আংটি – প্রথম পর্ব
লেখকঃ- #মতিউর_মিয়াজী
বিয়ে হয়েছে মাত্র তিনদিন হলো। তিন দিনের মাথায় আদরের ছোট বোনটি বাড়ি ফিরে বললো,
– যদি আত্মহত্যা পাপ না হতো, তাহলে এতক্ষণে সবাই আমার লাশ দেখতে পারতো।
তানিয়ার কথা শুনে আমি বিস্মিত হলাম। দু’চোখ তুলে তানিয়ার মুখের দিকে স্পষ্ট দৃষ্টিতে তাকালাম। তার বোকা সুলভ চেহারাটা একদম রেগে আছে। চোখ মুখ ফুলে আছে। চোখ দেখে বুঝতে পারলাম, বোনটা হয়তো পুরো রাতটি নির্ঘুম ছিল।
তানিয়ার হাতে কাপড় ভর্তি বিশাল ব্যাগ। এতক্ষণ ব্যাগটা খেয়াল করিনি। ব্যাগ দেখে চমকালাম। বিয়ে হয়েছে মাত্র তিন দিন হলো, এর মধ্যেই সব কাপড় চোপড় নিয়ে চলে আসার কারণ কি ? আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম,
– তানিয়া তুই এমন রেগে আছিস কেন ? এতো দূরের পথ একা একা চলে এসেছিস ?
– হুম, একাই চলে এসেছি। শুধু যে এসেছি তা নয়, একেবারেই চলে এসেছি। ওই বাড়িতে আর কখনোই যাবো না।
তানিয়া মুখ দিয়ে একবার যা বলে তাই করে। যে কোন সিদ্ধান্ত হঠাৎ করে নিয়ে নেয়, এমনটা ও নয়। ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিবে, যেটা নিবে সেটাই ফাইনাল। মাথা নিচু করে বললাম,
– ঠিক আছে, যেতে হবে না। আগে তুই শান্ত হয়ে নে।
তানিয়া করুণ গলায় বললো,
– ভাইয়া তুমিই বলো, কিভাবে শান্ত হবো ? তুমি কি জানো গতকাল রাতটা আমার কিভাবে কেটেছে ? এই নাও আংটি, এই আংটিটা যতক্ষণ আমার হাতে থাকবে ততো ক্ষণ আমি শান্ত থাকতে পারবো না।
তানিয়া মাঝখানের আঙ্গুল থেকে আংটিটা খুলে এগিয়ে এসে আমার হাতে দিলো। আমি আংটিটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলাম। এই আংটিটা তানিয়াকে বিয়ের আগে দেখতে এসে দিয়েছিল। তানিয়ার স্বামী ফয়সাল যখন ফ্যামিলির সাথে দেখতে এসেছে, এসেই আংটিটা পড়িয়েছিল। দেখতে এসে তনিয়াকে তাদের ভীষণ পছন্দ হয়েছে, পছন্দের মানুষকে আংটি পড়িয়ে যাওয়ার যে নিয়ম চালু রয়েছে তা পুরোপুরি পালন করা হয়েছে।
আংটি টার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম,
– শুনেছি স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া আংটি রাগ করে আঙ্গুল থেকে খুলে ফেললে সংসারের অমঙ্গল হয়। শুন তানিয়া, রাগ দেখানো ভালো, তবে এতটা নয়। বোনটা আমার বলনা, এতটা রেগে আছিস কেন ?
তানিয়া চুপ করে আছে। হঠাৎ করেই মুখ কালো করে মাথা নিচু করে ফেললো। তার চুল এলোমেলো। এলোমেলো চুল মুখের সামনে এসে পড়ে রয়েছে। বললাম,
– আরে আরে তোরে তো পাগলের তো দেখাচ্ছে, চুলগুলো ঠিক কর।
তানিয়া ঘাড় সোজা করে আমার চোখে চোখ রাখলো। তার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে, চোখে পানি দেখে বিস্ময় নিয়ে তাকালাম। বোনটাকে আগে কখনো কাঁদতে দেখিনি। যেদিন বিয়ে হলো, সেদিন ও এক মিনিটের জন্য ও কাঁদেনি। আমার এতো রাগী বোনটা চোখের পানি ফেলছে কেন ?
তানিয়ার গলায় কালো দাগ দেখে আশ্চর্য হলাম। একটু এগিয়ে এসে গভীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে দেখি গলার কাছে কালো দাগটা স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন কেউ একজন মোটা রশি জাতীয় কিছু দিয়ে গলায় চেপে ধরে রেখেছিল।
আমি আংটি হাতে নিয়ে দৌড়ে দু’তালায় উঠলাম। আমাদের ঘরের কিচেন রুমটা দু’তালায় মায়ের শোবার রুমের পাশেই। মা বেশির ভাগ সময়টা কিচেন রুমে কাটায়। রান্নাবান্না নিয়ে মায়ের যে আগ্রহ, এতটা আগ্রহ পৃথিবীতে আর কারো আছে কিনা আমার সন্দেহ আছে।
মাকে কিচেন রুমে পাওয়া গেলো। চুলায় আগুন জ্বলছে, হয়তোবা খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। আজকে শুক্রবার, এই দিন আমাদের ঘরে খিচুড়ি রান্না হয়। মায়ের হাতের এই খিচুড়িটা আমার জন্য স্পেশাল একটা খাবার। ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর ক্যান্টিন থেকে বন্ধুদের সাথে অনেকবার খিচুড়ি খাওয়া হয়েছে। মায়ের তৈরি করা খিচুড়ির যেই স্বাদ তা কোথা ও পাই নি।
সন্তানদের অস্থিরতা সবার আগে যে মানুষটা টের পায় সে হলো মা। আমাকে দেখেই আমার মনের ভেতরের অস্থিরতা মা বুঝতে পারলো। আতঙ্কিত গলায় বললো,
– কি হয়েছে রাকিব ? তোরে এতটা অস্থির দেখাচ্ছে কেন ?
আমি যতোটুকু সম্ভব সহজ গলার বলার চেষ্টা করলাম।
– মা বুঝতে পারছি না ছোট বোনটার কি হয়েছে! একা একাই স্বামীর বাড়ি থেকে রাগ করে চলে এসেছে। হাতে বিশাল ব্যাগ, ব্যাগ দেখে মনে হচ্ছে সব কাপড় চোপড় নিয়ে একেবারেই চলে এসেছে।
– বলছিস কি তুই এসব ?
মা যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। অবিশ্বাসী গলায় বললো,
– এতো দূরের পথ একা একা চলে আসার সাহস হলো কিভাবে ? রাগ করে আর যাই করে, আসার আগে আমাকে তো একবার ফোন দিবে।
– শুনো মা, তানিয়া নিচে দাঁড়িয়ে আছে। বোনটাকে জোর গলায় কিছু বলিও না। আমি তানিয়াকে আগে কখনোই কাঁদতে দেখি নি, আজ তানিয়া কাঁদছে। চোখের পানি দেখেই তোমাকে বলার জন্য দৌড়ে ছুটে এসেছি।
মা এক মুহূর্ত দেরি করলো না। তানিয়া কাঁদছে শুনে পাগলের মতো দৌড়ে নিচে ছুটে গেলো। মা দৌড়চ্ছে, আমি আংটিটা হাতে নিয়েই মায়ের পেছনে পেছনে ছুটছি।
নিচ তালায় এসেই মা পুরো ড্রয়িং রুমের চারপাশ খুঁজতে লাগলো। ড্রয়িং রুমে একটা টেবিল, টেবিলের চারপাশে চেয়ার বসানো। টেবিলের পাশেই সোফাটা, সোফায় বসে যেন টিভি দেখে যায় তাই টিভিটা একদম কোনা বরাবর লাগানো হয়েছে। এই মালামালের বাইরে ড্রয়িং রুমে আর কিছুই নেই। একপাশে দাঁড়িয়ে চোখ বুলাইলে পুরো রুমের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যায়।
তানিয়াকে না দেখে আমি নিজে ও অবাক হলাম। মাত্রই তো এখানে ছিল, মাকে সাথে করে নিয়ে আসতে আসতেই কোথায় চলে গেলো!
নিচ তালায় ড্রয়িং রুমটা ছাড়াও আরো তিনটে রুম রয়েছে। মেহমান আসলে ওই রুমের তালা খোলা হয়, এ ছাড়া সব সময় বন্ধ থাকে, এখনো বন্ধ। ড্রয়িং রুমের পাশেই একটা ওয়াশরুম। ওয়াশ রুমের দরজাটা দেখেই বুঝা যাচ্ছে ভেতর থেকে লাগানো। মা সোফায় বসল, আমি ও বসলাম মায়ের পাশে। মায়ের মাথায় হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। তানিয়া ওয়াশরুম থেকে বের হলেই জানতে চাইবে এসব প্রশ্নের উত্তর।
আমি আবার দু’তালায় গেলাম। কিচেন রুমের চুলা বন্ধ করলাম। খিচুড়ি পুরোপুরি হয়নি, তানিয়ার সাথে কথা শেষ হলে আবারো চুলা জ্বালানো হবে। বন্ধ করে নিচে এসেই মায়ের পাশে বসলাম।
প্রায় এক ঘণ্টার মতো হয়ে গেছে। তানিয়া এখনো ওয়াশ রুম থেকে বের হচ্ছে না। গোসল করলে ভেতর থেকে পানি পড়ার শব্দ হতো। কোন শব্দ আসছে না দেখে মা উঠে গিয়ে দরজা ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেলো।
ওয়াশ রুমের দরজাটা এমনিতেই চাপানো ছিল। ভেতরে কেউ নেই। তানিয়াকে না দেখে মা হতাশ চোখে আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম,
– তানিয়া তাহলে কোথায় গিয়েছে ? তাহলে কি আমরা উপর থেকে আসতে আসতেই ঘর থেকে বের হয়ে গেছে ?
মাকে সাথে নিয়ে দারোয়ানের কাছে গেলাম। আমাদের বাড়ির গেইট সব সময় বন্ধ থাকে, দারোয়ানের কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া ছাড়া এই বাড়ির ভেতরে কেউ ঢুকতে পারে না। অপরিচিত কেউ আসলে দারোয়ান মায়ের নাম্বারে ফোন দেয়। মা চিনতে পারার পর আসতে বললে তবেই ঢুকতে পারে। এই বাড়িতে আমার বন্ধুদের আসতে যেন সমস্যা না হয় তাই আগে থেকেই বলে দেই দারোয়ান পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে নাম বলার আগেই যেন ভার্সিটির নামটা বলে দেয়।
বাড়ির দারোয়ান মোখলেছুর প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছে। তার হাতে একটি ছোট লাঠি। আমি সব সময় বলি হাতে লাঠি রাখার প্রয়োজন নেই। দারোয়ান কথা শুনে হাসিমুখে জবাব দেয়, লাঠি ছাড়া হাত খালি খালি লাগে।
আমি এগিয়ে খুব কাছে গিয়ে দারোয়ানকে বললাম,
– কিছু সময় আগে তানিয়া গেইট পেরিয়ে বাইরে গিয়েছিল ?
আমার কথা শুনে দারোয়ান সাথে সাথে বললো,
– নাতো, আজকে এখনো কেউ বাড়ি থেকে বের হয় নাই। তানিয়া আপা কখন আসলো, আপাকে তো আসতে ও দেখি নাই।
কথা শুনে মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো। আমি রাগান্বিত গলায় বললাম,
– থাকেন কোথায় আপনি ? শুনি তো থাকেন কোথায় ? তানিয়া বাড়িতে ঢুকেছে এক ঘণ্টার মতো হবে, ওই সময় আপনি কোথায় ছিলেন ?
দারোয়ান করুণ গলায় বললো,
– বিশ্বাস করেন আমি কোনখানে ই যাই নাই। সকাল থেকেই গেইটে বসে আছি।
মা আমার দিকে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকাল। মায়ের ফোন বেজে উঠলো। তানিয়ার স্বামী ফয়সাল ফোন দিয়েছে। ফোনটা রিসিভ করতেই ফয়সাল বললো,
– আপনার নাম্বারে এক ঘণ্টা ধরে ট্রাই করছি, ফোন ঢুকছে না। রাকিবের নাম্বারে ফোন দিয়েই যাচ্ছি, রাকিব ফোন রিসিভ করছে না কেন ? আপনারা তাড়াতাড়ি আসেন। তানিয়া ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। এক ঘণ্টা হয়ে যাবে তানিয়ার লাশ পাখায় টানানো রডের সাথে ঝুলছে।
কথাগুলো কানের ভেতরে ঢুকতেই শরীরের সবগুলো পশম দাঁড়িয়ে গেলো। আমি চিৎকার দিয়ে মাটিতে বসে পড়লাম। তানিয়া তাহলে এখানে আসেনি, আমি কি তাহলে সবকিছু মিথ্যার মায়াজালে মাখানো ভুল দেখেছি ?
তানিয়ার হাত থেকে নেওয়া আংটিটার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। আমার হাতে নেওয়া এই আংটিটা, এটা কখনোই মিথ্যা হতে পারে না ?
চলবে…