আকাঙ্খিতো প্রণয় পর্ব-১০

0
914

#ধারাবাহিকগল্প
#আকাঙ্খিতো প্রণয়
পর্ব-দশ
মাহবুবা বিথী

ডেলিভারীর জন্য আমি হাসপাতালে ভর্তি হই। অবশ্য সমস্ত ব্যবস্থা আমার শ্বশুর করেছিলেন। নিয়মিত বাবার বাড়িতে আমার খরচ দিয়েছেন। ডাক্তার দেখানো থেকে শুরু করে সমস্ত দায়িত্ব উনি খুব চমৎকার ভাবে পালন করেছেন। হাসপাতালে ভর্তির পর ডাক্তার ম্যাম বললেন আমার সিজার করতে হবে। অপারেশনের আগে রোগীর পরিচয়ের একটা ফর্ম ফিলাপ করতে হয়। সেখানে হাসব্যান্ডের নামের পাশে রাসেলের নাম উনি লিখে দিলেন। পরিশেষে আমাকে কাগজটা দেখালে আমি একটু আপত্তি জানিয়ে শ্বশুরকে বললাম,
——বাবা আপনার ছেলের সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে। যদিও স্বামীর পরিচয়ে আপনার ছেলের নাম লিখেছেন কিন্তু আমি যে ডিভোর্সী এ কথাটা উল্লেখ করতেন। আর আপনার ছেলে তো বলেছে আমি যেন সন্তানের পিতৃ পরিচয়ের দাবিতে কোনোদিন ও বাড়ির সামনে গিয়ে না দাঁড়াই।
——প্রথমত সন্তান গর্ভে থাকলে ভুমিষ্ট হওয়ার আগ পর্যন্ত ভিভোর্স কার্যকরী হয় না। বাচ্চা হয়ে যাবার পর ডিভোর্স কার্যকরী হয়। সে জন্য ওর নামটা লিখেছি। তোমাকে কি রাসেল ফোন দিয়ে বলেছিলো ও এই সন্তানের পিতৃপরিচয় দিবে না?
——না আপনার ছেলে আমাকে ফোন দেয়নি। মা ফোন দিয়ে বলেছে।
——আমিও এটাই ভেবেছি। এরকম কথা রাসেলের মায়ের পক্ষে বলা সম্ভব। কারণ দু,দিন আগে আমি রাসেলকে তোমার সন্তানের কথা বলেছি। ও প্রথম অবাক হয়ে যায়। ও জানতো না। যারফলে ওকে কেন এই খবরটা জানোনো হয়নি সে জন্য সে মন খারাপ করে। তোমার সন্তানকে দেখতে আসতে চেয়েছিলো। আমি ওকে বলেছি বাবা হয়ে তুমি সন্তানের দায় নেওনি সন্তানের মায়ের খোঁজ খবর রাখোনি সেই সন্তানকে চোখে একপলক দেখা কিংবা কোলে নেওয়ার কোনো অধিকার তোমার নেই।

আমার শ্বশুরের কথা শুনে সেদিন আমার দুচোখে কান্নার ঢেউ উথলে উঠেছিলো। উনি আমার কষ্ট অনুভব করতে পেরেছিলেন। আমার হয়ে উনি সেদিন কাজটা করেছিলেন বলে আবেগে আপ্লুত হয়ে আমার চোখের পাতা সেদিন ভিজে গিয়েছিলো। আসলে রাসেল এসে পড়লে আমি ওকে সন্তানের মুখ দেখতে দিতাম না। ওতো সেই অধিকার অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে। হাসপাতালে সেদিন আমার সাথে আমার বাবা মা ছিলেন। উনারা আমার শ্বশুরকে দেখে অবাক হয়ে যান। এই বাবার ঐ সন্তান। এ যেন মানা যায় না। অবশেষে আমার সিজার করে পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। নাতির মুখ দেখে আমার শ্বশুর আমাকে সোনার চেইন উপহার দেন। আর আমাকে বলেন,
—–রুহী মা তুমি আমার দাদুভাইকে মানুষের মতো মানুষ করে বড় করবে। টাকা পয়সার কোনো চিন্তা করবে না। আমি যতদিন বেঁচে আছি আমার দাদুভাইয়ের সব দায়িত্ব আমার। শুধু দেখতে মানুষের মতো হলে হবে না। ওকে সত্যিকারের মানুষ হিসাবে গড়ে তোলো।
পাঁচদিন পর আমি হাসপাতাল থেকে আমার বাবুকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসি। শোভন আর প্লাবন দেখে মনে হচ্ছে মামা হতে পেরে ওদের বুকটা গর্বে ভরে উঠেছে। শোভন এসে আমায় বললো,
——আপুনি বাবুকে একটু আমার কোলে দাও না। আমি ওকে ঠিক সামলে রাখতে পারবো।
প্লাবন ওর বায়না দেখে বললো,
——তুই এখন পর্যন্ত নিজেকেই ঠিকমতো সামলাতে পারিস না। বাবুকে কি করে সামলাবি?

আব্বু আমার বর্তমান অবস্থা নিয়ে অনেক মুষড়ে পড়েছেন। আব্বুর ধারণা ছিলো মানুষ চিনতে আব্বুর ভুল হয় না। কেরানীর পোস্টে সারাজীবন চাকরি করেছেন। লক্ষ হাজার মানুষের সাথে উঠাবসা করেছেন। অথচ নিজের মেয়ের জন্য যে পাত্র ঠিক করলেন তাকে চিনতে তিনি ভুল করলেন। এই বিষয়টা মেনে নিতে আব্বুর কষ্ট হচ্ছে। আব্বুর ভেঙ্গে পড়া চেহারা দেখে আমার খুব কষ্ট হলো। কি আর করা। ভাগ্যের লিখন খন্ডানো যায় না। যতই কষ্টের পাথর বুকের উপর ভারী হয়ে থাকুক এতে আমার কিছু যায় আসে না। বাবুকে কোলে নিয়ে বুকের সাথে জড়িয়ে নিলে সাথে সাথে আমার সব কষ্ট এক লহমায় দূর হয়ে যায়। স্বর্গীয় সুখে মনটা ভরে উঠে। বাবুকে দুধ খাওয়াচ্ছিলাম। এ যেন বিরাট ঝক্কি। পাঁচদিন বয়স অথচ বাবু ঠিকমতো এখন দুধ খাওয়া শিখেনি। নিপলটা ধরে বেশীক্ষণ টানতে পারে না। ওর দুধ খাওয়ানোর সময় আমাদের মা ছেলেকে যুদ্ধ করতে হয়। আমি এইজন্য দরজা লাগিয়ে বাবুকে দুধ খাওয়াই। দরজা কে যেন নক করছে।
—-কে?
—–রুহী মা একটু দরজাটা খোল।
—–কেন মা কি দরকার?
—–একটু কথা ছিলো।
আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। আম্মুর মুখটা খুব চিন্তিত দেখে আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
——তুমি কি আমায় কিছু বলবে?
——না,মানে তোর শ্বশুর কি যেন বলছিলো?
——কি বলছিলো?
——ঐ যে বললো ডিভোর্স নাকি কার্যকরী হয় নাই। তাহলে তো তুই রাসেলের সাথে আবার সংসার শুরু করতে পারিস।
——আচ্ছা আম্মু আমি ও বাড়ি থেকে জীবন্ত ফিরে আসাতে তোমার ভালো লাগছে না। আবার পাঠাতে চাইছো যেন আমি লাশ হয়ে ফিরে আসি। আর তুমি তখন গর্বভরে সবাইকে বলবে আমার মেয়ে সতীনারী। তাই লালশাড়ি পরে শ্বশুর বাড়িতে ঢুকলো আর বের হওয়ার সময় সাদা কাফন পরে বের হলো।
——কি সব অলুক্ষণে কথা বলছিস।
—–এ ছাড়া তো আমার আর কিছু বলার ভাষা নেই
আমি তোমাকে বললাম ও বাড়ি যাওয়া আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। তারপরও তুমি আকার ইঙ্গিতে আমাকে চাপ দিয়ে যাচ্ছো।
——এমনি কি বলছি?দু,দিন পরে বুঝবি লোকের মুখে কত কটু কথা তোমায় শুনতে হয়। তখন বুঝবি এ সমাজে বেঁচে থাকা কত কঠিন। মানুষ তো সামাজিক জীব। তাই সমাজকে বাদ দিয়ে চলা যায় না।
——-আম্মু আমার জীবনটা যখন শ্যাওলা জমা বদ্ধ ডোবা হয়েছিলো তখন এই সমাজ কি করেছিলো? মানুষের জীবনের দুঃখ দুর্দশা থেকে সমাজ কি বললো এই গুরুত্বটা মনে হয় তোমার কাছে খুব বেশি।

আম্মু আমার উপর বিরক্ত হয়ে এ রুম থেকে বের হয়ে গেল। আমার ও বাড়িতে নিগৃহিত হওয়ার কথা শুনেও আম্মু কি করে আশা করে আমি আবার ও বাড়ি ফিরে যাবো। আমি নির্বাক হয়ে আম্মুর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

জীবনের স্রোতে জীবন বয়ে চলে। আমারও জীবনের
স্রোত নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চললো। মাসখানিকের মধ্যে বাবুকে আম্মুর কাছে রেখে আমি ভার্সিটিতে ক্লাস শুরু করলাম। এর মাঝে একদিন ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে আমাদের দু,জন প্রতিবশী পরস্পর আলাপ করছিলো। সেই আলাপের প্রসঙ্গ ছিলাম আমি। আমি ওদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শুনতে পেলাম একজন আর একজনকে বলছে,
——বড় লোকের ছেলে পেয়ে জামাই বানানোর খুব লোভ হয়েছিলো ওদের। কেমন শিক্ষা হলো এবার। মেয়েটাকে বিয়ে করলো বটে তবে বউ হিসাবে নয়। ভোগ করার জন্য বিয়ে করেছিলো। তারপর মজা লুটে পেট বাঁধিয়ে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন মেয়ের সাথে আর একজনকে পেলে পুষে বড় করতে হচ্ছে। একেই বলে উচিত শিক্ষা। কথায় আছে না লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।
আম্মু হয়ত সমাজের এ সব বক্রোক্তির দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন। সেদিন আমি আন্টিদের মুখের উপর দু,কথা শুনিয়ে দিতে পারতাম। তবে একটা প্রবাদ আছে না, শত্রুকে উঁচু পিড়িতে বসতে দিতে হয়। আর যুদ্ধে জিততে হলে দু,পা পিছাতে হয়। আমিও আপাতত এসব কটুকথাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করলাম। ভার্সিটিতে ক্লাস করার পাশাপাশি টিউশনিও শুরু করলাম। আমার এক ফ্রেন্ডের ভাস্তিকে পড়ানো শুরু করলাম। মেয়েটার বাবা মারা গিয়েছে। আমার ছাত্রীর নাম লিজা। আমি আমার ছাত্রীর মাকে ভাবী বলেই ডাকি। ভাবী কর্পোরেট সেক্টরে জব করে।বাচ্চার পড়াশোনা দেখার সময় পায় না। আমিও নিরিবিলি ওকে পড়াই। লিজা ক্লাস সিক্সে পড়ে। আমি ওকে অংক করাই। যদিও ইতিহাসে পড়ি কিন্তু বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পাশ করাতে অংকটা বেশ ভালোই পারি। ভালোই চলছিলো। কিন্তু আমার জীবনতো সরলরেখায় চলে না। যার ফলে আমিও বিশেষ কারনে এখানেও বাঁধা গ্রস্ত হলাম।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে