আংটি – পঞ্চম পর্ব
মস্তিষ্কে হাজারো প্রশ্ন নিয়ে মিজানুর রহমানের বাড়ি থেকে বের হলাম। বাইরে রোদ উঠতে শুরু করেছে। সকালের রোদটা শরীরে লাগছে, আরেকটু ভালো করে শরীরে রোদ মাখাতে একটু সামনেই পার্কে গিয়ে বসলাম।
পার্কের বেঞ্চে এবং চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কে যেন বাদামের খোসা ফেলে রেখেছে। একা একা কিংবা দু’জন মানুষ একসাথে ঘুরতে আসলে বেঞ্চে বসেই বাদাম খাওয়ার পর এই কাজটা করে যায়। বাদাম খাওয়ার পর খোসা চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলার মধ্যেই হয়তো আনন্দ খুঁজে নেয়। যদি বলা হয় খাওয়ার পর খোসাগুলো একসাথে করে ফিরিয়ে দিলেই খোসার বিনিময়ে আবার বাদাম দেওয়া হবে, তবু ও ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলবে। তাদের ভাবনা – ভুল কাজ করার মাঝে যে আনন্দ, তা থেকে বঞ্চিত হবো কেন ?
কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রকৃতির অদ্ভুত পরিবর্তন দেখে নিজে নিজেই বললাম, প্রকৃতি এতো দ্রুত পাল্টাতে পারে ? মাত্রই রোদ ছিল, রোদের তাপ আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করবে তা নয়, হঠাৎ করেই আকাশের উত্তর কোনায় কালো মেঘ জমতে শুরু করলো।
পার্কে থাকা মানুষজন ছুটাছুটি করে বেরিয়ে যাচ্ছে, হালকা বাতাস বইতে শুরু করলো। বেরিয়ে যাওয়া মানুষেরা বৃষ্টিতে ভিজতে চায় না, যে করেই হউক বৃষ্টি শুরু হওয়ার আগে নিরাপদে যেতে চায়।
আমি উঠলাম না। পার্কের বেঞ্চে বসে রইলাম, ইচ্ছে করে বৃষ্টিতে ভেজা আমার পছন্দ নয়। আনিকার বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগে। ভালো লাগার এই ইচ্ছেটা নিজে থেকেই অনেকবার আমাকে বলেছে, আমাদের দু’জনের মাঝে থাকা বন্ধুত্বের সম্পর্ক হয়ে ও আনিকা নিজে থেকেই বার নিজের ইচ্ছেগুলো বলতে থাকে কেন বুঝতে পারি না। মানুষ তার প্রিয়জনকে পছন্দ এবং অপছন্দ গুলো জানানোর চেষ্টা করে, আমি কি আনিকার প্রিয়জন ?
প্রথমে দু’একটা ফোটা পড়লো, কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। আমি বৃষ্টির মধ্যেই বেঞ্চে বসে রইলাম। পার্কে আমাকে ছাড়া কেউ নেই, আশ্চর্য জীবনে এই প্রথম বার বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগছে। হঠাৎ উত্তর দিক থেকে ছুটে আসা দমকা শীতল বাতাস শরীরে লাগলো, বৃষ্টির মাঝে ছুটে আসা এই বাতাসে শরীরে কাঁপুনি দিয়ে উঠলো। আমি তবু ও বেঞ্চ থেকে উঠলাম না, আজ যতো ক্ষণ বৃষ্টি হবে পুরোটা সময় ভিজবো।
দুপুরের একটু পরে বাড়িতে আসলাম, এসে ঘুমিয়ে গেলাম। দীর্ঘ ক্লান্তির ঘুম। ঘুম ভাঙ্গলো রাত দশটায়, ঘুম থেকে উঠে পুরো এক ঘণ্টা খাটে বসে রইলাম। পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা, তবু ও খেতে ইচ্ছে করছে না। বার বার ফয়সালের কথা মনে পরছে। ভাবছি, বোনটা আত্মহত্যা করেনি, এর পেছনে ফয়সাল নিজেই জড়িত আছে। এই সত্যিটা প্রমাণ করবো কিভাবে ? আদালত এমন এক জায়গা, “যেখানে মিথ্যার চেয়ে সত্যিটা প্রমাণ করাই বেশি কষ্টকর!”
হাতে এমন একটা প্রমাণ দরকার, যেটা পেলেই বেরিয়ে আসবে অজানা সব প্রশ্নের উত্তর। ভাবতে গিয়ে তানিয়ার মোবাইলটার কথা মনে পড়লো। তানিয়ার হাতের মোবাইটা দেখা দরকার। এই মোবাইলটাতে ও হয়তো লুকিয়ে থাকতে পারে গুরুত্বপূর্ণ কোন তথ্য, যে তথ্য আমার একদমই অজানা।
অনেকদিন পর আজ ভার্সিটিতে যাবো বলে একদম সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠলাম। ঘুম থেকে উঠেই রান্না ঘরে আসলাম। মা রান্না ঘরে নাস্তা তৈরি করছে। আমাকে দেখেই বললো,
– রাকিব তোর বড় মামা আমাকে ফোন দিয়েছিল। তোর জন্য একটা আনন্দের খবর।
– কি খবর শুনি তো।
মা আনন্দিত গলায় বললো,
– তোর ভিসা কনফার্ম হয়েছে। টিকেট কেটেছে আগামী শনি বারের, শনিবার ঠিক রাত দশটায় তোর ফ্লাইট।
দেশের বাইরে যাবো যাবো করে আগে অনেকবার চেষ্টা করেছি। ভিসা কনফার্ম হচ্ছিল না, হঠাৎ করে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাওয়ায় খবর শুনে ভীষণ মন খারাপ হলো। তানিয়ার মৃত্যুর আড়ালে যে অপরাধীরা লুকিয়ে আছে, তাদেরকে প্রমাণ সহ বের করতে না পারলে বিদেশে গিয়ে ও স্বস্তি পাবো না। তানিয়ার আংটিটা আমার নিজের আঙ্গুলে লাগিয়ে রেখেছি, এই আংটিটার রহস্য ততোক্ষণ আমাকে শান্তি দেবে না, যতক্ষণ তানিয়ার সাথে সেদিন রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা জানতে না পারবো।
আমি আমতা আমতা করে মাকে বললাম,
– শনিবার আসতে আর মাত্র সাতদিন বাকি, আমাকে জিজ্ঞাসা করেই তো টিকেট কাটতে পারতো। এতো তাড়াহুড়ো করার কি দরকার ছিল ?
মা আমার কথার জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। ভেবেছিল খবরটা শুনে আমি প্রচণ্ড খুশি হবো। উল্টো এমন প্রশ্ন করায় মায়ের মন খারাপ হলো। মায়ের এই বিষণ্ণতা মাখা মুখটা দ্বিতীয়বার দেখতে চাই না। মাকে বললাম,
– মা আমি ভীষণ খুশি, সাত দিনের মধ্যেই নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করবো।
রান্নাঘর থেকে ড্রয়িং রুমে আসলাম। আজকে ভার্সিটিতে যাবো না, সিদ্ধান্ত পাল্টালাম। আঙ্গুলে লাগানো আংটিটার দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, হাতে থাকা সাতদিন সময়ের মাঝেই তানিয়ার সাথে ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনাটা বের করবই।
সাথে সাথে আবার ছুটে গেলাম রান্না ঘরে। মায়ের খুব কাছে দাঁড়িয়ে বললাম,
– তানিয়ার হাতের মোবাইলটা কোথায় ?
– আসলেই তো! মোবাইলটা কোথায় ? মোবাইলটার কথা তো একবারই মনে পরেনি!
আমি দ্রুত গলায় বললাম,
– এসব তুমি কি বলছো মা ? মোবাইলটা তোমার কাছে নয় ? তানিয়াকে কবর দিতে যখন ফয়সালের বাড়িতে গিয়েছিলা, সাথে করে মোবাইলটা নিয়ে আসো নাই ?
মা নিচু গলায় বললো,
– নাতো, একবার ও মোবাইলটার কথা মনে ছিল না। ফয়সাল নিজে ও তো মনে করে দিয়ে দিলে পারতো। দিয়ে ও তো দেয়নি। হয়তোবা ফয়সালের ও খেয়াল ছিল না।
– ফয়সালের খেয়াল থাকবে না কেন ?
মা নরম গলায় বললো,
– মৃত্যু শোক মানুষের অনেক কিছুই ভুলিয়ে দেয়। তাই হয়তো খেয়াল নেই। তানিয়া তার স্ত্রী, বিয়ের তিন দিনের মাথায় স্ত্রীর এমন মৃত্যু মেনে নেওয়া খুব কষ্টের।
বললাম,
– তানিয়ার মৃত্যুর ঠিক একদিন আগে তোমাকে ফোন দিয়েছিল ?
– দিয়েছে তো, বিয়ের পর তানিয়া প্রতিদিন ফোন দিয়েছে।
রান্নাঘর থেকে দ্রুত পায়ে নিজের রুমে আসলাম। সেদিন সাথে ছোট মামা ছিল, ফয়সাল ছোট মামার কাছে তানিয়ার ফোনটা দিয়ে দেয়নি তো ?
ফোন দেওয়ার সাথে সাথে ছোট মামা ফোন রিসিভ করলেন। বললেন,
– শুনলাম তোর সব পেপার কনফার্ম হয়েছে। শুনে আমার অসম্ভব ভালো লাগলো। তোর মুখ থেকে খবরটা শোনার অপেক্ষায় ছিলাম। আমি আগেই জানতাম আমার কাছে তোর ফোন আসবে।
– মামা আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণে ফোন দিয়েছি, তানিয়ার হাতের ফোনটা আপনার কাছে আছে ?
– নাতো, আমার কাছে ফোন আসবে কিভাবে ? কেন, সেদিন ফয়সাল তাদের বাড়ি থেকে আসার সময় তানিয়ার ফোনটা দিয়ে দেই নি ?
প্রশ্নের জবাব দিতে ইচ্ছে করলো না। আমি ফোনটা রেখে দিলাম।
হাতে মাত্র সাত দিন সময়, এক মুহূর্ত ও সময়টা নষ্ট করা যাবে না। আমি নাস্তা শেষ করে শার্ট গায়ে দিয়ে সাথে সাথে বাড়ি থেকে বের হলাম।
ফয়সালের বাড়িতে ঢুকে শুনলাম ফয়সাল বাড়িতেই আছে। আজ তার অফিস বন্ধ। আমি ড্রয়িং রুমের সোফায় বসলাম। এই কয়েকদিনে ড্রয়িং রুমের সামান্য একটু পরিবর্তন এসেছে। ড্রয়িং রুমের টিভিটার ঠিক বাম পাশে তানিয়ার একটা ছবি টাঙানো ছিল। ছবিটায় তানিয়ার পাশে ফয়সাল দাঁড়িয়ে ছিল। বিয়ের দিন তোলা হয়েছিল ছবিটা। দেখলাম ছবিটা এখন টাঙানো নেই, ড্রয়িং রুমের চারপাশ ভালো করে তাকালাম, কোথাও নেই।
ফয়সালের মা নুডুলস নিয়ে এসেছে। টি টেবিলে নুডুলস রেখে বললেন,
– তোমাকে দেখে ভালো লাগলো, তানিয়ার মৃত্যুর পর এখন বেশিরভাগ সময়টা একা একা লাগে। মাত্র তিন দিনেই মেয়েটার সাথে ভালো বোঝাপড়া তৈরি হয়েছিল।
আমি আন্তরিক গলায় বললাম,
– নিশ্চয় বুঝতে পারছেন ভাই হয়ে বোনের এই মৃত্যুটা মেনে নিতে আমার কতোটা কষ্ট হচ্ছে। ফয়সালকে একটু আসতে বলবেন ? খুব জরুরী একটা কাজ ছিল।
– ফয়সাল তার রুমেই আছে, ইচ্ছে করলে রুমে যেতে পারো।
উঠে গিয়ে ফয়সালের রুমের সামনে দাঁড়ালাম। এই রুমের ভাঙ্গা দরজাটা পাল্টানো হয়েছে। ভেতরে ঢুকতেই আমাকে দেখে বললো,
– সেদিন আপনার সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে চেয়েছিলাম।
আমি আন্তরিক গলায় বললাম,
– ধৈর্য ধরে কথা শোনার মতো পরিস্থিতি সেদিন ছিল না। কি বলবে এখন বলো ?
– শুনলাম আপনি নাকি বেশ কয়েকবার থানায় গিয়েছেন। তানিয়ার আত্ম হত্যার রিপোর্ট বের হওয়ার পরে ও আপনার কাছে সবকিছু অবিশ্বাস্য মনে হয় কেন ?
আমি একবার নিজের আঙ্গুলের আংটিটার দিকে তাকালাম। তাড়পড় ফয়সালের দিকে তাকিয়ে বললাম,
– এখন এসেছি তানিয়ার ব্যবহার করা মোবাইলটা নিয়ে যেতে। তানিয়ার মোবাইলটা কোথায় ?
ফয়সাল কথা শুনে চমকে উঠলো। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে আমার দিকে একই সাথে বিস্ময় আর ভয় নিয়ে তাকালো। এই প্রথম বার ফয়সালের চোখে ভয়ের স্পষ্ট ছাপ ফুটে উঠেছে। ফয়সাল মোবাইলটা বের করার জন্য খাটের সাথে থাকা ড্রয়ারটা খুললো।
আমি ভাবলাম, মোবাইলটা তার এতো কাছে থেকে ও নিজে থেকে আগেই ফিরিয়ে দিতে চায়নি কেন ? তানিয়ার মৃত্যুর এতোদিন হয়েছে, একবার ও কি ফিরিয়ে দেওয়ার কথা মনে ছিল না ?
ফয়সাল ড্রয়ার থেকে তানিয়ার মোবাইলটা বের করলো। আমি মোবাইলটা হাতে নিলাম। মোবাইলটাতে এখনো দশ পার্সেণ্ট চার্জ রয়েছে। মোবাইলটার ফোন লিস্টে ঢুকে সাথে সাথেই পুরোপুরি শিউরে উঠলাম। আশ্চর্য, ফোন লিস্টে একটা নাম্বার ও নেই। সবগুলো নাম্বার ডিলিট করে দেওয়া হয়েছে!
( চলবে ….)
লেখকঃ- #মতিউর_মিয়াজী