#আঁধার_ভিড়ে_সন্ধাতারা❤️
#লেখিকা-মালিহা_খান❤️
#পর্ব-২২
সকালে মেসেজের টুংটাং শব্দে ঘুম ভাঙে আরিয়ানের।শান্তিময় নিদ্রায় হঠাৎ ব্যাঘাতে মেজাজ খারাপ হয়ে আসে।চোখ খুলতেই নজরে আসে মায়ার ঘুমন্ত মায়াবী মুখশ্রী।তার দিকে মাথা খানিকটা কাত্
করে রেখেছে মায়া।ফলস্বরূপ মায়ার ঠোঁটগুলো তার ঠোঁটের সাথে একেবারেই ছুঁই ছুঁই অবস্থায় আছে।পরমূহুর্তেই মুখের বিরক্তিকর আভাস বদলে ঠোঁটের কোঁণে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো আরিয়ানের।তার একটা হাত মায়ার গলার নিচ দিয়ে দেয়া।আরেকহাত মায়ার পেটের উপর রাখা যেটা মায়া শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে।
হাত বাকিয়ে আলতো করে মায়ার মুখের উপর আসা এলোমেলো চুলগুলো আঙ্গুলের ছোঁয়ায় সরিয়ে দেয় সে।অত:পর খুব সন্তর্পণে গলার নিচ থেকে হাতটা বের করে নিয়ে আসে।ঘুমের ঘোরে হাল্কা একটু নড়েচড়ে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আবার ঘুমিয়ে পরে মায়া।আরিয়ান একটা ফাঁকা ঢোক গিলে।মায়ার ঠোঁটের দিকে নেশাক্ত দৃষ্টিতে তাকায়।
হঠাৎ ফোনের রিংটন বেজে উঠে।চোখেমুখে আবারো বিরক্তি খেলা করে।ফোনটা মায়ার পাশে রাখা।আরিয়ান দ্রুত মায়ার উপর দিয়ে ঝুকে গিয়ে ফোনটা হাতে নেয়।ফোনের আওয়াজে পিটপিট করে তাকায় মায়া।আরিয়ানকে তার উপর দিয়ে ঝুকে থাকতে দেখে ঘুমঘুম কন্ঠে বলে,
—“কি করছেন?”
মায়ার কন্ঠে ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে ফোনটা সাইলেন্ট করে আরিয়ান।সে চাচ্ছিল মায়া যেন না উঠে।
সেই ঘুম ভেঙেই গেল তার।উপর থেকে সরে গিয়ে উঠে বসে সে।সেকেন্ডে ফোনের মেসেজগুলোয় একবার চোখ সে বুলিয়ে নেয়।মায়ার ধরে রাখা হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে পরপরই আবার ঝুঁকে গিয়ে মায়ার একগালে হাত রেখে অপর গালে ঠোঁটের ছোয়াঁ দিয়ে বলে,
—“ঘুমাও তুমি।ব্রেকফাস্টের সময় হলে আমি ডেকে দিবোনে”।
বলে গায়ের কম্বল সরিয়ে উঠে পরে আরিয়ান।
—“এই সকালে কোথায় যাচ্ছেন?”
—“একটু কাজ আছে।”
ফোনটা টাউজারের পকেটে ঢুকিয়ে কাবার্ড থেকে কিছু কাগজ বের করে দরজা আটকে বেরিয়ে যায় আরিয়ান।
আরিয়ানের বেরিয়ে যাওয়ার পর অলস ভঙ্গিতে মাথার ব্যান্ডেজটায় হাত বুলায় মায়া।এখন আবার ব্যাথা করছে জায়গাটা।এরপর হাতটা নিজের অজান্তেই গালে চলে যায়।যেখানটায় একটু আগে চুমু খেয়েছে আরিয়ান।মায়া মুচকি হাসে।প্রথমবার তার গালে চুমু দিয়েছে উনি।এর আগে শুধু কপালেই ঠোঁট ছোয়াঁতো।হাহ্।এত তাড়াহুড়ো করে কোথায় গেলো কে জানে?কোন ঝাঁমেলা হয়নি তো?
