#আঁধার_ভিড়ে_সন্ধ্যাতারা❤️
#লেখিকা-মালিহা_খান❤️
#পর্ব-২
আরিয়ান বিস্ময়ে ভ্রু উচায়,ঘাঁড় হাল্কা কাত করে তীর্যক কন্ঠে বলে,
—“তুমি রাশেদ চৌধুরির মেয়ে?”
মায়ার ঘুম পাচ্ছে।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সাড়ে চারটা অর্থ্যাৎ প্রায় ভোড় হয়ে গেছে।একবার চোখ কচলে সে উওর দেয়,
—“জি”।
আরিয়ান চোখজোড়া বন্ধ করে।রাশেদের মেয়ে আছে সে জানে।তবে রাশেদ নাকি সবসময় ওর মেয়েকে এইসব থেকে দুরে রাখে।জনসম্মুখে কখনো ওর মেয়েকে আনেনা।হয়তো ভাবে তার হাজারো শত্রুর ভিড়ে,হাজারো পাপের অভিশাপে যদি মেয়েকে হারিয়ে ফেলে।হতে পারে,এই মেয়েই তার সবচেয়ে বড় দূর্বলতা।তাই এ নিয়ে সে ও বেশি মাথা ঘামাতোনা।তার শত্রুতা রাশেদের সাথে।ওর মেয়ের সাথে তো নয়।আর তার মতে,”দুর্বলতায় কেবল দুর্বল ব্যক্তিরাই আঘাত করে।দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জেতার চেয়ে হেরে যাওয়াও শ্রেয়।”
মায়া ছোট্ট করে একটা হাই তুলে মুখের সামনের চুলগুলো ঘাড়ের পিছে দিয়ে দেয়।ছেঁড়া জামাটা সে খেয়াল করেনি।ফলস্বরূপ উন্মুক্ত হয়ে যায় ফর্সা কাঁধ।চোখ খুলে সর্বপ্রথম আরিয়ানের দৃষ্টি যায় সেদিকে।স্হির হয়ে যায় মনিগুলো।মায়া আবারো হাই তুলে।ঘুমঘুম চোখগুলোতে চোখ পরতেই চট করে ওঠে দাঁড়ায় আরিয়ান।লাইট নিভিয়ে দিয়ে বলে,
—“ঘুমিয়ে পড়ো,আমি এখানেই আছি”।
মায়া মাথা নাড়িয়ে শুয়ে পড়ে।ঘুম পেলে তার হুঁশ থাকেনা।কিছু সময়ের মধ্যই গভীর ঘুমে বিভোর হয়ে যায় সে।
আরিয়ান ফোনটা হাতে নিয়ে ব্যালকনিতে চলে যায়।ভোরবেলা বেশ স্নিগ্ধ পরিবেশ থাকে।আজকের ভোরটা যেন একটু বেশিই স্নিগ্ধ।কিছুক্ষন ফোন ঘাটাঘাটি করে একটা চিরপরিচিত নাম্বারে কল দেয় সে…
—————
মেয়ের চিন্তায় পাগলপ্রায় রাশেদ চৌধুরি।কাল সন্ধ্যা থেকে নিঁখোজ তার মেয়ে।কোন জায়গায় খোঁজ করা বাদ দেয়নি।অতিরিক্ত অনুরোধের কারণেই মেয়েকে বাইরে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলো সে।সঙ্গে যথেষ্ট নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করেছিলো।একটা জরুরি কাজে আটকে গিয়েছিলো নয়তো সে নিজেই যেতো মেয়ের সাথে।এখন আফসোস হচ্ছে কেন সে গেলোনা?
সচরাচর মেয়েকে বাইরে যেতে দেয়না রাশেদ।কখন কোন শত্রু কি করে ফেলবে!মেয়েকে একরকম লুকিয়েই রাখে সে।কাল খুব অনুরোধ করছিলো বান্ধবীর বাসায় যাবে তাই মেনে গিয়েছিলো সে।মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে না করতে পারেনি।সব ঠি কঠাকই ছিলো তবে সন্ধ্যার দিকে ফোন দিয়ে দেখে মায়ার ফোন অফ।এমনকি তার সাথে পাঠানো বডিগার্ডদের ফোনও অফ।তখনই ভয়টা জেঁকে বসে তার।তারপর খোঁজ নিয়ে জানতে পারে।যেখানে মায়া গিয়েছিলো সেখান থেকে ফেরার পথের রাস্তায়ই গাড়িতে ড্রাইভার ছিলো মৃত অবস্থায়।আর বডিগার্ডরা গাড়ির বাইরে তবে তারাও মৃত ছিলো।মায়া ছিলোনা সেখানে।
হঠাৎ কল আসায় চমকে উঠে সে।ভাবনায় ভাঁটা পরে তার।অতি প্যানিকে নাম্বার না দেখেই ফোন তুলে সে।
ওপাশের মানুষটার কথা না শুনেই ক্ষীপ্ত কন্ঠে বলে,
—“হ্যালো,কে?কি হয়েছে?”
রাশেদের এমন উদ্বিগ্ন কন্ঠে বেশ মজা পেলো আরিয়ান।তথাপি একটু ব্যঙ্গ করে বললো,
—“নাম্বার টা দেখে তো ফোনটা তুলবি।কখন কে ফোন দেয় একটু নজরে রাখা উচিত।”
আরিয়ানের কন্ঠ শুনে রাগে ফেটে পড়ে রাশেদ চৌধুরি।এসময় নিশ্চয় তার সাথে রসিকতা করতে ফোন দেবেনা আরিয়ান।তার সকল ধ্যান-ধারনা কেবল একটা দিকেই ইঙ্গিত করে তাহলো,”তাদের শত্রুতার জের ধরে,আরিয়ানই মায়াকে কিডন্যাপ করেছে।”তীব্র জেদ নিয়ে সে চিৎকার সমতুল্য কন্ঠে বলে,
—“মায়া?মায়া তোর কাছে?তুই কিডন্যাপ করেছিস মায়াকে?”
মেয়ের জন্য চিন্তাটা রাশেদ চৌধুরির কন্ঠেই প্রকাশ পাচ্ছে।তাচ্ছিল্যর স্বুরে হাসে আরিয়ান।তারপর যথেষ্ট গাম্ভীর্য রেখে বলে,
—“প্রথমটা ঠি কই ধরেছিস।হ্যাঁ,তোর মেয়ে আমার কাছেই আছে।…তবে দ্বিতীয় ধারণাটা ভুল…
আরিয়ানের কথার মাঝেই গর্জে উঠে রাশেদ।
—“আমার মেয়ের গায়ে যদি একটা আঁচরও পরে তুই দেখিস আরিয়ান।পরিণাম ভালো হবেনা।আমি..।
—“ওই চুপ,তোর কি মনে হয় তোর মেয়েকে আমি রেপ করবো?নিজের মতো ভাবিস সবাইকে?দিনে যে হাজারটা মেয়ের জীবন নষ্ট করিস,খেলনার বস্তু মনে করিস তখন খেয়াল থাকেনা?ওরাও কারো সন্তান?…।
—“ওইসবের সাথে আমার মেয়ের কোন তুলনা হয়না।”
পাশে রাখা একটা কাঁচের শো পিস সজোরে আছাড় মারে আরিয়ান।ঘৃনায় গা ঝাঁ ঝাঁ করছে তার।ঘাড় ঘুড়িয়ে কাঁচের দরজার ভেতর দিয়ে একবার মায়াকে দেখে নেয়।তার আওয়াজে আবার ঘুম ভেঙে গেল নাকি ওর।নাহ্,মায়া গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে।হাত বাড়িয়ে দরজাটা সম্পূর্ণ আটকে দিয়ে পুনরায় বলে সে,
—“আরিয়ান খান তোর মতো কাপুরুষ নয় যে মেয়েদেরকে শত্রুতার মাঝে টেনে আনবে।আজকে আমি না বাঁচালে তোর মেয়ের অবস্থা কি হত সেটা আর বলার প্রয়োজন বোধ করছিনা।একটা শ্বাস ফেলে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করে আরিয়ান তারপর স্বাভাবিক কন্ঠে বলে,তোর মেয়ের সাথে আমার কোন শত্রুতা নেই।কাল পৌছে যাবে বাসায়”।বলেই খট করে ফোনটা কেটে দেয়।
রাশেদ চৌধুরি ধপ করে সোফায় বসে পরে।তার সবচেয়ে বড় শত্রু হওয়ার পরও সে জানে আরিয়ান কেমন।
একবার যখন আরিয়ান বলেছে তার মেয়ের কোনো ক্ষতি হবেনা;মানে হবেনা।তার সিদ্ধান্তে সবসময় অনড় থাকে আরিয়ান।এজন্যই শত্রু হিসেবেও আরিয়ানকে পছন্দ তার।এ যেন বাঘে বাঘে লড়াই।
রুমে যায় আরিয়ান।একদৃষ্টিতে মায়ার ঘুমন্ত মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে।ভাবে,রাশেদ চৌধুরির মতো জঘন্য একটা লোকের মেয়ে এতটা ইনোসেন্ট কিভাবে হতে পারে?কি নিষ্পাপ,মায়াবী হয়ে ঘুমিয়ে আছে।
————
সকালে ঘুম ভাঙে মায়ার।আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে সে।
তখনই রুমে প্রবেশ করে আরিয়ান।তার পরণে ফর্মাল গেট-আপ।মায়াকে বসে থাকতে দেখে সে এগিয়ে যায়।
প্যাকেট থেকে ওড়নাটা বের করে মায়ার কোলের ওপর রেখে হাল্কা কেঁশে বলে,
—“পড়ে নাও”।
মায়া কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে তাকায়।এতটা সময় সে এই অবস্থায় ছিলো অথচ তার খেয়ালই নেই।এত গাধা কেন ও!লোকটা না জানি কি ভাবছে।লজ্জায় লাল হয়ে দ্রুত ওড়নাটা গায়ে জড়ালো।আরিয়ান তখন আয়নার সামনে দাড়িয়ে ঘড়ি পরছে।এলোমেলো চুলগুলো হাতখোপা করতে করতে বিছানা থেকে নেমে এক পা ফেলতে নিলেই হাঁটুর ব্যাথায় ককিয়ে উঠে মায়া।পরে যেতে নিলেই শক্ত হাতে তাকে ধরে ফেলে আরিয়ান।একহাত কোমড়ে আর একহাত হাতের বাহুতে।তাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ধমকে উঠে বলে,
-“একা উঠতে গেলে কেনো?জানোনা পায়ে ক্ষত?স্টুপিড!!
আরিয়ানের রাম ধমকে ফুঁপিয়ে উঠে মায়া।এত জোরে ধমক তো দুরের কথা কখনো কেউ তাকে বকেওনি।চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরে তার।
—“Why are you crying?ব্যাথা হচ্ছে বেশি?…মায়া উওর না দেয়ায় আবারো উঁচু গলায় বলে,কথা বলছোনা কেন?
মায়া কাঁদতে কাঁদতেই বলে,
—“আপনি আমাকে বকছেন কেন?”
।
আরিয়ান হতভম্ব হয়ে যায়।সামান্য ধমকানোয় মেয়েটা এভাবে কাঁদছে।এই মেয়ে কি আসলেই এতোটা বোকাসোকা নাকি অভিনয় করছে।রাশেদ চৌধুরির মেয়ে এতোটা ভালো কি করে হয়?
গলার স্বর নামিয়ে সে বলে,
—“আচ্ছা,ফাইন।বকবোনা আর।এবার কান্না বন্ধ কর।
মায়া কান্না থামিয়ে দেয়।আরিয়ান জুতো বের করে নিচে রাখো।ইশারায় মায়াকে পরে নিতে বলে।বিনাবাক্য মায়া জুতো গুলো পরে নেয়।সাইজ একটু বড় তবে ভালো হয়েছে ব্যান্ডেজে লাগছে না।পকেটে ফোনটা আর রিভলবার টা ডুকিয়ে কাছে এসে আচমকাই মায়াকে কোলে তুলে নেয় আরিয়ান।মায়া ব্যালেন্স রাখতে হুট করে দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরে আরিয়ানের।সচকিত হয়ে বলে,
—“কি করছেন?”
আরিয়ান হাঁটতে হাঁটতে বলে,
—“হাঁটতে পারবেনা এখন।আর এতো প্যানিক হওয়ার কিছু নেই।কালও তোমাকে কোলে করেই এনেছি।উড়ে উড়ে আসোনাই।”
মায়া চুপ হয়ে যায়।কথার পিঠে বলার মতো কিছু খুঁজে পায়না।তবে অসস্তি হয় তার।ঘোর অসস্তি।
আরিয়ান এসে গাড়িতে বসিয়ে দেয় তাকে।নিজেও তার পাশে বসে ড্রাইভারকে গাড়ি স্টার্ট দিতে বলে।তন্ময় বসেছে ড্রাইভারের পাশে।আরিয়ান আর মায়াকে দেখে মুচকি হাসে সে।আরিয়ান তখন ফোনে ব্যস্ত।
জামাকাপড় টেনে ঠি কঠাক হয়ে বসে মায়া।তাকিয়ে থাকে জানালার বাইরে।তার ভাগ্য অনেক সহায় এতো ভালো মানুষের কাছে এসেই সাহায্য চেয়েছিলো সে।
দীর্ঘক্ষন পর গাড়ি থামে রাশেদ চৌধুরি বাড়ির সামনে।রাশেদ চৌধুরি ইশারায় দরজা খুলে দিতে বলে।একটানে গাড়ি ঢুকে যায় তাদের বাড়ির ভেতর।আড়িয়ান বাঁকা হাসে…..
চলবে…