আঁধার পর্ব-২২

0
1365

আঁধার

২২.

দরগাবাজার পৌঁছানোর পরে মেজ দুলাভাই কণ্ঠস্বর নামিয়ে বললেন, ” আমাদের কিন্তু রীতিমতো যুদ্ধ করতে হবে টাকা দেয়ার জন্য। তিন শ্বশুড় আব্বা কিন্ত দিতে দিবেন না। ”

” তারা তো রাজি হলো আসার সময়। ” অটোতে উঠার পরে রাকার নাম্বার ব্লকলিস্ট থেকে ডিলিট করে রেখেছিলাম। কিন্তু একবারও ফোন আসেনি। রাগ যে হয়েছে বোঝাই যাচ্ছে। কীভাবে যে তার রাগ ভাঙাবো ভাবতে হবে। আপাতত রাকার চ্যাপ্টার ক্লোজ করে রাখতে হবে। ফরিদপুরে গিয়ে ভাবা যাবে।

” রাজি হয়নি। বলেছে দেখা যাবে। ” মেজ দুলাভাই আগের মতো করেই বললেন। ছোট চাচা শ্বশুড় বললেন, ” কী খবর? মনে হচ্ছে গোপনে কোনো বুদ্ধি আঁটা হচ্ছে? ”

বড় দুলাভাই বললেন, ” কী যে বলেন চাচা! ওই একটু প্রাইভেট আলাপ চলে আরকি। ”

” তিন জামাইয়ের মধ্যে ভালোই তো মিল! এমন কোথাও দেখিনি। ” ছোট চাচা শ্বশুড় বললেন। কথা বলতে বলতে আমরা নদীর কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম। শ্বশুড় আব্বা মোবাইলে ব্যস্ত ছিলেন। কাছাকাছি আসার পরে মোবাইল রাখলেন।

” কী মাছের ব্যাপারি? ফ্রেশ মাছ আছে টাছে নাকি? তোমার ভরসায় কিন্তু তিন জামাই নিয়ে হাজির হলাম। ” শ্বশুর আব্বা নদীর ধারে মাছের ডালা নিয়ে ব্যস্ত থাকা কারো উদ্দেশ্যে বললেন। উনি যে এতো জোরে কথা বলতে জানেন। আমার জানা ছিলো না।
যার উদ্দেশ্যে বলেছেন সে উত্তর দিলেন, ” ফ্রেশ মাছ তো আছেই। এখন আপনাদের পছন্দ না হলে কিন্তু খবর হয়ে যাবে। একটু আগেও আপনার আশায় কয়েকজনকে না করে দিলাম। ”

” মাছ ভালো হলে পছন্দ ক্যান হবেনা? ” কথাবার্তায় ঠিক মনোযোগ দিতে পারলাম না। তার আগেই মোবাইলে ম্যাসেজ আসলো। রাকার নাম্বার থেকে। বড় দুলাভাইকে বললাম, ” জরুরী একটা ফোন করতে হবে। আমি একটু আসছি। ”

মোবাইল নিয়ে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে পড়লাম। রাকার নাম্বারে ফোন দিলাম। প্রথম বারেই ফোন রিসিভ করল। আমিই আগে কথা বললাম,
” হ্যালো ”

” নাম্বার ব্লক লিস্টে কেনো দিয়েছ? ”

” কারণ তুমি আমার নিষেধাজ্ঞা শুনোনি। ”

” বউ পেয়ে আমাকে এভাবে ভুলে যাবা। ভাবতেও পারিনি। ”

” রাকা, ভুলে যাইনি। আমি এখানে আসার পরে মিলার বড় ও মেজ বোন ফ্যামিলি নিয়ে বেড়াতে চলে এসেছেন। পুরো বাড়িতে মানুষ দিয়ে ঠাসাঠাসি। এতো মানুষের মধ্যে আমি তোমার সাথে কীভাবে কথা বলবো? ”

” বাড়ির বাইরে পাঁচ মিনিটের জন্য হলেও বের তো হতে পারো? নাকি মিলা তোমার সাথে লেগে থাকে? ”

” মিলার বড় দুলাভাই ও মেজ দুলাভাই কেউ না কেউ সাথে থাকেন। ”

