আংটি – ষষ্ঠ পর্ব
তানিয়ার মোবাইলটা হাতে নিয়ে বাইরে আসলাম। গাড়িতে উঠতে ইচ্ছে করছে না। সামনেই স্টেশন, স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছতে অনেকক্ষণ হাঁটতে হবে। আমি হাঁটতে শুরু করলাম।
স্টেশনে এসে গাড়িতে বসার পর ফয়সালের অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকানোর দৃশ্যটা বার বার চোখের সামনে ভাসছে। বুঝতে পারলাম, ফয়সাল গোপনে গোপনে আমার খোঁজ রাখছে। আমি ইদানীং কয়েকবার থানায় গিয়েছি। এই খবরটা ফয়সাল জানার কথা নয়, জানলো কিভাবে ?
বাস চলতে শুরু করেছে। জানালার পাশে বসে বাইরে তাকালাম, বাস সামনে যতো দ্রুত এগোচ্ছে রাস্তার দু’পাশের বাড়িগুলো পেছনে পড়ছে। রাস্তার পাশে থাকা মানুষজন দ্রুত হেঁটে চলছে। সবার চোখে ব্যস্ততা, চলমান পৃথিবীতে থেমে থাকার মতো সময় কারো হাতেই নেই।
দ্রুত গতিতে ছুটে চলা বাসটা এসে থামলো। বাসে বেশিক্ষণ বাসে থাকলে মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়। আমি বাস থেকে নামলাম। একজন অপরিচিত বৃদ্ধ মহিলা কাছে এসে বললো,
– বাজান, দশটা টাকা দিবেন ?
আমি পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে বললাম,
– এই বয়সে এসে ও আপনাকে ভিক্ষা করতে হচ্ছে ?
– কি করবো বাজান বলো ? স্বামী মারা গেছে অনেকদিন হলো। একটা ছেলে আছে, ছেলেটার কোন খোঁজ নাই।
আমি মানিব্যাগ থেকে দশ টাকা বের বৃদ্ধ মহিলার হাতে দিলাম। ওনার মুখে মৃত্যুর কথা শুনে তানিয়ার কবরটার কথা মনে পড়লো। ফয়সালের বাড়ি থেকে ঘুরে আসলাম, অথচ কবরটা দেখে আসা হয়নি।মৃত্যু রহস্য বের করার টেনশন কবরটার কথা ভুলিয়ে দিয়েছে, কবরটা দেখতে অন্যদিন যেতে হবে।
ঘরে ঢুকে মায়ের রুমে গেলাম। মা রুমে নেই, হয়তো ছাদে গিয়েছে। তানিয়ার ফোনটা পকেট থেকে বের করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বারান্দায় টবে একটা অ্যালোভেরা গাছ লাগানো, গাছটায় অনেকদিন হলো পানি দেওয়া হয় না। গাছের পাতাগুলো লাল হয়ে যাচ্ছে, আর কয়েকদিন পানি বিহীন থাকলে মারা যেতে পারে।
কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে রুমে ঢুকে খাটে বসলাম। তানিয়ার মোবাইলটার ফোন লিস্টে একটা নাম্বার ও নেই, এটা জেনে ও বার বার মোবাইলটার ফোন লিস্টে ঢুকছি আর ভাবছি, ফয়সাল ফোন লিস্টের নাম্বার গুলো ডিলিট করে দিয়েছে কেন ?
তানিয়ার ফোনে ফয়সালের পরিচিত কারো নাম্বার থাকার কথা নয়, তাহলে ডিলিট করবে কেন ? ভাবতে গিয়ে মনে হলো, তানিয়া কি এমন কারো ফোন নাম্বার পেয়েছিল যে মানুষটার সাথে ফয়সালের ভালবাসাময় সম্পর্ক চলছিল ?
বিয়ের পর একটা ছেলে যদি কোন মেয়ের সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যায়, তা গোপন রাখতে চায়। গোপনীয় এই তথ্য জেনে গেলে ভয়ঙ্কর কিছু হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। ভাবতে গিয়ে আমার শরীরে কাঁপুনি দিয়ে উঠলো। যদি সত্যিই এই রকম কোন মেয়ের সাথে ফয়সালের সম্পর্ক থাকে, তাহলে মেয়েটাকে খুঁজে বের করতে পারলেই সবকিছু জেনে যাবো।
আনিকা ফোন দিয়েছে। ফোনটা রিসিভ করতে ইচ্ছে করছে না। তবু ও রিসিভ করলাম। আনিকা অভিমানী গলায় বললো,
– আচ্ছা তুই ভার্সিটিতে কবে আসবি শুনি। প্রতিদিন বের হওয়ার সময় মনে হয় তুই আজ আসবি, এসে দেখি তোর খোঁজ নেই, তুই কোথা ও নেই।
আমি বললাম,
– ভার্সিটিতে আসাটা কি খুব জরুরী ?
আনিকা অবাক করে দিয়ে বললো,
– তার চেয়ে ও জরুরী তোর সাথে দেখা করাটা। যদি বলি দেখা করার জন্য একটু সময় বের করতে, দেখা করবি আমার সাথে ?
কথাটা বলতে গিয়ে আনিকার গলা জড়িয়ে আসছে, আমি বললাম,
– ঠিক আছে, আমি এখনি আসছি। রেল স্টেশনে আসতে পারবি তো ?
– হুম, পারবো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই রেল স্টেশনে পৌঁছলাম। আনিকা স্টেশনে নেই, ফোন দিতে মোবাইলটা হাতে নিতেই আনিকাকে আসতে দেখা গেলো। সূর্য আনিকার ঠিক মাথা বরাবর, সূর্যের আলোতে আনিকার চোহারাটা আরো উজ্জ্বল রূপে ফুটে উঠেছে। আমি মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রইলাম।
আনিকা পাশে এসে বসলো। মাথা নিচু করে বললো,
– জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়টা পাড় করছি, সময়টা এতো কঠিন ভাবে কাটাতে হবে কল্পনা ও করিনি।
আনিকার মুখে এমন কথা শুনে বেশ অবাক হলাম। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললাম,
– আমাকে তো আগে কিছুই বলিস নাই, তোর হঠাৎ করে আবার কি হয়েছে ?
আনিকা করুণ গলায় বললো,
– জানিস আমার বাবা আমার সাথে এক সপ্তাহ ধরে কথা বলছে না, বাবার কাছে আমি রাজকন্যা ছিলাম। অথচ এই রাজকন্যার সাথেই বাবা অভিমান করে আছে।
– কি এমন অপরাধ করেছিস ? যে অপরাধের কারণে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে ?
– বাবার কাছে খুব দামী একটা মূল্যবান জিনিস চেয়েছি।
আমি রেল লাইনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। অনেক দূর থেকে স্টেশনে একটা ট্রেন ছুটে আসছে। ট্রনের গতি কমেছে, ট্রেনটা স্টেশনেই থেমে যাবে। মানুষের জীবনের মতো সমাপ্তির আগে সবকিছুর গতি কমে যায়।
আমি প্রসঙ্গ পাল্টে আনিকাকে বললাম,
– তানিয়াকে বিয়ে দেওয়ার সময় যখন তোর কাছে ফয়সালের চাকুরীটার কথা বলেছিলাম। শুনে তুই বলেছিলি ওই অফিসে তোর দূর সম্পর্কে পরিচিত একজন চাকুরী করে।
– হুম বলেছি, ছেলেটার নাম মামুন। আমার দূর সম্পর্কের খালাতো ভাই।
– ছেলেটার ফোন নাম্বারটা দিতে পারবি ?
– ওর নাম্বার দিয়ে তোর কি কাজ ?
আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম,
– ফয়সাল সম্পর্কে অনেক কিছুই আমার অজানা। তার চরিত্র সম্পর্কে জানাটা আমার খুব প্রয়োজন।
পরদিন সকালে ফয়সালের অফিসের সামনে আসলাম। অফিস থেকে একটু দূরেই চা দোকান, দোকানে বসলে অফিসের গেইটের সামনের সবকিছু দেখা যায়। আমি দোকানে গিয়ে বসলাম।
এখানে এসেছি মামুনের সাথে কথা বলতে। দোকানে বসা থেকেই মামুনকে আসতে দেখা গেলো, আমি এগিয়ে গিয়ে নিজের পরিচয় দিতেই মামুন দ্রুত গলায় বললো,
– আনিকা আমাকে ফোনে বলেছে আপনি বিকেলে দেখা করতে আসবেন। এখন তো হাতে সময় নেই, আপনি আরেকদিন আসিয়েন, তবে যেদিনই আসেন বিকেলে আসবেন।
আমি জোরালো গলায় বললাম,
– আরেকদিন নয়, আজকেই দেখা করবো। তুমি অফিস থেকে বের হওয়া পর্যন্ত পুরো সময়টা অপেক্ষা করবো।
– এতটা জরুরী ?
– হুম।
ঠিক আছে, আপনি আশেপাশে কোথাও অপেক্ষা করেন। আমি বের হয়ে ফোন দেবো, আপনার নাম্বারটা আনিকা আমাকে রাতেই দিয়ে রেখেছে।
মামুনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে দুপুর হলো। সে এখনো অফিস থেকে বের হয়নি। পেটে ক্ষুধা লেগেছে, বাইরের খাবার খাওয়া আমার খুবই অপছন্দ।
মামুন অফিস থেকে বের হতে হতে হয়তোবা বিকেল হয়ে যেতে পারে, ক্ষুধা নিয়ে এতটা সময় অপেক্ষা করা খুবই কঠিন। আমি চা দোকান থেকে দুই পিছ কেক, সাথে এক কাপ চা নিলাম। খেতে ভালোই লাগছে। বুঝলাম, ক্ষুধা নিয়ে খেলে যে কোন খাবারের স্বাদটা আসলেই বেড়ে যায়।
একটু পরেই মা ফোন দিয়ে বললো,
– রাকিব কোথায় আছিস ? দুপুরের খাওয়ার সময়টা পেরিয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আয়।
– মা আসতে আমার দেরি হয়ে যাবে।
মা রাগী গলায় বললো,
– কয়েকটা দিন ধরে ঠিক সময়ে ঘরে আসছিস না, খাওয়ার সময়ে ও তোরে পাওয়া যায় না। কয়েকদিন পরেই তোর ফ্লাইট, এখন এভাবে ঘুরাঘুরি করাটা কি উচিত হচ্ছে ?
– শুনো মা, কয়েকদিন পরেই ফ্লাইট বলেই এতটা ঘুরাঘুরি করতে হচ্ছে। যতোক্ষণ সমাধান বের করতে না পারবো না, নিজকে থামিয়ে রাখতে পারবো না।
মা শীতল গলায় বললো,
– বলছিস কি তুই ? কিসের সমাধান ?
আমি জবাব দিলাম না, ফোনটা রেখে চায়ে চুমুক দিলাম। এতক্ষণে চা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
মামুন অফিস থেকে বের হলো বিকেল পাঁচটায়। আমাকে এতোক্ষণ অপেক্ষা করতে দেখে বিস্ময় নিয়ে বললো,
– কি এমন জরুরী কথা ? যেটা বলার জন্য এতটা সময় ধরে অপেক্ষা করেছেন ?
আমি বসা থেকে উঠলাম। অনেকক্ষণ বসে থাকায় আর বসতে ইচ্ছে করছে না। মামুন আমার পাশাপাশি হাঁটছে। আমি বললাম,
– একজন মানুষ সম্পর্কে জানতে এসেছি। নাম বলবে অব্যশই চিনবে।
– জ্বী, নামটা বলুন।
– ফয়সাল নামের কাউকে চিনো ?
– অব্যশই চেনা। কি হয়েছে ফয়সালের ?
আমি নরম গলায় বললাম,
– ফয়সালের কিছুই হয়নি। যা হয়েছে আমার বোনটার হয়েছে। ফয়সালের সাথে বোনটার বিয়ে হওয়ার তিন দিনের মাথায় আত্মহত্যা করে মারা যায়।
মামুন বিস্ময় নিয়ে বললো,
– আপনার বোনের সাথে বিয়ে হয়েছে মানে ? ফয়সালের সাথে চাকুরি করা আমাদের অফিসের কেউ তো জানি না। ফয়সালের কলিগ তিশাকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করবে কেন ?
আমি সাথে সাথে হাঁটা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে গেলাম। হতভম্ব হয়ে মামুনের দিকে তাকিয়ে বললাম,
– বিয়ের কথা অফিসের কাউকে জানায়নি ? তিশা মেয়েটা আবার কে ?
মামুন বললো,
– তিশা আমাদের অফিসেই চাকুরি করে। তিশার সাথে মামুনের রয়েছে ভালবাসাময় গভীর সম্পর্ক। খুব শীঘ্রই দু’জন দু’জনকে বিয়ে করার কথা!
মনে হচ্ছে আমার পা দুইটা বরফের মতো জমাট বেধে যাচ্ছে। সামনে এগিয়ে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি সামনের দিকে পা বাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে ভাবছি, তানিয়া কি তাহলে সেদিন রাতে তিশা সম্পর্কেই জেনে গিয়েছিল ?
( চলবে …. )
লেখকঃ- #মতিউর_মিয়াজী