———–——–
নিচে নামতেই তন্ময় দ্রুত এগিয়ে এসে তার হাতে খবরের কাগজ দিয়ে বললো,
—“ভাই,দেখেন।”
আরিয়ান পেপারটা হাতে নিয়ে দেখল ফ্রন্ট পেইজেই তার আর মায়ার ছবি।একপাশে সে মায়াকে কোলে নিয়ে রেখেছে আর আরেকপাশে রাস্তায় যখন মায়াকে সে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলো তখনের ছবি।
হেডলাইনে বড় বড় করে লেখা,”আরিয়ান খানের গোপন বিয়ে ফাঁস।”তার একটু নিচে তুলনামূলক ছোট্ট অক্ষরে লেখা-“কে এই মেয়ে?যাকে নিজের স্ত্রী বলছে আরিয়ান খান।প্রমান চাওয়ায় সাংবাদিককে প্রকাশ্য হুমকি আরিয়ান খানের”
তারপর বিশাল বিস্তৃতি নিয়ে প্রায় আধা-পেইজ জুড়ে লেখা হয়েছে।তেল-মশলা মিশিয়ে গতরাতের মূল ঘটনার সাথে আরো একটু রঙচঙ মেরে নিউজ ছাপানো হয়েছে।
আরিয়ানের সেগুলো পড়ার রুচি হয়না।তন্ময়ের দিকে পেপারটা এগিয়ে দিয়ে শীতল কন্ঠে বলে,
—“বাইরে কারা এসেছে?”
—“দু’জন জার্নালিস্ট,মনে হচ্ছে নিউজ চ্যানেলের।”
আরিয়ান তাদের কাবিননামাটা তন্ময়কে দিয়ে বলে,
—“এটার ছবি চ্যানেলগুলোতে প্রকাশ করে দে”।আর বাইরে যারা এসেছে তাদের কেও দিয়ে দিস।”
তন্ময় মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে যায়।আরিয়ান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উপরে উঠতে থাকে।ফোন বেজে উঠে আবারো।
না দেখেই বুঝতে পারছে কে ফোন করেছে।মনে মনে কথাগুলো সাজিয়ে ফোনটা রিসিভ করলো।ওপাশ থেকে ভারি গলায় একজনের কন্ঠ শোনা গেলো,
—“এসব কি শুনছি আরিয়ান?তুমি বিয়ে করলে?আমাদেরকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলে না?আমি,তোমার মামী কতটা কষ্ট পেয়েছি জানো?”
আরিয়ান ঠোঁট কামড়ে বললো,
—“মামা শান্ত হও।আমি বলছি তোমাকে”।
—“কে?ওই মেয়েটা কে?আমাদের বললে কি আমরা অমত করতাম?শত বলেও তো তোমাকে বিয়ে করাতে পারিনি।আর এখন তুমি আমাদের না জানিয়েই,,,,”
আরিয়ান হতাশভাবে বলে,
—“মামা,আমাকে বলার সুযোগটা তো দিবে।”
—“কতদিন হয়েছে বিয়ের?এতদিনেও বলার সুযোগ হয়নি তোমার।আর এখন সবাই জানার পর আমাকে বলার জন্য সুযোগ খুঁজছো তুমি।”
—“বিয়ের একদিনও হয়নি মামা।মাত্র একরাত হয়েছে।”
—“মানে?”
অত:পর সবকিছু খুলে বলে আরিয়ান।নিজের মামার কাছে কোনকিছুই গোপন করার নেই তার।একদম প্রথম থেকে সবটা শোনার পর মাথায় আকাশ ভেঙে পরে সজীব খানের।সব ছেড়ে রাশেদ চৌধুরির মেয়েকেই বিয়ে করতে হলো আরিয়ানের।গম্ভীর গলায় বলে,
—“তাই বলে তুমি রাশেদের মেয়েকে বিয়ে করলে?”
—“মায়া রাশেদ চৌধুরির মেয়ে এই পরিচয়টার থেকে সে আমার স্ত্রী এটাই কি যথেষ্ট নয়?”
—“আরিয়ান তুমি ভুলে যাচ্ছো,রাশেদ চৌধুরি তোমার মা-বাবার সাথে কি করেছিলো।
—“আমি কিছুই ভুলিনি মামা।তবে সেটার সাথে তো মায়ার কোন যোগসূত্র নেই।মায়া তো কিছু করেনি মামা।
বাবার কুকর্মের শাস্তিতো আমি মেয়েটাকে দিতে পারিনা।তাইনা?”
—“আমি কিছু জানিনা আরিয়ান।তুমি আজই মেয়েটাকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসবে।তারপর এ বিষয়ে কথা হবে।”
আরিয়ান শক্ত কন্ঠে বলে,
—“এ বিষয়ে বলার মতো কিছু নেই মামা।আর মায়ার সামনে এ বিষয়ে কোন কথা হবেনা।ও খুবই সহজ সরল একটা মেয়ে।আমি চাইনা ও এসব নিয়ে আপসেট হোক।তোমরা যদি আমার স্ত্রী হিসেবে ওর সাথে দেখা করতে চাও,তবে অবশ্যই আমরা আসবো।”
সজীব খান একটু শিথিল হয়।গলার স্বর নরম করে বলে,
—“তুমি কি বলতে চাচ্ছো আমি বুঝতে পারছি আরিয়ান।তোমার যদি ওকে পছন্দ হয় তবে আমাদের কোন সমস্যা নেই।তোমার পছন্দ নিশ্চয় খারাপ হবেনা।তুমি যা করেছো ভেবে চিন্তেই করেছো আমি জানি।”
আরিয়ান কোন উওর দেয়না।সজীব খান আবার বলে,
—“আজকে কি আসবে এই বাসায়?”
—“মায়াতো একটু অসুস্থ মামা।কাল সিঁড়ি থেকে পরে গিয়েছিলো।তবুও আমি আসার চেষ্টা করবো।”
—“আচ্ছা ঠিকাছে।রাখছি তাহলে?
—“আল্লাহ হাফেজ।”
ফোন রেখে ঘড়ির দিকে তাকায় আরিয়ান।দশটা বেজে গেছে।
রুমে যেতেই দেখে মায়া চোখ খুলেই শুয়ে আছে।আরিয়ান এগিয়ে গিয়ে ফোনটা বিছানায় রাখলো।
মায়া একহাতে ভর দিয়ে উঠে বসলো।
—“ইতিকে একটু ডেকে দিবেন?আমি চেন্জ করবো।একা তো পারবোনা।”
—“চেন্জ করবে?ব্যান্ডেজ তো খুলতে হবে তাহলে।ব্যাথা করছে হাতে এখনো?নয়তো ব্যাগটা খুলে দেই”
—“অতো ব্যাথা নেই।সমস্যা হবেনা।”
আরিয়ান পাশে বসে খুব যত্ন করে হাতের বাঁধা ব্যাগটা খুলে রাখে।যেটা দিয়ে গলার সাথে এটাচ্ করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিলো হাতটা।একটা বালিশ এনে কোলে রেখে তার উপর মায়ার ব্যান্ডেজ করা হাতটা রাখে।
।।
ইতির সাহায্য বহুকষ্টে জামা বদলে নেয় মায়া।
ব্রেক-ফাস্ট শেষে আবারো রুমেই এসে বসেছে মায়া।আরিয়ান অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে।মুখ লটকিয়ে বসে আছে সে।
মায়ার এমন চেহারা দেখে আরিয়ান বলে,
—“কি হয়েছে?শরীর খারাপ লাগছে?”
মায়া কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে,
—“আমাকে আপনার সাথে অফিসে নিয়ে যাবেন?”
~চলবে~
#আঁধার_ভিড়ে_সন্ধ্যাতারা❤️
#লেখিকা-মালিহা_খান❤️
#পর্ব-২৩
আরিয়ান ভ্রু কুচকায়।পরণের কালো রংয়ের শার্টের হাতা কুনুই পর্যন্ত উঠাতে উঠাতে বলে,
—“তুমি অফিসে যেয়ে কি করবে?”
মায়া এতক্ষন উৎসুক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে ছিলো।মনের মতো উওরের জায়গায় পাল্টা প্রশ্নে কিছুটা হতাশ হলো সে।চোখে মুখে যথাসম্ভব অসহায়ত্ব ফুটিয়ে কাতর কন্ঠে বললো,
—“আমার ভালোলাগেনা বাসায়।একা একা লাগে।”
—“একা একা কোথায়?ইতি আছেতো।”
আরিয়ানের উওরটা বিশেষ পছন্দ হয়নি মায়ার।সে তড়িৎ গতিতে বলে,
—“আপনি নিয়ে যাবেন নাকি না?”
আরিয়ান উওর না দিয়ে ফোনটা পকেটে ঢুকায়।ধীরে সুস্থে হাতের ঘড়িটা পরে নেয়।চুলগুলো ব্রাশ করে।তাকে দেখে মনেই হচ্ছেনা মায়ার প্রশ্নটা আদৌ তার কানে গেছে।মায়া উশখুশ করে।কিছুক্ষন পর অধৈর্য হয়ে বলে,
—“আপনি কি আমার কথা শুনতে…”
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই আরিয়ান ঘুরে গিয়ে তার বাহু ধরে উঠায়।নিজের পিঠ বরাবর দাড় করিয়ে পেছন থেকে দু”হাতে পেট জড়িয়ে ধরে।
মায়া বেকুব বনে যায়।হঠাৎ এমন কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলোনা সে।মুহুর্তেই লজ্জা নেমে আসে সারা মুখে।
আরিয়ান তার কাঁধে নাক ঘঁষতে ঘঁষতে ফিসফিসিয়ে বলে,
—“বাসায় ভালো লাগেনা নাকি আমাকে ছাড়া ভালো লাগেনা?”
মায়া কেঁপে উঠে।আধো আধো লজ্জামিশ্রিত কন্ঠে বলে,
—“সেরকম কিছু না।..ছাড়ুনতো।”
—“কেন ছাড়বো?”হুম?বলে মায়ার কানের একটু নিচে গভীরভাবে চুমু এঁকে দেয় আরিয়ান।”
মায়া লাফিয়ে উঠে।খিলখিলিয়ে হেসে দিয়ে বলে,
—“উফ্।সুড়সুড়ি লাগছে।মুখ সরান প্লিজ।
আরিয়ান মুখ উঠিয়ে ফেলে।মায়ার কাঁধের সরে যাওয়া ওড়না ঠি ক করে দিয়ে তাকে ছেড়ে দাড়ায়।
মায়া হাফ ছেড়ে বাঁচে।এখনো মনে হচ্ছে,ওখানে কেউ সুড়সুড়ি দিচ্ছে।ছোটবেলা থেকেই তার প্রচন্ড সুড়সুড়ি লাগে।আর স্পর্শকাতর জায়গাগুলোতে তো সবচেয়ে বেশি।
—“আসো,দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
বলে মায়ার হাত ধরে তাকে নিয়ে বেরিয়ে যায় আরিয়ান।মায়ার মুখে হাসি ফুটে উঠে।তারমানে তাকে সাথে নিয়ে যাবে আরিয়ান।
———––——
আরিয়ানের কেবিনে আরিয়ানের পাশে আরেকটা চেয়ার রাখা হয়েছে।সেটাতেই দুই পা ভাঁজ করে আরাম করে বসে রয়েছে মায়া।তার মাথাটা আরিয়ানের হাতের বাহুতে হেলান দাওয়া।চোখ ল্যাপটপের স্ক্রীনে নিবন্ধ।আরিয়ান সেদিকে মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছে।অন্য কোনোদিকে যেন খেয়ালই নেই তার।মায়াও কিছু বলছেনা।মূলত আরিয়ানকে বিরক্ত করতে চাচ্ছেনা সে।
খানিক পরে পাশ থেকে ধোঁয়া উঠা কফির মগে হাতে নিলো আরিয়ান।তারপর মায়ার দিকে না তাকিয়েই মগটা একটু সামনে ধরে বললো,
—“খাবে?”
মায়া আপত্তি করে বললো,
—“নাহ্,আপনি খান।এঁটো হয়ে যাবে।”
আরিয়ান নির্বিকার ভঙ্গিতে মায়ার ঠোঁটে মগটা ঠেকিয়ে ধরল।মায়া মুখ খুলছেনা দেখে হাল্কা একটু চেপে ধরলো।এবার হা করলো মায়া।এক চুমুক খেয়ে বললো,
—“আপনি খাবেন না?”
আরিয়ান আবারো তাকে আরো এক চুমুক খাইয়ে দিয়ে বললো,
—“আবার আনিয়ে নিবো নে।তুমি খাও।”
চুপচাপ আরিয়ানের হাত থেকে কফি খেতে লাগলো মায়া।অর্ধেক খেয়ে বললো,
—“আর খাবো না”।
আরিয়ান মগ সরিয়ে নিলো।ল্যাপটপে কিছু একটা টাইপ করতে করতে মগের বাকি অর্ধেক কফিতে চুমুক দিতেই মায়া আৎকে বললো,
—“আরে এটা আমার এঁটোতো..”
—“তো?”
মায়া কিছু বলার জন্য মুখ খুলেও চুপ হয়ে গেল।আরিয়ানের এটা একটা অদ্ভুত ক্ষমতা।কথা দিয়েই মানুষকে চুপ করিয়ে দিতে পারে।অন্তত তাকে তো অবশ্যই।
মায়া কোন উওর দিচ্ছেনা দেখে আরিয়ান এক চুমুকে অবশিষ্ট কফিটা শেষ করে ধীর কন্ঠে বলে,
—“এই কফির স্বাদ আমার জন্য কি তা তোমার বুঝে আসবে না মায়াবতী।”
॥॥
হুট করে নক না করেই কেউ একজন কেবিনে প্রবেশ করে।মায়া চমকে তাকায়।সামনে একটা ছেলেকে দেখতে পেয়ে দ্রুত পা নামিয়ে ঠিক করে বসে সে।ছেলেটার পরণে ক্যাজুয়াল গেট-আপ। ব্লু কালার টি-শার্টের সাথে ব্ল্যাক জিন্স।উজ্জ্বল শ্যামলা গড়নের সুদর্শন একটা ছেলে।কিন্তু ছেলেটা এমন নক না করেই ঢুকলো কেনো?দেখেতো ইম্পলোয়ি মনে হচ্ছেনা।
আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে চোখ-মুখ শক্ত করে রেখেছে।রাগে হাতগুলো মুঠো করা।চোখ লাল হয়ে আছে।আরিয়ান কিছু বলার আগেই ছেলেটা মায়ার দিকে হাত বাড়িয়ে সহাস্যমুখে বললো,
—“ভাবি,নিশ্চয়ই?কেমন আছেন?”
মায়া টেবিলে রাখা হাত গুটিয়ে নিল।আরিয়ানের দিকে একবার তাকিয়ে আমতাআমতা করে বললো,
—“ভা..ভালো।”
ছেলেটা বাড়িয়ে রাখা হাতটা সরিয়ে নেয়।আরিয়ান শীতল কন্ঠে বলে উঠে,
—“কোন সাহসে এখানে এসেছিস রাহাত?”
—“আহা,এতো রেগে যাচ্ছো কেন ভাইয়া?আমি তো আমার এই চিনির মতো মিষ্টি ভাবিটাকে দেখতে এলাম।মানতে হবে ভাইয়া,ভাবি ইস্ সো হ…
আরিয়ান সজোরে চেয়ার ছেড়ে উঠে রাহাতের কলার চেপে ধরে।
—“ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট রাহাত।মামা-মামির দিকে তাকিয়ে তোকে কিছু বলিনা বলে এটা ভাবিসনা তোর সব কিছু সহ্য করবো।মায়ার ব্যাপারে একটা কথাও যদি তোর মুখ দিয়ে বের হয়…I swear,মামা-মামির ব্যাপারে ভুলে যাবো আমি।”
রাহাতও গর্জে উঠে বলে,
—“তুমি তাদের মনেই রেখেছিলা কবে?তাদের কথা ভাবলে তুমি অন্তত আমার সাথে ওই…।
ততক্ষনে তন্ময় চলে এসেছে।মায়া হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে আছে।তন্ময় একবার মায়ার দিকে তাকিয়ে দ্রুত রাহাত কে আরিয়ানের থেকে ছাড়িয়ে নেয়।
—“ওকে নিয়ে যা তন্ময়।আমি কিন্তু কিছু একটা করে ফেলবো।
তন্ময় মাথা নাড়ায়।রাহাত নিজেই ঝামটা মেরে তন্ময়কে ঠেলে দিয়ে।নিজের কলার ঠিক করে বলে,
—“আমিই যাচ্ছি।তারপর একটু হেসে হাত নাড়িয়ে বলে,”গুড বাই ভাবি।সি ইউ সুন।”
মায়া থতমত খেয়ে দাড়িয়ে থাকে।প্রতিত্তরে কিছু বলেনা।রাহাত-তন্ময় বেরিয়ে যেতেই আরিয়ান জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নেয়।ঢকঢক করে এক-গ্লাস পানি খেয়ে ফেলে।
কিছুটা শান্ত হতেই মায়া তাকে জিজ্ঞেস করে,
—“উনি কে ছিলেন?”
—“আমার মামার ছেলে।”
—“ওহ্,আপনার মামাতো ভাই?”
—“নো,আমার ভাই না ও।ওর মতো একটা ছেলে কখনোই আমার ভাই হতে পারেনা।কখনো ওকে আমার ভাই বলবেনা।”
আরিয়ানের এমন রাগের কারণ বুঝলোনা মায়া।আর কিছু বলার সাহসও হলোনা তার।চুপচাপ বসে রইলো সে।
————––
গাড়ির পিছের সিটে আরিয়ানের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে মায়া।আরিয়ান সযত্নে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।বাইরে গাঢ় সন্ধ্যা নেমে এসেছে।তন্ময় গাড়ি ড্রাইভ করছে।
গাড়ি থামে নির্জন জায়গায়।ঘুটঘুটে অন্ধকার চারপাশে।কোলাহল নেই কোনো।তন্ময় নি:শব্দে গাড়ি থামিয়ে বেরিয়ে যায়।আরিয়ান মায়াকে সিটে শুইয়ে দেয়।মেয়েটা গভীর ঘুমে আছে।
গাড়ির সব জানালা দরজা লক করে দিয়ে সেও নি:শব্দে বেরিয়ে যায়….
~চলবে~
#আঁধার_ভিড়ে_সন্ধ্যাতারা❤️
#লেখিকা-মালিহা_খান❤️
#পর্ব-২৪
আধমরা অবস্থায় অন্ধকার রুমে পরে আছে একটা ছেলে।মুখ বাঁধা নেই।হাত পাও বাঁধা নেই।তবুও দু-দিন না খেয়ে থাকায় উঠার অবস্থা নেই তার।হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ হয়।ছেলেটা একবার তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে।শরীরে কোন শক্তি নেই।একটু পানি পেলে বেশ হতো।
দরজা খুলে প্রবেশ করে আরিয়ান।পেছনে পেছনে তন্ময় ঢুকে হাল্কা বাতির সবুজ লাইটটা জালিয়ে দেয়।
ঘরটা কেমন একটা ভয়াবহ রুপ ধারণ ধারণ করে।ছেলেটা বহুকষ্টে উঠে বসে।আরিয়ান শান্ত কন্ঠে বলে,
—“কেমন আছো জার্নালিস্ট জীবন মাহমুদ?”
জীবন আধো আধো চোখে একবার তাকালো।মৃদু গলায় বললো,
—“এক..একটু…পা…পানি..
আরিয়ান একটু হেসে বললো,
—“তন্ময় ওকে পানি দে।ঠান্ডা পানি খাবে নাকি গরম পানি?
জীবন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালো।চোখে মুখে ভয় স্পষ্ট।আরিয়ান এখন ও তার দিকে উওরের আশায় চেয়ে আছে।জীবন কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না।আরিয়ান তার সামনে এক হাঁটু ভাঁজ করে বসলো।তন্ময় কোথা থেকে যেন একটা ঠান্ডা পানির বোতল এগিয়ে দিলো।আরিয়ান সেটা হাতে নিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে বললো,
—“এখন চুপ যে?ওইদিন তো খুব কথা বলছিলে।আমাকে ছাপিয়ে মায়াকেও প্রশ্ন করছিলে।জঘন্য সব প্রশ্ন।
ভুলে গেলে নাকি জার্নালিস্ট জীবন?”
—“স্যা..স্যার,মাফ করে দেন স্যার।আমার…ভুল হয়ে গেছে।”
আরিয়ান চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে,
—“কিন্তু আমি যে এতোটা উদার না।এতটা দয়ালু ও না।কি করা যায় বলোতো?আচ্ছা সেসব পরে,আগে তুমি পানি খাও।নাও,এ্যান্ড ডোন্ট ওয়ারি,এটায় কিছু মিশানো নেই”
বলে ছেলেটার হাতে পানি ধরিয়ে দিল আরিয়ান।জীবন হুড়মুড় করে পুরো পানির বোতল খালি করে ফেললো।অনেক বেশি পিপাসু ছিলো সে।এখন একটু অভয় লাগছে তার।
—“ধন্যবাদ স্যার।আমি আসলে সেদিন না বুঝেই…”
—“এই পৃথিবীতে সবাই বুঝেই সবকিছু করে জীবন।নিজের সার্থের জন্য,সবাই স্বার্থপর।সবাই।
আরিয়ান শব্দ করে হেসে,পরমূহুর্তেই চোখমুখ শক্ত করে ফেলে।জীবন আবারো ভয় পেয়ে যায়।আরিয়ানের গতিবিধি বুঝতে পারছেনা সে।
আরিয়ানের ইশারা করার আগেই তন্ময় দরজাটা ভিড়িয়ে বেরিয়ে যায়।সে জানে এখন কি হবে।
নিশব্দে হেটে সে গাড়ির পাশে এসে দাড়ায়।চাঁদ উঠেছে।চারদিকের অন্ধকার সেই আলোর কাছে ফিঁকে হয়ে গেছে।চাঁদের আলোয় গাড়ির কাঁচের ভিতর দিয়ে মায়াকে দেখা যাচ্ছে।মুখের উপর চুলের কারণে চেহারা দেখা যাচ্ছেনা মেয়েটার।তন্ময় মৃদু হেসে চোখ সরিয়ে নেয়।আরিয়ান মেয়েটাকে অতিরিক্ত ভালোবাসে।অতিরিক্ত বলতে ভয়ানকভাবে অতিরিক্ত।আরিয়ানের এই হিংস্র রুপটা মায়া যদি দেখতো তখন সে কি করতো?তার মতোই ভয় পেতো নিশ্চয়ই।আরিয়ান যখন হিংস্র হয়ে উঠে তখন সে নিজেই ভয় পেয়ে যায় আর সেখানে মায়া তো ভয়ে অজ্ঞানই হয়ে যেতো।মেয়েটা যে ভীতু!!দীর্ঘ:শ্বাস ছাড়ে তন্ময়।সে কখনো ভাবেওনি আরিয়ান কাউকে এতোটা ভালোবাসবে।হাহ্।
জীবন ভয়ে কাঁপছে।আরিয়ানের হাতে একটা ধারালো ছুরি চকচক করছে।একদম নতুন বোঝাই যাচ্ছে।
আরিয়ান ছুড়িটায় নিজের আঙ্গুল স্লাইড করতেই আঙ্গুলের ডগা কেটে রক্ত বেরিয়ে এলো।আরিয়ান রক্তের দিকে তাকিয়ে বললো,
—“তোকে আমি কিছুই করতাম না বুঝলি?কিন্তু ওইয়ে তুই মায়াকে প্রশ্ন করেছিলি।আমি ওকে জোড় করিনা কিনা,একসাথে থাকি কিনা সেসব জিজ্ঞেস করছিলি।তুই জানিস মায়া কতটা কেঁদেছিলো?ডু ইউ হেভ্ এনি আইডিয়া?”
জীবন বুঝতে পারছে তার আর বাঁচার কোন চান্স নেই।তাই সে মুখ দিয়ে টু শব্দ টাও করলোনা।আরিয়ান বাঁকা হেসে গালের ভিতর দিকে সজোরে ছুড়ি ঢুকিয়ে দিলো।চোখ বড় বড় হয়ে গেলো জীবনের।ছুড়িটা একটানে বের করে অপরপাশের গাল দিয়ে ঢুকিয়ে দিলো আরিয়ান।যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে চোখ বুজে এলো জীবনের।আরিয়ান আরেকটা ছুড়ি তার বুক বরাবর ঢুকিয়ে দিয়ে সরে এলো।তারপর সময় নষ্ট না করে ঘরের লাইট নিভিয়ে বেরিয়ে এলো।
——————
বাসায় এসে মায়াকে কোলে করেই রুমে নিয়ে আসলো আরিয়ান।বিছানায় সুইয়ে দেয়ার আগেই চোখ খুললো মায়া।কিছু বলার আগেই আরিয়ান তাকে বসিয়ে দিয়ে বললো,
—“গাড়িতে ঘুমিয়ে পরেছিলে মায়াবতী।তাই আর ডাকিনি।এখন যখন উঠেই গিয়েছো আমি ইতিকে ডেকে দিচ্ছি।চেন্জ করে ফ্রেশ হয়ে নাও।ঠিকাছে?”
মায়া উপরনিচে মাথা নাড়ায়।আরিয়ান তার কপালে চুমু খেয়ে বেরিয়ে যায়।
॥॥
মায়ার পরণে ঢিলেঢালা সাদা রংয়ের লং ফ্রক।ধবধবে ফর্সা গায়ে সাদা রংটা যেন একটু বেশিই মানিয়েছে।ইতি একটু আগেই তাকে রাতের খাবার খাইয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেছে।যেহেতু তার ডানহাতে ব্যান্ডেজ তাই নিজে খেতে পারেনা।দুদিন যাবত ইতিই খাইয়ে দিচ্ছে।
এখন আর ঘুম আসছেনা।বিছানা ছেড়ে উঠে যায় মায়া।আরিয়ানের ঘরের কোঁণে একটা কাঁচের শোকেসের মতো আছে।সেটার মাঝের তাঁকে একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি।একটা মেয়ে পাশে একটা লোক দাড়ানো।মেয়েটার কোলে একটা বাচ্চা।অদ্ভুত সুন্দর হাসি মেয়েটার।মায়া কাঁচ খুলে ছবিটা বের করে।
এরা নিশ্চয় আরিয়ানের মা-বাবা।আর কোলে আরিয়ান।মায়ার চোখ ভরে উঠে।এই সুন্দর পরিবারটাকে তার বাবা শেষ করে দিয়েছে।
সেসময়ই আরিয়ান পিছন থেকে বলে উঠে,
—“ওখানে কি করছো মায়া?”
মায়া চোখের জলটা মুছে নিয়ে পেছনে না ফিরেই বলে,
—“উনারা আপনার মা-বাবা তাইনা?যাদের সাথে আমার বাবা…”
আরিয়ান দ্রুত এগিয়ে যায়।মায়ার চোখে পানি না থাকলেও সে বুঝে মায়া কাঁদছিলো।ছবিটা নিয়ে সে একবার হাত বুলায়।তারপর সাবধানে ছবিটাকে জায়গামতো রেখে দিয়ে বলে,
—“আমার কাছে আব্বু-আম্মুর এই একটা ছবিই আছে,যেটা আমি সবসময়ই নিজের সাথে নিয়ে যেতাম।সেবার মামার বাড়িতেও সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম।এজন্যই এটা এখনো আমার কাছে আছে।বুঝলে?”
—“হুম”।মায়া কথা বাড়ায়না।কথা বললেই কেঁদে দিবে।আর আরিয়ানের সামনে কেঁদে তাকে রাগাতে চাচ্ছেনা সে।
______________
ব্যালকনিতে দাড়িয়ে আছে আরিয়ান।একটা জরুরি বিষয়ে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে।মায়া রুমে।রাত হয়েছে কিন্তু মেয়েটার চোখে ঘুম নেই।ঘরের লাইট জ্বালানো।মায়া বসে আছে বিছানায়।
অনেকক্ষণ যাবত ফোনে কথা বলছে আরিয়ান।বিছানায় বসে সেদিকেই তাকিয়ে রয়েছে মায়া।আরিয়ানের কথা বলার স্টাইলটা খুব সুন্দর।মায়া নিজে নিজেই হাসে।কিসব ভাবছে সে!
একসময় ধৈর্যহারা হয়ে ব্যালকনির দিকে এগিয়ে যায় সে।আরিয়ানের কাছাকাছি গিয়ে দাড়লে আরিয়ান কথা বলতে বলতেই তাকে একহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়।মিনিটখানেক পরে ফোনটা কেটে দিয়ে বলে,
—“কি হলো?আজ ঘুমকাতুরে মায়াবতীর চোখে ঘুম নেই কেন?”
—“আপনি আমাকে ঘুমকাতুরে বলছেন কেন?।”
—“ঘুমকাতুরেই তো।এ পর্যন্ত কয়বার যে তোমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় কোলে নিয়েছে হিসাব নেই।অজান্তেই যে তুমি কতবার আমার বুকে ঘুমিয়েছো তা আর নাই বললাম।সেগুলো শুধু আমিই জানি”
বলেই হাসে আরিয়ান।মায়ার মুখের সামনে চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দিয়ে হাত সরানোর সময় মায়া আৎকে উঠে তার হাত চেপে ধরে বলে,
—“আপনার হাত কাটলো কি করে?”
আরিয়ান কিছুক্ষন চুপ করে থাকে।মায়ার থেকে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে মৃদু হেসে বলে,
—“সে কেটেছে একভাবে।তোমার জেনে লাভ নেই।”
—“কিন্তু…”
আরিয়ান তার কথা এড়িয়ে বলে,
—“সামনে তাকিয়ে দেখো।”
মায়া সামনে তাকায়।বাগানে জেনি আর জ্যাক পাশাপাশি বসে আছে।জেনি নিজের শরীর চাটছে বসে বসে।নিজেদের ঘরের ভিতর নেই তারা,ছাড়া অবস্থায় আছে।জ্যাক বারবার চেটে দিচ্ছে জেনিকে।মায়া হেসে ফেলে।
আরিয়ান মায়ার হাসি দেখে বলে,
—“ওরা কিন্তু ভাই-বোন না।হাজবেন্ড-ওয়াইফ।দেখেছো জ্যাক কতো কেয়ার করে জেনির।”
—“কেয়ার করে না ছাঁই।বারবার বিরক্ত করছে জেনিটাকে।”
—“এটা তোমার বিরক্ত করা মনে হলো?”
—“তা নয়তো কি?”
আরিয়ান হুট করে দুহাতে মায়ার কোমড় জড়িয়ে ধরে।পাশের দেয়ালের সাথে মায়াকে ঠেকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
—“আমারো তোমাকে খুব “বিরক্ত” করতে ইচ্ছে করছে মায়াবতী।”
মায়া আরিয়ানের বাহু খামছে ধরে।লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে মাথা নিচু করে রাখে।আরিয়ান ঘোরলাগা দৃষ্টিতে একবার দেখে মায়ার গলায় ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়।ভালবাসার পবিত্র স্পর্শে ভরিয়ে দিতে থাকে তার মায়াবতীকে…
~চলবে~