আঁধার
২১.
” অর্ধেক পথে তো ফেলে চলে যাবেন না? ” আমার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলো মিলা। ওর শীতল চোখের চাহনিতে বুকের ভেতরে কোথাও একটু কেঁপে উঠল। আমি যে তাকে কথা দিচ্ছি, সেটা কি পূরণ করতে পারবো?
” না, কখনোই না। ” মিলা চোখ নামিয়ে হেসে ফেলল। লজ্জার হাসি বলে মনে হয়। কী সুন্দর হাসি! মা আর বড় আপা আমার জন্য এতো সুন্দর হাসির মেয়ে কীভাবে খুঁজে বের করলো কে জানে! মিলার শাড়ী একটু উপরে উঠে যাওয়াতে ওর নুপুর পরা পা চোখে পড়লো। ঝট করে একটা জিনিস মনে পড়ে গেল। ঢাকা থেকে আসার সময় বাসস্ট্যান্ডে এক ফেরিওয়ালা আলতা বিক্রি করছিল। বয়স্ক লোকটা এতো করুণ ভাবে কিনবো কিনা জিজ্ঞেস করলেন যে, না করতে পারলাম না। বিয়ের আগে হলে দাম দিয়ে দিতাম কিন্তু আলতা নিতাম না। কারণ রাকা এসব কমদামী জিনিস ব্যবহার করে না। কিন্তু এখন তো মিলা আছে। মিলার মতো মেয়েরা অল্পতে খুশি হতে জানে। এতো বড় বাড়ির মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও সে আমার সাবলেটের বাসায় বিনা নালিশে থেকেছে। সব কাজ নিজ হাতে করতে হয়েছে। অবাক হওয়ার মতো! আমার ব্যাগের দিকে এগিয়ে গেলাম। মিলা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
” ব্যাগের কাছে কেনো? ”
” ওয়েট, মিসেস ”
ব্যাগের মধ্যে হাত দিয়েই কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা পেয়ে গেলাম। আলতা হাতে নিয়ে ফিরতে দেখে মিলা অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুললো কিন্তু কিছু বলল না।
” আলতা রাঙা পায়ে আবার নুপুর পরেছে – এমন একটা গান কোথাও শুনেছিলাম। ” মিলার পায়ের কাছে বসে অজুহাত দেয়ার ভঙ্গিতে বললাম।
” নুপুর পরা পা দেখে মনে পড়ে গেল? ”
” হ্যাঁ, ভুলেই গেছিলাম। তাহলে তো ওভাবেই পড়ে থাকতো জিনিসটা। ”
” কিন্তু আপনি পায়ের কাছে কেনো বসেছেন? ”
” তোমার পায়ে আলতা পরিয়ে দিবো তাই। আমি এই প্রথম আলতা দিতে যাচ্ছি । ভালো হবেনা কিন্তু তুমি মাইন্ড করতে পারবেনা। ”
” আমি কখনো আলতা পরিনি। এই প্রথম! ”
” কী? গ্রামের মেয়েরা তো আলতা খুব পছন্দ করে। ”
” আমার শৈশব, কৈশোর আর যৌবন অন্যসব মেয়ের মতো না যে। স্বাভাবিক হয়ে বাঁচার সুযোগটাই তো পাইনি কখনো। আমি যখন রাস্তায় বের হতাম। তখন আমাকে আড়চোখে সবাই দেখত। মানুষের চোখের চাহনিতেই বুঝতে পারতাম তারা কোন চোখে আমাকে দেখে। তাদের মনে কী চলে! মুখের উপর কেউ কিছু বলার সাহস পেতো না। কিন্তু ভাব সাব, চাহনিই যথেষ্ট ছিল। ”
” মানুষের কাজই তো অন্যের কষ্টগুলো খুঁজে বের করে খোঁচা দেয়া। ”
” হ্যাঁ ”
” এখন পা গুটিয়ে না রেখে মেলে দাও। আমি আলতা দেয়ার চেষ্টা করি। জানিনা কেমন হবে। ”
” খারাপ হলেও সমস্যা নেই। আমার তুলনা করার মতো কোনো স্মৃতি নেই আর মানুষও নেই। আপনি যাই দিবেন সেটাই আমার কাছে অনন্য হবে। কারণ ইতোপূর্বে কেউই আলতা দিয়ে দেয়ার জন্য পায়ের কাছে এভাবে বসেনি। ”
” আমিও কখনো এভাবে বসিনি। ”
আলতার মুখ খোলার পরে ওর পায়ে দিতে শুরু করলাম। ভেবেছিলাম ব্যাপারটা সহজ হবে। কিন্তু না! এক জায়গায় বেশি পড়ে গেল। সেখানে পুরো মাখিয়ে গেল৷ অন্য জায়গায় চিকন করে দিতে গিয়ে মোটা করে দেয়া হয়ে গেলো। পায়ের পাতার উপরে গোল করে দিতে গিয়ে হয়ে গেল পৃথিবীর মতো। কমলালেবুর মতো কিন্তু উত্তর দক্ষিণে চ্যাপ্টা! দুই পায়ে দিতে গিয়ে আমার হাতও লাল হয়ে গেছে। মিলা এতক্ষণ যাবত এক চুলও নড়েনি। আলতার বোতলের মুখ আটকে যখন শান্তির নিশ্বাস নিলাম। তখন খেয়াল করলাম আমার হাত, মিলার পায়ের পাশাপাশি ফ্লোরকেও আলতা দিয়ে মাখিয়েছি।
” একটা ছবি তুলে রাখবেন? আমার মোবাইলের ক্যামেরায় পুরোটা ভালো উঠবে না। ”
” ওহ হ্যাঁ তোমার তো বাটন সেট। ”
মারিয়া কবিরের দ্বিতীয় একক উপন্যাস ‘ হলুদ খাম ‘ সংগ্রহ করতে চাইলে নিম্নের যেকোনো অনলাইন বুকশপ থেকে নিতে পারেন।
বইটি অর্ডার করার জন্য নিচে দেওয়া লিংকে ক্লিক করুন ।রকমারি
https://www.rokomari.com/book/207068/holud-kham
” আমার কাছে কিছু টাকা জমানো আছে৷ ফরিদপুরে যাওয়ার পরে আমাকে একটা টাচস্ক্রীন এন্ড্রয়েড মোবাইল কিনে দিবেন। ”
” আমিই কিনে দিবো। তোমার টাকা জমিয়ে রাখো৷ যদি আমার কখনো টাকার টানাটানি হয় তখন দিও। ”
” আপনার বেতন তো… ”
” আমি আগে ব্যবসা করতাম। সে টাকা আর ব্যবসার শেয়ার বিক্রি করে দেয়ার টাকা ব্যাংকেই পড়ে আছে। ওগুলো তো খরচ করতে হবে। ”
” দ্রুত ছবি তুলুন। আমি এখন ঘুমাবো। আপনাকেও ঘুমাতে হবে তাড়াতাড়ি। ”
মোবাইল পকেট থেকে বের করে বিছানার উপর রেখেছিলাম। মোবাইল হাতে নিয়ে লক খুলে নোটিফিকেশনে রাকার নাম্বার দেখাচ্ছে। ব্লক লিস্টে দেয়া। একশো+ মিসড কল আর ম্যাসেজ অগণিত! নোটিফিকেশন বাদ দিয়ে ক্যামেরা ওপেন করে ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কী মনে করে সেল্ফি ক্যামেরা ওপেন করলাম।
” আমি সেল্ফি তুলবো না। ছবি ভালো উঠে না। ”
” আরে আমার সাথে একটা মাত্র তুলবা। ” বলেই ওর গালে চুমু দেয়া অবস্থায় সেল্ফি তুলে ফেললাম।
” এই ছবি কেনো তুললেন? কেউ দেখে ফেললে লজ্জায় পড়ে যাবো। ”
” আমার মোবাইল লক করা থাকে। সমস্যা নাই কেউই দেখবে না। ”
*****
সকালে ঘুম ভাঙলো বড় দুলাভাইয়ের ডাকে। মিলাকে আশেপাশে কোথাও দেখলাম না। ঘুম থেকে উঠে এভাবে চোখ বুলিয়ে খোঁজা খুঁজি করতে দেখে বড় দুলাভাই বললেন, ” মানে বউ পাগলারও তো সীমা থাকে। ”
” আরেনা সেটা না দুলাভাই। ও তো প্রায় রাত বিরাতে নাকি ঘর থেকে বের হয়ে যায়। তাই আরকি! ”
” মিলা ছাদে বসে ভাগ্নীদের সাথে গল্পগুজব করছে। তার আবার ভাগ্নীদের খুব পছন্দ। ”
” হ্যাঁ, গতকালই বুঝতে পেরেছি। অনেক দেরি হয়ে গেছে ঘুম থেকে উঠতে? ” প্রশ্ন না করে পারলাম না৷ রাত তিনটার দিকে দু’জনে চোখ বুজেছিলাম৷ মিলাও সুস্থ ছিলো৷ গল্প হাসাহাসি আর রোমান্স করতে করতেই কখন যে রাত তিনটা বেজে গেছিল খেয়ালই করিনি। মিলার কণ্ঠনালীর নিচে তিনটা তিল আছে। তিল গুলো ভালো করে খেয়াল না করলে বোঝাই যায়না৷ তিল তিনটা এমনভাবে সাজানো যে, দেখে মনে হয় এদেরকে সংযোগ করে দিলে একটা সমকোণী ত্রিভুজ তৈরি হবে। এই কথা বলাতে মিলা হাসতে হাসতে অস্থির। হাসি অনেক কষ্টে থামিয়ে বলেছিল, ” আপনি আসলেই শিক্ষক হওয়ার জন্যই জন্ম নিয়েছেন৷ নিজের স্ত্রীর শরীরেও জ্যামিতি খুঁজে পান। ”
ওই তিনটা তিলে আমি হাত দিয়ে দাগ কেটে ওকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম। এটা আসলেই সমকোণী ত্রিভুজ। সে উল্টো হাসে। একসময় তার হাসি থামানোর জন্য ঠোঁট দখল করলাম। তখন লাভ হলো!
” না, কেবল ছয়টা পয়তাল্লিশ বাজে। ”
” ওহ, তাহলে আরেকটু ঘুমাই। ”
” সেই উপায় নাই ভাই। আমাদের শ্বশুড় আব্বার অনেক দিনের সখ তিন মেয়ে জামাই নিয়ে ভোরবেলা বাজারে যাবেন। তারপর তিন জামাইয়ের পছন্দে বাজার করবেন। মাছ কেনার জন্যই তিনি দরগাবাজার যাবেন আমাদের নিয়ে। পদ্মার সাথে বাজার হওয়াতে সব ধরনের নদীর মাছ পাওয়া যায়। ”
” পুলিয়া বাজার হয়ে না দরগাবাজার? ” বিছানা থেকে উঠে বসলাম। এখনো চোখে ঘুম লেগে আছে।
” হ্যাঁ যায়। তবে সব থেকে ভালো হয় মালিগ্রাম থেকে কাউলিবেড়া হয়ে দরগাবাজার যাওয়া। ”
” তাহলে আমি ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে আসি। মেজ দুলাভাই কোথায়? উনি যাবেন না? ”
” ও যাবেনা ওর ঘাড়ে যাবে। শ্বশুড়বাড়িতে তার কোনো অজুহাত কাজে আসেনা। দুই চাচাশ্বশুড় আর আব্বা শ্বশুড় চা, বিস্কুট খেয়ে উঠানে আমাদের অপেক্ষায় আছেন। তোমার চাও ওখানে ফ্লাক্সে রাখা। তুমি দ্রুত ফ্রেশ হয়ে আসো। আর মুখে, হাতে আলতা লেগে আছে। ভালো মতো ধুয়ে আসো। রাতে রোমান্স করেছ – এই খবর পুরো বাড়িকে প্রমাণ দিতে হবেনা। ” শেষের কথাগুলো বলার সময় বড় দুলাভাই হাসি চেপে রাখলেন।
” মিলার পায়ে আলতা দেয়ার সময় কীভাবে যেন লেগে গেছে। ” কী একটা লজ্জার ব্যাপার আল্লাহ!
” বুঝেছি৷ যাও এখন আড়মোড়া ভেঙ্গে ফেল। ” বড় দুলাভাই রুম থেকে বের হয়ে গেলেন।
আলনায় মিলার রাতের পরা শাড়ী এলোমেলো ভাবে রাখা৷ শাড়ীর আঁচলে, পাড়ে আলতার রঙ লেগে আছে। সকালে রুম থেকে বের হওয়ার সময় শাড়ী পালটে বের হয়েছে। যাক এটুকু বুদ্ধি আছে তার।
ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হলাম। মেজ আপা আমাকে দেখে বললেন, ” উঠানের টি-টেবিলে তোমার চা আর বিস্কুট রাখা আছে৷ চা ঢেলে নিতে পারবা তো? ”
উঠানে তাকিয়ে দেখলাম টি-টেবিলের চারপাশে সুন্দর করে চেয়ার সাজানো। এতো সকালেই এই আয়োজন! ঘুম থেকে এরা উঠেছে কখন?
” জ্বী পারবো। ”
টি-টেবিলের পাশে চেয়ার নিয়ে বসলাম। ফ্লাক্স থেকে চা ঢেলে চুমুক দিব তখনই মিলাকে বারান্দায় দেখলাম। বেগুনি রঙের টাঙ্গাইল শাড়ী তার পরনে৷ পায়ে আলতা ও নুপুর। কোমড়ের কাছাকাছি চুলগুলো ওর হাঁটার কারণে দুলছে। যত সময় যাচ্ছে ততবেশি মুগ্ধ হচ্ছি। জানিনা এই মুগ্ধতা কবে শেষ হবে!
*****
দরগাবাজারে অটোতে করে যাওয়ার সময় বড় চাচা বললেন, ” তোমরা তোমাদের পছন্দ মতো যত ইচ্ছা মাছ কিনবা। টাকার ব্যাপারে কোনো চিন্তা করবেনা। টাকা সব আমরা দিবো। ”
মেজ দুলাভাই বললেন, ” এটা কেমন হলো বড় চাচা? আমরা তিন জামাই আসছি। আজকে না হয় আমরাই বাজার করি। ”
আল্লাহর রহমত মিলা আসার সময় আমার পকেটে এক হাজার টাকার চারটা নোট ঢুকিয়ে দিয়ে বলেছিল, ” একেবারে খালি পকেটে যাওয়া ঠিক না। ”
” আমার বিকাশে আছে। আমি বাজার থেকে উঠায় নিতে পারবো। বিকাশে সবসময় থাকে বলেই পকেটে বেশি টাকা রাখিনা। ”
” সেই সুযোগও পাবেন না৷ ”
” তাই বলে তোমার জমানো টাকা আমি কীভাবে নেই?”
” এই টাকা আপনার হলে আমি যেভাবে নিতাম সেভাবে । ”
” তুমি পাগলামি করো না। ”
” কেউ কিছু একটা কিনতে গেলে আপনি সেধে টাকা দিতে যাবেন৷ তারা নিবে না কিন্তু খুশি হবে। আপনার যে উদার মন আছে একটা সেটা আমি বাদে তাদেরও জানানোর প্রয়োজন আছে। ”
” জানিয়ে কী হবে?”
” তিন জামাইয়ের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা আছে। একটু একটু করে বুঝতে পারবেন। আমি চাইনা আপনি লজ্জা পান বা পিছিয়ে যান। ”
মিলার সাথে কথোপকথন মনে করতেই আমি বলে উঠলাম, ” হ্যাঁ, আজকে আমরা তিন জামাই বাজার করি। ”
বড় দুলাভাই বললেন, ” যাক, এরা আমার মনের বাসনা ধরতে পেরেছে। ”
এদিকে আমার মন পড়ে আছে মিলার কাছে। কখন এরা কেনাকাটা শেষ করবে কে জানে!
চলবে…
~ Maria Kabir