অন্তরাকে ধরে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। এই প্রথম অন্তরা যেন এত ভালোবাসা পেল। কা ন্না আসছে কিন্তু সেটা আড়াল করার চেষ্টা করছে। যদিও সেটা আর্য ভালো করেই বুঝতে পারছে।

এই কদিনে যেন আর্য মেয়েটার মায়ায় বেশি জড়িয়ে পড়েছে। আর্য দুনিয়ার সব খুশি অন্তরাকে এনে দিতে চায়। অন্তরার খুশিতে যেন তার ভালোলাগা জড়িয়ে আছে। সেই প্রথম দেখা থেকে আজ অব্দি অন্তরার প্রতি একটা অনুভূতি কাজ করছে। সেটা কি শুধুই বন্ধুত্ব নাকি অন্য কিছু। এই অবস্থায় নিজের কথাগুলো বললে, অন্তরা বুঝবে?

অন্তরার ডাকে সম্বিৎ ফিরলো, তারপর বললো, হুম বল।
অন্তরা হেসে বললো, কী ভাবছো?
আর্য বললো, কই কিছু না তো।
ফোনটা বেজে উঠলো, স্ক্রিনে ডক্টর অরুন্ধতীর নাম্বার। অন্তরার থেকে একটু সরে গিয়ে ফোনটা রিসিভ করলো আর্য। অরুন্ধতী বললেন, এখন কিছুতেই অন্তরাকে একা রাখা যাবে না। কিন্তু ২৪ ঘন্টা ওর দেখাশোনা করবে এমন মানুষই তো নেই। আর্য বললো, আমি সব ম্যানেজ করে নেব।

অন্তরার কাছ থেকে সবাই চলে যেতেই, আর্য বললো, ফ্রেশ হয়ে নে, আমি এখানেই আছি। তোর সব দরকারী জিনিস আমি প্যাকিং করছি। অন্তরা অবাক হয়ে বললো, আমি কোথায় যাবো? আর্য অন্তরার ওষুধ গুলো দেখতে দেখতে বললো, আমার বাড়িতে থাকবি।
অন্তরা বললো, তা হয় না আর্য। আমি আর তোমার উপর বোঝা হতে চাই না। তাছাড়া তোমারও একটা জীবন আছে। আমাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে গেলে সবাই নানারকম কথা বলবে। আমি চাই না, আমার জন্য তোমার কোনো ব’দনাম হোক।
আর্য এবার রা গী চোখে তাকিয়ে বললো, তোকে এত ভাবতে কে বলেছে? তোকে যা বলছি তুই শুধু তাই কর।
অন্তরাও উত্তেজিত হয়ে বললো, কিছুতেই না। আমি আর তোমার জীবনে বোঝা হতে চাই না। এইভাবে দুজনের কথা কা’টাকা’টিতে হঠাৎ করে অন্তরা থেমে গিয়ে পেটে হাত দিয়ে বসে পড়লো। আর্য অন্তরার কাছে গিয়ে বললো, কী হয়েছে অন্তরা? তুই ঠিক আছিস তো? সরি সরি। আমার মাথার ঠিক ছিল না, তোর সাথে জোর গলায় কেমন কথা বলছিলাম, ভুলেই গিয়েছিলাম তোর শরীরটা ভালো নেই।
অন্তরা কিছু না বলে আর্যর হাতটা তার পেটের কাছে রাখতেই আর্য চমকে উঠলো। বাচ্চাটা নড়ছে। যেন বলতে চাইছে, তোমরা ঝ গ ড়া করছো কেন? আমি যে তোমাদের সাথে আছি, সেটা কি ভুলে গেছ?
এই অনুভূতিটা যে কত সুন্দর তা বলে বোঝানো যাবে না। যাঁরা এটা অনুভব করেছেন তাঁরাই শুধু জানেন। আর্যর চোখে জল, ধীরে ধীরে বললো, আমাকে বিয়ে করবি অন্তরা? আমি জানি তোর কাউকে দরকার নেই। কিন্তু আমার প্রয়োজন তোদেরকে। আমি এই অল্প সময়েই তোদের অনেক আপন করে নিয়েছি। আমাকে একটু অধিকার দে না, যাতে আমি জোর গলায় বলতে পারি, এই সন্তান আমারও।
অন্তরা কাঁ’দতে কাঁ’দতে বললো, আমাকে দয়ায় রেখো না। আমি দয়ার পাত্রী হয়ে থাকতে চাই না।
আর্য এবার অন্তরার গাল দুটো ধরে বললো, একদম দয়া করছি না আমি, আমি দয়া করার কে? আমি শুধু তোর মনে আমার একটা জায়গা করতে চাইছি। বাচ্চাটা যখন হাঁটতে শিখবে, আমি আমার আঙুলটা বাড়িয়ে দিতে চাইছি। তোর এই সুন্দর জার্নিটা থেকে শুরু করে, যতদিন প্রাণ থাকবে ততদিন সাথে রাখতে চাই। আমাকে ফিরিয়ে দিস না। আমি অনেক ভেবেছি, তারপর সিন্ধান্ত নিয়েছি। কোনো আবেগ বা দয়া করে নয়।

এক মাস পর,
রেজিস্ট্রি ম্যারেজ অফিসে হাজির আছে, অরুন্ধতী, বিশ্বজিৎ, আর কিছু অন্তরা আর আর্যর বন্ধু, আর অন্তরাকে যিনি বড়ো করেছেন, সেই ফাদার। সকলে যেন ভীষণ খুশি। আর্য অন্তরার হাত ধরে ঢুকলো অফিসে।
অরুন্ধতী, অন্তরাকে দেখেই বুঝতে পারছেন, মেয়েটা শরীর এবং মন দুদিক দিয়েই ভালো আছে। অন্তরার মুখের হাসি যেন ভেজালহীন। রেজিস্ট্রি ম্যারেজ হয়ে গেল।
আর্যর ফোনে একটা ফোন আসতেই, আর্য বললো, একটু পরেই যাচ্ছি।
অন্তরা জিজ্ঞাসা করলো কয়েকবার, আমরা কোথায় যাবো? আর্য ততবারই হেসে বললো, সারপ্রাইজ।
ফাদার অনেক আশীর্বাদ করলেন ওদের। আর্যকে কিছুক্ষণ বুকে জড়িয়ে রেখেছিলেন তিনি।
তারপর আর্য, অন্তরা, বিশ্বজিৎ আর ডক্টর অরুন্ধতী গেলেন অন্তরার বাড়িতে।
অন্তরা একটু অবাকই হলো, কারণ সে এই একমাস আর্যর বাড়িতে ছিল। হঠাৎ করে আবার ওর বাড়ি যাওয়ার কারণ সে জানে না।
গাড়ি এসে বাড়ির কাছে থামতেই, অন্তরার পাশের বাড়ির আন্টিরা উলুধ্বনি দিতে লাগলেন। সকলে অন্তরাকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করলেন। অন্তরার এখন নয় মাস চলছে। তাই নিয়মানুযায়ী এই মাসেই অন্তরার সাধ। আন্টিরা নিজেদের মতো রান্নাবান্না করেছেন। অন্তরাকে বসিয়ে সব খাবার সাজিয়ে দিলেন। লাল শাড়িতে অন্তরাকে আরও যেন সুন্দর লাগছে। আর্য যেন এক মুহুর্তের জন্য চোখ সরাতে পারছে না। তার জীবনে এই প্রথম ভালোবাসার বসন্ত এসেছে। অরুন্ধতী বললেন, খুব গর্ব হচ্ছে আপনার জন্য ডক্টর আর্য। এত সুন্দর একটা সিন্ধান্ত নেওয়ার জন্য। আপনাদের ভালোবাসা সারাজীবন অটুট থাকুক।

… কী ভাবছিস?
… কিছু না তো।
… বললেই আমি শুনে নেব। বল কী ভাবছিস?
… একটা সম্পর্কের নাম থাকা খুবই আবশ্যক? দেখো আমার বাড়ির পাশের আন্টিদের ব্যবহার কেমন পালটে গেল। যে মানুষগুলো আমার মুখ দেখতে চাইতেন না, তাঁরাই আজ আমায় কত আশীর্বাদ করলেন।
… ব্যাপারটা ঠিক তেমন না। সমাজের কথা বাদই দিলাম, আমরা যতই নামহীন সম্পর্ক নিয়ে মাতামাতি করি না কেন, একটা সময় পর সব মানুষই অধিকার খোঁজে।
যেমন ধর, প্রথম প্রথম এমন একটা সম্পর্ক শুরু হলো, যেখানে বলা হলো, আমাদের সম্পর্ক মুক্ত, আমরা নিজেদের মতো স্বাধীন, আমরা যেমন চাইবো সেভাবে নিজেদের জীবন কা’টাবো। কিন্তু একটা সময় পর মানুষ অধিকার খুঁজে। সারাদিন কাজের পর কেউ অপেক্ষা করে না থাকলে, বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না। অপেক্ষা, অধিকার, বিশ্বাস, ভালোবাসা আর সম্মান এইগুলো যেকোনো সম্পর্কের একটা স্তম্ভ।
বিয়ে মানেই যে সেই সম্পর্ক পবিত্র হয়ে গেল তেমন না। একে অপরের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে সেটা বিয়েই না। আর রইলো সমাজ, সেটাও একদিন পালটে যাবে সময়ের সাথে সাথে। চল রাত হলো, ঘুমিয়ে পড়।

এতক্ষণ ধরে ডক্টর মেঘা, ডক্টর আর্যর প্রেমকাহিনী শুনছিল। এবার আর্য একটু থামলো। মেঘা বললো, তারপর কী হলো?
আর্য বললো, আমাদের জীবনে এল রাজকুমারী। আমার সন্তান।
উঠি এবার, ভোর হয়ে গেল। আবার রাউন্ডে যেতে হবে।

মেঘার মন তখনও ভরে নি। নিশ্চয় এর পরে আরও কিছু হয়েছিল, যেটা ডক্টর আর্য এড়িয়ে গেল। না, মেঘাকে জানতেই হবে।

দুপুরে কলিং বেলের আওয়াজে দরজা খুললো আর্য। সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেঘা। বেশ অবাক হয়ে বললো, আপনি আমার বাড়িতে?
মেঘা বললো, আসলে এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম, ভাবলাম আপনার অন্তরাকে একবার দেখে যায়।
আর্য হেসে বললো, ওহ এই ব্যাপার। আসুন ভিতরে।

আর্য জলের গ্লাসটা নামিয়ে ডাকলো অন্তরাকে।
রুম থেকে বেরিয়ে এল, একটি ৩ বছরের বাচ্চা মেয়ে, আদো আদো গলায় বললো, আমায় ডাকছো কেন?
আর্য বললো, এই আন্টিটা তোমায় দেখতে এসেছেন। আন্টিকে হ্যালো বলো।
বাচ্চা মেয়েটি তখন মিষ্টি গলায় বললো, হ্যালো আন্টি!
মেঘা অবাক হলেও, মুখে হাসি নিয়ে বললো, হ্যালো বেটা! কী নাম তোমার?
বাচ্চা মেয়েটি বললো, আমার নাম অন্তরা।
কথাটি বলেই কোলে থাকা পুতুলটিকে দেখিয়ে বললো, এবার আমি যাই, মিমিকে ঘুম পাড়াতে হবে।
মেঘা ঘাড় নাড়লো।
বাচ্চা মেয়েটি চলে যেতেই, আর্য বললো, আপনি যার খোঁজে এসেছেন, তাকে দেখতে পাবেন না। সে ছিল স্বাধীন পাখি। অনেক চেষ্টা করেছিলাম, তাকে আটকে রাখার, কিন্তু পারি নি। অন্তরাকে জন্ম দিয়ে ওই অন্তরা হারিয়ে গেল। বহু চেষ্টা করেছিলেন ডক্টর অরুন্ধতী এবং বাকি সব ডক্টর। কিন্তু যা হওয়ার তাই হলো। সে ছিল ক্ষণিকের অতিথি। তবে সেই ছিল আমার ভালোবাসা।

অনেকক্ষণ আগেই মেঘা, আর্যর বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। মনে মনে ভাবছে, এমনও মানুষ পৃথিবীতে আছে বলেই, এখনও পৃথিবী টিকে আছে।

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে