আকাঙ্খিতো প্রণয় পর্ব-১১

0
713

#ধারাবাহিকগল্প
#আকাঙ্খিতো প্রণয়
পর্ব-এগারো
মাহবুবা বিথী

গরীব ঘরের মেয়েদের মনে হয় খুব বেশী স্বপ্ন দেখতে নেই। স্বপ্ন দেখা হয়ত গরীবের অপরাধ। এই কারণে স্বপ্নগুলো বাঁধাগ্রস্ত হয়। এগুলো অবশ্য আমার একান্তই ব্যক্তিগত ধারণা। আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা তাই বলে। কারো ক্ষেত্রে হয়ত জীবন অনেক সহজ হয়। কিন্তু আমার জীবনের বাস্তবতা বড় কঠিন। আমার কিইবা এমন বয়স। এই বয়সে আমাকে জীবনের কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হলো। সন্তান মানুষ করার গুরুদায়িত্ব। অথচ আমি নিজেকেই এখন তৈরী করতে পারিনি।
আমার সমবয়সি ক্লাসের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করছে, ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার প্রেমও করছে। হাসি আর আনন্দে ওরা ওদের জীবনটা উপভোগ করছে।
আমার বয়সও ওদের সমান। অথচ আমি কঙ্কর বিছানো পথে হেঁটে হেঁটে আমার পায়ের তলা ক্ষয়ে যাচ্ছে। মেহেদীকে আম্মুর কাছে রেখে ভার্সিটির ক্লাস করে দুটো টিউশনি করি । আম্মুর বয়সটা বেড়ে যাওয়াতে মেহেদীকে সামলাতে কষ্ট হয়। তাই ফুলটাইম আম্মুকে সহযোগিতা করার জন্য একজন কাজের খালা রেখে দেই। এতে আম্মুর লাইফটা একটু ইজি হয়। এই খরচটা আমি বহন করি। ওদিকে প্লাবনের কোচিং এর টাকা মাঝে মাঝে আমাকেই দিতে হয়। আসলে এছাড়াতো উপায় নাই। আব্বু ছোটো চাকরি করে এতো খরচ বহন করতে কষ্ট হয়। অনেক ক্ষেত্রে পেরে উঠে না। আমার শ্বশুর মেহেদীর খরচ বাবদ যে টাকা আমাকে দেয় আমি যদি কিছু নাও করি তবুও ভার্সিটির খরচ থেকে শুরু করে আমার টুকটাক হাতখরচ ভালভাবেই হয়ে যায়। কিন্তু আব্বু আম্মুকে সাহায্য করার জন্য আমাকে টিউশনি করাতে হয়। এতে অবশ্য আমার কোনো সমস্যা নেই। বরং টিউশনি করার কারণে বিসিএসটা হয়ত দিতে একটু সহজ হবে। আমার বিসিএস দিয়ে টিচিং প্রফেশনে যাওয়ার ইচ্ছা।
সেদিন রাতে আমি অনেক রাত জেগে পড়ছিলাম। মেহেদী অবশ্য ঘুমিয়ে পড়েছে। দরজায় কে যেন নক করছে।
—–কে?
——আপু আমি।
—–প্লাবন কিছু বলবি?
—–আপু একটু দরকার ছিলো।
—–আয় ভিতরে আয়।
প্লাবন এসে আমার বিছানায় বসে বললো,
—–আপু মেহেদী রাত জাগে না।
——এতো ভণিতা না করে কি বলতে এসেছিস, বলে ফেল।
——আপু আমার কিছু টাকার দরকার ছিলো। আব্বু ফরমফিলাপের টাকা দিয়েছে কিন্তু কোচিং ফি গুলো বাকী আছে। আমরা যারা একসাথে পড়ি সবাই স্যারক টাকা দিয়েছে। শুধু আমার টাকাটা বাকী আছে। স্যার ক্লাসে এসে আমাকে মনে করিয়ে দেয়। ক্লাসে সবার সামনে আমার খুব লজ্জা লাগে। নিজেকে খুব ছোটো মনে হয়।
আমার প্লাবনের দিকে তাকিয়ে খুব খারাপ লাগলো। মাথা নিচু করে খুব অসহায় ভঙ্গিতে ও কথাগুলো বলছিলো। আমি চেয়ার থেকে উঠে ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম,
—–আমি তো তোকে আগেই বলেছি। টাকা লাগলে বলিস। আমি তো দেই। টাকা চাইতে তোর এতো লজ্জা পাওয়ার কি আছে?
——না চাইতে তোমার কাছে পাই। এরপর ও আপু তোমাকে কিভাবে বলি? মেহেদীর খরচ নিজের খরচ সব মিলিয়ে তোমার হিমসিম অবস্থা। সেখানে আমি আবার কোন মুখে তোমার কাছে বেশি টাকা চাই। স্যার কিছু মডেল টেস্ট নিবেন। তুমি যে টাকাগুলো এর আগে দিয়েছিলে সেটা দিয়ে মডেল টেস্টের রেজিস্টেশন করেছি। এইজন্য কোচিং এর টাকা বাকী থেকে গেছে।
আমি প্লাবনকে ওর প্রয়োজন মতো টাকা দিয়ে বললাম,
—–রাত দুটো বাজে। শুয়ে পড়। আমিও শুয়ে পড়বো। সকালে ক্লাস আছে। আবার টিউটিরিয়াল হবে।
প্লাবন চলে যাওয়ার পর মেহেদীর পাশে শুয়ে পড়লাম। মেহেদীকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। ওকে বুকে নিলে আমি এক ধরণের শক্তি পাই। আমার সব ক্লান্তি এক লহমায় দূর হয়ে যায়। কেন যেন মনে হয় ও হয়ত বলছে, মা আর কিছুদিন কষ্ট করো। আমি বড় হলে তোমার জীবনটা সুখে ভরিয়ে দিবো। চোখের কোল বেয়ে দু,ফোঁটা অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। মোবাইলের ম্যাসেজে টুং করে শব্দ হলো। হৃদ্য ম্যাসেজ পাঠিয়েছে।
“প্রিপারেশন কেমন হলো”?
“ভালোই হয়েছে”।
“তোমার কেমন হলো”?
“মোটামুটি। কাল ক্লাসের পর তোমাকে নিয়ে লাঞ্চ করতে চাইছি। তোমার সময় হবে”?
“না, আমার টিউশনি আছে। রাত হয়েছে। আর কথা না বাড়াই। সকালে ভার্সিটি যেতে হবে। গুড নাইট”।
আসলে আমার এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আমি কারো সাথেই খুব গভীর বন্ধুত্ব
করতে চাই না। পাছে আমার জীবন নিয়ে ওদের কৌতূহল হয়। তারপর কেন ডিভোর্স হলো, সংসার কেন করতে পারলাম না এসব নানা প্রশ্নের উত্তর আমার এখন আর দিতে ইচ্ছে হয় না।

সেদিন ভার্সিটির ক্লাস শেষ করে লিজাদের বাসায় পাঁচটার মধ্যে পৌঁছে যাই। ডোরবেল চাপ দিতেই ভাবী এসে দরজা খুলে দেয়। আমি এসময় ওয়ার্কিং ডে তে ভাবীকে বাসায় দেখে অবাক হয়ে বললাম,
——-ভাবী আজকে অফিসে যান নাই?
——–গিয়েছি। তবে তাড়াতাড়ি চলে এসেছি। আজ আমার একজন গেস্ট আসার কথা। তাই একটু রান্না করছি। আগামীকাল শুক্রবার। তোমারতো ক্লাস নেই। তোমার সমস্যা না থাকলে রাতে আমাদের সাথে ডিনার করতে পারো।

লিজার পড়ার টেবিলে বসে ওর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। লিজা এসে চেয়ারে বসে বললো,
——ম্যাম আজকে আমি বেশীক্ষণ পড়বো না। বাসায় আম্মুর কলিগ আসবে। আজ আম্মুর জন্মদিন। উইশ করার জন্য আঙ্কেল আসবেন। আঙ্কেল আমাকেও খুব আদর করেন। যখনি আসে আমার পছন্দের চকলেট নিয়ে আসে। মাঝে মাঝে আমি আঙ্কেল আর আম্মু বাইরে খেতে যাই।তখন অনেক মজা হয়। ঐ আঙ্কেলটা আম্মুর সাথে ভার্সিটিতে একসাথে পড়েছে। আম্মু আঙ্কেলকে খুব পছন্দ করে। আঙ্কেলও আম্মুকে পছন্দ করে।
লিজার উপর মেজাজটা একটু খারাপ হলো। ওর খুব গল্প করার অভ্যাস। সুযোগ পেলেই ওদের বাড়ির কথা আমায় বলবে। যেটা বলা যায় সেটাও বলে যে কথাগুলো বলা উচিত না সেগুলো ও বলে। আমি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ওকে বললাম,
—–লিজা আমি খুব টায়ার্ড। তোমাকে যে হোম ওয়ার্কগুলো দিয়েছিলাম সেগুলো করেছো?
—–ম্যাম এখনও কিছু বাকী আছে। শেষ করতে পারিনি।
——তোমার তো সামনে পরীক্ষা। এতো ফাঁকি দিলে তো রেজাল্ট ভালো হবে না। তখন তোমার আম্মু আমার উপর রেগে যাবে।
——আমি এখনি শেষ করে দিচ্ছি ম্যাম।
এমন সময় ডোরবেলটা বাজলো। লিজা উঠতে যাচ্ছিল। আমি ওকে বললাম,
——তুমি অংকটা শেষ করো। আমি দরজা খুলে দিচ্ছি।
দরজাটা খুলে আমি আগুন্তককে দেখে চমকে উঠলাম। এ আমি কাকে দেখছি। উনিও আমাকে দেখে চমকে উঠলেন। আমি তাড়াতাড়ি রুমে এসে লিজাকে বললাম,
——লিজা আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। তুমি অংকগুলো করে রেখো। আমি অন্য আর একদিন এসে দেখবো। আজ আমি উঠি।
ব্যাগটা নিয়ে আমি লিজাদের বাসা থেকে চলে যাওয়ার সময় ড্রইংরুমে আবার রাসেলের মুখোমুখি হলাম। রাসেল আস্তে করে বললো,
——রুহী কেমন আছো?আমার ছেলেটা
আমি ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই ঝড়ের গতিতে বের হয়ে গেলাম।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে