আকাঙ্খিতো প্রণয় পর্ব-১৫

0
653

#ধারাবাহিকগল্প
#আকাঙ্খিতো প্রণয়
পর্ব-পনেরো
মাহবুবা বিথী

ঘুমাতে গিয়ে কাগজ আর ছবিটা দেখে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। এটা অবশ্যই আব্বু আম্মুর কাজ। ওদের মাথা থেকে এখনও আমাকে বিয়ে দেওয়ার ভুতটা নামেনি। অথচ আমার জীবনে এতোবড় দুর্ঘটনা ঘটে গেল তাতেও ওদের শিক্ষা হলো না। কাল সকালে আব্বু আম্মুর সাথে আমার কঠিন বোঝাপড়া হবে। মাঝে মাঝে রাতে ঘুম আসতে চায় না।
আমি জানি আজও রাত আমার নির্ঘুম কাটবে। এমনিতেই আমার খুব ভয় লাগছে। সোহেল এখনও পুলিশের হাতে ধরা পড়েনি। ও আবার আমার কোনো ক্ষতি করবে নাতো? ঘুম না আসলে বিছানায় শুয়ে থাকতে আমার ভালো লাগে না। জানালার পাশে এসে দাঁড়ালাম। রাস্তার মিটিমিটি নিয়ন আলোয় রাতের পরিবেশটা মায়াময় হয়েছে। আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে মনে হলো আজ পূর্ণিমা। হয়তো মায়াবি জোৎস্নার কারণে পরিবেশটা এতো মায়াময় হয়েছে। মাঝে মাঝে মেঘ এসে চাঁদটাকে ঢেকে দিয়ে যায়। তখন চারিদিকটা ক্ষণিক অন্ধকারে ঢেকে রয়। আবার মেঘ সরে গিয়ে চারিদিক আলোকিত হয়ে উঠে।
মানুষের জীবনও আচমকা মেঘের মতো অন্ধকার ঘনীভূত হয়। আবার সময়ের স্রোতে মেঘ কেটে গিয়ে চারিদিক আলোয় ভরে উঠে। আমি জানি আমার জীবনের অন্ধকার একদিন কেটে যাবে। তখন আমার জীবনটাও আলোকিত হবে। আমি সেদিনের অপেক্ষায় আছি।
চোখের পাতাটা ভারী হয়ে আসছে। একটু মনে হয় ঘুমঘুম পাচ্ছে। বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। হয়ত কিছুক্ষণের মধ্যে আমি ঘুমের দেশে পাড়ি জমাবো।

আম্মুর ডাকে ঘুম থেক ধড়মড় করে উঠে পড়লাম।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সকাল নয়টা বাজে।
——এতো বেলা করে উঠলি। রুহী তোর শরীর ঠিক আছে তো?
——মেহেদী কোথায়?
——-তোর বাবার কাছে।
——ও কখন উঠেছে?
——ছ,টার দিকে উঠেছে। ওকে ডায়াপার চেঞ্জ করে দিয়েছি। তারপর হাতমুখ ধুয়ে দিয়ে নাস্তা
খাইয়ে দিয়েছি। এখন তোর বাবার সাথে খেলা করছে।
আম্মুর দিকে তাকিয়ে মনে হলো কি একটা বোঝাপড়া করা বাকি আছে। মনে করতে পারছিলাম না। তাই মনে করার জন্য মস্তিস্কের পাওয়ার বাটন অফ করে আবার চালু করলাম। ও মনে পড়ছে। সাথে সাথে মেজাজ চড়ে গেল। ছবিটা বালিশের নীচ থেকে বের করে আম্মুর হাতে দিয়ে একটু রাগী গলায় বললাম,
—–আমার বালিশের নীচে এই ছবিটা তুমি রেখেছো?
——তুই তো জানিস কিছুদিন পরেই তোর আব্বু অবসরে যাবেন। তাই ভাবছে ভালো ঘর বর দেখে তোর বিয়েটা দিয়ে দিতে।
——মা আমি তোমাদের কতবার বলবো এই মুহুর্তে আমার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়। আমি শুধু এখন আমার ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চাই।
——তুই তো ভালো করে বায়োডাটা দেখিসনি। ছেলের গার্মেন্টেস এর ব্যবসা আছে। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। এমনকি ওরা মেহেদীরও দায়িত্ব নিবে। মেহেদীর খরচটা হয়ত ওর দাদাবাড়ি থেকে দেয় কিন্তু তোর নিজের খরচটা তো টিউশনি করে তোকেই চালাতে হয়। তোর তো অনেক কষ্ট হয়।
——আম্মু আমি বায়োডাটা দেখার প্রয়োজন বোধ করিনি। আর এই যে তুমি বললেনা আমি নিজের খরচ টিউশনি করে চালিয়ে নেই এতে আমার কষ্ট হয় এটা তুমি ভুল বললে। বরং এর মাঝে আমি মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার আনন্দ অনুভব করি। যা তুমি বুঝবে না। আর একটা কথা শুনে রাখো আজকাল কেউ যদি খুব ভালো মানুষি দেখায় তাতেও সন্দেহ হয়। ভিতরে কোন গলদ আছে কে জানে। আমার সন্তানের দায়িত্ব এই পৃথিবীর কাউকে নিতে হবে না। আল্লাহপাকের রহমতে ওকে যখন আমি পৃথিবীর আলো দেখাতে পেরেছি তখন ইনশাআল্লাহ মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তুলতে পারবো।
আমাদের মা মেয়ের চিৎকার চেঁচামেচিতে বাবা আমার রুমে এসে বললো,
——শোন রুহী, মাথাটা ঠান্ডা করে আমার কথা শোন। ছেলের মামা আমার কলিগ। উনি তোর বিষয়টা জানে। উনার ভাগনারও বিয়ের তিনমাসের মধ্যে ডিভোর্স হয়েছে। মেয়েটার অন্য জায়গায় সম্পর্ক ছিলো। বিয়ের তিনমাসের মধ্যে প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে যায়।
——বাবা আমাকে এতো কথা কেন বলছো? আমি তো তোমার কাছে শুনতে চাইছি না। এই বিষয়ে কথা বলা তোমরা এখন বন্ধ করো।
আব্বু কথা না বাড়িয়ে আমার রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। আমি ওয়াশরুমে গিয়ে দাত ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে নিলাম। তারপর তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে কিচেনে গিয়ে নিজের জন্য চা বানিয়ে দুটো টোস্ট বিস্কুট হাতে নিয়ে আমার রুমে আসলাম। চা,টা শেষ করতে পারিনি এমন সময় শোভন এসে বললো,
—— আব্বুর শরীরটা ভালো লাগছে না। মনে হয় প্রেসারটা বেড়েছে। তুমি একটু মেপে দেখবে প্রেসার কত?
আমি দৌড়ে আব্বুর রুমে গিয়ে দেখলাম কপালের দুপাশের শিরাটা বেশ ফুলে আছে। প্রেসার মেপে দেখলাম অনেক বেশী। আম্মুকে বললাম,
——তুমি আব্বুকে রেডী হতে বলো।আমি সিএনজি ডাকতে গেলাম।
রুমে এসে ড্রেস চেঞ্জ করে আব্বুকে হার্ট ফাউন্ডেশনে নিয়ে গেলাম। আম্মু আমার সাথে ছিলো। শোভন আর মেহেদী বাসায় রইলো। ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বললো আব্বুর একটা মাইল্ড অ্যাটাক হয়ে গেছে। কয়েকদিন হাসপাতালে থাকতে হলো। আমি আব্বুর সাথে থাকলাম। আম্মুকে বাসায় পাঠিয়ে দিলাম। মেহেদী আম্মুর কাছে ভালোই থাকে। আব্বু কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর বাড়ি ফিরলাম। রিলিজের সময় ডাক্তার বলেছে আব্বু যেন কখনও উত্তেজিত না হয়। কারণ এরপরে যদি অ্যাটাক হয় তা খুব সিভিয়ার আকার ধারণ করবে।
যাইহোক আব্বুুকে বাসায় আনার পর খেয়াল করলাম আম্মু খুব প্রয়োজন ছাড়া আমার সাথে খুব একটা কথা বলে না। আমি এমনিতেই দুটো টিউশনি করতাম। এখন আর একটা টিউশনি বাড়িয়ে দিলাম। আব্বুর ওষুধের খরচ আমাকেই যোগাড় করতে হয়। আর আমি ছাড়া করবেই বা কে? প্লাবন কেবল ইন্টার সেকেন্ড ইয়ার। শোভন ক্লাস টেন এ পড়ে। আব্বু আর ক,টাকাই বা বেতন পায়। সংসারের যাবতীয় খরচ আব্বুর বেতনের টাকা দিয়ে সামলানো হয়।
মানুষ যখন তার আপন মানুষগুলো দ্বারা আহত হয় এবং ভুল বুঝাবুঝির শিকার হয় তখন প্রচন্ড কষ্ট হয়। আমি বুঝতে পারি আব্বু হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক করে অসুস্থ হলো এর পুরো দায় আম্মু আমার উপর চাপিয়ে দিলো। আমার চিন্তায় আব্বুর হার্ট অ্যাটাক করেছে। কিন্তু বাস্তবতা তো সম্পূর্ন ভিন্ন। কারণ হার্টে ব্লক থাকলে অ্যাটাক হয় অথবা আনুষঙ্গিক আরোও অনেক কারণ থাকে। যা পরীক্ষা নিরীক্ষা করলে জানা যায়। আব্বু একটু স্টেবল হলে ডাক্তার বলেছে এনজিওগ্রাম করাতে।
আমার উপর আম্মু যে দায় চাপালো সেটা যে ঠিক নয় তা এখন বুঝালেও বুঝবে না। তাই সময়ের উপরেই ছেড়ে দিলাম।

সব ভুলে পরীক্ষা পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। জীবনটা আমার রেলগাড়ির মতো ছুটে চলছে। সেকেন্ড ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। রাত জেগে পড়াশোনা করছি। হঠাৎ রাত বারোটায় আমার মোবাইলে একটা মেসেজ আসলো। তাকিয়ে দেখি লিজা পাঠিয়েছে।
——ম্যাম আপনি যদি ফিরি থাকেন তাহলে একটু কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
আমার নানান ব্যস্ততায় লিজার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। ও কি বিষয়ে কথা বলতে চায় এটা নিয়ে টেনশন হচ্ছিলো। তারপরও মেসেজ পাঠিয়ে বললাম,
—–ওকে, তুমি কল দিতে পারো।
ফোনটা মাঝরাতে আর্তনাদ করে বেজে উঠলো।
——হ্যালো ম্যাম কেমন আছেন?
——ভালো। তুমি এতো রাতে ফোন দিতে চাইলে কেন? বিশেষ কোনো দরকার আছে কি? তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে। নতুন টিউটর তোমায় কেমন পড়াচ্ছে?
—–নতুন টিউটর ভালোই পড়ায় তবে আপনার মতো নয়। আমি আমাকে মাঝরাতে ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব করার জন্য সরি ম্যাম। আসলে একটা বিশেষ প্রয়োজনে আপনাকে ফোন দিয়েছি।
—–বলো কি সেই বিশেষ প্রয়োজন।
—–আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই।
——এতো ভণিতা করছো কেন?যা বলতে চাও বলে ফেলো।
——রাসেল আঙ্কেল নাকি আপনার এক্স হাসব্যান্ড।
——হুম। সেটাতো অনেক আগেই চুকে গেছে। আজ হঠাৎ এটা জানার জন্য তুমি মাঝরাতে আমাকে ফোন দিয়েছো?
——উনি আমার আম্মুর সাথে চিট করেছে। উনি বলেছেন, যে উনি নাকি বিয়েই করেননি। আম্মুর সাথে উনার ভালো বোঝাপড়া হয়েছিলো। বিয়ের কথাটা উনি চেপে না গেলেই পারতেন। আম্মু উনাকে বিয়ে করতে রাজি ছিলো। কিন্তু এটা জানার পর আম্মু উনার সাথে সম্পর্ক রাখেননি। আম্মুর কথা হচ্ছে যে মানুষ নিজের জীবনের এতো বড় সত্যকে আড়াল করে অবলীলায় মিথ্যা বলতে পারে তাকে বিশ্বাস করা উচিত নয়।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে