আংটি পর্ব-০৪

0
2758

আংটি – চতুর্থ পর্ব

তানিয়ার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বানানো ডাক্তার মিজানুর রহমানের বাড়িতে আসলাম। রাস্তার সাথে বিশাল বাড়ি। বাড়ির চারপাশে পাথর দিয়ে ঢালাই করা উঁচু দেয়াল। দেয়াল উঁচু হওয়ায় বাড়িটা স্পষ্ট দেখার জন্য গেইটের সামনে থেকে একটু পেছনের দিকে গেলাম।

বাড়ির গেইটের সামনে একটা বিশাল নেইমপ্লেট লাগানো। লেখা- স্বপ্নচারিতা হাউজ। বাড়ির নামটা একটু ভিন্ন ধর্মী দেখে সামান্য চমকালাম। এই নামের বাড়ি এই শহরে আগে কখনো দেখিনি।

গেইটের ঠিক সামনে দু’জন দারোয়ান বসা। দু’জনের মধ্যে থেকে আমাকে দেখে একজন উঠে দাঁড়ালো। সহজ গলায় বললো,
– জরুরী কোন প্রয়োজন ছাড়া ডাক্তার স্যারের বাড়িতে প্রবেশ নিষেধ।

আমি গম্ভীর গলায় বললাম,
– নিষেধ বলেই তো তোমাদের দু’জনকে এখানে বসিয়েছে। এসেছি পোস্টমর্টেম সম্পর্কিত ঝামেলা নিয়ে।

দারোয়ান আগ্রহ নিয়ে বললো,
– তাহলে অবশ্যই যেতে পারেন। স্যারকে দু’তালায় পাবেন। যদি দেখেন দু’তালায় রুম তালা বদ্ধ তাহলে ছাঁদে পাবেন। স্যার এই সময়টা ছাঁদে কাটাতে পছন্দ করে।

– তোমার স্যার কি একা মানুষ ?

– একা নয়, পরিবারের সবাই বেড়াতে গেছে। ডাক্তারদের ব্যস্ততা খুব বেশি, চাইলে ও বেড়ানোর সময় বের করা কঠিন।

দরজায় টোকা দিতেই মিজানুর রহমান প্রায় সাথে সাথে দরজা খুললেন। তার হাতে একটি ছোট খরগোশের বাচ্চা, মনে হলো তিনি বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে দরজা খোলার জন্য দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিছু বলার আগেই আমাকে বললেন,
– একটু বারান্দায় গিয়েছি, গিয়ে দেখি তুমি বাড়ির ভেতরে আসছো। বিশেষ কোন প্রয়োজনে এসেছ ?

আমি সোফায় বসলাম। মাথার উপর পাখা ঘুরছে, তবু ও আমার গরম লাগছে। বললাম,
– তানিয়া নামের একটা লাশের পোস্টমর্টেম করেছিলেন মাত্র কয়েকদিন আগে, মনে আছে আপনার ?

কথা শুনে মিজানুর রহমান চুপচাপ ভাবতে লাগলেন। বুঝা যাচ্ছে তিনি কিছু একটা মনে করার চেষ্টা করছেন। মনে করতে পারলেন না। বললেন,
– আমাকে দু’এক দিন পর পরই নতুন নতুন লাশের পোস্টমর্টেম করাতে হয়। তুমি যেই নামটি বলেছ এই নামের কারো কথা ঠিক মনে করতে পারছি না।

আমি ডাক্তারের দিকে হতাশ চোখে তাকালাম। তাকিয়ে থেকে বললাম,
– তানিয়া নামের লাশটা মারা যায় আত্মহত্যা করে, বিয়ের তিন দিনের মাথায় ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করে মারা যাওয়া মেয়েটা ড্রাগ এডিক্টেট ছিল।

আমার কথা শুনে সাথে সাথে আমার দিকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকালেন। কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
– ওহ হ্যাঁ, চিনতে পেরেছি। আচ্ছা তুমি মেয়েটার কে হও ?

– মেয়েটার বড় ভাই, যে ভাই আত্মহত্যা করে মারা যাওয়া বোনের আংটি হাতে নিয়ে ছুটাছুটি করছে।

মিজানুর রহমান আমার দিকে বিভ্রান্তি কর দৃষ্টিতে তাকালেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন,
– ভাই হয়ে বোনের মৃত্যু মেনে নেওয়াটা খুবই কষ্টকর।

আমি বললাম,
– মেনে নেওয়াটা আমার জন্য বেশি কষ্টকর। কারণ তানিয়ার মৃত্যুটা আত্মহত্যা ছিল না, আপনি রিপোর্টে লিখেছেন ড্রাগ এডিক্টেট। সত্যি করে বলবেন, রিপোর্টে বোনটার নামে এই মিথ্যাটা কেন লিখেছেন ?

মিজানুর রহমান আমার কথা শুনে পুরোপুরি বিস্মিত হলেন। কঠিন গলায় বললেন,
– আবেগ নিয়ে আমরা অনেক কিছুই বলতে পারি, আমার ডাক্তারি জীবনে অনেকের মুখেই এমন সব কথা শুনেছি। একটা কাজ করো, দয়া করে এসব অভিযোগ থানায় কিংবা কোন আদালতে গিয়ে জানাও। এটা আমার নিজস্ব বাসা, নিশ্চয় বুঝতে পারছো কারো ব্যক্তিগত বাসায় এসে এসব আলোচনা করা ঠিক নয়।

আমি সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। কপাল থেকে ফোটা ফোটা ঘাম পড়ছে। পকেট থেকে হাত দিয়ে টিস্যু দিয়ে কপালের ঘাম মুছলাম। মিজানুর রহমান আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন,
– লাশ পোস্টমর্টেম করানোর আগে তুমি কি জানতে পোস্টমর্টেম করানো ব্যক্তিটা আমি হবো ? নিশ্চয় জানতে না, যদি নাই জেনে থাকো তাহলে আমি তোমার বোনের ক্ষেত্রে ভুল রিপোর্ট কেন লিখবো ? একটা লাশকে পোস্টমর্টেম করানোর সময় সম্পর্কটা থাকে শুধুমাত্র লাশের সাথেই। মারা যাওয়া মানুষটার স্বজনদের সাথে নয়!

আমি মিজানুর রহমানের দিকে অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে তাকালাম। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে পা বাড়ালাম। যাওয়ার সময় তিনি বললেন,
– একটা কাজ করলে পারো, লাশটা তুলে আরো একবার পোস্টমর্টেম করানোর ব্যবস্থা করো। তাহলে কমপক্ষে নিজের মনের অস্বস্তি টা দূর হবে। সাময়িক সময়ের জন্য মস্তিষ্কে যে আবেগ প্রবণতা এসেছে, তা পুরোপুরি কেটে যাবে।

আমি জবাব না দিয়ে বাসা থেকে বের হলাম। গেইটের কাছে আসতেই দারোয়ান দু’জন আমাকে দিকে তাকালো। ভেবেছিল তাদেরকে কিছু একটা বলবো। আমি না বলেই রাস্তা পেরিয়ে গাড়িতে উঠলাম।

টানা কয়েক দিনের চেষ্টার পর একদম হতাশ হলাম। কয়েকবার থানার ওসির সাথে কথা বলেছি, সাথে আইনজীবী ও নিয়ে গেলাম। তাতে ও লাশ তোলায় এগিয়ে যেতে পারলাম না। তানিয়ার লাশ কবর থেকে তোলার অনুমতি পেলাম না।

তানিয়ার স্বামী ফয়সাল রিপোর্ট দেখার পর আমাকে কয়েকবার ফোন দিয়েছে। আমি ইচ্ছে করেই ফোন রিসিভ করলাম না। গিয়ে সরাসরি ফয়সালের বাসায় উঠলাম।

ফয়সাল এখনো অফিস থেকে ফিরে নাই। বিকেল পাঁচটা বাজলো। এই সময়ে ফয়সাল অফিস শেষ করে বাসায় ফেরার কথা, আজ এখনো আসছে না কেন ?

কিছুক্ষণ পরেই ফয়সালকে দেখলাম। বাড়িতে ঢুকে আমাকে দেখে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো। হাত থেকে অফিসের ব্যাগটা রেখে বললো,
– আত্মবিশ্বাস ভালো, তবে অতিরিক্ত নয়। একটা কথা মনে রাখবেন, একমাত্র নিজেকে ছাড়া পৃথিবীর কাউকে বিশ্বাস করা খুব কঠিন।

আমি বললাম,
– ফয়সাল তুমি শান্ত হও, কি বলছো এসব ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।

– কেন ? ভুলে গেলেন! বলেছিলেন আপনার বোন তানিয়া সুস্থ মস্তিষ্কের, একটা ড্রাগ এডিক্টেট মেয়ে কিভাবে সুস্থ মস্তিষ্কের হয়। বিয়ে দেওয়ার আগে কমপক্ষে আমাকে এটা জানানো উচিত ছিল।

আমি কঠিন গলায় বললাম,
– তানিয়া ড্রাগ এডিক্টেট নয়, এই রিপোর্টটা ভুল ছিল। অনেক চেষ্টা করে ও লাশটা আবার তোলার অনুমতি আনতে পারলাম না। যদি পারতাম তাহলে আসল সত্যিটা বের হতো।

ফয়সাল চোখ বড় করে আমার দিকে তাকালো। কিছু একটা বলতে চাইলো। আমি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম, দাঁড়িয়ে হাত দিয়ে তাকে থামিয়ে বললাম,
– ভেবেছিলাম তোমার সাথে একটা আংটির পুরো ঘটনাটা শেয়ার করবো। সামান্য একটা রিপোর্ট পেয়ে তুমি তানিয়াকে নিয়ে যে নিচু মানসিকতার চিন্তা তৈরি করেছ। শুনে কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে না।

ফয়সাল চুপ করে রইলো। আমি মাথা নিচু করে তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলাম।

বোনটা মৃত্যুর পর বেঁচে থাকা মানুষের কাছে অপবাদ আর চরিত্রহীন হিসেবে হৃদয়ে জায়গা করেছে। এটা ভাবতেই হৃদয়টা যন্ত্রণায় অস্থির করে তুললো।

আজ অনেকদিন পর আবারো মায়ের পাশে বসে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেললাম। মা ডান হাত দিয়ে পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। মাকে বললাম,
– মা আমি আবারো পোস্টমর্টেম করানো ডাক্তারের কাছে যাবো।

মা বললো,
– তুই আগে ও একবার গিয়েছিস ?

– হ্যাঁ মা, গিয়েছি। যে কারণে গিয়েছি তার সমাধান এখনো পাইনি, তাই তোমাকে এর উত্তর ও শোনার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বিশ্বাস করো মা, সেদিন তানিয়া আমার কাছে সত্যিই এসেছিল।

আনিকা টানা কয়েকদিন ধরে ফোন দিয়ে যাচ্ছে। ফোন রিসিভ করে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। পুরো সময়টা অস্থিরতায় কাটে। আজকে রাতে শুয়ার পর পরই আনিকার ফোন আসলো। ফোনটা রিসিভ করতেই বললো,
– রাকিব আজকে কতোদিন হয়ে গেলো তুই ভার্সিটিতে আসছিস না। এভাবে আর কতোদিন ?

আমি হতাশ গলায় বললাম,
– খুব বেশি নয়, আর মাত্র একটা দিন। একদিন পরই ভার্সিটিতে আসবো। একটা আংটি আমাকে স্বাভাবিক জীবনে আসতে দিচ্ছে না, আগামীকাল সন্ধ্যায় এটা ছুঁড়ে ফেলে দেবো।

আনিকা আগ্রহ নিয়ে বললো,
– আংটি ? কিসের আংটি ?

আমি জবাব না দিয়ে ফোনটা রেখে দিলাম।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কিছু না খেয়েই বাইরে বের হলাম। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর গাড়িতে উঠেই চলে আসলাম ডাক্তার মিজানুর রহমানের বাড়িতে।

মিজানুর রহমানকে ছাদে পাওয়া গেলো। তিনি ছাদে দ্রুত পায়ে একবার এদিকে যাচ্ছেন আরেকবার ওইদিকে। আমাকে দেখে বিরক্তকর দৃষ্টিতে তাকালেন। এগিয়ে এসে বললেন,
– সমস্যাটা কি তোমার ? তুমি আবার এসেছ কেন ?

আমি আন্তরিক গলায় বললাম,
– আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে এসেছি। সেদিন আপনার সাথে কথা বলার পর বুঝতে পেরেছি আমি আসলে আবেগ প্রবণতা নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছি, এই আবেগ আমাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে। এখন যন্ত্রণা কেটেছে। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি।

মিজানুর রহমান মুচকি হাসলো। হাসিমুখে বললো,
– প্রিয় মানুষদের মৃত্যু যেমনি প্রিয়জনেরা মেনে নিতে পারে না। তেমনি পারে না প্রিয় মানুষদের ভুলগুলো। তোমার এখন ক্যারিয়ার গঠন করার সময়, মৃত্যু শোক ভুলে নিজের ক্যারিয়ারে সময় দাও, আশা করি তাহলে খুব ভালো কিছু করতে পারবে।

– তানিয়া আমার একমাত্র ছোট বোন, বোনটা খুব আদরের ছিল। এমন আদরের বোনটার মৃত্যুতে একদমই ভেঙ্গে পরেছিলাম। আমার সাথে সাথে মা নিজে ও কঠিন পরিস্থিতি পার করছে। আপনার সাথে আমার মা কথা বলতে চায়, যদি একটু সময় দিয়ে কথা বলতেন তাহলে মায়ের দুশ্চিন্তা কেটে যেত।

মিজানুর রহমান সহজ গলায় বললেন,
– কিভাবে কথা বলতে চায় ? দেখা করতে হবে ?

– না, ফোনে কথা বললে ও হবে। আমি এখনি মায়ের নাম্বারে ফোন দিচ্ছি।

– ঠিক আছে দাও।

আমি পকেট থেকে মোবাইলটা করলাম, মায়ের নাম্বারটা বের করে ফোন দিলাম। মোবাইলে টাকা নেই, তাই ফোন ঢুকছে না। সকালে ইচ্ছে করেই টাকা ঢুকাইনি।

মিজানুর রহমানকে বললাম,
– মোবাইলে একটা টাকা ও নেই, যদি আপনার হাতের মোবাইলটাতে টাকা থাকে একটু দিবেন ?

মিজানুর রহমান তার হাতের মোবাইলটা এগিয়ে দিলেন। আমি মোবাইলটা হাতে নিয়েই সকালে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মুখস্থ করা ফয়সালের নাম্বারটা তুলতে শুরু করলাম।

মাত্র পাঁচটা ডিজিট তুলতেই দেখলাম মোবাইলটাতে আমার মুখস্থ করা পুরো নাম্বারটা ‘ফয়সাল’ লিখে সেইভ করা। মিজানুর রহমানের মোবাইলে ফয়সালের নাম্বার সেইভ থাকবে কেন ? ভাবতে গিয়ে আমার পুরো শরীরটা কেঁপে উঠলো।

আমি মিজানুর রহমানের সামনে বিস্ময় লুকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে ভাবছি – আংটিটা ফেলে দেওয়া যাবে না। আংটিটা সাথে নিয়েই বের করতে হবে আসল সত্যিটা। আমাকে জানতেই হবে সেদিন রাতে কি ঘটেছিল তানিয়ার সাথে!

( চলবে … )

লেখকঃ- #মতিউর_মিয়াজী

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে