আংটি পর্ব-০২

0
4409

আংটি – দ্বিতীয় পর্ব

তানিয়ার মৃত্যুর খবর সবকিছু এলোমেলো করে দিলো। হঠাৎ করেই মায়ের হাত থেকে ফোনটা মাটিতে পরে গেলো। ফোনটা হাত দিয়ে ধরে রাখার শক্তিটুকু ও মা হারিয়ে ফেলেছে। আমি কথা বলার চেষ্টা করে ও বলতে পারছি না, ইচ্ছে করছে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে হাউমাউ করে কাঁদি।

আমার চোখ দিয়ে ফোটা ফোটা জল পড়ছে। আমি চোখের পানি মুছার চেষ্টা করলাম না, জানি এই জল মুছে শেষ করতে পারবো না।

গেইটের দারোয়ান নির্বাক ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার মায়ের দিকে। সে চিৎকারের কারণ জানতে চাচ্ছে। বার বার মাকে বলে যাচ্ছে,
– আমগো তানিয়া আপার কি হয়েছে ?

মা কোন জবাব দিচ্ছে না। মায়ের চোখে এক ফোটা ও পানি নেই। মা চোখ বড় বড় করে দারোয়ানের দিকে তাকাল।

ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে মায়ের শীর্ণ শরীর। মা কিছু একটা বলতে চেয়ে বলতে পারছেন না। আমি শীতল গলায় দারোয়ানকে বললাম,
– আপনার তানিয়া আপু আর বেঁচে নেই।

– কি হইছে আপার ?

কথার জবাব দিতে পারছি না। পুরো শরীর হিমশীতল বরফ হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে শব্দনালীতে সব কথা আটকে গেছে। চেষ্টা করে ও মুখ দিয়ে বের করতে পারবো না।

গেইটের সামনেই মা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। দাঁড়ানো থেকেই মাটিতে পরে যেতেই ভয় পেলাম, খুব ভয়। দারোয়ান চারদিকে ছুটাছুটি করছে। আমি মায়ের পাশে বসে আছি।

জ্ঞান হারিয়ে ফেলা মানুষের শরীর এতটা ঠাণ্ডা হয়ে যায় জানা ছিলো না। আমি মাকে ডাকলাম, বার বার ডেকে যাচ্ছি। দারোয়ান বালতি দিয়ে পানি নিয়ে আসলো। মায়ের হাতে চেপে ধরে বললো,
– শরীর তো খুব ঠাণ্ডা হয়ে আছে, এখুনি মাথায় পানি ঢালা যাবে না। শরীর গরম করার জন্য হাতে আর পায়ের তলায় তেল গরম করে, গরম তেল মাখতে হবে।

দারোয়ান এসব কি বলছে ঠিক বুঝতে পারছি না। দু’জনে মাকে ধরে ঘরে ঢুকলাম। ছুটে গেলাম আমার রুমে। ফোনটা চার্জ থেকে খুলতে গিয়ে দেখি ফয়সালের নাম্বার থেকে অনেকগুলো ফোন দিয়ে রেখেছে।

জরুরী সময় কোন কিছু খুঁজে পেতে যেমন সমস্যা হয়, তেমনি জরুরী কোন সার্ভিস পেতে ও দেরি হয়। হসপিটালে ফোন দিলাম, নাম্বারটা ওয়েটিং দেখিয়ে বার বার কেটে যাচ্ছে।

এবার ফোনটা রিসিভ হলো। বাড়ির ঠিকানায় অ্যাম্বুল্যান্স পাঠাতে বললাম। ফোন রিসিভ করা মানুষটা জানালো, খুব একটা দেরি হবে না। এখুনি অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে দিবে।

অ্যাম্বুলেন্সে করে মাকে নিয়ে হসপিটালে আসলাম। জীবনে এই প্রথম বার এতো কঠিন পরিস্থিতিতে পরলাম। একদিকে মায়ের জ্ঞান ফিরছে না, অন্যদিকে তানিয়ার খোঁজ নিতে পারছি না। তানিয়াকে দেখতে যাওয়া প্রয়োজন, মাকে এমন অবস্থায় রেখে কিভাবে যাবো ?

মাকে কেবিনে ঢুকানোর পর পরই একজন নার্স উপরে গিয়ে ডাক্তার নিয়ে আসলো। ডাক্তার কেবিনে ঢুকেই আমার দিকে তাকালো। তাকিয়েই আমার অস্থিরতা ধরতে পারলো। আমার খুব কাছে এসে বললো,
– আরে আরে আপনি এতো চিন্তিত হচ্ছেন কেন ? রোগী সম্পর্কে আপনার কে হয় ?

– সম্পর্কে আমার মা।

ডাক্তার সাহেব হাসিমুখে বললো,
– আপনার মাকে নিয়ে কোন টেনশন করবেন না। হসপিটালে এসে পৌঁছেছেন তো, মনে করেন টেনশনের আর কোন কারণ নেই। সামান্য জ্ঞান হারানো নিয়ে এতটা চিন্তিত হতে কখনোই কাউকে দেখি নি।

আমি জবাব দিলাম না। দাঁড়িয়ে থেকে শব্দহীন মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

একটু পরেই আমার মোবাইলে ফোন বেজে উঠলো। তানিয়ার স্বামী ফয়সালের নাম্বার থেকে ফোন আসতেই ফোনটা তাড়াহুড়ো করে রিসিভ করলাম।

ফোনটা কানে নিয়ে হ্যালো হ্যালো বলেই যাচ্ছি। কারো কোন সাড়া শব্দ নেই। ফোনটা কান থেকে নামিয়ে রাখলাম। রাখতেই আবারো ফোন আসলো। এবার রিসিভ করার সাথে ফয়সাল বললো,
– রাকিব তুমি এখনো আসছো না কেন ? এদিকে অনেক ঝামেলা হয়ে যাচ্ছে। পুলিশ লাশ নিয়ে থানায় এসেছে। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব থানায় চলো আসো। তানিয়ার লাশের সাথে আমি ও এখন থানায় আছি।

– মাকে সাথে নিয়ে আমি হসপিটালে আছি, জ্ঞান না ফিরলে মাকে রেখে কিভাবে থানায় যাবো ?

ওপাশ থেকে কোন জবাব আসছে না। কিছুক্ষণ হ্যালো হ্যালো বলেই যাচ্ছি। ফয়সাল ফোনটা কেটে দিয়েছে।

থানায় যাওয়া খুব জরুরি হয়ে পরেছে। হসপিটালে আনিকাকে আসতে বলা দরকার। তাকে মায়ের পাশে রেখে আমাকে থানায় যেতেই হবে।

আনিকার সাথে পরিচয়টা খুব বেশি দিনের নয়। দু’জনে একই ডিপার্টমেন্টের হয়ে ও কারো সাথে তেমন কোন কথা হয় না। সামান্য কিছুদিন হলো একটু আধটু কথা হয় দু’জনের। প্রতিদিনের সামান্য সময়ের কথায় বন্ধুত্বের সম্পর্কটা যতটুকু মজবুত হয়েছে, মনে হচ্ছে আনিকাকে হসপিটালে আসতে বললে আসবে, অবশ্যই আসবে।

ফোন পেয়ে আনিকা হসপিটালে ছুটে আসলো। মায়ের এমন অবস্থা দেখে সে একদম থমকে গেলো। মায়ের হাতে স্যালাইন লাগানো দেখে মন খারাপ করে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
– রাকিব তুই আন্টিকে এমন পরিস্থিতিতে রেখে কোথায় যেতে চাচ্ছিস ?

আমি বললাম,
– একজন ভাই হয়ে তার আদরের বোনটার লাশ দেখতে থানায় যাচ্ছি।

আনিকা কিছু একটা বলতে চেয়ে ও বলতে পারছে না। বার বার কথাটা আটকে যাচ্ছে। আমি এক মুহূর্ত দেরি করলাম না। এক মুহূর্তের জন্য হলে ও বোনটার বোকাসুলভ চেহারাটা দেখতে থানায় ছুটলাম।

থানায় এসে ঢুকে দেখলাম ফয়সাল এই থানার ওসি শফিকুর রহমানের সাথে বসে আছে। ফয়সালের সাথে শফিকুর রহমানকে ও চিন্তিত দেখাচ্ছে। ফয়সাল আমাকে ওসি’র সাথে পরিচয় করে দেওয়ার পর তিনি বললেন,
– আপনি মেয়েটার ভাই হয়ে কিভাবে এতো দেরি করলেন ? মেয়েটাকে পোস্টমর্টেম করাতে হবে। আপনি কি জানেন পোস্টমর্টেম রাতে করানো যায় না।

আমি মাথা নিচু করে বললাম,
– জ্বী, জানি।

– তাহলে আসতে এতো দেরি করেছেন কেন ? আজকের মধ্যেই মেয়েটার লাশ পোস্টমর্টেম করাতে হবে।

একজন সেন্ট্রি আমাকে সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে লাশটা দেখানোর জন্য। সেন্ট্রি খুব আস্তে আস্তে হাঁটছে, তবু আমি একসাথে হাঁটতে পারছি না।

তানিয়ার শরীরের উপরে একটা সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে রেখেছে। শুধু মুখটি খোলা। আমি তানিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে সাথে সাথে শব্দ করে চিৎকার করলাম। তানিয়ার কপালের ঠিক বাম পাশে কালো কালো দাগ পড়ে আছে। মনে হচ্ছে এখানের রক্ত চলাচল হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। চামড়ার নিচে থাকা জমাট বাধা রক্তের কালো দাগ দেখে তীক্ষ্ণ ধারালো ছুরির মতো হৃদয়ে আঘাত করলো।

আমার চিৎকার শুনে ফয়সাল দৌড়ে আসলো। আমি তানিয়ার খুব কাছে বসলাম। ফয়সালের চোখে পানি, সে তানিয়ার নাম ধরে ডেকে ডেকে কাঁদছে।

কিছুক্ষণ পরেই আনিকা মাকে সাথে নিয়ে থানায় আসলো। মায়ের জ্ঞান ফিরেছে দেখে কিছুটা স্বস্তি লাগছে। আনিকা আমাকে নরম গলায় বললো,
– ডাক্তার বলেছে আন্টিকে রেস্ট নেওয়ার জন্য। কিন্তু জ্ঞান ফেরার পর ডাক্তাররা এক মুহূর্ত ও আটকে রাখতে পারে নি।

তানিয়াকে পোস্টমর্টেম রুমে ঢুকানো হবে শুনে মা দুই হাত দিয়ে তানিয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। দেখে মনে হচ্ছে পৃথিবীর কোন শক্তি নেই, মাকে তানিয়ার কাছ থেকে আলাদা করবে। মা চিৎকার করতে করতে বললো,
– আমার মেয়ের শরীর আমি পোস্টমর্টেম করতে দেবো না। মেয়েটা আমার খুব কষ্ট পেয়ে মরেছে। দয়া করে তোমারা আমার মেয়েটাকে আর কষ্ট দিও না।

ফয়সাল চোখের পানি মুছতে মুছতে রুম থেকে বের হলো। কিছুক্ষণ পর আমি মুখ ধোয়ার জন্য ওয়াশ রুমের দিকে গেলাম।

থানার এই ওয়াশ রুমটা খুব বিশাল। সিরিয়ালে কয়েকটা বেসিন বসানো। ওয়াশ রুমে ঢুকতেই দেখলাম কোনায় বসানো একটা বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে ফয়সাল চোখে পানি দিচ্ছে। ফয়সাল পকেট থেকে টিস্যু বের করে চোখ মুছে আয়নায় তাকিয়ে হাসতে শুরু করলো। আয়নায় তাকিয়ে ফয়সালকে শব্দ করে হাসতে দেখে পুরোপুরি বিস্মিত হলাম। বিস্মিত হয়ে ভাবলাম, তানিয়ার মৃত্যুর দিনে তার মুখে হাসি আসছে কিভাবে ? একমাত্র খুনীদের দ্বারাই মৃত্যুর দিন এমন করে হাসা সম্ভব!

ওয়াশ রুমে আমার উপস্থিতি টের পাওয়ার আগেই আমি তানিয়ার লাশটির কাছে ছুটলাম। মনে পড়লো আংটিটার কথা। আংটিটা মাকে হসপিটালে নেওয়ার সময় পকেটে রেখেছি, হাত দিয়ে দেখলাম এখনো পকেটেই আছে। আমি পকেট থেকে বের করে হাতে নিলাম।

মা তানিয়ার পাশেই বসে আছে। আমি ও তানিয়ার পাশে বসলাম। তানিয়ার হাতের আঙ্গুলটা দেখার জন্য শরীরের উপরে দিয়ে রাখা চাদরটা টান দিলাম। চাদরের কারণে এতক্ষণ গলার কাছের জায়গাটা ঢাকা ছিল, একটু সরাইতে গলার কাছে কালো দাগটি দেখে চমকে উঠলাম। গলার এই দাগটা আমি তখনো দেখেছি যখন তানিয়া বাড়িতে এসেছিল।

পুরোটা চাদর সরালাম। আশ্চর্য, তানিয়ার আঙ্গুলে কোন আংটি নেই। মাঝখানের আঙ্গুলটায় আংটি পড়ার দাগটা একটু ও মুছেনি। দাগটি দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে আমার হাতের এই আংটিটা তানিয়ার হাতেই পড়ানো ছিল।

( চলবে …. )

লেখকঃ- #মতিউর_মিয়াজী

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে