আঁধার
৩৫.
এখন আমি কী করবো? আমার হাতে কি কোনো উপায় আছে? রাকা আর আমার পরিবারকে সব জানিয়ে দিব? নাকি মাহমুদ ভাইকে ফোন করে জানাব? রাকা যা বলেছে সেটা সে করবেই। এর প্রমাণ তো আজকেও পেলাম। ছোট্ট একটা বাচ্চাকেও সে ঘুমের মেডিসিন খাইয়েছে। এখন আমি যদি সবকিছু ফাঁস করে দেই তাহলে ও আমাকে ও মিলাকে ফাঁসিয়ে দিবে। সে যদি সুইসাইডও না করে তাহলে অন্য কোনো কিছুতে ফাঁসিয়ে দিবে। আর বিশ্রী ভাবেই কাজটা সে করবে। তার উপর সে নারীবাদী গ্রুপের সাথে যুক্ত। সে যদিও এই বিষয়ে খুব একটা মুখ খুলেনি কখনো। কিন্তু এটুকু বলেছিল যে, এরা ভালো ক্ষমতা রাখে। ওশান আমার সন্তান এই খবর জানার পরে মাহমুদ ভাই আমাকে ছেড়ে দিবেন না। আমার পরিবারের বাবা ও বড় আপা আমার সাথে কথা বলেন না। এই খবর জানাজানি হলে মাও কথা বলে ছেড়ে দিবেন। মিলার পরিবারও আমাকে নাকানিচুবানি খাওয়াবে। এটা স্পষ্ট! কারণ মিলার বাবা বেশ নামকরা রাজনীতিবিদ। আমার কোনো ক্ষতি করতে না পারলেও আমার পরিবারের ক্ষতি করবেনা এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমার পরিবারের যেকারোর উপর প্রতিশোধটা নেয়া হবে। আর মিলার সাথে থেকে গেলে রাকা আমাদের দু’জনকে পুলিশের ঝামেলায় জড়ায় দিবে। তারপর পরিবার জানতে পারবে।
এদিকে মিলাকে ছাড়া থাকা আমার জন্য কষ্টকর আর অকল্পনীয়। আমি আমার অতীতের কাজের জন্য খুবই বিশ্রীভাবে ফেঁসে গেছি। যেদিক যাবো সেদিকেই গভীর গর্ত। যে গর্তে একবার পড়লে উঠে আসার ক্ষমতা আমার নেই। আল্লাহ ছাড়া আমাকে রক্ষা কেউই করতে পারবেনা। যে দিকেই যাই না কেনো মিলাকে আমার হারাতেই হবে।
আর রাকার ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি না। সে আসলে চায়টা কী? আমাকে ফেলে সে বিয়ে করল। মানলাম খালু জোর করে বিয়ে দিয়েছিলেন। তার মান ইজ্জত চলে যাবে আমার মতো বেকার, ইন্টার পড়ুয়া স্টুডেন্ট এর সাথে মেয়ে বিয়ে দিলে। তাহলে এখন কেনো আমার সাথে চলে আসতে চাচ্ছে? এখন তার বাপির মান ইজ্জত যাবে না?
আর আমরা চলে আসলে মাহমুদ ভাই কি ছেড়ে দিবে? সে নাকি এমন প্ল্যান করেছে যে মাহমুদ কিচ্ছু বলবে না। এটা কীভাবে সম্ভব! সে আমাকে নিয়ে সংসার করতে চায়।
তাহলে আমাকে বিয়ে কেনো করালো সে? মিলাকে এর মধ্যে জড়ানোর কী দরকার ছিল?
হাজারটা প্রশ্ন আছে কিন্তু রাকা একটারও ঠিক উত্তর দিবে না।
অসহ্যকর যন্ত্রণা হচ্ছে আমার। মনে হচ্ছে সবকিছু শেষ করে দেই। চারপাশে শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার। মিলা এখনো বারান্দায়। মৃদু পায়ে এগিয়ে গেলাম বারান্দায় গেলাম। দুই হাত দিয়ে রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁট নড়ছে কিন্তু কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। আমি কাছে গিয়ে ঘাড়ে হাত রাখলাম। আমার দিকে না ফিরে বলল, ” কবে যাবেন? ”
” এখনো জানায়নি। ”
” ওশান খুব সুন্দর। বাবা – মা দুজনেই সুন্দর তো। আমার গর্ভে হলে এতো সুন্দর হতো না। ” ঠান্ডা স্বরে বলল।
” সৌন্দর্য দিয়ে কি সবকিছু হয় মিলা? ”
” হয়। এই পুরো পৃথিবী সৌন্দর্যের পূজারী। এইযে আপনি ভালোবেসেছেন আপুকে সৌন্দর্য দেখেই তো। এতো সুন্দরী নারীকে যে কেউ ভালোবাসতে চাইবে। ”
” না, আমি বাসিনি। ”
” কী বলেন? তাহলে আপুর বিয়ের পরেও যোগাযোগ রেখেছিলেন কেনো? ”
” জানিনা। ” সত্যিই আমি জানিনা। আমি কেনো এতগুলো বছর সবকিছু উপেক্ষা করে এই এক রাকার পেছনে ছুটেছি। জানিনা…
” বারো বা তেরো বছরের সম্পর্কে ভালোবাসা ছিল না? তাহলে এতগুলো বছর এক হয়ে থাকলেন কীভাবে? ”
” মরীচিকার পেছনে ছুটেছি বা ছিলাম হয়তোবা। হয়তোবা শুধুই রূপের মোহ ছিলো। যেটা তুমি আসতেই কেটে গেছে। ”
” হাসালেন। আমি কারো ভালোবাসার যোগ্য না। আমি এই জীবন থেকে অনেক বেশি কিছু পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম। ”
” আমার ভুলের মাশুল তোমাকে দিতে হলো। ” ওর তো এখানে কোনো দোষ বা ভুল ছিল না৷ তাকে পরিবার থেকে বিয়ে দেয়া হয়েছে। তার অতীত আমার মতো পাপে পূর্ণ না।
” আমি আজ অব্দি যত শাস্তি পেয়ে এসেছি। সবই অন্যের পাপের শাস্তি। ”
আমার আসলে ঠিকই হয়নি রাকার কথামতো বিয়ে করা।
মারিয়া কবিরের দ্বিতীয় একক উপন্যাস ‘ হলুদ খাম ‘ সংগ্রহ করতে চাইলে নিম্নের যেকোনো অনলাইন বুকশপ থেকে নিতে পারেন।
বইটি অর্ডার করার জন্য নিচে দেওয়া লিংকে ক্লিক করুন ।রকমারি
https://www.rokomari.com/book/207068/holud-kham
” আপনার আসলে যাওয়া উচিৎ। বাচ্চাটার কথা ভেবে। কত সুন্দর করে ঘুমিয়ে ছিল। ”
” হুম ”
” রাকা আপুর স্বামী বুঝতে পারেন নি যে বাচ্চাটা আপনার? ” মিলা আমার দিকে ফিরে প্রশ্নটা করল।
” কীভাবে বুঝবে? ”
” কী যে বলেন আপনি! আপনার বাচ্চা আপনার আর রাকা আপুর মতো চেহারা, স্বভাব হবে ওর। মাহমুদ ভাইয়ের সাথে তো ওর কোনোকিছুরই মিল থাকার কথা না। ”
” মাহমুদ ভাইয়ের সাথে আমার গায়ের রঙ এর মিল আছে। হয়তোবা এজন্য সে সন্দেহ বা বুঝতে পারেনি। ”
” যাই বলেন আরও কয়েক বছর গেলে উনার মনে সন্দেহ ঢুকে যেত। ”
” হুম ” কেনো আমি এই ভুলটা করলাম? রাকার বিয়ের পরে আমার আবার ওর সাথে যোগাযোগ করার কোনো মানে ছিলো না। তাহলে আজকে আমরা যার যার স্থানে ভালো থাকতাম।
” তারপর দেখা যেত সে ডিএনএ টেস্ট করে বসতেন। ”
” উনি রাকাকে খুব ভালোবাসেন। এই সন্দেহ কখনো আসতই না উনার মনে। ”
” যেমনটা আপনার আসেনি। ”
” মানে? ”
” মানে ওশান তো আপনার বাচ্চা নাও হতে পারে। এই সন্দেহটা আরকি। ”
” রাকা এই ব্যাপারে মিথ্যা কেনো বলবে? ”
” ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট তো দেখিয়েছে আপনাকে। তাহলে মিথ্যা হবার সম্ভাবনাও নেই। ”
” না, কোনো রিপোর্ট আমাকে দেখায় নাই। ”
” তার স্বামীর কোনো সমস্যা আছে? ”
” কোন ধরনের সমস্যা? ”
” বিবাহির জীবনের যে সমস্যা গুলো হয় আরকি। ”
” ওকে তো কখনো বলতে শুনিনি। ” মিলা আবোলতাবোল কীসব বলছে আল্লাহ ভালো জানেন।
” তাহলে শিওর কীভাবে হলেন যে, ওশানের জন্মদাতা আপনি? ”
” একজন মা তার সন্তানের পিতৃ পরিচয় নিয়ে মিথ্যা বলে না। ”
” ওহ, আসলে মা হইনি তো তাই জানি না। ”
” আমাকে যেতেই হবে। তোমার পরিবার কোনো…” কীভাবে বলবো গুছিয়ে নিতে পারছি না।
” আমার পরিবার, এলাকা এবং আপনার পরিবারও জানে আমি সুস্থ, স্বাভাবিক না। আমাকে নিয়ে কেউ সংসার করতে পারবে না – এই কথাটা আমার পরিবার মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। আপনার সাথে আমি ভালো ব্যবহার করেছি। আপনি কোনো নালিশ করেননি। এই বিষয়গুলো তাদেরকে হতভম্ব করেছে। ”
” তুমি যেমনই আছো তেমনই ভালো আছ। আমার তোমাকে এই অবস্থায় ভালো লাগে। ”
” আমার সংসার এক মাস টিকেছে এটাই আলহামদুলিল্লাহ। আর এখন ভালো লাগলেও বা কী? ”
” হ্যাঁ তাই তো কিছুই না। ”
” আপনি ঠিক কতদিন পরে যাবেন? ”
” রাকা জানাবে। ”
” একটা অনুরোধ করবো, রাখবেন? ”
” চেষ্টা করবো। ” আবার পাগলামি শুরু করেছে কিনা বুঝতে পারছি না।
” আমাকে ডিভোর্স দিবেন না দয়া করে। ডিভোর্স দিলেই আমার বাবা – মা উঠে পড়ে লাগবেন আবার বিয়ে দেয়ার জন্য। ”
” আমাকে খুব বেশি ভালোবাসো? ”
” না, পুরুষের প্রতি আমার ঘৃণার মাত্রা সবকিছু ছাড়িয়ে গেছে। এতো ঘৃণা নিয়ে কোনো পুরুষের সাথে থাকা যায়না। ”
মিলা বারান্দা থেকে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। কিছুসময় পরে এক কাপ চা নিয়ে ড্রয়িংরুমে টিভি ছেড়ে বসল।
*****
টিফিন টাইমে বাসায় এসে অবাক হলাম। মিলা বাসায় নেই। মেইন দরজায় তালা ঝোলানো। আমার কাছে যদিও চাবি থাকে। রাকা সকালেই ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। কোনোমতে যদি আমাদের পরিকল্পনার কথা কেউ জানতে পারে তাহলে আমার আর মিলার চরম শিক্ষা সে দিবে। ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজানো নেই। রান্নাঘরের র্যাকে খাবার রাখা। মিলার নাম্বারে ফোন দিলাম কিন্তু সে রিসিভ করলো না। গরুর গোস্তো, ঘন ডাল আর ভাত রান্না করেছে। সালাদ হলে মন্দ হতো না। কোথাও কোনো নোটও রেখে যায়নি। কোথাও চলে টলে গেল নাকি? রাতে এক ঘরেও সে ঘুমায়নি। শোবার ঘর বাদেও আরেকটা ঘর আছে। ও রাতে সেখানেই ঘুমিয়েছে। একবার ভেবেছিলাম বলব, ” শেষ কয়টা দিন একসাথে ভালো ভাবে কাটাই। ” পরে আর বলিনি। দূরত্ব যত বেশি রাখা যাবে তত কম কষ্ট হবে। ওকে বলেছিলাম শুক্রবারে গরুর গোস্তো রান্না করতে। সে আগেই করে বসে আছে। যেকোনো সময় আমার ডাক পড়বে। জেনেই মনে হয় রান্নাটা করেছে। ও যদি আর বাসায় না আসে তখন আরেক ঝামেলায় পড়ে যাবো। নাকি আত্মহত্যা করে বসল?
বাসা থেকে বের হয়ে আবার ফোন দিলাম। এবারও রিসিভ করল না। সব ভাবনা ঠেলে স্কুলে গেলাম৷ ক্লাস টাইম গুলোতে অন্ততপক্ষে কষ্ট, ভুল আর না পাওয়ার হিসাব মাথায় আসেনা।
বারবার মনে হচ্ছিল, এই হয়তোবা ফোন আসবে। আর জানাবে মিলার… চিন্তাও করতে পারিনা।
চলবে…
~ Maria Kabir