আঁধার
১৬.
” তুমি নাস্তা করে যাও। রাতেও তো ঠিকমতো খাওনি। ” রাকা আমার হাত ধরে বলল।
” তোমাকে ক্ষণিকের জন্য হলেও কাছে পেয়েছি। এটাই অনেক আমার। ”
” এটার সাথে খাওয়া দাওয়ার সম্পর্ক কীভাবে হলো? ”
” প্রথম যেদিন তুমি আমাকে ভালোবাসি বলেছিলে। তখন আমার অবস্থা কেমন হয়েছিল? মনে পড়ে? ”
রাকা হেসে বলল, ” আমি কখনোই ভুলবো না সেদিনের কথা। তুমি বাচ্চাদের মতো খুশিতে লাফাচ্ছিলে। ”
” লাফাতে লাফাতে পড়েও গেছিলাম। আশেপাশের মানুষ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিলো। ”
” তখনকার সময় গুলো কত সুন্দর ছিলো তাই না? ”
” হ্যাঁ, ফিরে পাওয়া যাবেনা আর! ” কী সুন্দর এই মেয়ে। চোখ, নাক, ঠোঁট, হাসি, গায়ের রঙ, কণ্ঠ, চুল সবকিছু পারফেক্ট। কোনো খুঁত খুঁজে পাওয়া যাবে না। কত স্মার্ট রাকা। মিলার কিছুই পারফেক্ট না। চোখ বাদে। কারো সাথে ভালোভাবে কথাও বলতে জানেনা। নিজেকে লুকিয়ে রাখার একটা ধরন থাকে।
” এভাবে কেনো তাকিয়ে আছো? ” রাকা ন্যাকা স্বরে জিজ্ঞেস করল।
” তোমাকে দেখি। ” আসলেই ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। যদি সারাজীবন এভাবেই কাটিয়ে দিতে পারতাম। আচ্ছা এই কথাটা মিলাকে বললে। ও কী করতো? চোখ নামিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে হাসতো। ওর হাসির মতো সুন্দর ও নিজেও না।
” তুমি এতো পাগল কেনো আমার জন্য? আমি এর উত্তর খুঁজে পাইনা। ”
” কারণ তোমাকে ভালোবাসি। ”
” মিলা কি আমার থেকেও সুন্দর? ”
” তোমার কি মাথা খারাপ? কীসের সাথে কী তুলনা করো? ওর বাপের টাকা না থাকলে ওকে রাস্তার সাইডে থাকা ফকিন্নির মতো লাগতো। ” আমি কেনো এই কথা বললাম জানিনা। কিন্তু কথাগুলো বলে খুব একটা শান্তি পেলাম না। মনে হলো অনেক বড় মিথ্যা বলে ফেললাম।
” এজন্যই আমি তোমাকে এই মেয়েকে বিয়ে করতে বলেছি। আমার থেকে সুন্দরী হলে তার দিকে চলে যেতে। ”
” আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার থেকে হাজার সুন্দরী আসলেও, এই ভালোবাসা কমবে না। ”
” তোমার লেট হয়ে যাচ্ছে। ” রাকা ঘড়ির দিকে আঙ্গুল দিয়ে বলল।
” জানি ”
ভেতর থেকে একটা তাড়া আসতেছে। তাই দ্রুত ফ্ল্যাট থেকে বের হয়ে এলিভেটরের দিকে এগিয়ে গেলাম।
*****
বাসে উঠার পরে মায়ের নাম্বার থেকে ফোন আসল। ফোন কেটে দিয়ে ব্যাক করলাম। মায়ের সাথে কথা বলার প্রথম শর্ত হচ্ছে, শুদ্ধ করে সালাম দিতে হবে। তারপর চৌদ্দগুষ্টির খোঁজ খবর নিতে হবে।
” হ্যালো, আসসালামু অলাইকুম আম্মা। ”
” এই হ্রামী, হ্যালোর সাথে আবার কেউ সালাম দেয়? শিক্ষিত হইয়া অশিক্ষিতের মতো কথাবার্তা ক্যান? ”
” সরি আম্মা ভুল হয়ে গেছে। ”
” সরি আবার কী? ”
” সরি মানে দুঃখিত। আমি তোমার কাছে দুঃখিত। ”
মারিয়া কবিরের দ্বিতীয় একক উপন্যাস ‘ হলুদ খাম ‘ সংগ্রহ করতে চাইলে নিম্নের যেকোনো অনলাইন বুকশপ থেকে নিতে পারেন।
বইটি অর্ডার করার জন্য নিচে দেওয়া লিংকে ক্লিক করুন ।রকমারি
https://www.rokomari.com/book/207068/holud-kham
” কিন্তু দুঃখিত কীজন্য? ”
” আম্মা বাদ দাও। বলো কেমন আছো? ”
” আমি কেমন আছি জানা লাগবেনা তোমার। তুমি তো সেই আকাশের চান্দা মামা হইয়া গেছ। ”
” আম্মা তিন আগেও তোমার সাথে কথা হয়েছে। তুমি তো জানোই আমার স্কুলে…”
” দিনে একবার ফোন কইরা তো কথা কইতে তোর স্কুলের হেডমাস্টার তো আর রাগ করবেন না। আর তোর স্কুল তো রাইতে না। রাইতে তো ফোন দিতে পারোস? তোর বউটা কিন্তু ঠিকই আমার খোঁজ নেয়। ”
কী? মিলা আম্মাকে ফোন দেয়? ও তো নিজের মায়েরই ফোন রিসিভ করে না। আজব তো।
” এখন থেকে রেগুলার ফোন করবো। ঠিক আছে? ”
” না দিলে বউয়ের কাছে নালিশ কইরা দিমু। তখন বউয়ের ছ্যাচা খাইয়া বুঝবি। ”
” ঠিকাছে ঠিকাছে। ”
” গাড়ির শব্দ পাইতাছি। তুই কোথাও যাচ্ছিস? ”
” শ্বশুড়বাড়িতে যাই। মিলা ওখানে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ”
” বলিস কী? আমাকে একটু জানাবিনা? এইজন্য তো কই বউ দুই তিন দিন ধইরা ফোন কেনো করে না! আমারও কী আক্কেল? আমিও তো ফোন দিবার পারতাম। ”
” এতো অস্থির হবার কিছুই নাই। জ্বর হয়েছিল এমনকি কমেও গেছে। ভোরের দিকে কথা হয়েছে। ”
” ওর কাছে গিয়ে আমাকে ফোনে ধরায় দিবি। মনে থাকবে তো?”
” হ্যাঁ থাকবে। তোমার শরীর কেমন সেটা বলো। ”
” বয়স হলে তো বাপ শরীর পুরোপুরি ঠিক হয়না। বিহানে খারাপ থাকলে রাইতে ঠিক হয়া যায়। আমারে নিয়ে টেনশন করা লাগবেনা। ”
” আম্মা, তুমি কি পাগল? তোমাকে নিয়ে টেনশন কেনো করবো না? ”
” বাপ আগে নিজের সংসার ঠিক কর। অনেক ভালো একটা বউ পাইছস। ”
” সংসার ঠিক আছে । মেডিসিন তো ঠিকমতো খাচ্ছো? আব্বা কেমন আছেন? ”
” তোর আব্বা ঠিক আছেন৷ বাজারে গেছে তো। তাই ফোনে ধরায় দিতে পারলাম না। ”
” আব্বা আমার সাথে কথা বলবেন না। তুমি যতই অজুহাত দাও না কেনো আমি বুঝি। ”
” কথা বলবে, বলবে বাপ। বিয়ে করছস তো। ”
” হুম ”
” তাহলে রাখ এখন৷ গাড়িতে উঠে বেশি কথা কওনের দরকার নাই। ”
” ভালো থাইকো। আর আব্বার যত্ন নিও। বড় আপা আর আসেন নাই?”
” না রে। ওর পোলার নাকি পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ করে আসবে। ”
” এখন রাখি আম্মা। ”
” রাখ। ”
ফোন কেটে দিয়ে চোখ বুজলাম। গত রাতেও এক ফোটা ঘুম হয়নি। এইবারও মিলা দায়ী। ওর সাথে কথা বলতে বলতে ফজর আজান দিয়ে দিল৷ তারপর সে ঘুমাবে বলে ফোন রেখে দিল। কিন্তু আমার আর ভালো লাগতেছিল না। অস্থিরতা কমছিলও না। ফরিদপুরে ব্যাক করার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঝামেলা বাঁধল রাকাকে কী বলবো? এক সপ্তাহের জন্য আসছিলাম। একদিনেই যদি যাওয়ার জন্য পা বাড়াই। ও সন্দেহ করে বসতে পারে। মায়ের উপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে চলে এলাম।
মিলার নাম্বারে ফোন দিলাম৷ মিসেসের ঘুম ভাঙলো কিনা জানতে হবে। আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছে কিনা কে জানে! শ্বশুর আব্বা আর ফোন করেননি। মিলাকে কয়েকবার ফোন দিলাম। কিন্তু সে রিসিভ করল না।
মোবাইল পকেটে রেখে ঘুমানোর জন্য চোখ বন্ধ করলাম।
( মিলা )
মনে হলো কেউ আমার উপর ঝুকে আছে। গরম নিশ্বাস আছড়ে পড়ছে মুখের উপর। এমনিতেই জ্বরে শরীর গরম হয়ে আছে। তার উপর মা গোসল করতে দেয়নি। গরম নিশ্বাসে অসহ্য লাগছে। চোখ খুলতে মন চাচ্ছে না৷ অসম্ভব রকমের ক্লান্ত লাগতেছে আমার। চার হাত পা ছড়িয়ে চোখ বন্ধ করে এভাবে পড়ে থাকতে ভালো লাগতেছিল। কিন্তু কোথা থেকে কে যেন এসে ভালা লাগার বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে।
হাত দিয়ে সরিয়ে ফেলতে গেলাম। মনে হলো হাত কেউ একজন ধরে ফেলল।
” মিলা আমি ”
” যেই হন এখন দূর হন। আমি ঘুমাবো। ” কে এইভাবে ঝুকে আছে সেটা জানতেও ইচ্ছা করতেছে না৷ কণ্ঠ চেনা চেনা মনে হলো।
” আমি ঘুমে তো ডিস্টার্ব করছিনা। ”
” অবশ্যই করতেছেন৷ মুখের উপর আপনার গরম নিশ্বাস পড়তেছে আর আমার গরম লাগতেছে। এমনিতেই মা গোসল করতে দেয়নি। ” রাসেল আসলো কোন সময়? কণ্ঠ তো রাসেলেরই। সে ঢাকায়। এর অর্থ আমি স্বপ্ন দেখছি।
” অনেক ঘুমাইছ। এখন উঠো, আমি তোমার সাথে কথা বলবো। ”
” আমি ঘুমাইনি। খুব ক্লান্ত লাগতেছে তাই ঘুমের ভান ধরে পড়ে আছি। ”
” তাহলে চোখ খুলো। ”
আমি চোখ খুলে অবাক হলাম। রাসেল আমার উপর ঝুকে আছে। এমনকি মুখ চেপে হাসতেছে।
” তুমি এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? ” রাসেল প্রশ্ন করলেন।
” আপনি তো ঢাকায় ছিলেন? আপনার জরুরী কাজ হয়ে গেছে? ”
” না, হয়নি। ”
” তাহলে? ”
রাসেল আমার এলোমেলো জট পাকানো চুলে চিরুনির মতো আঙ্গুল চালিয়ে দিলেন৷ এতো কাছে তো এর আগেও এসেছে কিন্তু এখনকার মতো অনুভূতি কখনো হয়নি।
” তোমার বাবা ফোন করেছিলেন। নিজেকে অনেক বেশি দায়িত্বহীন মনে হচ্ছিল। তাই আরকি। ”
” ওহ আচ্ছা। কথা বলা হয়েছে? ”
রাসেল চুল থেকে হাত আমার চিবুকে নামিয়ে আনলেন।
” না, হয়নি। ”
” আপনি সত্যি এসেছেন নাকি স্বপ্ন দেখছি?”
” আমি সত্যি এসেছি। বিশ্বাস হচ্ছে না কেনো? ”
” আপনাকে ঠিক আগের মতো মনে হচ্ছে না। আপনার চোখের চাহনিতে পরিবর্তন এসেছে। ”
” আমারও মনে হচ্ছে কিছু একটা চেঞ্জ এসেছে আমার মধ্যে। ”
” আমার খুব ক্লান্ত লাগতেছে। চোখ বন্ধ করলাম। ”
চোখ বন্ধ করার সাথে সাথে রাসেল আমার ঠোঁট দখল করলেন৷ ঠিক আগের মতো না, খুব সূক্ষ্ম একটা পরিবর্তন এসে গেছে আমাদের মাঝে। এই প্রথম তার স্পর্শে আমি ডুবে যাচ্ছি একটু একটু করে…
চলবে…
~ Maria Kabir