আঁধার পর্ব-৩৩

0
1398

আঁধার

৩৩.

রাসেলের দুপুরে খেতে আসার আগেই সবকাজ গুছিয়ে নিলাম। রান্না শেষ করে গোসল করে বের হওয়ার সাথে সাথে উনি চলে আসলেন। একসাথে দুপুরের খাবার খেতে বসলাম। টুকটাক কথাবার্তা হলো। তার কথাবার্তা, ভাবভঙ্গীতে মনে হলো কিছু একটা নিয়ে খুব চিন্তিত সে। সরাসরি জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। সে বলবে না। রাসেল অনেক বেশি চাপা স্বভাবের। আমার থেকেও বেশি। এ ধরনের মানুষ নিজ থেকে কিছু না বললে কিছু করার থাকে না। বিকালে নাকি আজকে কোচিং-এ ক্লাস হবেনা। তাই আজকে স্কুল থেকে সরাসরি বাসায় ফিরবে। রাসেল দুপুরে খেয়ে চলে যাবার পরে ভাত ঘুম দিলাম। একা একা কাজ করার সুবিধা এখানেই। দ্রুত ঘুম চলে আসে। আগের মতো বিনিদ্র রাত কাটেনা আমার। সেই ভয়ানক স্মৃতিও আবছা হয়ে গেছে। আমার ভাবনাতেই ছিলো না আমাকে কেউ ভালোবাসবে। যাওয়ার সময় সে আমাকে ছয় থেকে সাত মিনিটের মতো জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। হঠাৎ এমন করার কারণ জানার জন্য মন ছটফট করছে কিন্তু কিছু করার নাই। ভাবতে ভাবতেই বিকালের রূপ দেখছিলাম। কলিংবেলের শব্দে অবাক হলাম। আমাদের বাসায় ধরা যায় কেউই আসেনা। আর আমিও আশেপাশের কোনো ফ্ল্যাটেও যাইনা। কে এলো এই সময়? রাসেল না তো? উনার তো বিকালেই আসার কথা। দ্রুত গিয়ে দরজা খুললাম কিন্তু রাসেল না। খুবই সুন্দরী একজন মেয়ে সাথে তিন থেকে চার বছরের একটা ছেলে। বয়স মনে হয় আমার কাছাকাছি হবে। চেহারা দেখে অন্ততপক্ষে তাই মনে হয়। সাথে বেশ বড়সড় ব্যাগ। আমি তার সৌন্দর্য্য দেখে অবাক হচ্ছি। মুখের কোথাও কোনো দাগ নেই। তাকে কিছুটা গ্রীক দেবীদের মতো লাগে। আমি অনেক কষ্টে মুখ দিয়ে একটা প্রশ্ন বের করলাম, ” আপনাকে তো চিনলাম না? ” আমার আত্মীয়দের মধ্যের কেউ না। আমার ক্লাসমেটদের মধ্যেও না। এখন রাসেলের দিকের কেউ হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। খুবই মিষ্টি চেহারা। ফরশা দবদবা গায়ের রঙ। এমন গায়ের রঙ রাসেলের।
” আমি রাসেলের কাজিন। ও তোমাকে আমার কথা বলেনি? ” মেয়েটা মুখে হাসি এনে বলল। হাসলে আরো বেশি সুন্দর লাগে। এজন্যই মনে হয় বাচ্চাটার সাথে ওর গায়ের রঙ এ মিল এতো!
আমি দরজার কাছ থেকে সরে গিয়ে উনাকে ভেতরে আসতে দিলাম। উনি ড্রয়িংরুমের সোফায় আরাম করে বসলেন। বাচ্চাটাকেও বসিয়ে দিলেন। বাচ্চাটা খুব চুপচাপ স্বভাবের মনে হলো৷
” না, উনি বলেন নি। ”
” বলো কী? আমার সম্পর্কে তোমাকে কিছু না বলে থাকলো কীভাবে? ” চোখ মুখে অবিশ্বাসের ভঙ্গি। আমি নিজেও তো আমার কাজিনদের নিয়ে কিছু বলিনি। এটা না বলা দোষের হয় কীভাবে?
” না, মানে আমি নিজে কখনো আমার কাজিনদের নিয়ে বলিনি। তাই হয়তোবা উনিও বলেননি। ” হুটহাট এভাবে চলে আসার কারণও জানিনা। রাসেল তো একবারও বলেননি তার কাজিন আসবে। তাহলে ফ্রীজ থেকে গরুর গোস্তো বের করে রান্না করতাম। বাসায় একজন মেহমান আসছেন। আর খালি মুখে যদি পাঠাই তাহলে মা রাগ করবেন।
” আমি কিন্তু শুধু ওর কাজিন না৷ সমবয়সী ছিলাম আমরা। অনেক ভালো সময় আমাদের একসাথে কাটানো হয়েছে। ” বাচ্চাটা এইবার মায়ের কোলে মাথা দিয়ে চোখ বুজলো।
” ওহ, তাহলে আপনি একটু বসুন। আমি চা বানিয়ে আনি। উনি আজকে বিকালেই বাসায় ফিরবেন। উনার সাথে দেখা করে যাবেন। ”
” হ্যাঁ, দেখা না করে যাই কীভাবে! ”
” আপনাকে দেখে মনেই হয়না আপনি উনার বয়সী। আপনাকে আমার বয়সী মনে হয়। ” আমার কথাটা শুনে মনে হলো উনি বিরক্ত হয়েছেন। কপাল কুঁচকে ফেলেছেন।
” আমি রাসেলের বয়সী কিন্তু তোমার বয়সী না। তুমি রাসেলের চেয়ে বয়সে বড় তাই না? ” উনার প্রশ্ন শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। রাসেল আর আমার মধ্যে বয়সের পার্থক্য আট বছরের মতো হবে।
” না, না উনি আমার বড়। আমার তো এইবার ঊনিশ চলে। ”
” কী যে বলো! তোমার চেহারায় তো বয়স স্পষ্ট বোঝা যায়। বয়স বেশি বলেই তো চেহারায় কোনো লাবণ্য নেই। ” উনার কথা বলার ধরনে মনে হলো আমি ডাস্টবিনের ময়লার মতো দেখতে। এতো সুন্দর চেহারা কিন্তু বলার ধরন এমন কুৎসিত কেনো?
” আমার বয়স ঊনিশ। আপনি বসুন আমি চা বানিয়ে আনি। ” কথাটা বলেই রান্নাঘরে চলে এলাম। আমি কি আসলেই বাজে দেখতে? নিজের যত্ন করিনা। করলে উনার মতো না লাগলেও অতো খারাপ লাগতো না। ভাবতে ভাবতেই চায়ের পানি চুলায় দিলাম। উনার নামটা জানা হলো না। সত্যিই কি রাসেলের কাজিন কিনা কে জানে!
চা বানিয়ে সাথে বিস্কুট ট্রেতে নিয়ে ড্রয়িংরুমে এলাম। আমাকে দেখে মিষ্টি করে হাসলেন। টি- টেবিলের উপর ট্রে রেখে জিজ্ঞেস করলাম, ” আপনার নামটা জানা যাবে? ”
বাচ্চাটা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। সোফায় ঘুমাতে কষ্ট হচ্ছে ওর।
” রাকা , আমার আর রাসেলের নাম মিলিয়ে রেখেছিলেন নানু মনি। ”
” আপনি চা খান। বাবুকে বিছানায় শুইয়ে দেই কেমন? ওর বোধহয় কষ্ট হচ্ছে এভাবে। ”
” না, সমস্যা নেই। ” রাকা আপু হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নিলেন। তখনই কলিংবেল বেজে উঠলো। আমি দরজা খুলে দিলাম। রাসেল ক্লান্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে এসে আমার কপালে চুমু দিল। আমি ফিসফিস করে বললাম, ” বাসায় আপনার কাজিন এসেছেন। রোমান্স এখন না। ” উনি খেয়াল করেননি যে ড্রয়িংরুমে কেউ আছেন।
” আমার কোন কাজিন এসেছে…” বলতে বলতেই থেমে গেলেন। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। আমি দরজা আটকে দিলাম। রাকা আপু হেসে বলল, ” কেমন আছো? ”
” ভালো ” রাসেল পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন। শব্দটাও উচ্চারণ করলেন যান্ত্রিক স্বরে। হচ্ছেটা কি এখানে? কাজিনের সাথে নাকি উনার ভালো সম্পর্ক। তাহলে এখন এমন হতভম্ব হয়ে আছেন কেনো!
” জিজ্ঞেস করবে না আমরা কেমন আছি? ” রাকা বাচ্চাটার গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
” ওহ হ্যাঁ, আসলে অনেক দিন পরে দেখা হলো তো। তাই আরকি। তো তোমরা কেমন আছো? ” রাসেল সোফায় না বসে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
” কী যে বলো রাসেল৷ অনেক দিন পর কেনো দেখা হবে? দুই সপ্তাহও হয়নি আমাদের দেখা হয়েছে। ঢাকায় আমার বাসায় গিয়ে এক রাত থেকে আসলে। মনে নাই? ” রাকা আপুর কথা শুনে আমি কী বলবো, কী ভাববো বুঝতে পারছি না৷ এসব কী বলছে? আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম রাসেলের দিকে।

মারিয়া কবিরের দ্বিতীয় একক উপন্যাস ‘ হলুদ খাম ‘ সংগ্রহ করতে চাইলে নিম্নের যেকোনো অনলাইন বুকশপ থেকে নিতে পারেন।

বইটি অর্ডার করার জন্য নিচে দেওয়া লিংকে ক্লিক করুন ।রকমারি

https://www.rokomari.com/book/207068/holud-kham

রাসেল মাথা নিচু করে কিছু ভাবলো তারপর বলল, ” কী চাও তুমি? আর কী কারণে আমার বাসায় এসেছ? ”
” তোমাকে চাই, আমার বাচ্চার বাবাকে চাই। ” রাকা রাসেলকে উদ্দেশ্য করে বললেন।
” বাচ্চার বাবা? ” মুখ দিয়ে প্রশ্নটা ফসকে গেল।
” রাসেল তুমি বলবা নাকি আমি? ” রাকা দৃঢ়তার সঙ্গে বলল।
” কী বলবেন? ” আমি কিচ্ছু ভাবতে পারছি না। রাকা আসলে কে?
” রাকা এখানে ঝামেলা করবে না৷ আমার স্ত্রী এখানে। আমার সংসার ভাঙার চেষ্টা করবা না। ” রাসেল অনুরোধের মতো করে বলল।
” আমাকে কেউ বলেন আপনারা কী নিয়ে কথা বলছেন? কী এমন কথা যে সংসার ভাঙবে? ”
আমি না বলেও থাকতে পারছি না। রাসেল আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, ” মিলা লক্ষ্মী আমার তুমি শোবার ঘরে যাও। আমি ওকে বিদায় করে আসছি। ”
” তার আগে বলুন আপনারা কী নিয়ে কথা বলছেন? বাচ্চার বাবা আবার আপনাকে চায়? আপনি তো আমার তাই না? ” আমার ভেতরে কেমন কষ্ট হচ্ছে। খুব অচেনা অনুভূতি! রাকার সাথে তার কী সম্পর্ক আমি একটা ধারণা করতে পেরেছি। কিন্তু মন থেকে দোয়া করছি যেন তা আমার ধারণাই হয়।
” রাসেল তোমার না, আমার। আর আমার বাচ্চার বাবাও সে। ” রাকা একই ভঙ্গিতে বলল।
রাসেল উনাকে ধমকে উঠে বলল, ” রাকা যাস্ট স্টপ ইট। ”
” কেনো? আমার সাথে তোমার দীর্ঘ বারো বছরের সম্পর্ক সেটা তোমার এই ইউজড টিস্যুকে বলতে ইচ্ছা করছে না? তোমার সাথে আমার সম্পর্কটা মনের না শরীরেরও। এমনকি প্রায় দু সপ্তাহ আগেই আমার সাথে রাত কাটিয়ে এসেছ। এখন স্বীকার করতে ভয় কেনো পাচ্ছ? এইযে ওশান ঘুমিয়ে আছে। ওকে কি অস্বীকার করতে পারবে? ” রাকার প্রশ্নগুলো শুনে আমার কাছে সবকিছু পরিষ্কারভাবে ধরা দিল। রাসেল আমাকে বলল, ” মিলা তুমি ওর কথায় কান দিও না। তুমি বিশ্বাস করো আমাকে? ”
” করি কিন্তু উনি কি সত্যি বলছেন? ” রাসেল আমাকে জড়িয়ে ধরলেন কিন্তু প্রশ্নের উত্তর দিলেন না।
” আমি বুঝিনা এই রেপড মেয়েটার কাছে কী এমন আছে যে নিজের ছেলেকে ভুলে গেলা। ” রাকার কথায় আমি পুরোপুরি শিওর হয়ে গেলাম যে আমার ধারণাই ঠিক।
” রাকা তোমার সংসার আছে, স্বামী আছে আর বাচ্চাও আছে। আমারও সংসার, বউ আছে। তাহলে কেনো এই ঝামেলাটা করছ?”
” কারণ আমি সুখে নাই। আমি তোমাকে চাই। আমি আমার বাচ্চার বাবাকে ছাড়া থাকতে পারতেছি না৷ আর এখানে তুমিও সুখে নাই৷ এই মেয়ে রেপড তার উপর চেহারার দিকে তাকালে বুড়ি মনে হয়। তার সাথে আমার রাসেল সুখে থাকতে পারেনা। ”
” আমি সুখে আছি। আমি মিলাকে নিয়ে অনেক অনেক ভালো আছি। আমি তোমার সাথে বারো বছরের সম্পর্কে এতো ভালো ছিলাম না। ”
” তুমি আমাদের একসেপ্ট করবা না রাসেল? ” আমি রাসেলের বুকের সাথে লেপ্টে রইলাম। আমার পুরো শরীর কাঁপছে। এই জতৎ মনে হচ্ছে ঘুরছে। আমার ভালোবাসার মানুষটা এরকম! বিয়ের পর থেকে একবারের জন্যও তার স্বভাবে আমি এই ব্যাপারটা ধরতে পারেনি। এমনকি উনি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার একবার কি দুইবার করেছেন। তাও সরি বলতে বলতে মাথা নষ্ট করে দিয়েছেন।
” না ”

চলবে…

~ Maria Kabir

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে