#ধারাবাহিকগল্প
#আকাঙ্খিতো প্রণয়
পর্ব-বারো
মাহবুবা বিথী
লিজাদের বাসা থেকে বের হয়ে একটা সিএনজি নিয়ে মিরপুরের দিকে ছুটে চললাম। আর বার বার সিএনজির পেছনের জানালা দিয়ে দেখতে লাগলাম রাসেল আমাকে ফলো করছে কিনা। নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো। এতো ট্রমার মধ্যে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন আমার ছেলে মেহেদী। ওকে ছাড়া আমি তো বাঁচতে পারবো না। এখন রাসেল যদি ওকে কেড়ে নিতে চায় তাহলে আমি কাকে নিয়ে বাঁচবো? রাসেল যেহেতু মেহেদীর বাবা। তার উপর রাসেলের আছে অঢেল টাকা। মামলা করে ছেলেকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিতেই পারে। তখন আমার শ্বশুরের কি করার থাকতে পারে?
এসব নানা এলেবেলে চিন্তায় কখন যে মিরপুর পাইকপাড়ায় পৌছে গিয়েছি টের পাইনি। সিএনজির ড্রাইভারের কথায় সম্বিত ফিরে পেলাম।
——আফা আপনার বাসার গলি কোনদিকে?
——-আর একটু সামনে এগিয়ে ঐ মোড়ের চা এর দোকানটার পাশে থামান।
ভাড়া মিটিয়ে বাসায় পৌঁছে ডোরবেলটা চাপ দিতেই আম্মু দরজা খুলে দিলো। আমি রুমে গিয়ে মেহেদীকে বুকে জড়িয়ে নিলাম। আম্মু আমার হতবিহ্বল আচরণ দেখে বললো,
—–ঘুমের ছেলেটাকে কোলে তুলছিস কেন?
আম্মুর কথার জবাব না দিয়ে আমি মেহেদীকে বুকে নিয়ে পাগলের মতো আদর করতে লাগলাম। আমার অবস্থা দেখে আম্মু মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
—-তুই কি কোনো কারণে ভয় পেয়েছিস?
—–আম্মু রাসেল আমার কাছ থেকে মেহেদীকে কেড়ে নেবে নাতো?
—–আমি যতটুকু জানি সাত বছর বয়স পর্যন্ত মেহেদী তোর কাছে থাকবে। এর পর বাবা দাবি করলে আইনি লড়াইয়ে ফয়সালা হবে। এক্ষেত্রে কোর্ট ঠিক করে দিবে সন্তান কার কাছে থাকবে। ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তুই বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আয়। আমি টেবিলে ভাত বেড়ে দিচ্ছি।
এ কথা বলে আম্মু রুম থেকে চলে যায়। আম্মুর যদিও সব কিছু বুঝিয়ে বলেছে তারপরও আমার মনের ভিতর থেকে ভয় দূর হচ্ছে না। আমি টেনশন না নিতে পেরে আমার শ্বশুরকে ফোন দিলাম।
——বাবা কেমন আছেন?
——আমি ভালো আছি। কিন্তু তুমি হঠাৎ ফোন দিলে কেন? মেহেদী ভালো আছে?
——হ্যা বাবা আমরা ভালো আছি। বাবা আমার খুব ভয় হচ্ছে।
——কেন?কিসের ভয়?
——বাবা, মেহেদীকে রাসেল কোনোদিন আমার কাছ থেকে কেড়ে নিবে নাতো?যদি কোনোদিন ও সন্তানের দাবী করে সেদিন আপনি আমার পাশে থাকবেন তো?
আমি এ কথা বলে ফোনের মধ্যেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম।
——শান্ত হও রুহী মা। আমি তো তোমাকে বলেছি বাবা বলে যেহেতু আমায় ডেকেছো সারাজীবন আমার পিতৃস্নেহের হাত তোমার মাথার উপর থাকবে। রুহী শক্ত হও। তোমাকে অনেকটা পথ একলা হাঁটতে হবে। চেম্বারে রোগী বসে আছে। পরে কথা বলবো। এখন রাখছি।
ফোন রেখে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দিলাম। ফ্রেস হয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে নিলাম। তারপর ভাত খেয়ে বিছানায় শুয়ে একটু গড়িয়ে নিলাম। মাগরিবের আযান শেষ হয়েছে। ওজু করে নামাজ পড়ে আবারো বিছানায় শুয়ে পড়লাম। আর মনে মনে ভাবলাম লিজার টিউশনিটা ছেড়ে দেই। আমি রাসেলের মুখোমুখি হতে চাই না। পুরোনো ক্ষতকে খুঁচিয়ে আর রক্তাক্ত করতে চাই না। ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখি লিজার আম্মু ফোন দিয়েছে।
——কি ব্যাপার রুহী ডিনার না করে এভাবে তড়িঘড়ি করে চলে গেলে?আমাকে ও বলে গেলে না। সবকিছু ঠিক আছে তো। তোমার কি শরীর খারাপ করেছিলো? এভাবে আমাকে না জানিয়ে চলে গেলে।
——ভাবী ফোন দিয়েছেন ভালোই হলো। আপনি না দিলে আমিই দিতাম। আমি আর লিজাকে পড়াতে পারবো না। আমার সামনে পরীক্ষা। নিজেরও পড়াশোনা আছে। তাই লিজাকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারবো না।
——এটা তুমি কি বললে রুহী? আর একমাস পরে লিজার পরীক্ষা। এখন আমি টিচার কোথায় পাবো? তোমার কাছে আমি এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ আশা করিনি।
——ভাবি যতদিন আপনি ওর জন্য টিউটর না পান আমি অনলাইনে ওকে হয়ত কিছুটা হেল্প করতে পারবো। তবে খুব তাড়াতাড়ি টিউটর নিয়োগ দিলে আমার জন্য ভালো হয়।
——আমি তোমাকে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি?
——বলুন।
——তুমি কি রাসেলকে আগে থেকেই চিনতে?
——আমি রাসেল নামে কাউকে চিনি না।
——কিন্তু রাসেলতো তোমাকে চিনে। তোমার সাথে ওর কি সম্পর্ক?
—-ভাবি আপনি তো বললেন রাসেল আমাকে চিনে। তাহলে উনার কাছেই জেনে নিতেন আমার সাথে উনার কি সম্পর্ক? আমি রাখছি।
যদিও লিজার টিউশনিটা ছাড়ার পর আমার অনেক প্রবলেম হয়। কারণ আমি বেশ ভালো টাকা পেতাম। আর ভাবিও আমার উপর অনেক নির্ভর করতো। কিন্তু জীবনের নিজস্ব গতিতে কারো জন্য কোনো কিছু আটকে থাকে না। আমি আবারও নতুন টিউশনি যোগাড় করে নিলাম।
আমি আমার জীবনটাকে ভার্সিটি টিউশনি আর বাসা এই গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেছি। এই গন্ডির মধ্যে আমি থাকার চেষ্টা করি।
এর মধ্যে প্লাবনের এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। শোভন ক্লাস নাইনে উঠেছে। মেহেদীর বয়স এক বছর পূর্ণ হতে চললো। দু,মাসের মধ্যেই আমার মেহেদী বছর পূর্ণ হবে। আমার বাবার চাকরি আর একবছর আছে। অথচ প্লাবনের নিজের পায়ে দাঁড়াতে এখনও কয়েকবছর সময় লাগবে। এই কয় বছর আমাকেই সামলে নিতে হবে। এসব নিয়ে ভাবলে আমি খুব অস্থিরতা বোধ করি। বিশেষ করে রাতে ঘুমানোর সময় এই চিন্তাগুলো আমার মাথায় জেঁকে বসে। আর মেহেদীর ভবিষ্যতের চিন্তায় মাঝে মাঝে নির্ঘুম রাত কেটে যায়। আজও আমার চোখে ঘুম নেই। দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত বারোটায় ঘড়ির কাঁটা ছুঁয়েছে। মোবাইলের ম্যাসেজের শব্দে আমার চিন্তায় ছেদ পড়লো। তাকিয়ে দেখি হৃদ্য ম্যাসেজ পাঠিয়েছে।
——কেমন আছো?
——ভালো।
—–আচ্ছা তুমি এমন কেন বলতো?তুমি কারো সাথে মেলামেশা করো না। আড্ডাও মারো না। ক্লাস শেষ হওয়ার সাথে সাথে তুমি বাসায় চলে যাও। আমার খুব ইচ্ছে হয় তোমার সাথে বন্ধুত্ব করতে। আমরা ঘুরবো সুন্দর সময় কাটাবো। শোনো বন্ধু হলে তো দোষ নাই। এর বেশি আমি তোমার কাছে আর কিছু চাই না।
——আমরা তো বন্ধুই। ক্লাসে যারা একসাথে পড়াশোনা করি আমরা সবাই তো বন্ধু তাই না? আচ্ছা ঠিক আছে তুমি এতো করে যখন চাইছো তখন একদিন তোমার সাথে লাঞ্চ করবো। অনেক রাত হয়েছে। গুড নাইট।
ওর সাথে কথা শেষ করে জানালা দিয়ে রাতের অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। তারাগুলো মিটমিট করে জ্বলছে। হয়ত ভোরের দিকে মনে হয় চোখটা লেগে এসেছিলো। সেদিন বেলা করে আমার ঘুম ভাঙ্গে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সকাল আটটা বাজে। ভার্সিটির বাস তো চলে গেছে। আমি মেহেদীকে দুধ খাইয়ে পরনের কাপড় চেঞ্জ করে আম্মুর কাছে দিয়ে নিজে রেডী হয়ে একটা সিএনজি নিয়ে ভার্সিটিতে রওয়ানা হলাম। সকাল সাড়ে নটায় ক্লাস শুরু হবে। এই ম্যাডাম দেরী হলে ক্লাসে ঢুকতে দেয় না। ঠিক নটা,চল্লিশে ভার্সিটিতে পৌঁছালাম। সিএনজি ভাড়া মিটিয়ে ক্লাস রুমের দিকে দৌড়াতে লাগলাম। এমন সময় কে যেন পিছন দিক দিয়ে রুহী বলে ডাকছে। তাকিয়ে দেখি আমার পিছনে হৃদ্য আসছে।
——রুহী এখন ক্লাসে গিয়ে লাভ নাই। ম্যাডাম ক্লাসে ঢুকতে দিবে না। বরং তার চেয়ে চলো আমরা আজ একটু চারুকলায় যাই। ওখানে একটা আর্টের এক্সিবিশন হচ্ছে।
আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি পৌনে দশটা বাজে। মনে মনে ভাবছি হৃদ্য ঠিক কথা বলেছে। তারপর আমি আর হৃদ্য হাঁটতে হাঁটতে চারুকলায় যাই। সেদিন হৃদ্যকে আমার অনেক কথা শেয়ার করি। কথা প্রসঙ্গে বলে ফেলি আমি ডিভোর্সি। হৃদ্য ওর ব্রেকআপ হয়ে যাওয়া সম্পর্কের কথা আমায় বলে। ওর মা বেঁচে নেই। সৎ মায়ের সংসারে বেড়ে উঠেছে। ওর শৈশব কৈশর অনাদর আর অবহেলায় কেটেছে। আমরা দুজন চারুকলায় ঘুরতে ঘুরতে এমন একজনের মুখোমুখি হলাম তাকে দেখে আমার বুকটা কেঁপে উঠলো।
চলবে