” এই মেয়ে ও মেয়ের ফ্যামিলি হইলো খুব চালাক। রেপ হওয়া ক্যারেক্টর লেস রাস্তার কুত্তার মতো দেখতে মাইয়া তো ঘাড়ে বসায় দিলে হয়না। সেই ঘাড়কে তো দিন রাত পাহারায় রাখতে হয়। এজন্যই কেউ তোমার পিছু ছাড়ছে না। ” রাকা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল।
আমার রাগ উঠে গেল। অনেক কষ্টে রাগ দমিয়ে রাখলাম।

” আমার ওকে ঘাড়ে রাখার জন্য কারো পাহারার প্রয়োজন নেই। সে নিজেই জানে জায়গা নিতে। ”

” বলোতো তোমার কী হইছে? তুমি ওর পক্ষ নিয়ে কথা কেনো বলতেছ? তুমি তো ওকে সহ্যই করতে পারতে না। ”

মারিয়া কবিরের দ্বিতীয় একক উপন্যাস ‘ হলুদ খাম ‘ সংগ্রহ করতে চাইলে নিম্নের যেকোনো অনলাইন বুকশপ থেকে নিতে পারেন।

বইটি অর্ডার করার জন্য নিচে দেওয়া লিংকে ক্লিক করুন ।রকমারি

https://www.rokomari.com/book/207068/holud-kham
” আমার কিছুই হয়নি। আমি ওর পক্ষ নিচ্ছি না। আমি যাস্ট সত্যটা বললাম তোমাকে। ”

” ওই মেয়ে শরীরে কিছু আছে নাকি? চারজন মিলে তো সব নিয়েই নিছে। তার উপর মেয়ে সুস্থ স্বাভাবিক না। তুমি কোন কারণে ওর পক্ষ নিচ্ছ? ”

” আমি এখন রাখি। বাজারে আসছি বাজার করতে। ”

” ওশানের সাথে কথা বলবা না? ও অনেক দিন ধরে তোমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে। ”
ওশানের প্রসঙ্গ আসাতে বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠলো। আমার একমাত্র সন্তান। আমার ভালোবাসার ফসল ওশান। তার জন্মের সময় আমি পাশে থাকতে পারিনি। তার প্রথম পা ফেলার সময়ও না। এমনকি তার মুখের বাবা ডাকও শুনিনি। সে আধো আধো ভাষায় বাবা আমাকে ডাকেনি। ডেকেছে মাহমুদ ভাইকে!

” না ”

” বুঝেছি আমি। আমার সব বুঝা হয়ে গেছে। ওই মাগী তোমাকে বশ করে ফেলেছে। ”

” এরপর থেকে ওকে গালি দেয়ার আগে দ্বিতীয় বার ভাববে। তোমার সাথে আমার যা হবে তারমধ্যে কখনো ওকে টানবা না। শত হলেও সে আমার স্ত্রী। তার সম্মান আমার সম্মানের সাথে জড়িত। তাকে গালি দেয়ার অর্থ আমাকেও দেয়া। আমাকে যত ইচ্ছা গালাগালি করো। আমি কিছু বলবো না। কিন্তু আমার স্ত্রীকে না। ”

” আমি বুঝতে পারছি। তোমাকে বিয়ে করানোটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। ”

” আমি কিন্তু তোমাকে আমার সাথে চলে আসতে অনেকবার বলেছি। কবুল বলার আগ মুহূর্তেও বলেছি। কিন্তু তুমি আসতে রাজি হওনি। আমার ছেলের মুখে আজ অব্দি বাবা ডাক শুনতে পারিনি। কিন্তু বাচ্চা কিন্তু আমার! কেস করলে কিন্তু তুমি তাকে দিতে বাধ্য। ”

” কিন্তু সবাই জানে সে মাহমুদের ছেলে। ”

” ডিএনএ টেস্টে প্রমাণ করা ব্যাপার না। কিন্তু আমি করিনি। কারণ ওশান তোমারও। আর কেস করলে ফ্যামিলির মধ্যে ঝামেলা হতো। এজন্য আমি আইনের দিকে যাইনি। তোমার আর আমার মধ্যে শান্তভাবে মিটিয়ে নিতে চেয়েছি। ”

” তুমি এভাবে কেনো কথা বলতেছ, রাসেল? এসব কী বলতেছ? ” রাকা ন্যাকা স্বরে বলল।

” আমার ভালো মানুষির রূপটা যদি খসে পড়ে তাহলে কী হতে পারে সেটা তো ভালো করেই জানো? তুমি ছাড়া তো কেউই সেই রুপ দেখেনি। তাই না রাকা? ”

” হ্যাঁ, জানি। ”

” গুড, তাই দয়া করে আমার সাথে বাড়াবাড়ি রকমের কিছু করবা না। তোমাকে তো কথা দিয়েছি। তোমাকে আর ওশানকে খুব তাড়াতাড়ি নিয়ে আসবো। ”

” তাড়াতাড়িটা কবে আসবে? ”

” আমি ফরিদপুরে গিয়ে এটা নিয়ে আলোচনা করবো। ঠিকাছে রাখি জান? ”

” আবার কখন কথা হবে?”

” আমি ফ্রী হয়েই ফোন দিব। নিজের আর আমার ওশানের যত্ন করবা। ঠিকাছে? ”

” ঠিকাছে। অনেক ভালোবাসি তোমাকে। ”

” আমিও। ” ফোন কেটে দিয়ে আশেপাশে তাকালাম। এখানে লোকজন নাই বললেই চলে। কনভারসেশন কেউ না শুনলেই হয়। মিলার বংশ হচ্ছে ওদের এরিয়ার ক্ষমতাশীল বংশ। সেই বংশের মেয়ের জামাই ফোনে পরনারীর সাথে প্রেমালাপ চালাচ্ছে। খবরটা খুব সহজে কানে চলে যাবে। তারপর দেখা যাবে আমাকে আটকে ফেলবে এরা। মিলাকেও বুঝতে দেয়া যাবেনা। ভাঙাচোরা একটা মেয়ে। জানলে খুব কষ্ট পাবে। সে ভেবে বসে আছে আমি তাকে ভালোবাসি। ভালোবাসি না কিন্তু খুব ভালো লাগে। ওর মধ্যে কিছু একটা আছে। যা আমাকে খুব টানে। আমি সেই টান অগ্রাহ্য করতে পারিনা। ব্যস এটুকু!
তাছাড়া কিছুই নাই ওর প্রতি। মোবাইল পকেটে রেখে মাছের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখে বড় চাচাশ্বশুর বললেন, ” তোমার জন্যই আমরা কেনাকাটা করতে পারতেছি না। ”

” একজন কলিগ ফোন করেছিল। উনি আবার একবার ফোনে কথা বলতে শুরু করলে শেষ করতে চান না। ”

বড় দুলাভাই বললেন, ” কথাবার্তা পরে বইলেন। এখন তাড়াতাড়ি কেনাকাটা শেষ করুন। দুপুরে রান্না দেরি হয়ে যাবে। ”

নদীর ফ্রেশ মাছ ডালা ভরে সাজিয়ে রাখা। চিতল, বোয়াল,আইড়, ইলিশ, বাইলা, রুই, কাতল, কাজলী, ফলি আরো অনেক মাছ আছে। এতো দেখার ধৈর্য্য হচ্ছে না। ওশানের কথা বারবার মনে পড়ছে। বড় দুলাভাই দেড় কেজি সাইজের চারটা ইলিশ কিনলেন। মেজ দুলাভাই বোয়াল আর কাতল মাছ নিলেন। সাইজ বিশাল। কাতল মাছের মাথাটাই দেড় কেজি হবে। ভাগ্যিস মিলা পকেটে টাকা গুজে দিয়েছিল । এখানে আশেপাশে বিকাশের পয়েন্ট আছে কিন্তু বন্ধ। মান ইজ্জত শেষ হয়ে যেত। আমার পালা আসলো। আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম। কী মাছ নিবো এই ভেবে? আমার তো পছন্দ কাজলী, ফলি আর বাইলা। মানে ছোট সাইজের মাছ। কিন্তু এই মাছ নিতে গেলে
ভাববে আমি কৃপণ। আমি চিতল মাছ নিলাম একটা। মাছটা মাঝারি সাইজের হলেও পেটের দিক দিয়ে চওড়া। দেড় কেজি বাইলা, দুই কেজি ফলি আর দেড় কেজির মতো কাজলী মাছ নিলাম। শ্বশুড় আব্বা আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ” মিলার পছন্দ তোমার মনে আছে। আমি ভেবেছিলাম তোমার পছন্দে মাছ কিনবা কিন্তু তুমি আমাকে অবাক করে দিয়েছ। ”

