‘আকাশ তীরে আপন সুর’
|পর্ব ০২|
লাবিবা ওয়াহিদ
নির্মলের বাবা মারা যায় বেশিদিন হয়নি। প্রায় মাস তিনেক হবে হয়তো। নির্মলের একটি ছোটো বোন আছে। নাম তার নোভা। নোভা হঠাৎ-ই অন্যকারো হাত ধরে পালিয়ে গেল। পালিয়ে যাওয়ার পরপরই সুস্থ, সবল নির্মলের বাবা সম্মানহানির কারণে স্ট্রোক করলেন। স্ট্রোক করার পর শয্যাশায়ী ছিলেন প্রায় মাসখানেকের মতো।
নির্মলের বাবার বাজারে যেই দুটো দোকান ছিল তার একটা বিক্রি করে দিতে হয়েছিল, নির্মলের বাবার চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে। এরপর থেকে নির্মল-ই কোনো রকমে টেনে-টুনে সংসার চালাত। কিন্তু সেই বাবাও বেশিদিন টিকেনি।
মেয়ে এবং স্বামীর শোকে নীলুফাও অনেকটা ভেঙে পড়েন। লোকের বিষাক্ত, তিক্ত কথাবার্তাও তিনি সইতে পারছিলেন না। বাবা মারা যাওয়ার পর নির্মলও যেন কেমন হয়ে গেল। রোজ রোজ মাকে প্রতিবেশিদের তিক্ত প্রশ্নের অতলেও রাখতে পারছিল না। মোটকথা, সুনামগঞ্জ এবং প্রিয় মাতৃভূমি তাকে দমবন্ধকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। এজন্য হঠাৎ-ই যোগাযোগ করল নুহাশ সাহেবের সাথে।
নুহাশ সাহেবের সঙ্গে নির্মলের বাবার বেশ ভালো বন্ধুত্ব ছিল। আবার এটাও বলা যায়, নির্মলের বাবাই নুহাশ সাহেবের ঘটকালি করেছিল ফাহিমার বিষয়ে। তাইতো বিপদের দিনে নুহাশ সাহেবকেই মনে পড়ল। নির্মল নুহাশ সাহেবকে কল করে বলেছিল,
–“আমার একটা চাকরির দরকার চাচা। আপনার হাতে কোনো চাকরি আছে?”
সেই মুহূর্তে নুহাশ সাহেবের কাছে সেরকম চাকরির খোঁজ ছিল না। পাহাড়ি এলাকার চা বাগানে থাকে নুহাশ সাহেব। সে তো আর নির্মলের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি দিতে পারবে না। তাই সেই মুহূর্তে অবশ্য দুঃখী মনেই নির্মলকে ফিরিয়ে দিতে হয়েছিল। নির্মলও কোনো রকম অভিযোগ করেনি। হাসি মুখে কল কেটেছে।
নুহাশ সাহেব সেদিন যেমন হতাশও হয়েছেন তেমনই নির্মলের সাবলীল, সুন্দর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছেন। তাইতো যখন নতুন ম্যানেজারের কথা ওঠল তখনই মাথায় নাড়া দিল নির্মলের ব্যাপার। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই যোগাযোগ করেন নির্মলের সাথে।
নুহাশ সাহেব অবশ্য এই ভেবে ভয় পেয়েছিলেন নির্মল অন্যত্র চাকরি পেলো নাকি? নির্মলের সঙ্গে যোগাযোগ করে অবশ্য সেই ভয়, দ্বিধা কেটে গেছে। তার এই ভেবে আফসোস হচ্ছিল এতদিন যাবৎ বেকার ছেলেটাকে কোনো ভাবে সাহায্য করতে পারেনি। অর্থ সাহায্য করে নির্মলকে কখনোই নিচু দেখাতে চাননি নুহাশ সাহেব।
সন্ধ্যার পর নীলুফা ফাহিমার সঙ্গে বসে বিভিন্ন আলাপে ব্যস্ত। ফাহিমা যেমন নীলুফাকে পেয়ে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। এই বিশাল চা বাগানের মাঝে ফাহিমার গল্প করার মতো বিশেষ কেউ নেই। মেয়েটাও সেভাবে গল্প করে না, সারাদিন কেমন মুখ ভার করে রাখে যেন কতদিনের বিরহে ভুগছে। এ নিয়ে ফাহিমাও কম কথা শোনায় না প্রণয়াকে। কিন্তু তবুও প্রণয়ার মধ্যে বিশেষ পরিবর্তন দেখা যায়নি। তাই ফাহিমা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। আর এমনিতেও মায়েদের মেয়ের সামনে জিভের নিয়ন্ত্রণ রাখতে হয়। তার বয়সী কথাবার্তা চাইলেও সব সময় মেয়ের সাথে বলা যায় না।
প্রণয়া সিঁড়িতে বসে আছে হাতে পাঠ্যবই নিয়ে। সিঁড়ির লাইটটা জ্বালানো নেই, প্রণয়াই বন্ধ করে দিয়েছে। সিঁড়িটা বাড়িতে ঢুকতেই ডানপাশে। কাঠের সিঁড়িতে আবার লম্বা করে কাঠের রেলিং। প্রণয়া মূলত নীলুফার প্রতি আগ্রহী। তাই দূরে বসেই মা এবং আন্টির আলাপ নীরবে শুনছে। বৈঠকঘরের আলো এতটাও তীক্ষ্ণ নয়, তাই সেই আলো সিঁড়ি অবধি পৌঁছাতে পারেনি।
প্রণয়া শুনল নীলুফাদের বাজে পরিস্থিতি। একে একে নোভার পালিয়ে যাওয়া, নির্মলের বাবার মৃ%ত্যু, নির্মলের কষ্ট করে সংসার চালনা সবকিছুই। প্রণয়া শুনে অবশ্য কিছুটা আহত হলো। না জানি কীভাবে কঠিন পরিস্থিতি কাটিয়ে এখানে এসেছে।
নীলুফার শুকনো, ভাঙা মুখের মায়া টেনেছে প্রণয়াকে। মানুষটাকে সরল-ই লেগেছে প্রণয়ার। তবে সে এখনো মহান নির্মলকে চোখের দেখা দেখতে পারেনি। দুপুরে নাকি খেতে এসেছিল। প্রণয়া তখন কোথায় ছিল কে জানে?
–“এই আপু! তুমি এখানে চোরের মতো বসে আছ কেন?”
প্লাবনের আচমকা বলা কথায় প্রণয়া ঘাবড়ে গিয়ে পিছে ফিরে তাকায়। প্লাবনের গলার স্বর প্রয়োজনের চাইতে বেশি ছিল। ফলে ফাহিমা, নীলুফার কানেও সেই গলা পৌঁছায়। প্রণয়া তা বুঝতে পেরে রাগ দেখালো প্লাবনকে। ধমক দিয়ে বলল,
–“এভাবে ভূতের মতো পিছে এসে দাঁড়িয়েছিস ভালো কথা, মুখ এত চলে কেন তোর? আমাকে তোর কোন দিক দিয়ে চোর লাগে?”
প্লাবন মুখ চেপে হাসে বোনকে খেলাতে পেরে। ফাহিমা তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে গলা উঁচিয়ে বলল,
–“এই, তোদের না পড়তে বসতে বললাম? তোরা এখানে কী করিস?”
প্রণয়া আবছা আলোয় পুণরায় প্লাবনকে গরম মেজাজ দেখিয়ে নেমে এলো। সভ্য, মাথায় কাপড় দেওয়া প্রণয়াকে দেখে নীলুফার মুখে হাসি ফুটল। প্রণয়া তার দিকে চেয়ে বিনয়ের সাথে হেসে বলল,
–“চা বানিয়ে দেই তোমাদের?”
ফাহিমার মুখটা শুকিয়ে গেল মেয়ের কথা শুনে। ইশ! কথায় কথায় নীলুফার সামনে নাস্তা দিতেই ভুলে গেছে। এজন্য মেয়েকে বাঁধা দিল না। প্রণয়া নীরবে চলে গেল রান্নাঘরে। পেছন থেকে ফাহিমার গলা শুনতে পেল,
–“প্রণয়ার হাতে চা বানানোর জাদু আছে। প্রতিদিন একবার হলেও ওর হাতের চা খেতে হয় আমার।”
.
