আঁধার
১৯.
” আমার তো আসতে সমস্যা নেই কিন্তু মিলাই আসতে চায়না। এইযে এইবারও আসতে চায়নি। সে নাকি ফরিদপুরেই থাকতে পারবে। জোর করে এখানে পাঠিয়েছি। ” আসতে না চাওয়ার ব্যাপারটা ক্লিয়ার করা উচিৎ। তা নাহলে শ্বশুড় মশাই আমাকে ভুল বুঝে বসে থাকবেন।
” আমি জানি বাবা৷ সমস্যা আমার মেয়ের। ছোট বেলায় অযত্নে, অবহেলায় মানুষ হয়েছে। বড় হওয়ার পরে যখন আমরা ভুল বুঝতে পারলাম। তখন অনেক বেশি দেরি হয়ে গেছে। মেয়ের সমস্যা যা হবার হয়ে গেছে। ”
মানে? ওকে অবহেলায়, অযত্নে মানুষ করেছে? কিন্তু কেনো? ওতো কখনো বলে নাই। ও বলেই বা কী? আজকে আমাদের মধ্যের সম্পর্কটা অনেকখানি এগিয়েছে। এই কারণে হয়তোবা সে তার সম্পর্কে ৫-৬% বলেছে। আমার মুখের অবস্থা দেখে মিলার বাবা কিছু বুঝতে পেরেছেন।
” মিলা তোমাকে কিছু বলেনি? ”
মারিয়া কবিরের দ্বিতীয় একক উপন্যাস ‘ হলুদ খাম ‘ সংগ্রহ করতে চাইলে নিম্নের যেকোনো অনলাইন বুকশপ থেকে নিতে পারেন।
বইটি অর্ডার করার জন্য নিচে দেওয়া লিংকে ক্লিক করুন ।রকমারি
https://www.rokomari.com/book/207068/holud-kham
” না, ও তো কথাই বলে কম। জিজ্ঞেস করলে বলে আর জিজ্ঞেস না করলে ভুলেও মুখ দিয়ে কিছু বের করে না। ”
” দুই মেয়ের পরে মিলা হয়। মেয়ে হয়েছে শুনে আমি দুই মাস পর্যন্ত ওর মুখ দেখিনি। তারপর চোখের সামনে থাকতো তাই দেখতে হতো। কিন্তু ব্যবহার ভালো আসতো না। আমাদের ফ্যামিলির কেউই ওকে খুব একটা পছন্দও করতো না। এর কারণ আমি নিজেই। এদিকে ওর মাও আর বাচ্চা নিতে পারবেনা। ওর হওয়ার পরে মিলার মায়েরও সমস্যা হয়েছিল। মানে আর কখনো বাচ্চা নিতে পারবে না।
মূলত ও একটা নেতিবাচক পরিবেশে বড় হয়েছে । পুরো পরিবার ছেলে চাচ্ছিল কিন্তু হয়েছে মেয়ে । আমার পার্টির লোকজনও ছেলের আশায় ছিল। আমার পরে যেন সে গদির জায়গা নিতে পারে। তার উপর ও নিজেও কেমন মুখচোরা স্বভাবের ছিলো। যখন একটু বুঝতে শিখলো। আমাদের ফ্যামিলির কেউ খুব একটা পছন্দ করে না। তখন ও নিজেকে লুকিয়ে রাখতো। ছোট বেলায় একটা বাচ্চা যেমন ব্যবহার পায়। বড় হয়ে সে ওইরকম ব্যবহারই উগড়ে দেয়। ও ঠিক তাই করেছিল। কিন্তু আমরা তো বাঙালি! আমরা দ্বিগুণ হারে ওকে সেটা রিটার্ন করেছি। তারপর আবার মেশুর বিয়ের পরে… ”
” নানাজান আপনাকে কতো জায়গায় খুঁজেছি। ” মিলার বড় আপার মেয়ে দৌড়ে এসে শ্বশুর আব্বাকে জড়িয়ে ধরলো। আব্বা তার কথার মাঝে থেমে গেলেন। বড় আপার বিয়ের পরে কী এমন হয়েছিল এটা জানার জন্য ভেতরে একটা অস্থিরতা কাজ করছে বুঝতে পারলাম।
” আরে আমার মেশুর কন্যা নাকি? তো এতদিনে নানার কথা মনে পড়লো? ” বাবা বললেন।
” আম্মুই তো আসতে দেয়না। বলে ক্লাস মিস যাবে, টিউশন মিস যাবে। পিছিয়ে যাবো, খারাপ রেজাল্ট হবে। ” সাদিয়া বলল।
” তোমার মা তো জানে শুধু এক জিনিস। ” বাবা বললেন। এদিকে আমার পরের কাহিনী শোনার জন্য মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
” নানাজান, আজকে মা’কে ভালো করে বকে দিবা। ওকে? ” সাদিয়া চেয়ারে উঠে বসে বলল।
” তা নাহয় দিবো কিন্তু তোমার ছোট খালুর সাথে তো কথা বলবে? ”
সাদিয়া আমাকে খেয়াল করেনি। বাবার বলাতে আমার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে দিয়ে বলল, ” আমি খেয়ালই করিনি, ছোট খালু। আপনি ভালো আছেন? ”
” আমি বুঝতে পারছি। হ্যাঁ, আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুমি কেমন আছো? ” আসলেই আমি আজকে অনেক ভালো আছি।
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি৷ ছোট খাম্মি কোথায়? ”
” ওর বেডরুমে। ”
” যাক, ছোট খাম্মিকে তার বেডরুমে পাওয়া যাবে। ” কথাটা শেষ করে সাদিয়া যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই চলে গেল।
আমার খাওয়া এখনো শেষ হয়নি। বাবা বললেন, ” তুমি খাও। আবার পরে কথা হবে। ”
এদিকে আমার পকেটে ভূমিকম্প চলছে। রাকা ননস্টপ ফোন দিয়েই যাচ্ছে। ও আমাকে বিপদে ফালাবে। এদিকে মোবাইল অফ করেও রাখতে পারছি না। খাওয়া দাওয়া শেষ করে বেসিনে হাত ধুয়ে নিলাম। তারপর মোবাইল বের করে রাকার নাম্বারে ফোন দিলাম।
ফোন রিসিভ করার সাথে সাথে রাকার কান্নার শব্দ শুনতে পারলাম।
কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ” তুমি আমাকে ইগ্নোর করছো কেনো? ”
” আমি ইগ্নোর করছি না। আমি তোমাকে বারবার বলছি যে, আমি শ্বশুড়বাড়িতে। ”
” সারাক্ষণ তো আর সবাই তোমার পাশে বসে নাই। তুমি পারলেই আমাকে ফোন দিতে পারো। কথা বলতে পারো। ”
” পাশে না থাকলেও কথা বলতে দেখে সন্দেহ করবে। ”
” কেউই সন্দেহ করবে না। ”
” করবে। মিলা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, কী কাজে ঢাকায় গেছিলাম। ওর মনে প্রশ্ন তো জাগবে, আমি কার সাথে কথা বলছি। ”
” বলবা ফ্রেন্ড। ”
” আমি মিথ্যা বলতে বলতে ক্লান্ত। আমাকে তোমার মিথ্যা কথা বলার জ্যাকপট ভেবেছ তুমি? ”
” এতদিন তো খুব সুন্দর করে মিথ্যার উপর চলছিলে। এখন কী হলো তোমার? ”
আমিও জানিনা আমার কী হয়েছে! আমার এখন আর মিথ্যা ভালো লাগেনা। এতো যন্ত্রণা, এতো লুকোচুরি, এতো মুখোশ নিয়ে থাকতে ভালো লাগেনা।
” সব দোষ ওই মিলার। মাগী এখনই তোমাকে তাবিজ করেছে। ”
” মুখে লাগাম দাও। ” মোবাইল আছাড় দিতে পারলে শান্তি লাগতো। দপ করে মেজাজ চড়ে গেল আমার। রাকাকে কড়া কথা বলতে গিয়েও বললাম না। অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলাম। নিজেকে শান্ত করতে হবে। এটা আমার বাড়ি না যে, রাগ ঝাড়বো। মেঝের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিলাম। তারপর ফোন কেটে দিয়ে, রাকার নাম্বার ব্লক লিস্টে ফেলে দিলাম। এই কয়দিন সে ব্লক লিস্টেই থাকুক।
নিজেকে স্বাভাবিক করে খাবার রুম থেকে বের হয়ে আসলাম। বড় দুলাভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে গেল। আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন। পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ” তো কেমন আছেন ভাই? ”
” ভালো, আপনি? ” আমাকে ছেড়ে দিলেও এক হাত ধরে রাখলেন। এইসময় মেজ দুলাভাই লাগেজ নিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন। সবার সাথে কুশল বিনিময়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
” সেই আছি। দেখে তো মনে হচ্ছে শালী অযত্ন করেনি। ”
আমি হেসে ফেললাম। হাসিটা মনে হলো লজ্জা পেয়ে যেভাবে হাসে তেমনি হলো।
আমার দিক থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে বড় দুলাভাই বললেন, ” যাক শালী আমার ভেজা বেড়াল। আর যাই করুক জামাই ঠিক রাখছে। মেয়ে মানুষ তো এমনই দরকার। তোমার বড় আপা তো আমাকে পাত্তাই দেননা। ”
মেজ দুলাভাই আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, ” তো রাসেল, বিয়ে কেমন লাগলো? অনেস্ট রিভিউ চাই কিন্তু! ”
বড় দুলাভাই খিলখিল করে হেসে উঠলেন৷
” এই জিনিস হচ্ছে এমন খাবার, যা খাওয়ার পরে না পারা যায় হজম করতে না পারা যায় বমি করে উগড়ে দিতে। ”
আমি হাসি আটকে রাখতে পারলাম না। মেজ দুলাভাই বললেন, ” তাহলে আজকে জমিয়ে আড্ডা দেয়া যাবে। আপাতত যাই, ফ্রেশ হয়ে আসি। ”
” যাও, আমিও ফ্রেশ হয়ে আসি। ”
বড় ও মেজ দুলাভাই চলে গেলেন। আমি মিলার বেডরুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। রুমের দরজা খোলা ছিল। মিলা মেজ আপার তিন বছরের মেয়ে রুমুকে কোলে নিয়ে আদর করছে। পাশে সাদিয়া বসে হাত নেড়ে গল্প বলছে। আমাকে দেখে মিলা বলল, ” আপনি একটু শোবেন?”
” হ্যাঁ, একটু না বিশ্রাম নিলে হয়না। ”
মিলা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ” আমি ওদেরকে নিয়ে পাশের রুমে যাই। আপনি বিশ্রাম নিন। ” হলো কী এইটা? ও পাশে বসলে একটু কথা বলা যেত। ম্যাডামের যে মুড।
” ঠিকাছে, তবে মোবাইল নিয়ে যাও। ”
মিলা মোবাইল নিয়ে ভাগ্নীদের নিয়ে পাশের রুমে চলে গেল। বিছানায় কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করলাম। কিন্তু ভালো লাগলো না। তারপর মিলাকে ফোন দিলাম। ও রিসিভ করলো না কিন্তু কিছুক্ষণ পর সে রুমে এসে দরজা লক করে দিল।
” ডাকলেই পারতেন। ”
” এতো মানুষের মধ্যে দিনের বেলা বউকে ডাকাডাকি করা যায়না। লজ্জাশরমের একটা ব্যাপার আছে। ”
” হুম ” মিলা আমার বিছানায় আমার পাশে শুয়ে পড়লো। আমি ওর দিকে আরেকটু এগিয়ে গেলাম।
” আপনি এটাই তো চাচ্ছিলেন তাই না? ”
এক হাত দিয়ে কোমড় জড়িয়ে ওকে কাছে টেনে নিলাম। এতটা কাছে যে ওর হৃদস্পন্দন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। ওর শরীর আগের তুলনায় একটু ভালো মনে হচ্ছে। মুখের উপর ওর চুলগুলো এসে পড়েছে। ও হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল, ” আপনি অনেক সুন্দর। ”
কথা বলার সময় ওর নিশ্বাস আমার মুখের উপর আছড়ে পড়লো। ভেতরের সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল আমার। সব নিয়ন্ত্রণ ভেঙে গেল। আমি ওর মাঝে ডুব দিলাম। জীবনে এই প্রথম কারো প্রতি এতো বেশি আসক্ত হয়ে পড়লাম। এই প্রথম কাউকে খুব কাছ থেকে পাওয়ার ব্যকুলতা পূরণ হলো। এতদিন ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে সে চোখ মুখ শক্ত করে রাখতো। কিন্তু এখন এই মুহূর্তে তার চোখ মুখে, শরীরে নিশ্বাসে ছন্দ খুঁজে পেলাম।
তার শরীরের প্রতি ইঞ্চিতে আমাকে ছড়িয়ে দিলাম। আর সেও আমাকে নিজের মধ্যে গ্রাস করে নিতে লাগল।
*****
রাতে বিশাল আয়োজনে সবাই কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে দেয়ে ক্লান্ত হয়ে যার যার রুমে চলে গেল।মিলার শরীর খুব একটা ভালো লাগছিল বলে সেও দ্রুত ঘুমিয়ে পড়লো। আমিও তাকে বেশি একটা জোর করলাম না। এমনিতেই দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরে যে কাজ করেছি। তাতে তার খারাপ লাগার পেছনে আমিই দায়ী। কিন্তু কী আর করার! রয়ে গেলাম আমি আর বড় দুলাভাই। আমরা দুজন ছাদে পাটি বিছিয়ে বসে আছি। আইডিয়াটা বড় দুলাভাইয়ের। মেজ দুলাভাইয়েরও থাকার কথা ছিলো। কিন্তু তার হঠাৎ করে প্রেশার ফল করাতে পারেননি।
বড় দুলাভাই পান বানিয়ে আমাকে সাধলেন।
” আমি পান খাইনা। ”
পান নিজের মুখে পুড়ে দিয়ে বললেন, ” মিলা ভার্জিন না। সেটা তো জানোই? ”
সরাসরি এই প্রসঙ্গে আসবে উনি ভাবতেই পারিনি। আর হঠাৎ এই কথাই বা কেনো বললেন? মিলা ভার্জিন ছিলো না, এটাও বা উনি কীভাবে জানলেন?
” হ্যাঁ কিন্তু আপনি কীভাবে জানলেন? ”
আমাকে হতভম্ব অবস্থায় দেখে বললেন, ” অবাক হওয়ার কিছুই নাই। ওর ভার্জিন না হওয়ার পেছনে ওর কোনো দোষ নেই। আর এই খবর পুরো এলাকা জানে। ”
বুঝলাম না আমি! মিলার তো মাথার ঠিক নেই। ও নিজেই কি নিজের এই কথা ছড়িয়েছে নাকি যার সাথে… ভাবতেও পারিনা ওর সাথে অন্য কাউকে!
পানের পিক ফেলে দিয়ে বড় দুলাভাই বললেন, ” তোমাকে আমার এই কথাগুলো বিয়ের আগেই বলা উচিৎ ছিলো। কিন্তু এতো ব্যস্ত ছিলাম যে সময় করতে পারলাম না৷ আমি একটা ভয়ে ছিলাম যে, তুমি না জেনেশুনে ওর সাথে খারাপ ব্যবহার না করে বসো। ”
” কারণটা কী? ” আমার অস্থিরতা হয়তো বুঝতে পারলেন।
” মিলা গ্যাং রেপ হয়েছিল। চারজন লোক ওকে তিন দিন আটকে রেখে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছিল। ”
” কী? ” হায় আল্লাহ! আর আমি ওকে দোষারোপ করেছি। হাবিজাবি কথা ভেবেছি ওকে নিয়ে । আর মিলাও আমাকে কিছু বলেনি। এজন্যই সে শারীরিক সম্পর্ক পছন্দ করতো না। আমি আগে কেনো এই দিকটা ভাবিনি!
চলবে…
~ Maria Kabir