আংটি – তৃতীয় পর্ব
তানিয়ার লাশ পোস্টমর্টেম করতে নিয়ে যাওয়া হলো। মা ফ্লোরে বসে আছে, একটু দূরে বসে আছে আনিকা। আমি বসা থেকে উঠে ফয়সালের কাছে গেলাম।
ফয়সালকে এবার ওয়াশ রুমে পেলাম না। সে ওসি’র রুমে বসে আছে। ভেতরে ঢুকে দেখলাম ওসি শফিকুর রহমান রুমে নেই। আমি ভেতরে ঢুকে পাশে রাখা চেয়ারটাতে বসলাম না। ফয়সালকে বললাম,
– তানিয়ার মৃত্যুটা আত্মহত্যা ছিল না।
আমার কথা শুনে ফয়সাল চমকালো। প্রথমে জোর গলায় কিছু একটা বলতে গিয়ে ও বললো না। গলার স্বর স্বাভাবিক করে বললো,
– এসব আপনি কি বলছেন ? দরজা বন্ধ করে গলায় ফাঁস লাগিয়ে মারা যাওয়া মানুষটাকে বলছেন আত্মহত্যা ছিল না ?
– না, এটা কোন ভাবেই আত্মহত্যা হতে পারে না। তানিয়া আমার বোন, ছোট বোনটাকে ভাই হিসেবে ভালো করেই চেনা আছে আমার। বোনটা আমার এতটা অসুস্থ মস্তিষ্কের নয়, যতটা হলে আত্মহত্যা করতে হবে।
ফয়সাল চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। এবার উচ্চস্বরে বললো,
– আপনি তাহলে কি বোঝাতে চাচ্ছেন ? আপনার বোনকে আমাদের বাড়িতে খুন করা হয়েছে ?
আমি একদম চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। পুরো মাথাটা অস্থিরতায় এলোমেলো লাগলো। ফয়সালকে কি বলবো বুঝে উঠতে পারলাম না।
ফয়সাল আমার হাতটি ধরে নরম গলায় বললো,
– তানিয়া শুধুই কি আপনার বোন ? আমার কিছু নয় ? তানিয়া আমার বিবাহিত স্ত্রী, নিজের স্ত্রীর এমন মৃত্যুটা মেনে নিতে কতোটা কষ্ট হচ্ছে বলে বোঝাতে পারবো না। আর শুনুন, আপনি হয়তো ভুল কিছু ভাবছেন। তানিয়া সুস্থ মস্তিষ্কের তা আমি মানছি, সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষেরাই সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা প্রবণ রোগে ভোগে। এই প্রবণতা সুস্থ মানুষকে অসুস্থ বানিয়ে দেয়।
আমি থানা থেকে বিষণ্ণতা নিয়ে বের হলাম। পোস্টমর্টেম শেষ হওয়ার পর পরদিন সকালে তানিয়ার লাশের সাথে ফয়সালের বাড়িতে গেলাম।
আমার সাথে মা এসেছে। বড় মামা খবর পেয়ে দেশের বাইরে থেকে জরুরী টিকেটে দেশে আসতে চাইলো। মামাকে বোঝালাম, পোস্টমর্টেম করা লাশ কবর দিতে দেরি করা যাবে না। ইচ্ছে করলে ও অপেক্ষা করা সম্ভব নয়।
মায়ের সাথে ছোট মামা রয়েছে। খবর পেয়ে রাতের ট্রেনে ছুটে এসেছে। ছোট মামা এসে মাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বললো,
– তিন দিন আগে ভাগ্নী টার বিয়ে খেয়ে গেলাম। তিন দিনের মাথায় এই ভাগ্নী টার লাশ দেখতে হবে কখনো ভাবিনি। পৃথিবীটা এতো কঠিন কেন ? কেন এমনটা হলো ?
পৃথিবীর কঠিন নির্মম সত্যিটা ছোট মামার মতো আমার ও মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তানিয়ার নামটা মুখে নেওয়ার সাথে সাথে যখন মনে হয় বোনটা আর বেঁচে নেই চারপাশটা একদমই ফাঁকা মনে হয়, মনে হয় সামনে বিশাল গর্ত, পা বাড়ালেই গর্তে আটকে যাবো।
মা চাইলো তানিয়ার লাশ যেন আমাদের বাড়ির কবরস্থানে কবর দেওয়া হয়। বিয়ের পর মেয়েদের কিছু অধিকার চিরদিনের জন্য পরিবর্তন হয়ে যায়। এই সত্যিটা মাকে বোঝাতে গিয়ে বললাম,
– বোনের লাশটা এই বাড়িতে কবর দেওয়ার কথাটা তাদেরকে কিভাবে বলবো, মা তুমিই বলো ? বিয়ের দিনই যে মেয়ের বাবা-মা সেই অধিকারটা হারিয়ে ফেলে।
আমার কথা শুনে মা নির্বাক ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। ফয়সালের বাড়িতে এসে শুনলাম কবরস্থানে কবর খুঁড়ে রাখা হয়েছে। আমি ছোট মামাকে সাথে নিয়ে কবরটা দেখতে গেলাম।
শুনেছি আত্মহত্যা করে মারা যাওয়া মানুষদের কবর দিতে সবাই ছুটে আসে না। কথাটা কিছু সময়ের জন্য মিথ্যা মনে হলো। মুরুব্বী থেকে শুরু করে সবাই এসেছে, খবর পেয়ে বিবাহিত অনেক মহিলারা ও ফয়সালের বাড়িতে আসলো, এসেছে কবরে নিয়ে যাওয়ার আগে তানিয়ার চেহারাটা এক নজর দেখতে।
তানিয়ার লাশ কবরে নামিয়ে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেললাম। সবাই কবরে মাটি ফেলছে, ছোট মামা এক মুঠো মাটি হাতে নিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছে। আমি ছুটে গিয়ে মামাকে জড়িয়ে ধরলাম। এভাবে কতক্ষণ জড়িয়ে ধরেছিলাম ঠিক জানা নেই।
বোনকে কবর দিয়ে ফয়সালের ঘরে ঢুকলাম। দৌড়ে গেলাম ফয়সালের রুমে, ফয়সালের রুমের দরজাটা ভাঙ্গা। ভাঙ্গা দরজাটা ভালো করে দেখলাম। আমাকে দেখে ফয়সাল এগিয়ে আসলো। এসে বললো,
– দরজাটা ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কাঠের এতো মজবুত দরজা ভেঙ্গে ফেলা কি এতটা সহজ ?
আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম,
– দরজা বন্ধ করে গলায় ফাঁস দেওয়ার কতক্ষণ পরে টের পেয়েছিলে ?
– প্রথমে আমি টের পাইনি। অফিসে যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে। তাই গোসলে গেলাম। জানেনই তো, বাড়িতে আমার মা ছাড়া কেউ নেই। মা তানিয়াকে ডাকতে আমার রুমের দিকে গেলো, গিয়ে দেখে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, তাড়পড় বাহির থেকে কয়েকবার উচ্চ স্বরে ডাকলো। ভেতর থেকে শব্দ না পেয়ে পাশের জানালাটা একটু ফাঁক করতেই দেখে তানিয়া ফাঁসিতে ঝুলে আছে। মা দেখেছে ঝুলে থাকা অবস্থায় তানিয়ার পা নড়াচড়া করছে। দেখেই আমাকে ডেকে নিয়ে আসলো।
বিকেলে ছোট মামাকে রেল স্টেশনে গিয়ে এগিয়ে দিলাম। স্টেশনে মানুষজনের তেমন একটা ভিড় নেই। এগিয়ে দিয়ে স্টেশনের প্লাটফর্মে বসলাম। দক্ষিণার খোলা জায়গা থেকে শীতল বাতাস এসে শরীরে লাগলো। অনেক সময়ের পর শরীরে শীতল বাতাসের স্পর্শতা অনুভব করতে পারলাম।
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে, রেল স্টেশনে রাত কাটানো ছোট ছোট ছেলেরা চলন্ত অবস্থান ট্রেনের ভেতর থেকে লাফিয়ে নামতে শুরু করলো। তাদের বয়স দশ থেকে বারো হবে, কিংবা তার চেয়ে ও কম। এতো কম বয়সী ছেলে হয়ে তাদের মনে বিন্দুমাত্র ভয় নেই। তারা সবাই চলন্ত ট্রেন থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে নামার আনন্দে আনন্দিত।
স্টেশন থেকে বাড়িতে এসে দেখলাম মা ঘরে নেই। ছাঁদে গিয়ে দেখি মা বেলীফুল গাছটার কাছে দাঁড়িয়ে। এই ফুল গাছটা তানিয়া লাগিয়েছে। এটা তার প্রিয় ফুল। যখন এই গাছে ফুল ফুটে তানিয়া গাছটির কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। দীর্ঘ সময় মুগ্ধ হয়ে গাছটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
সন্ধ্যার একটু পরেই দারোয়ান হাতে টিফিন নিয়ে রুমে ঢুকলো। হাতে এতো বড় টিফিন বক্স দেখে অবাক হয়ে বললাম,
– এতো বড় টিফিনে করে কি নিয়ে এসেছেন ?
– একজন আপা এসে খাবারের টিফিনটা দিয়ে গেলো।
– দিয়ে গেলো, আর নিয়ে নিলেন ?
দারোয়ান বললো,
– আপাটার নাম আনিকা, আমাকে বললো আপনাদেরকে নামটা শুনালেই চিনবেন।
মাকে ডাকতেই রুম থেকে বের হলো। আনিকা টিফিন দিয়ে গেছে শুনে বক্স গুলো খুললাম। বক্সে বোয়াল মাছ রান্না করা আছে, পেঁয়াজ দিয়ে ভুনা করে সুন্দর করে রেঁধেছে। তরকারীর চমৎকার কালার দেখে বুঝা যাচ্ছে অনেক সময় নিয়ে যত্ন করে রেঁধেছে।
রাত প্রায় বারোটার মতো বাজে, কখনো এতো রাত পর্যন্ত সজাগ থাকা হয় না। দশটার পর পরই চোখে ঘুম চলে আসে। আজ চোখে ঘুম নেই, দশটার পর থেকেই বিছানায় গড়াগড়ি করছি, ঘুম আসছে না। ভার্সিটিতে পড়া ছেলে-মেয়েরা এতো তাড়াতাড়ি ঘুমায় না। আনিকা কি ঘুমিয়ে গেছে ?
আনিকার সাথে যেদিন রাতে কথা হয় দশটার আগে হয়, বেশিরভাগ সময় প্রয়োজনে ফোন দেওয়া হয়। আজ প্রয়োজন ছাড়া এতো রাতে ফোন দেওয়া কি ঠিক হবে ? কিছু সময় ভাবনার পর ফোন দিলাম। আনিকা সাথে সাথে ফোনটা রিসিভ করে বললো,
– আন্টি কেমন আছে ?
– এখন অনেকটা ভালো। তুই এখনো ঘুমিয়ে যাস নাই ?
– না, ভেবেছিলাম এখনি শুয়ে পড়বো। এর মধ্যে তোর ফোন পেলাম।
আমি আন্তরিক গলায় বললাম,
– তোরে হসপিটালে আসতে বলার পর থেকেই অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। দাঁড় করেয়েছি একটা করুণ পরিস্থিতির মুখোমুখি। বোনের মৃত্যু, তার মধ্যে মায়ের অসুস্থতা কোন কিছুই সামলে উঠতে পারছিলাম না।
– আরে তুই এসব কি বলছিস ? যদি সেদিন তোর ফোন পেয়ে না যেতাম তাহলে পৃথিবীর কঠিন বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারতাম না।
– কে বলেছে তোরে টিফিনে করে তরকারি দিয়ে যেতে। আমার জন্য তোরে অনেক ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে।
আনিকা সহজ গলায় বললো,
– একটা জিনিস তোর কাছে চাইবো বলেই এতো ঝামেলা করছি ?
– আমার কাছে কি এমন আছে যেটা তোর প্রয়োজন ?
আনিকা গলার স্বর পাল্টে বললো,
– আছে, যেদিন চাইবো সেদিনই বুঝতে পারবি।
কিছুক্ষণ কথা বলার পর আনিকা ঘুমিয়ে পড়লো। আমার চোখে ঘুম এখনো আসছে না। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছি আর ভাবছি, আমার কাছে এমন কি আছে, যেটা আনিকার প্রয়োজন ?
পোস্টমর্টেম রিপোর্টের কপি হাতে আসতে কয়েক দিন লাগলো। রিপোর্ট হাতে পেয়ে পুরোপুরি বিস্মিত হলাম। রিপোর্টে বলা হলো, তানিয়া একজন ড্রাগ এডিক্টেট। ফাঁসিতে ঝুলেই তার মৃত্যু হয়েছে, এই মৃত্যুটা আত্মহত্যাই ছিল।
রিপোর্ট দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। নিয়মিত নেশার সাথে জড়িত থাকলে পরিবারের কেউ না কেউ তো জানতে পারতাম! একটা মেয়ে হয়ে নিয়মিত নেশা করে যাবে আর কেউ জানবো না ?
তানিয়ার এমন রিপোর্ট দেখে মায়ের কাছে বলার সাহস করতে পারলাম না। মাকে বললে কথাটা শুনে আবার যদি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ? এতো আদরের মেয়ের নামে রিপোর্টে এমন লিখা দেখলে মেনে নেওয়াটা কঠিন যন্ত্রণাদায়ক।
রিপোর্ট হাতে নিয়ে থানায় ছুটলাম। আমার ধারণা এই রিপোর্টে ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে, গভীর ষড়যন্ত্র। আমার ধারণা কখনোই মিথ্যা হতে পারে না। যে করেই হউক আমাকে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট তৈরি করা ডাক্তারটাকে খুঁজে বের করতে হবে। প্রয়োজনে পরীক্ষার মাধ্যমে সত্যিটা বের করতে কবর থেকে তানিয়ার লাশ আবার তুলবো।
( চলবে ….)
লেখকঃ- #মতিউর_মিয়াজী