রাত এখন বেশ গভীর। পুরো চা বাগানের অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা। গভীর রাতে তো আরও গা ছমছমে পরিবেশ। তার ওপর ইলেক্ট্রিসিটি নেই। প্রণয়া গায়ে চাদর জড়িয়ে দরজার বাইরে বসে আছে। তাদের সদর দরজার সামনে ছাউনি দেওয়া। ছাউনির নিচে বেতের জোড়া সোফা এবং মাঝে একটি টি-টেবিল। প্রণয়া অবশ্য সেখানে বসেনি। সে সোজা মেঝেতেই বসল দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে।
গভীর রাতের গা ছমছমে এই পরিবেশে কারোই মূলত সাহস থাকার কথা নয়। তবুও প্রণয়া এই ভয় ভয় অনুভূতিতে সাময়িকের জন্য নিজের থেকে ছিন্ন করে এই দুঃসাহসিক কাজটা করল। সঙ্গে অবশ্য মোম আর একটি ম্যাছ রেখেছে। হাতে একটা লোহার চুড়িও পরেছে শুনেছে আগুন এবং লোহা সাথে থাকলে নাকি খারাপ নজর সহজে লাগে না। এছাড়া বের হওয়ার আগে আয়াতুল কুরসিও পড়তে ভুলেনি সে।
প্রণয়া ঠায় বসে রইলো সে স্থানে। আকাশে চাঁদ নেই, আশেপাশে আলোর চিহ্নও নেই। কারেন্ট আসলে ছাউনির নিচের হলদে বাতিটা জ্বলে উঠবে, যা সারা রাত বিরতিহীন জ্বলে। প্রণয়া কারেন্ট আসার অপেক্ষায় বসে রইলো। অপেক্ষা নীরব হলেও মস্তিষ্ক থেমে নেই। মস্তিষ্কে ঘূর্ণিপাকের মতো ঘুরছে অসংখ্য ভাবনার মেলা। বেশি নাড়া দিচ্ছে নির্মলের ভাবনা। আজ পুরো দিনেও একবারের জন্যেও দেখেনি নির্মলকে। এখন নিশ্চয়ই মা ছেলে ঘুম। এই গভীর রাতে ঘুমাবে সেটাই স্বাভাবিক। বরং রাত জাগা পাখির মতো প্রণয়ার জেগে থাকাটা অস্বাভাবিক।
প্রণয়া মনোযোগ দিয়ে অবশ্য কোথাও চাইতে পারছে না। যখনই কোথাও একটু নজর স্থির করতে চাইছে তখনই ভয় নাড়া দিয়ে উঠছে বুকে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে চা বাগানের মাঝে এভাবে বসে থাকা কোনো মেয়ের পক্ষে সম্ভব? সময় যত যেতে লাগল প্রণয়ার সাহসও ততটাই নিভে আসতে লাগল। তবুও প্রণয়া একই ভাবে বসে রইলো।
হঠাৎ শুকনো পাতায় কারো হাঁটার শব্দ পেল। মুহূর্তে-ই প্রণয়া থমকে যায়। সামনে চাইতেই দেখল অদূরে আলোর মৃদু উৎস। সেটা দেখে প্রণয়া ভয়ে জমে গেল। নড়াচড়ার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলল। মৃদু আলোটা ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগল। যত আলোটা এগোচ্ছে তত প্রণয়া অনুভব করছে তার কপালে ঘাম জমেছে।
ওদের কাঠের সাদা-মাটা গেটটার কাছে আলোটা আসতে আসতে হঠাৎ নিভে গেল। আলো নিভলেও অদৃশ্য তাণ্ডব থামল না। কাঠের দরজার এক নিজস্ব শব্দে সেই দরজা খুললও আবার লাগালও। সঙ্গে শোনাল সেই একই পায়ের শব্দ। প্রণয়ার তখন গলা শুকিয়ে কাঠ কাঠ। ভয়ে কথা বলার শক্তিও খুইয়ে বসেছে সে। কাউকে ডাকার সাহস অবধি পাচ্ছে না। যে-ই পায়ের শব্দটা প্রণয়ার কাছাকাছি এলো ওমনি ধপাস করে একটা শব্দ হলো। এই শব্দ শুনে প্রণয়ার প্রাণ-ভোমরা একদম যায় যায় অবস্থা।
ঠিক তখনই কারেন্ট এলো। কিছু স্থান জুড়ে হলদে আলো বিস্তৃত হলো। প্রণয়া দেখতে পেল কালো পোশাকধারী এক লোক উঠানে বসে রয়েছে। আলোর সঙ্গে সঙ্গে প্রণয়া যেন তার বাকশক্তি ফিরে পেল। মুহূর্তে-ই নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ক্রমাগত চেঁচিয়ে বলল,
–“চোর, চোর, চোর!!”
#আকাশ_তীরে_আপন_সুর
চলবে~~