#ধারাবাহিকগল্প
#আকাঙ্খিতো প্রণয়
পর্ব-ষোলো
মাহবুবা বিথী
——-লিজা তোমার আম্মু বুদ্ধিমতি মহিলা। একটু দেরী হলেও নিজের সর্বনাশ ঘটার আগে রাসেলকে চিনতে পেরেছে। অনেক রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়ো। আমারও কাল সকালে পরীক্ষা আছে। খুব ভোরে উঠতে হবে। গুড নাইট।
এর মাঝে বছরখানিক সময় পেরিয়ে গেল।আমার পরীক্ষা ভালোই হলো। পাশাপাশি আমি এখন থেকে বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছি। গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট হওয়ার সাথে সাথে বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিবো। আব্বু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়াতে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। অফিস করতে পারবে কিনা।যাক আল্লাহর রহমতে সুস্থ হয়ে অফিসটা চালিয়ে গেল। আজ আব্বুর অবসরে যাওয়ার দিন। সকালে মনটা একটু বিমর্ষ দেখেছি। এটাই স্বাভাবিক। এতোদিনের কর্মস্থল কলিগরা সবার জন্যই তো মায়া পড়ে যায়। জানি আব্বু নানারকম চিন্তাভাবনা করছে। বাসা ভাড়া দিয়ে সংসারের যাবতীয় খরচ কিভাবে চলবে। এখন তো এলপিআর। টাকাও কমে আসবে। এককালীন টাকাগুলো পেতে এখনও সময় লাগবে। যাক আল্লাহ ভরসা।
মেঘে মেঘে বেলা বয়ে যায়। মেহেদীটা আধো আধো বোলে কথা শিখেছে। মাম্মা বলে যখন আমায় ডাকে প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। তিনবছরে পড়লো। না, সেদিনের পর থেকে আমায় আব্বু আম্মু আর বিয়ের কথা বলেনি। থার্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষার কারণে মাসখানিক আমার ভালোই ধকল গেল। মেহেদীকে একদম সময় দেওয়া হয় না। আগামীকাল শুক্রবার। মেহেদী আর শোভনকে নিয়ে
বাইরে খেতে যাবো। শোভনও পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। ও এবার এসএসসি দিলো।
ওদিকে অনেকদিন আমার শ্বশুরকে ফোন দেওয়া হয় না। ফোনটা বেজে উঠলো। টেলিপ্যাথি ব্যাপার। শ্বশুর ফোন দিয়েছেন।
——কেমন আছো রুহী মা? অনেকদিন তোমার কোনো খোঁজ খবর নাই। দাদুভাই কেমন আছে?
——পরীক্ষা নিয়ে একটু ব্যস্ত ছিলাম। তাই আপনার খোঁজ নিতে পারিনি। বাবা মেহেদীর দাদী এখন কেমন আছেন?
——খুব বেশী ভালো না। শরীরের একটা পাশ অবস হয়ে আছে। নিয়মিত ফিজিওথেরাপী করাতে হয়। সাবা ওর মায়ের দেখভাল করে।
——সাবা আপু উনার যত্ন ঠিকমতো করতে পারে?
—–পারতো না। এখন শিখে গিয়েছে। পরিস্থিতি মানুষকে সব কিছু শিখিয়ে দেয়। আসলে সোহেলের ঘটনাটা ঘটার ফলে এবাড়ির মানুষগুলো পরিবর্তন হয়েছে। সাবা ওর মায়ের দেখভালের পাশাপাশি একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে জয়েন করেছে। জীবনের সব দিন কারো সমান যায় না। অবশেষে এটা ওরা বুঝতে পারছে। তুমি তো জানো সোহেলের নামে খুনের মামলা হয়েছে। কেসের সময় তিনবছর চলছে। শীঘ্রই হয়তো মামলার রায় বেড়োবে। হয়ত ফাঁসি হবে।
শ্বশুরের গলাটা কান্নায় বুজে আসলো। আমিও সান্তনার জন্য বললাম,
——-বাবা আপনার ভেঙ্গে পড়া ঠিক হবে না। নিজেকে শক্ত রাখুন। দেখবেন সময়ের সাথে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
——কিছুই ঠিক হবে না। রেপিস্টের বাবা হওয়ার দাগ কোনদিন শরীর থেকে মুছে যাবে না। আসলে মুখে যতই বলি ওর মতো সন্তান চাই না। ওর ফাঁসি হয়ে যাক। কিন্তু যখনি ভাবি ওর ফাঁসি হবে বুকের ভিতরে ব্যথা হয়। কষ্টে বুকটা ফেটে যায়। আমার ছেলেটা যে অধঃপতনে গেল এর দায় কিছুটাতো আমার উপর বর্তায়। মানসিকভাবে আমরা সবাই বিপর্যস্ত। সোহেলের নামে মামলা হওয়াতে সাবার নিজের পছন্দ করা বিয়ে ভেঙ্গে যায়। যাবার ই কথা। একজন রেপিস্ট এর বোনের সাথে কোন ছেলে সম্পর্কে জড়াতে চায় বলো? একদিন ওরা তোমাকে এ বাড়ির বউ হিসেবে মুল্যায়ন করতে চায়নি। অথচ ভাগ্যের চাকা ঘুরে আজ ওরাও মানুষের কাছে মুল্যহীন হয়ে পড়েছে। এটাই হচ্ছে আল্লাহপাকের তরফ থেকে ওদের প্রাপ্ত শাস্তি।
—–মাসাবা কেমন আছে? দেখেন বাবা পারিবারিক এতো সমস্যার মাঝে ও ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। একদিকে যেমন সোহেলের অধঃপতনের কষ্টে আপনি তুষের আগুনের মতো পুড়ছেন তেমনি অন্যদিকে মাসাবার প্রাপ্তি আপনার পোড়াক্ষতে শীতল পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। আল্লাহপাক উনার বান্দাদের ভালবাসেন। তাই বান্দার দুঃখে উনি কোনো না কোনো আনন্দের প্রাপ্তি দান করেন।
——তা ঠিক বলেছো। আসলে মানসিকভাবে আমরা কেউ ভালো নই। সেদিন মাসাবা মেডিকেল কলেজ থেকে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছে। ওর ক্লাসের মেয়ে ওকে রেপিস্টের বোন বলেছে। পরে নিজেকে সামলে নিয়েছে। মেয়েটা আমার এমনিতেই ঠান্ডা প্রকৃতির। এখন আরোও বেশি চুপচাপ হয়েছে। কোনো বন্ধুবান্ধব নেই। কলেজে থেকে ফিরে পড়াশোনায় ডুবে যায়। যাক ওসব কথা থাক। আমার দাদুভাইয়ের কথা বলো।
——ভালোই আছে। আধো আধো বোলে কথা বলতে শিখেছে।
——একই শহরে থাকি। অথচ আজ দুবছরের অধিক সময় হলো দাদুভাইয়ের সাথে দেখা হয় না।সোহেলের ঘটনার পরে আমার কারো সামনে যেতে ইচ্ছা হয় না। তোমাদের বাড়ি গিয়ে তোমার বাবা মায়ের সামনে কোন মুখে দাঁড়াবো? যাই হোক আল্লাহ কপালে রাখলে একদিন আমার দাদুভাইয়ের সাথে দেখা হবে। রুহী মেহেদীর দাদী ইদানিং ওর কথা জিজ্ঞাসা করে। ওকে একটু দেখতে চায়। সেদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করলো,মেহেদী দেখতে কার মতো হয়েছে? তুমি কি একদিন মেহেদীকে নিয়ে আসতে পারবে? ওর দাদী হাঁটাচলা করতে পারলে তোমাকে বলতাম না। আমি আর সে তোমাদের বাসায় গিয়ে মেহেদীকে দেখে আসতাম।
——না,বাবা আমার সমস্যা নেই। দেখি সময় পেলে মেহেদীকে নিয়ে একদিন ও বাড়িতে যাবো।
—–মাঝে মাঝে ফোন করে তোমার এই বাবার একটু খোঁজ নিও। আমার বাসায় আমরা সবাই এখন নিজ ঘরে পরবাসী। শুধু তোমার সাথে কথা হলে আমার মনটা শীতল হয়। আল্লাহ তোমাকে অনেক বড় করুক। আর আমার নাতীটাকে দশজনের একজন করে গড়ে তোলো। পরমকরুনাময় আল্লাহ পাক তোমাকে সেই তওফিক দান করুন। ফোন রাখলাম।
শ্বশুরের সাথে কথা বলে ফোনটা রাখার সাথে সাথে আমার আম্মু এসে একটু রেগে আমায় বললো,
—— রাসেলের বাপের সাথে সম্পর্ক রাখতে তোকে না নিষেধ করছি। তারপরও তুই আবার ঐ ব্যাটার সাথে কথা বলিস।
——আম্মু উনার তো কোনো দোষ নাই। আর উনি আমাকে এ পর্যন্ত সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। আমার জীবনের চরম দুঃসময়ে উনি আমাকে ছেড়ে যাননি। অকাতরে বাবার স্নেহ ভালবাসা দিয়ে গেছে। আমি পারবো না অকৃতজ্ঞ হতে।
—–শোন রুহী উনি যেটা করেছে সেটা উনার দায়িত্ব থেকে করেছে। এতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের কিছু নেই। উনার নাতীর জন্য নিয়মিত টাকা পাঠান। এটাইতো স্বাভাবিক। আর আমি যে জন্মের পর থেকে তোর ছেলেটার দেখভাল করে যাচ্ছি সেটা কিছু না তাই না?
——আমি কি তাই বলেছি নাকি? তোমাদের সহযোগিতা ছাড়া আমি কি এতদূর আসতে পারতাম। মা, থাক না ওসব কথা। শোন আব্বুর দিকে খেয়াল রাখতে হবে। রিটায়ার করার পর অনেকের শরীর খারাপ হয়ে যায়। এমনিতেই আব্বুর একটা মাইল্ড অ্যাটাক হয়ে গেছে।
—–রাসেলের ভাই তো খুনের মামলার আসামি। তাই তোকে বলেছিলাম উনাদের সাথে যোগাযোগ না রাখতে।
——আমার এমনিতেই কোনো সময় নাই। উদ্যেগ করে আজ অবধি উনার সাথে দেখা করতে কখনও যাওয়া হয় নাই। শুধু মেহেদী অসুস্থ হলে উনার চেম্বারে দেখাতে নিয়ে যেতাম। এটা নিয়ে তুমি এতো প্যারা নিও না।
কলিংবেলের শব্দে আম্মু দরজা খুলতে চলে গেল।যোহরের আযান হচ্ছে। মেহেদীকে গোসল করিয়ে দিতে হবে। আসলে আম্মু বুঝে না। এখনও আমার কাঁটাবিছানো পথে হাঁটা বাকি আছে। আমার ছেলেটাকে সঠিকভাবে মানুষ করতে গেলে ওর দাদার সহযোগিতা কিছুটা হলেও দরকার। যদিও আমি একা যে পারবো না তা নয়। কিন্তু আমার ছেলেটা যেন মানসিকভাবে একটু ভাল থাকে সেজন্য উনাকে আমার প্রয়োজন। যাক সময় এলে সবাই বুঝবে। ফোনে টুং করে মেসেজের শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখি হৃদ্যে মেসেজ পাঠিয়েছে।
চলবে