আমি মুচকি হাসলাম। আমি নিজের অজান্তেই মিলার পছন্দের মাছ কিনে বসে আছি। আর ও ভাববে আমি তার পছন্দ অপছন্দ খেয়াল রাখি। আসল খবর কেউই জানবে না। জোরজবরি করে মাছের দাম দিয়ে বাসায় এসে পৌঁছাতে দশটা বেজে গেল।

বড় চাচাশ্বশুর ঘোষণা দিলেন, ” যার যার স্বামীর আনা মাছ সে সে কুটবে। আর রান্নাও সে করবে। ”
এই ঘোষণা শুনে সবচেয়ে বেশি খেপলেন মেজ আপা। এতো বড় মাছ কাটবেন কীভাবে? এই নিয়ে কতক্ষণ মেজ দুলাভাইয়ের সাথে চিল্লাচিল্লি করলেন। বড় আপা আর দুলাভাই হাসতে হাসতে অস্থির। বড় দুলাভাই বললেন, ” আমি জানতাম এমনই কিছু ঘটবে। তাই চালাকি করে ইলিশ নিয়েই ফিরেছি। আমার তো কষ্ট হচ্ছে আমার ছোট শালীর জন্য। বেচারির আজকে সন্ধ্যা হয়ে যাবে মাছ কুটতে কুটতে। ”

আমি তো এটা খেয়ালই করিনি। মিলার দিকে তাকালাম। সে ভাবলেশহীন মুখ নিয়ে বসে আছে। তারপর বসা থেকে উঠে চুল খোঁপা করে নিল।

” চেষ্টা করে দেখি । ”

শ্বাশুড়ি আম্মা বললেন, ” বলে কি এই মেয়ে? বিয়ের আগে তো প্লেট ধুয়েও খাস নাই। এতো মাছ কাটবি ক্যামনে? ”

” বিয়ের পরে সব কাজ আমি করি। মাছ, মুরগি সবজি সবই আমি কাটি। কাজ না করলে পারবো কীভাবে? ”

” দুজনের জন্য আনা মাছ কাটার সাথে এই মাছে তুলনা করিস না। তুই ঘরে যা। কুলসুম আছে পাকঘরে। ও কাটবে মাছ। বড় ভাই তো মশকরা করছে। ”

বড় চাচা মনে হয় কিছু একটা বুঝতে পেরেছেন। তাই শ্বাশুড়ি আম্মার কথায় সায় দিয়ে বললেন, ” আমি তো এমনিই বলছি। ”

*****

দুপুরে খেতে বসে মিলাকে আশেপাশে দেখলাম না। আছে কোথাও। তারপরও ভদ্রতার খাতিরে বড় আপাকে জিজ্ঞেস করলাম, ” মিলাকে দেখছি না। ও কোথায়? ”

বড় আপা বললেন, ” দুই বাড়ি পরে ওর বান্ধবীর বাসা। সেখানে গেছে। দুপুরে নাকি ওরা একসাথে খাবে। ”

” ওহ ” খাওয়ায় মন দিলাম। কিন্তু মাথার মধ্যে একটা চিন্তাই রয়ে গেল৷ আমাকে তো একটা বার বলল না কিছু। যদিও বাজার থেকে আসার পরে তেমন একটা কথাই হয়নি। কিন্তু একটা বার তো বলতে পারতো। খাওয়া দাওয়া শেষ করে রুমে এসে দরজা লক করে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। মিলার আসলে যেন বুঝতে পারি। রাকাকে ভিডিও কল দিলাম। ভেবেছিলাম এখানে নেটওয়ার্কই মনে হয় পাওয়া যাবেনা। কিন্তু উল্টো ভুল প্রমাণ করে খুব ক্লিয়ারভাবেই ভিডিও কল কানেক্ট হলো। রাকার পরনে স্লিভলেস কালো ব্লাউজ আর পেটিকোট। দুধের মতো ফরশা শরীরে কালো ব্লাউজ অদ্ভুত সুন্দর ভাবে মানিয়ে গেছে। ব্লাউজের গলা বড় হওয়াতে ক্লিভেজও দেখা যাচ্ছে।
” তুমি একটু পরেই ফোন দিলে পারতে। আমাকে শাড়ী পরা বাদ দিয়ে ফোন ধরতে হলো। ” চিরচেনা ন্যাকা স্বরে কথাটা বলল রাকা।

চলবে…

~ Maria Kabir

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে