আঁধার
১৫.
এখন কি ফোন করা ঠিক হবে ? মোবাইল হাতে নিয়ে ফোন দিব কি দিব না ভাবছিলাম। তখনই রাসেলের নাম্বার থেকে ফোন আসলো। এতো রাতে সে আমাকে ফোন দিল? ভাবতে ভাবতে ফোন রিসিভ করলাম। রাসেলের কণ্ঠ শুনতে পেলাম, ” হ্যালো, মিলা? ”
” জ্বী, বলুন। ” অদ্ভুত ব্যাপার হলেও এটা আমাদের বিয়ের পরের দ্বিতীয় বার ফোনে কথা বলা। সে আমাকে ফোন ঠিকই দেয়। কিন্তু আমিই রিসিভ করিনা।
” আলহামদুলিল্লাহ, তোমাকে পাওয়া গেল৷ ”
” হুম ”
” জ্ঞান ফিরল কখন? ”
” দশ পনেরো মিনিট হবে। ”
” বাবার কাছ থেকে তোমার অসুস্থতার কথা শুনে অস্থির হয়ে ছিলাম। তোমার নাকি কোনো হুশ ছিলো না। আমার ঠিক হয়নি তোমাকে এভাবে একা পাঠানো। আল্লাহর রহমত রাস্তায় কিছু হয়নি। ”
” হলেও বা কী। আমি এমন কেউ না। যার থাকা না থাকাতে কারো কিছু যায় আসবে। ”
” মিলা, তুমি এভাবে কেনো বলতেছ? আমি তো বললামই আমার ঠিক হয়নি। ”
” আমি আপনার জন্য বলতেছি না। আসলে আমি সত্যিটাই বলতেছি। আমি এই পৃথিবীতে একটা আবর্জনা মাত্র। ”
” মিলা, সরি। আমি আর কখনো এমন করবো না। ”
” আপনি সরি কেনো বলতেছেন? আপনি তো কিছুই করেননি। ”
” তাহলে তুমি হাবিজাবি কথা বলতেছ ক্যান? তোমার থাকা না থাকাতে কারো কিছু যায় আসবে না। এই কথা কেনো বললে? ”
” কারণ এটাই সঠিক। আমি কারো জীবনের স্পেশাল মানুষ না। ”
” তোমার শরীর এখনো ভালো না৷ তুমি একটা কাজ করো চা বানিয়ে খাও। তারপর মাথা ঠিক হলে, আমি আবার ফোন করবো। ”
” এই জঙ্গলে আমি চা বানানোর সরঞ্জাম কই পাবো? ”
” কী? কী বললা মিলা? ”
” বললাম, এই জঙ্গলে আমি চা বানানোর সরঞ্জাম কই পাবো? ”
” তুমি জঙ্গলে? তুমি না তোমার বাপেরবাড়িতে? ”
” হ্যাঁ, আমি আমার বাপেরবাড়িতেই। কিন্তু এখন আমি জঙ্গলের শেষ প্রান্তের শান বাঁধানো পুকুর ঘাটের সিঁড়ির উপর বসে আছি। ”
” ওই পুকুর পাড়ে দিনের বেলাই তো একা থাকা ঠিক না। সেখানে তুমি একা একা এই রাতে… না, তুমি আমার সাথে ঠাট্টা করতেছ। তাই না? ”
” না, আমি ঠাট্টা করতেছি না। আমার কাছে তো টাচস্ক্রীন মোবাইল নাই। তা নাহলে ভিডিও কল করে দেখাতাম। ”
” তোমার কিছু হয়ে যাবে। লক্ষীটি আমার বাড়িতে ফেরত যাও। তোমার জ্বর এখনো কমেনি। ”
” কিছুই হবেনা। আমি বিয়ের আগে এখানে নিয়মিত বসে থাকতাম। এই পুকুরে রাতের বেলাও গোসল করেছি। পানির মধ্যে শুধু নাক বের করে ডুবে থেকেছি। ”
” তোমার ভয় বলতে কিছু নাই? ”
” জানিনা। আমার রাতে ঘুম খুব একটা হয়না। তাই এখানে এসে নিরিবিলি বলে থাকতাম। এই পুকুরে সারাবছর লাল শাপলা ফুটে। জোছনার আলোয় অসম্ভব রকমের সুন্দর দেখায়। আশেপাশে কিছু সময় পরপর প্যাঁচা ডেকে উঠে, ঝিঝি পোকা ডাকে, কুক পাখি হঠাৎ হঠাৎ ডেকে উঠে। আমার ভালো লাগে। ”
মারিয়া কবিরের দ্বিতীয় একক উপন্যাস ‘ হলুদ খাম ‘ সংগ্রহ করতে চাইলে নিম্নের যেকোনো অনলাইন বুকশপ থেকে নিতে পারেন।
বইটি অর্ডার করার জন্য নিচে দেওয়া লিংকে ক্লিক করুন ।রকমারি
https://www.rokomari.com/book/207068/holud-kham
” তুমি আমার কথা শুনো। প্লিজ মিলা, তুমি ঘরে যাও। আমার ভয় লাগতেছে। বিশ্বাস করো আমার অস্থিরতা বেড়ে গেছে। তুমি কি চাও তোমার স্বামী তোমার চিন্তায় হার্ট অ্যাটাক করে মরুক? ”
” আমার চিন্তায় আপনি কেনো মারা যাবেন? আমাকে তো আপনার পছন্দ না। ”
” কে বলেছে শুনি? তোমাকে আমার খুব পছন্দ মিলা। সকালে তোমার রান্নাঘরের কথা মনে নেই? আমি পাগলের মতো তোমাকে দেখছিলাম। পছন্দ না করলে তোমার সেবাযত্ন করতাম? ”
” আমাকে তাহলে পাগল ছাগল কেনো বলেন? এতো পছন্দই যেহেতু তাহলে আমি এখানে অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিলাম। আর আপনি ঢাকায় বসে বসে কী করছিলেন? ”
” আমি জরুরী একটা কাজে আসছি। তুমি বুঝতে চেষ্টা করো। ”
” তাহলে আপনিও বুঝতে চেষ্টা করুন। আমি এখানে আমার শান্তির জন্য এসেছি। ”
” তুমি এখনই এখান থেকে উঠে বাসায় যাবে। তা নাহলে আমি ফরিদপুরে আসলে তোমার খবর আছে। ”
” কী খবর করবেন আপনি? একটা থাপ্পড় মারার পরে তো সরি বলতে বলতে আমার মাথাটা খারাপ করে দিয়েছিলেন। ” অনেক কষ্টে হাসি আটকে রাখলাম।
” এক মিনিট। তুমি তোমার এক্সের সাথে তো দেখা করতে বের হওনি? ”
” করলেও বা কী? ”
” তোমার স্বামী আছে। আমি এখনো জীবিত। ”
” তো? ”
” মিলা সত্যি করে বলো তুমি ওখানে কী করতে গেছ? ”
” আমি এখানে বসে বসে পুকুর দেখি, পানি দেখি, রাতের সৌন্দর্য দেখি, গোসল করি, হাঁটাহাঁটি করি। আর কিছুই করিনা। ”
” কোনো ছেলে তো তোমার সাথে নাই?”
” না, চিন্তার কিছু নাই। আমি এতো খারাপ না যে বিয়ের পরেও প্রেমিক রাখবো। যেখানে আপনি একাই একশো। দেহের চাহিদা মেটাতে আপনার তুলনা হয়না৷ ”
” আর মনের? ”
” জানিনা। ”
” মিলা? ”
” জ্বী বলুন। ”
” বাসায় যাও। ”
” ঠিকাছে। ”
” আর কিছু খেয়ে নিবে। ”
” ঠিকাছে। ”
” বাসায় গিয়ে আমাকে ফোন দিবে। আমার সাথে কথা বলবে আর খাবে৷ মনে থাকবে? ”
” হ্যাঁ ”
( রাসেল )
মিলার যে ভয়ডর কিছু নাই আজকে প্রমাণ পেলাম। ভাগ্যিস রাকা গভীর ঘুমে ব্যস্ত। তা নাহলে আমাদের কথোপকথন শুনলে এতক্ষণ আমার খবর হয়ে যেত। মিলার বাবার কাছে ওর অসুস্থতার কথা শোনার পর থেকে শান্তি পাচ্ছিলাম না। অস্থিরতা কোনোভাবেই কাটাতে পারছিলাম না। রাকার সাথে থাকা অবস্থায় এই প্রথম আমার মন অস্থির হলো। মিলার সাথে থাকলে ওকে বাড়ি থেকে এক পা বের হতে দিতাম না৷ মোবাইল হাতে নিয়ে অপেক্ষা করতে করতে শেষ পর্যন্ত মিসেসের দেখা পাওয়া গেছে। কে জানে পুকুর পাড়ে কার সাথে কী করতেছিল? ভাবতেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বিয়ের আগে যা ইচ্ছা হয় করছে। এখন কেনো করবে? এখন সে আমার স্ত্রী। তার উপর আমার অধিকার শুধুমাত্র। সকালে যেভাবে হাসলো। ওভাবে কি এক্সের সামনে হাসত? আমার সামনে তো হাসেই না ধরা যায়। ড্রয়িংরুমের টিভি ছাড়া কিন্তু মন অন্যদিকে। এদিকে ওর ফোনও আসতেছে না। ওক বলে সে নিজেই উধাও। আমিই ফোন দিলাম। সাথে সাথেই রিসিভ হলো৷ এই মেয়ে আগে দশ, বারো, এমনকি কয়েকশ বার ফোন করলেও রিসিভ করতো না।
” আমার ফোনে টাকা নাই। তাই ফোন দিতে পারিনি। ”
” আমারই ভুল। তোমার নাম্বারে আমি এই পর্যন্ত টাকা লোড দেইনি। ”
” হুম ”
” এখন থেকে আমি মনে রাখবো। তুমিও তো কিছু বলো না। মানুষ তো বলে মুখ ফুটে। ”
” আমার ভালো লাগেনা বলতে। ”
” তোমার ভালো লাগেটা কী? ”
” কিছুই না। আমার এখন শুধু মৃত্যুর অপেক্ষা। সবসময় ভাবি কখন চিরকালের জন্য চোখ বুজব। সবকিছু থেকে মুক্তি পেয়ে যাবো। ”
” এভাবে কেনো বলতেছ? ”
” আমি আপনাকে সত্যিটাই বলতেছি। আমি আপনাকে বেশিদিন বিরক্ত করবো না। খুব বেশি বিরক্ত করি আপনাকে। ”
” না, আবোলতাবোল কী বলতেছ! তুমি আমাকে মোটেও বিরক্ত করো না। ”
” আপনি মুখে না বললেও, চেহারায় বুঝা যায়। ”
” বেশি বুঝো তুমি৷ খেতে বসেছ? ”
” না, আমার খুদা নাই। সেলাইন চলতেছিল তো। ”
” সেলাইন কি পুরোটা শেষ হয়েছে? ”
” না ”
” আর তুমি ওই অবস্থায় পুকুর পাড়ে চলে গেছ? হাতে ক্যানাল লাগানো ছিলো না?”
” আমি সাবধানে খুলে তারপর বের হইছিলাম। ”
” আমি বুঝতে পারছি। ওখানে তোমার কেউ আছে। এইজন্যই তুমি এতো রাতে বাইরে বের হয়েছ। ”
” না, আপনি ভুল বুঝতেছেন। ”
” আমি ঠিকই বুঝেছি। ”
*****
” এতো সকালে গোসল করে, ফুলবাবু সেজে কোথায় যাচ্ছ? ” রাকা ঘুম জড়ানো কণ্ঠে আমাকে জিজ্ঞেস করল। দেয়াল ঘড়িতে সকাল সাতটা বেজে দশ মিনিট। মোবাইল প্যান্টের পকেটে রেখে বললাম, ” মা আজানের সময় ফোন করে আমাকে ওয়াজ শুনিয়েছেন। ”
রাকা চুল খোঁপা করতে করতে বলল, ” খালা পারেই ওয়াজ শুনাতে। তাছাড়া আর কিছু তার করার ক্ষমতা আছে নাকি? ”
” হ্যাঁ, এজন্যই আমাকে বের হতে হচ্ছে। ”
” ফরিদপুরে যাচ্ছ? ” রাকার কপালে ভাঁজ পড়ল।
” হ্যাঁ, যা বলেছে ফোনে। তাতে এছাড়া উপায় নাই। ”
” কী শুনালো? ” রাকা রেগে যাচ্ছে।
” অসুস্থ বউকে একা একা পাঠিয়ে দিয়েছি। কেনো তার সাথে যাইনি। ব্লা ব্লা ব্লা… তারপর গালাগালি করলেন। কানের যদি মস্তিষ্ক আর মন থাকতো। তাহলে নিশ্চিত সুইসাইড করতো। ”
” আর একটা দিন থেকে যাও, রাসেল। আমার দিকটা ভাবো। ” রাকা আমার খুব কাছে এসে দাঁড়ালো।
ওকে কাছে টেনে নিয়ে ঠোঁটে চুমু দিয়ে বললাম, ” আমি আবার আসবো। তুমি তো জানোই তোমাকে কতটা ভালোবাসি। ”
” সত্যিই আসবে দ্রুত? ”
” হ্যাঁ, ওশানকেও তো এবার দেখা হয়নি। ”
রাকা আমাকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রইলো। তারপর ছেড়ে দিয়ে বলল, ” তাহলে তাড়াতাড়ি যাও। যাতে তাড়াতাড়ি আসতে পারো। ”
” ঠিকাছে। ”
চলবে….
~ Maria Kabir